STORYMIRROR

Laxman Bhandary

Others

4  

Laxman Bhandary

Others

বেগম মহলের কান্না (সম্পূর্ণ উপন্যাস) রচনা: লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বেগম মহলের কান্না (সম্পূর্ণ উপন্যাস) রচনা: লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

10 mins
3

বেগম মহলের কান্না (সম্পূর্ণ উপন্যাস)

রচনা: লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


প্রথম পরিচ্ছেদ: সোনার খাঁচার পাখি

সময়: ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ। স্থান: রায়গঞ্জ এস্টেটের নবাব সিকান্দার আলি খানের বিশাল মহল।

সন্ধ্যা নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ। রায়গঞ্জ এস্টেটের প্রধান প্রকোষ্ঠ ‘বেগম মহল’। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে যেন রূপকথার স্বপ্নপুরী—শ্বেতপাথরের দেয়াল, ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় ঝলমলে প্রাঙ্গণ, আর চারদিকে সুগন্ধি ফুলের বাগান। অথচ এর অভ্যন্তরে ছিল এক গভীর ও হিমশীতল শূন্যতা।

বেগম রোশনারা, নবাব সিকান্দার আলি খানের কনিষ্ঠা ও প্রিয়তমা স্ত্রী, আজ সন্ধ্যার প্রদীপের আলোয় একা বসে ছিলেন। তাঁর বয়স বাইশ, অথচ দু’চোখে রাজ্যের ক্লান্তি। নবাবের বয়স সত্তর পেরিয়ে গেলেও তাঁর বিলাসিতা ও প্রতাপ অটুট। রোশনারা এই মহলে এসেছেন তিন বছর হলো, কেবল বংশরক্ষার স্বার্থে। তাঁর যৌবন এই প্রাসাদের জাঁকজমকের নিচে চাপা পড়ে গেছে।

আজ পূর্ণিমা ছিল। বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছিল দূরের চাঁদ। বেগম রোশনারা শান্ত স্বরে তাঁর দাসী শায়স্তাকে বললেন, "শায়স্তা, এই সোনার খাঁচার মধ্যে কেবলই দম বন্ধ হয়ে আসে। বাইরের জগৎটা কি সত্যিই এত সুন্দর?" শায়স্তা, বহুদিনের পুরনো সেবিকা, যার চুল পেকেছে এই মহলের আনাচে-কানাচে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "সুন্দরী, বাহিরে সৌন্দর্য আছে, কিন্তু নিরাপত্তা নেই। আর নবাবের মহলে সৌন্দর্যও আছে, কিন্তু স্বাধীনতা নেই। এটাই নিয়ম, বেগম সাহেবা।"

সেই রাত্রে, রোশনারা জানালা দিয়ে দেখলেন, মহলের প্রধান ফটক দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে কেউ একজন প্রবেশ করছে। এ সময়ে সাধারণত কেউ আসে না। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই নবাবের কোনো জরুরি কাজ। কিন্তু সেই আগমনীর শব্দ যেন তাঁর জীবনের নিস্তরঙ্গ পুকুরে ছোট একটি ঢেউ তুলল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: নতুন অতিথির আগমন

পরদিন সকালে মহল জুড়ে চাপা উত্তেজনা। জানা গেল, নবাবের দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত হাকিম অসুস্থ হয়ে পড়ায় কলকাতা থেকে এক তরুণ, আধুনিক চিকিৎসককে আনা হয়েছে। তাঁর নাম ডক্টর জামিল হায়দার।

ডক্টর জামিল হায়দার কেবল ডিগ্রিধারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তরুণ, উদ্যমী এবং বাইরের বিশ্বের প্রগতিশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। তিনি এসে দেখলেন, নবাবের জীবনযাত্রা অত্যন্ত বিলাসী হলেও তাঁর স্বাস্থ্যের যত্ন সেকেলে। তিনি নবাবকে পরামর্শ দিলেন জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার।

