নিভে গেল হায় আশার প্রদীপ (সামাজিক উপন্যাস) রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
নিভে গেল হায় আশার প্রদীপ (সামাজিক উপন্যাস) রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
নিভে গেল হায় আশার প্রদীপ (সামাজিক উপন্যাস)
রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
প্রকাশকের নিবেদন
আমাদের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে, যেখানে প্রতিভার মূল্য প্রায়শই সোনার চেয়ে কম, সেখানে লক্ষ লক্ষ স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। লেখক লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী তাঁর এই নতুন সামাজিক উপন্যাসে সেই সব নীরব ব্যথার কথাই তুলে ধরেছেন, যা দিনের আলোয় ঢাকা পড়ে যায়। ‘নিভে গেল হায় আশার প্রদীপ’ শুধু একটি গল্প নয়, এটি কঠিন বাস্তবের দর্পণে সময়ের প্রতিবিম্ব। আমরা আশা করি, পাঠক সমাজ এই মর্মভেদী আখ্যানের গভীরে প্রবেশ করে এক নতুন জীবনবোধ লাভ করবেন।
উৎসর্গ
সেই সমস্ত সংগ্ৰামী আত্মার উদ্দেশ্যে, যারা কঠোর পরিশ্রমের পরেও ভাগ্যের জীর্ণতার কাছে পরাজিত হয়ে, নিজেদের হৃদয়ের আশার প্রদীপ নীরবে নিভিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। নিয়তির এই নির্মম পরিহাসের কাছে নতজানু সমস্ত স্বপ্নাহত মানুষের পদতলে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস নিবেদিত।
লেখক- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
মুখবন্ধ
প্রদীপ, এক মেধাবী যুবক। তার চোখে ছিল ভবিষ্যৎ গড়ার উজ্জ্বল স্বপ্ন, পরিবারকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার সংকল্প। কিন্তু সমাজ, রাজনীতি ও দুর্নীতির করাল গ্রাস তার প্রতিটি প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। একদিকে বৃদ্ধা মায়ের অসুস্থতা, অন্যদিকে ছোট বোনের বিয়ে—দায়িত্বের পাহাড় এবং প্রত্যাশিত সাফল্যের অভাব প্রদীপকে ক্রমশ এক গভীর আঁধারের দিকে ঠেলে দেয়। এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, কীভাবে একটি সরল, সৎ জীবন সমাজের জটিল অঙ্কের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয় এবং শেষমেশ আশার শেষ শিখাটুকুও নিভে যায়।
প্রথম অধ্যায়
জীর্ণ পাতার দীর্ঘশ্বাস
শ্রাবণ মাসের শেষ বিকেল। শহরতলির সেই দু’কামরার পলেস্তারা খসা বাড়িটার বারান্দায় গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে। শুধু অন্ধকার নয়, সেই অন্ধকারের সঙ্গে মিশে আছে এক অদ্ভুত ভারী, স্যাঁতসেঁতে ক্লান্তি। বাইরের অবিরাম বৃষ্টিপাত যেন পৃথিবীর নয়, কোনো ক্লান্ত হৃদয়ের অশ্রুপাত।
প্রদীপ বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। হাতে ধরা একটি ভাঁজ করা চিঠি। চিঠিটি সাদা, কিন্তু তার ভেতরে যে সিদ্ধান্ত লেখা আছে, তা প্রদীপের জীবনের সব রং মুছে দিয়েছে। সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের মেধা তালিকা প্রকাশের পর আজ চতুর্থ দিন। টানা তিন রাত সে ঘুমাতে পারেনি। ঘুম যেন স্বেচ্ছায় তাকে এড়িয়ে চলছে, পাছে স্বপ্নের মধ্যে আবারও সেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের মুখ দেখে ফেলে, যা বাস্তবে কেবলই প্রতারণা।
প্রদীপ শুধু একটি নাম ছিল না। সে ছিল এই মধ্যবিত্ত পরিবারের ‘আশা’। ছোটবেলা থেকেই তার খাতাপত্র ছিল গ্রামের স্কুলের প্রতিটি শিক্ষকের গর্বের বস্তু। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেও সে উচ্চশিক্ষায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিল। প্রতিবারই আত্মীয়-স্বজনরা বলত, "প্রদীপ পাশ করলেই সব দুঃখ ঘুচবে রে, রমা (প্রদীপের মা)। ও আমাদের কপাল ফেরাবে।"
তার মা, রমা দেবী, সেই কথা শুনে নীরবে চোখের জল ফেলতেন। একটি ছেলে কঠোর পরিশ্রম করছে, সামান্য টিউশনির টাকায় সংসার চালাচ্ছে আর নিজের পড়ার খরচ জোগাচ্ছে—এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কী হতে পারে! তার বিশ্বাস ছিল, মেধা একদিন না একদিন তার যোগ্য সম্মান এনে দেবেই।