মহলের অভ্যন্তরে চিকিৎসা করতে গেলে কঠোর পর্দা প্রথার কারণে অনেক সমস্যা দেখা দিল। বিশেষ করে, বেগম মহলের অভ্যন্তরীণ নারীদের চিকিৎসার নামেও বাইরে থেকে পুরুষের প্রবেশ কড়াভাবে নিষিদ্ধ ছিল।

একদিন দুপুরে শায়স্তা এসে জানালেন, "বেগম সাহেবা, আপনার মাথা ঘোরার পুরোনো সমস্যা আবার দেখা দিয়েছে। নবাব হুকুম দিয়েছেন, নতুন হাকিম যেন একবার আপনাকে দেখেন।" রোশনারা প্রথমে আপত্তি জানালেন। কিন্তু নবাবের আদেশ অমান্য করা অসম্ভব। শর্ত হলো, জামিল একটি ভারী পর্দার আড়াল থেকে কেবল নাড়ী পরীক্ষা করবেন এবং শায়স্তা মধ্যস্থতা করবেন।

প্রথম সাক্ষাতের দিন, পর্দা ভেদ করে জামিল যখন রোশনারার শীতল হাত স্পর্শ করলেন, তখন দুজনের শরীরেই যেন এক মুহূর্তের বিদ্যুৎ খেলে গেল। জামিল অবাক হলেন, এই বয়সে এমন সুন্দর হাতে এমন ক্লান্তি কেন?

তৃতীয় পরিচ্ছেদ: পর্দার আড়ালের দৃষ্টি বিনিময়

চিকিৎসা শুরু হলো। জামিল বুঝতে পারলেন, রোশনারা শারীরিকভাবে অসুস্থ নন, তিনি মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত—যা এই বন্দী জীবনের ফল। তিনি ওষুধের পাশাপাশি তাঁকে কথা বলার সুযোগ খুঁজলেন।

পর্দার আড়াল থেকে শুরু হলো তাঁদের কথোপকথন। প্রথমে কেবল স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা, ধীরে ধীরে তা সাহিত্য, কবিতা এবং বাইরের জগতের বিষয়ে গড়িয়ে গেল।

একদিন জামিল সাহস করে বললেন, "বেগম সাহেবা, আপনার কণ্ঠস্বরে যে বিষাদ শুনি, তা কোনো ওষুধের দ্বারা দূর করা সম্ভব নয়। আপনার তো খোলা হাওয়ায় হাঁটা উচিত।" মুহূর্তেই উল্টো দিক থেকে রোশনারার চাপা হাসি শোনা গেল। "ডাক্তার সাহেব, যে পাখি জানে তার ডানা নেই, সে উড়তে চাওয়ার সাহস করে না।"

এই সময় থেকেই মহল জুড়ে ফিসফাস শুরু হলো। দেউড়ির রক্ষক মীর জাফর, যিনি নবাবের বিশ্বস্ত না হয়েও চাটুকারিতায় শীর্ষস্থানে ছিলেন, তিনি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। মীর জাফরের চোখে নতুন ডাক্তার একটি বিপদচিহ্ন হিসেবে দেখা দিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ: মীর জাফরের ফন্দি

মীর জাফর ছিলেন নবাবের উজির এবং এস্টেটের সম্পদ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে। নবাবের অসুস্থতা তাঁকে মনে মনে খুশিই করেছিল। তিনি চাইতেন নবাবের মৃত্যু হোক, যাতে তিনি এস্টেটের ক্ষমতা দখল করতে পারেন। ডক্টর জামিলের উপস্থিতি তাঁর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াল। জামিলের আধুনিক চিকিৎসা যদি নবাবকে সুস্থ করে তোলে, তবে তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যাবে।

তাছাড়া, মীর জাফর বুঝতে পারলেন, বেগমের সঙ্গে জামিলের সম্পর্ক কেবল ডাক্তার-রোগীর নয়। তিনি তাঁর গুপ্তচরদের নির্দেশ দিলেন বেগম মহল এবং জামিলের গতিবিধির উপর নজর রাখতে।

একদিন রাতে, মীর জাফর চুপিচুপি নবাবের কাছে গিয়ে বললেন, "জাঁহাপনা, নতুন ডাক্তার খুবই ভালো, কিন্তু তিনি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আমরা শুনেছি, তিনি বেগম মহলের পর্দার আড়ালে গিয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেন। এমন গোপন আলোচনার কী প্রয়োজন?"

নবাব সিকান্দার আলি খান, যিনি বয়সের ভারে কিছুটা দুর্বল হলেও মেজাজে ছিলেন তপ্ত, প্রথমে বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু মীর জাফরের ক্রমাগত প্ররোচনায় তিনি বিচলিত হলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, ডাক্তার জামিল যেন এখন থেকে কেবল নবাবের চিকিৎসার জন্য সূর্যোদয়ের আগে বা সূর্যাস্তের পরে প্রবেশ করেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ: গোপন কথোপকথন

নবাবের নতুন নির্দেশের কারণে জামিল এবং রোশনারার সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ হলো। কিন্তু ততদিনে তাদের মধ্যে এক গভীর আত্মিক সংযোগ তৈরি হয়ে গেছে।

শায়স্তা, যিনি রোশনারার প্রকৃত কষ্ট জানতেন, তিনি মধ্যস্থতাকারী হলেন। তিনি জামিলের কাছ থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত চিরকুট নিতেন এবং তাতে ছোট্ট করে একটি কবিতার লাইন বা একটি বার্তা লুকিয়ে রাখতেন।

একদিন রোশনারা চিরকুটে পেলেন: "আপনি শুধু খাঁচায় বন্দী নন, আপনার মনও যেন বন্দী। মুক্তির পথ খুঁজুন।" রোশনারা উত্তরে লিখলেন: "মুক্তি তো কেবল মৃত্যুতেই সম্ভব।"

এক বিকেলে, মহল যখন স্তব্ধ, রোশনারা সাহস করে শায়স্তাকে বললেন, "শায়স্তা, আমি জানতে চাই বাইরের জগৎটা কেমন। আমি ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই, কোনো আড়াল ছাড়া।"

শায়স্তা প্রথমে ভয় পেলেন, কিন্তু বেগমের অসহায় মুখ দেখে তিনি পরিকল্পনা করলেন। মহলের পশ্চিম দিকে একটি পুরনো গ্রন্থাগার ছিল, যা বহু বছর ধরে তালাবদ্ধ। সেই ঘরটি বেগম মহলের একটি অপ্রয়োজনীয় বারান্দার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: দুর্গম গ্রন্থাগারে সাক্ষাৎ

শায়স্তার পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা সেই পরিত্যক্ত গ্রন্থাগারের বারান্দায় একটি মোমবাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করলেন। জামিলকে জানানো হলো, তিনি যেন বিশেষ অজুহাতে সেই দিক দিয়ে নবাবের কাগজপত্র দেখতে যান।

নির্ধারিত দিন। রাত তখন গভীর। মহলের সবাই ঘুমে মগ্ন। জামিল নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছালেন। সেখানে পৌঁছানোর পর তিনি দেখলেন, মোমবাতির অস্পষ্ট আলোয় রোশনারা দাঁড়িয়ে আছেন। এই প্রথম তারা একে অপরের মুখ দেখল।

রোশনারার চোখ দুটি ছিল অশ্রুসজল। জামিল স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তার সৌন্দর্য দেখে। কিন্তু সেই সৌন্দর্য কেবলই বিষাদের মোড়কে ঢাকা।