কিন্তু এই সমাজ শুধু মেধার বিচার করে না। সে বিচার করে সংযোগের, ক্ষমতাশালীর প্রশ্রয়ের, মোটা অঙ্কের ঘুষের।
প্রদীপ যে চাকরিটির জন্য গত পাঁচ বছর প্রস্তুত নিচ্ছিল, সেখানে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ। শূন্যপদ ছিল মাত্র শ’খানেক। মেধা যাচাইয়ের সমস্ত ধাপ সে সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়েছিল। ইন্টারভিউয়েও তার পারফর্ম্যান্স ছিল নজরকাড়া। তবুও, চূড়ান্ত তালিকায় তার নাম নেই।
কারণটা সে জানে। একটি সহকর্মী, যার পরীক্ষার স্কোর প্রদীপের চেয়ে অনেক কম ছিল, আজ সেই চাকরি পেয়েছে। তার বাবার স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে ভালো যোগাযোগ ছিল। ‘যোগাযোগ’—এই শব্দটি আজ প্রদীপের কাছে ‘যোগ্যতা’-র চেয়েও বেশি ভারী মনে হলো।
প্রদীপ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শ্বাসটা বুক চিরে এমনভাবে বের হলো, যেন শরীরের ভেতর থেকে উষ্ণ কোন মোমবাতি নিভে গেল। এই দীর্ঘশ্বাস শুধু ব্যর্থতার নয়, এটি তার যৌবনের, তার স্বপ্নের, তার আদর্শের মৃত্যুঘণ্টা।
ঘরের ভেতর থেকে মায়ের ক্ষীণ গোঙানির শব্দ ভেসে এলো। মায়ের হার্টের অসুখ। ডাক্তারের পরামর্শ, দ্রুত একটা বড় শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। চিকিৎসা মানে প্রচুর টাকা। আর টাকা মানেই একটা নিশ্চিত রোজগার।
প্রদীপ চিঠিটি মুষ্টিবদ্ধ করল।
"নিভে গেল হায় আশার প্রদীপ," স্বগতোক্তি করল সে।
বারান্দার মেঝেতে সদ্য জমা হওয়া বৃষ্টির জল, আর প্রদীপের চোখের জল আজ একাকার। সে জানত না, নিজের সঙ্গে এই প্রতারণা সে কীভাবে সামলাবে। সে তো সমাজের সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু নিয়তি যে তার নিজের আদর্শের ওপরই আঘাত হানবে, তা সে কল্পনাও করেনি।
যদি সেও ঘুষ দিত? যদি সেও অন্যায়ের পথে হাঁটত?
এই প্রশ্নটি তার হৃদয়ে তীব্র শূলের মতো বিঁধল। না, সে পারেনি। মেরুদণ্ড সোজা রেখে বাঁচতে চেয়েছিল। আর এই সোজা থাকাটাই হয়তো এই সমাজে সবচেয়ে বড় অপরাধ।
প্রদীপ ঘরে ফিরল। অন্ধকার ঘরে একটি পুরোনো কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প রাখা। ল্যাম্পের কাঁচ ঘোরানো, ভেতরে তেল নেই। ল্যাম্পটি আজ তার জীবনের প্রতীকের মতো—অন্ধকার, শূন্য এবং ব্যবহারের অযোগ্য।
"প্রদীপ?" ফিসফিস করে ডাকলেন রমা দেবী। "তোর কি শরীর খারাপ? আজ তুই এত চুপ কেন রে? খবরের কাগজে... খবর কি বেরিয়েছে?"
প্রদীপ দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। এই মুহূর্তে সত্যটা মুখ ফুটে বলা অসম্ভব। সত্যটা বললে মায়ের অসুস্থতা আরও বেড়ে যাবে।
"হ্যাঁ মা, বেরিয়েছে," প্রদীপ ম্লান হাসার চেষ্টা করল, যা হাসি নয়, বরং যন্ত্রণার বিকৃতি। "কিন্তু এবারও..." সে কথা শেষ করতে পারল না।
রমা দেবী খাটের ওপর উঠে বসলেন, চোখে উদ্বেগ। "এবারও কী? হলো না?"
প্রদীপ মাথা নিচু করে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করল: "না।"
ঘরের ভেতরের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হলো। বাইরের বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে রমা দেবীর ভেতরের কান্না যেন প্রদীপের কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তাঁর কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, "এত পড়া, এত কষ্ট... সব কি তবে বৃথা গেল? ভগবান কি তোর কপাল এমন করেই লিখলেন, বাপ? আমাদের আর কী হবে?"
প্রদীপের মনে হলো, এই মুহূর্ত থেকে তার জীবনের সমস্ত সরল রেখা বাঁকা হয়ে গেছে। আশার প্রদীপ নিভে যাওয়ায়, এখন কেবল অন্ধকারই তার পথপ্রদর্শক। কিন্তু এই দীর্ঘ অন্ধকারে সে এখন কী করবে? পরিবারকে বাঁচানোর জন্য কি তাকে সেই পথেই নামতে হবে, যে পথকে সে এতদিন ঘৃণা করত?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রদীপ অনুভব করল, তার ভেতরে একজন সৎ, আদর্শবাদী মানুষ চিরদিনের জন্য বিদায় নিচ্ছে।