"ডাক্তার সাহেব," রোশনারা ফিসফিস করে বললেন, "আমি বুঝতে পারি, আপনি আমাকে বাঁচাতে চান। কিন্তু আমি অভিশাপের জালে জড়িয়ে আছি।"

এই সাক্ষাতে জামিল রোশনারার পূর্ব জীবনের কথা জানতে পারলেন। রোশনারা ভালোবেসেছিলেন এক সাধারণ যুবককে, কিন্তু নবাবের প্রতাপের কাছে তার বাবা সেই সম্পর্ক অস্বীকার করতে বাধ্য হন এবং রোশনারাকে এই মহলে পাঠান। সেই যুবক এখন কোথায়, রোশনারা জানেন না।

জামিল বুঝতে পারলেন, সমস্যা শারীরিক নয়, আত্মার। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, তিনি রোশনারাকে এই গ্লানি থেকে মুক্তি দেবেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ: ষড়যন্ত্রের গন্ধ

ডক্টর জামিল গভীর মনোযোগে নবাবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছিলেন। নবাবের শারীরিক দুর্বলতা স্বাভাবিক বার্ধক্যজনিত ছিল না। জামিলের মনে সন্দেহ জাগল। তিনি গোপনে নবাবের ঔষধপত্রের নমুনা পরীক্ষা করতে পাঠালেন।

পরীক্ষার ফল জামিলকে চমকে দিল। নবাবের খাবারে এবং ঔষধের মধ্যে ধীরে ধীরে কাজ করা সামান্য বিষ (আর্সেনিক) মেশানো হচ্ছে।

জামিল বুঝতে পারলেন, এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা মীর জাফর ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তিনি যদি নবাবকে সুস্থ করে তোলেন, তবে মীর জাফর নিশ্চিতভাবে তাঁর ওপর প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু তথ্যটি নবাবকে সরাসরি জানানো কঠিন, কারণ মীর জাফরের ক্ষমতা মহলের সর্বত্র বিস্তৃত।

এই বিপজ্জনক সত্য জানার পর জামিল আরও সতর্ক হলেন। নবাবের জীবন বাঁচানো এবং একই সাথে রোশনারার মুক্তির পথ খোঁজা—এই দুটো দায়িত্ব তাঁর উপর এসে পড়ল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ: নবাবের সন্দেহ

মীর জাফরের কানকথা নবাবের মনকে বিষিয়ে তুলছিল। যদিও নবাবের প্রতি জামিলের সেবা ছিল আন্তরিক, তবুও পুরোনো আমলের নবাবের মনে সন্দেহের বীজ সহজেই বপন করা যায়।

এক রাতে, নবাব সিকান্দার আলি খান অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় বেগম রোশনারাকে ডেকে পাঠালেন। "রোশনারা," নবাবের কণ্ঠস্বর ছিল ভারী, "তুমি কি সুখী নও?" রোশনারা বাধ্যগতভাবে উত্তর দিলেন, "জাঁহাপনা, আপনার মহলে কোনো দুঃখ থাকতে পারে না।" "কিন্তু আমি তোমার চোখে জল দেখি," নবাব বললেন। "শোনো, শোনো, তুমি কি সেই নতুন হাকিমকে খুব বিশ্বাস করো?"

রোশনারা ভয় পেলেন। তিনি জানেন, ক্ষুদ্রতম ভুল উত্তরও বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। "তিনি অত্যন্ত দক্ষ, জাঁহাপনা। তাঁর সেবায় আপনার স্বাস্থ্য উন্নতি করছে।" নবাব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর চোখে সন্দেহের ছায়া। তিনি বললেন, "তোমাকে মনে রাখতে হবে রোশনারা, এই মহলের প্রতিটি ইট আমার সম্পত্তি। আর তুমি, তুমি আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি। এর উপর কারো দৃষ্টি পড়লে আমি তাকে ধ্বংস করে দেব।"

এই কথোপকথন রোশনারাকে আরও আতঙ্কিত করে তুলল। তিনি বুঝলেন, এখন থেকে তাঁদের আরও সাবধানে চলতে হবে।

নবম পরিচ্ছেদ: প্রমাণ সংগ্রহ

জামিল নিশ্চিত হলেন, মীর জাফরই নবাবকে তিলে তিলে মারছে। এখন তাঁর প্রয়োজন শক্তিশালী প্রমাণ যা নবাবের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

তিনি শায়স্তার সাহায্যে বেগম মহলের পেছনের একটি অব্যবহৃত রান্নাঘর থেকে মীর জাফরের বিশ্বস্ত এক সেবকের ব্যবহৃত একটি পাত্র পেলেন। তিনি সেই পাত্রে বিষের চিহ্ন খুঁজে পেলেন।

জামিল সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি সরাসরি নবাবকে প্রমাণ দেবেন না। তিনি জানেন, নবাব মীর জাফরের দীর্ঘদিনের বিশ্বাসী ছিলেন। কেউ একজন যদি নবাবের সামনে মীর জাফরের ষড়যন্ত্র প্রকাশ করে, তাহলে নবাব উল্টে সেই ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারেন।

তাই জামিল একটি নাটকীয় পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি রোশনারাকে একটি গোপন চিঠি পাঠালেন। চিঠিতে অনুরোধ করলেন, নবাবকে দেওয়া ঔষধে কেবল তাঁর তত্ত্বাবধানেই যেন দেওয়া হয়, এবং মীর জাফরের দেওয়া কোনো উপকরণ যেন ব্যবহার না করা হয়।

দশম পরিচ্ছেদ: বিপদের ঘণ্টি

মীর জাফর সন্দেহ করতে লাগলেন যে জামিল তাঁর ষড়যন্ত্র ধরতে পেরেছেন। তিনি দেখতে পেলেন, মহল জুড়ে তাঁর কর্তৃত্ব যেন কমে আসছে। নবাবের শরীর কিছুটা হলেও উন্নতি করছে।

মীর জাফর সিদ্ধান্ত নিলেন, জামিলকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

তিনি রাতের অন্ধকারে একদল ভাড়াটে গুণ্ডাকে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন জামিলকে আক্রমণ করে। জামিল তখন তাঁর কক্ষ থেকে নবাবের বিশেষ ঔষধ আনতে যাচ্ছিলেন। আক্রমণের সময় জামিল চিৎকার করে উঠলেন। রক্ষীরা দ্রুত ছুটে আসায় গুণ্ডারা পালিয়ে গেল।

এই ঘটনার পর জামিলের নিরাপত্তা জোরদার করা হলো। নবাব বুঝতে পারলেন, জামিলের পেছনে শত্রু লেগেছে। কিন্তু তিনি তখনও সন্দেহ করেননি যে শত্রু তাঁর এত কাছে।

জামিল বুঝতে পারলেন, সময় আর নেই। তাঁকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

একাদশ পরিচ্ছেদ: রোশনারার সাহসী পদক্ষেপ

হামলার ঘটনার পর রোশনারা বুঝতে পারলেন যে জামিল যদি নবাবকে বাঁচাতে গিয়ে মারা যান, তবে তাঁর মুক্তি এবং নবাবের জীবন—দুটোই ব্যর্থ হবে।

তিনি শায়স্তাকে ডেকে বললেন, "শায়স্তা, আমার কাছে আর লুকানোর কিছু নেই। আমি জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। আজ রাতে আমাকে ডক্টর জামিলের কাছে যেতে হবে। তাঁকে প্রমাণসহ নবাবের সামনে আসার পথ দেখাতে হবে।"

শায়স্তা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন, "বেগম সাহেবা, যদি কেউ দেখে ফেলে, তবে আপনার আর ডাক্তারের প্রাণদণ্ড হবে!" "মৃত্যু তো এই মহলে এমনিতেই আমাকে গ্রাস করছে," রোশনারা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, "অন্তত লড়াই করে মরব।"

সেই রাত্রে, প্রবল ঝড়বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে, রোশনারা বোরখা পরিধান করে শায়স্তার সাহায্যে সেই গোপন গ্রন্থাগার দিয়ে জামিলের কক্ষের কাছাকাছি পৌঁছালেন।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ: সত্যের উন্মোচন

জামিল রোশনারাকে দেখে অবাক হলেন। রোশনারা জামিলকে মীর জাফরের ষড়যন্ত্রের সব প্রমাণ দিলেন এবং বললেন, "নবাব আপনাকে বিশ্বাস করবেন না, যদি না আপনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে প্রমাণ দেন।"

রোশনারা জামিলকে পরামর্শ দিলেন, কাল সকালে সবার সামনে নবাবকে তাঁর শেষ ঔষধ দেওয়ার সময় যেন জামিল নাটকীয়ভাবে ঔষধের পাত্রটি ফেলে দেন এবং বলেন যে পাত্রটি বিষাক্ত ছিল। এরপর মীর জাফরকে আটক করলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে।

পরদিন সকালে সভা বসল। নবাব উপস্থিত, মীর জাফরও হাস্যমুখে উপস্থিত। ঠিক যখন জামিল নবাবের হাতে ঔষধের পাত্র তুলে দিচ্ছেন, তখন তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পাত্রটি মেঝেতে ফেলে দিলেন।

"জাঁহাপনা!" জামিল হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, "এই ঔষধ বিষাক্ত! কেউ আপনাকে তিলে তিলে মারতে চাইছে!" মীর জাফর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন, "মিথ্যা কথা! এই ডাক্তার নবাবকে বিপদে ফেলতে চাইছে! ওকে এখনই বন্দী করুন!"

কিন্তু জামিল প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ইঙ্গিত করলেন। ততক্ষণে বিশ্বস্ত রক্ষীরা মীর জাফরের কক্ষ তল্লাশি করে বিষের একটি শিশি এবং ষড়যন্ত্রের কিছু লিখিত প্রমাণ উদ্ধার করেছে।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ: মহলের বিপর্যয়

প্রমাণ দেখে নবাব সিকান্দার আলি খান স্তম্ভিত হলেন। তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী মীর জাফর তাঁর মৃত্যু চাইছিলেন! নবাব ক্রোধে ফেটে পড়লেন। মীর জাফরকে সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে পাঠানো হলো।

কিন্তু মীর জাফর যাবার আগে শেষ একটি আঘাত হানলেন। তিনি চিৎকার করে নবাবকে বললেন, "জাঁহাপনা! আপনি কি জানেন, আপনার প্রিয়তমা বেগম রোশনারা এই জামিলের সঙ্গে গোপনে দেখা করেছেন? তিনি আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন! এই প্রমাণ আপনি আমার ঘরে খুঁজে পাবেন না, কিন্তু আপনার মহলে খোঁজ করুন!"

নবাবের চোখ জ্বলে উঠল। তিনি রোশনারাকে তলব করলেন।

রোশনারা এলেন। তাঁর চোখে কোনো ভয় ছিল না, ছিল এক কঠিন দৃঢ়তা। নবাব প্রশ্ন করলেন, "তুমি কি সত্যিই জামিলের সঙ্গে দেখা করেছ?" রোশনারা মাথা নত করলেন না। "হ্যাঁ, জাঁহাপনা। আমি বাইরে থেকে তাঁকে আনতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ আপনার জীবন বিপন্ন ছিল। আমি আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছি।"

নবাবের কাছে সত্য রক্ষা করার চেয়ে তাঁর সম্মান রক্ষা করা জরুরি ছিল। তিনি ভাবলেন, তাঁর সম্মান ধূলিসাৎ হয়েছে।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ: কঠিন বিচার

নবাবের নির্দেশে ডক্টর জামিলকে বন্দী করা হলো। রোশনারাকেও তাঁর কক্ষে নজরবন্দী করা হলো।

দিনের পর দিন চলল তাদের বিচার। নবাব বুঝতে পারছিলেন, জামিল নির্দোষ এবং রোশনারা তাঁকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু লোকনিন্দা এবং তাঁর নিজের অহংকার তাঁকে ক্ষমা করতে দিচ্ছিল না।

একদিন রাতে, নবাব রোশনারার কক্ষে গেলেন। নবাব তখন কিছুটা সুস্থ। "রোশনারা," নবাব বললেন, "তুমি আমাকে রক্ষা করেছ, কিন্তু তুমি আমার মহলের পবিত্রতা নষ্ট করেছ। তুমি জানো এর শাস্তি কী?" রোশনারা বললেন, "জানি, জাঁহাপনা। কিন্তু আমার অনুরোধ, ডক্টর জামিলকে মুক্তি দিন। তিনি কেবল আমার মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন, অন্য কোনো সম্পর্ক আমাদের মধ্যে নেই।"

নবাবের হৃদয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। তিনি রোশনারাকে ভালোবাসতেন, কিন্তু তাঁর ক্ষমতার দম্ভ তাঁকে গ্রাস করেছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, জামিলকে নির্বাসনে পাঠানো হবে। আর রোশনারাকে চিরকালের জন্য বেগম মহলের অভ্যন্তরে একাকী জীবন যাপন করতে হবে।

"তোমার শাস্তি হলো, তুমি এই মহলের কান্না হয়ে থাকবে," নবাব বললেন। "তোমার মুক্তি কেবলমাত্র যখন তুমি আমার সকল স্মৃতি থেকে মুছে যাবে।"

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ: বেগম মহলের কান্না

ডক্টর জামিলকে রাজ্য থেকে চিরতরে নির্বাসিত করা হলো। মহল ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি কেবল একবার শায়স্তার মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠাতে পারলেন—"মুক্তির পথ রুদ্ধ হলেও স্বাধীনতা মনে থাকে। সাহস হারাবেন না।"

নবাব সিকান্দার আলি খান মীর জাফরকে কঠোর শাস্তি দিলেন এবং রাজ্যের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করলেন। কিন্তু তাঁর মন থেকে রোশনারার প্রতি সন্দেহ দূর হলো না।

রোশনারা সেই দিন থেকে সত্যিই ‘বেগম মহলের কান্না’ হয়ে রইলেন। তিনি আর কখনো হাসলেন না। তাঁকে তাঁর পছন্দের গ্রন্থাগার কক্ষে বন্দী করে রাখা হলো। নবাব তাঁকে দেখতেন, কিন্তু কথা বলতেন না। তিনি জানতেন, রোশনারার নীরবতা তার প্রতি তাঁর করা অন্যায়ের প্রমাণ।

বছরের পর বছর কেটে গেল। নবাব বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলেন। রোশনারা এরপর স্বাধীন হলেন। কিন্তু তিনি আর মহল ছেড়ে কোথাও গেলেন না। তাঁর যৌবন, তাঁর ভালোবাসা, তাঁর মুক্তির স্বপ্ন—সবই বন্দী ছিল সেই মহলের শ্বেতপাথরের দেয়ালের মধ্যে।

নতুন নবাব এলেন, কিন্তু রোশনারা সেই পুরাতন বেগম মহল ত্যাগ করলেন না। তিনি সেখানে একাকী রইলেন, মহলের ছায়া হয়ে। বলা হতো, এখনও নাকি পূর্ণিমার রাতে বেগম মহলের বারান্দা থেকে এক গভীর, চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসে—যে কান্না ক্ষমতার অহংকার, অসমাপ্ত প্রেম এবং চিরন্তন বন্দিত্বের প্রতীক।

(সমাপ্ত)



Rate this content
Log in