রাঙাবধূ ধরেছে ত্রিশূল (সামাজিক উপন্যাস) রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
রাঙাবধূ ধরেছে ত্রিশূল (সামাজিক উপন্যাস) রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
রাঙাবধূ ধরেছে ত্রিশূল (সামাজিক উপন্যাস)
রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
প্রথম পরিচ্ছেদ
বহ্নিশিখার বিয়ের পর মাস না ঘুরতেই গ্রাম আলো করে নতুন বউ এলো সুন্দরপুর গ্রামে। বহ্নিশিখা, নামটি যেমন মিষ্টি, মেয়েটিও ছিল ঠিক তেমনই। বহ্নিশিখাকে দেখে গ্রামের সকলেরই মনে হয়েছিল, যেন এক টুকরো রাঙা সকাল এসে আস্ত গ্রামটাকে নতুন রঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেল। তার পরনে সদ্যবিয়ের লাল পাড়ের শাড়ি, সিঁথিতে সিঁদুর আর কপালে কুঙ্কুমের টিপ তাকে যেন এক জীবন্ত প্রতিমার রূপ দিয়েছিল। নীলকান্তর মতো শান্তশিষ্ট আর অভাবী ঘরের ছেলের কপালে যে এমন চাঁদপানা বউ জুটবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি।
নীলকান্তর মা, বিধবা সুমিত্রা দেবী, ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। সামান্য চাষবাস আর অন্যের খেতে মজুরি করে সংসার চলতো তাদের। ছেলেকে লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছে থাকলেও অভাবের তাড়নায় তা হয়ে ওঠেনি। তাই নীলকান্ত ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাজে হাত লাগাতো। বহ্নিশিখা আসার পর থেকে সুমিত্রা দেবীর মনে এক নতুন আশা জাগল। তিনি জানতেন, বহ্নিশিখা শুধু রূপবতী নয়, গুণবতীও। তার মুখ দেখে মনে হতো না সে কোনোদিন ভেঙে পড়বে, বরং তার চোখে ছিল এক স্থির আত্মবিশ্বাস। গ্রামের পথ দিয়ে যখন বহ্নিশিখা কলসি কাঁখে ঘাটে যেত, তার নুপুরের শব্দে আর হাসি মুখে এক নতুন স্নিগ্ধতা খেলে যেত। কিন্তু সুন্দরপুর গ্রামের বুকে যে এক কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছিল, তা তখনো রাঙাবধূ বহ্নিশিখার চোখে পড়েনি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সুন্দরপুর গ্রাম যেন হাজারো গল্প আর প্রকৃতির খেলায় গড়া এক প্রাচীন গ্রাম। এখানে একদিকে যেমন সবুজ ধানক্ষেতের ঢেউ, অন্যদিকে তেমনই বাঁশঝাড়ের ছায়াঘেরা মেঠো পথ। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই সহজ সরল, মেহনতী। কিন্তু এ গ্রামের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার প্রতাপরুদ্র চৌধুরী প্রকাণ্ড অট্টালিকা। প্রতাপরুদ্র চৌধুরী জমিদার না হলেও, তার দাপট গ্রামের জমিদারের চেয়ে কম কিছু ছিল না। তিনি ছিলেন গ্রামের মহাজন এবং গ্রাম্য মোড়ল। তার কথার বাইরে গ্রামের একটি পাতাও নড়তো না।
নীলকান্তদের ছোট্ট কুঁড়েঘরটি ছিল গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে, আমবাগান পেরিয়ে। ভাঙাচোরা হলেও, ঘরটায় মায়ের হাতের যত্নে এক পবিত্রতা লেগেছিল। বহ্নিশিখা আসার পর ঘরটা যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। বহ্নিশিখা সকাল হতে না হতেই ঘরদোর গুছিয়ে, উঠোন ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলতো। তারপর সুমিত্রা দেবীর সাথে হাত লাগাতো দৈনন্দিন কাজে, কখনও রান্নাঘরে, কখনও পুকুর ঘাটে অথবা কখনও বা ফসলের মাঠে। নীলকান্ত ভোরে উঠে লাঙল কাঁধে মাঠে চলে যেত, আর ফিরতো সন্ধ্যা বেলায়। বহ্নিশিখা চেয়ে থাকতো পথের দিকে, কখন আসবে তার স্বামী। নতুন বিয়ের এই দিনগুলো যেন এক স্বপ্নের মতো কাটছিল। কিন্তু এই স্বপ্নের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক ভয়ঙ্কর বাস্তব, যা নীলকান্ত তার নতুন বধূর কাছ থেকে আপ্রাণ লুকিয়ে রাখতে চাইছিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
হঠাৎ করেই নীলকান্তের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ দেখা যেতে শুরু করলো। সে কাজের ফাঁকে প্রায়শই দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, আর রাতের বেলায় ছটফট করতো। বহ্নিশিখা প্রথম প্রথম ভেবেছিল, হয়তো কাজের চাপ বেশি। কিন্তু স্বামীর মুখে যে হাসি একদা ঝলমল করতো, তা যেন ফিকে হয়ে আসছিল দিন দিন। বহ্নিশিখা জিজ্ঞাসা করলে সে এড়িয়ে যেত, বলতো, "কিছু না গো বহ্নিশিখা, কাজের চাপ বেশি, তাই একটু ক্লান্তি লাগছে।" কিন্তু বহ্নিশিখা বুঝতে পারছিল, এটা কেবল ক্লান্তি নয়। এটা এক গভীর দুশ্চিন্তা, যা নীলকান্তকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
একদিন বিকেলে বহ্নিশিখা পুকুর ঘাটে গিয়েছিল জল আনতে। সেখানে গ্রামের আরও দু-একজন নারীর সাথে তার দেখা হলো। তাদের কথায় কথায় প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর প্রসঙ্গ উঠল। একজন নারী বললেন, "শুনেছিস গো, প্রতাপরুদ্র চৌধুরী নাকি বিশুর ভিটেটা কেড়ে নেবে! বেচারা মহাজনের কাছে ধার করেছিল, শোধ করতে পারেনি।" আরেকজন যোগ করলো, "ওই লোকটার চোখ বড় খারাপ গো। একবার যার ওপর চোখ পড়ে, তার আর নিস্তার নেই।" বহ্নিশিখা তাদের কথা শুনছিল। প্রতাপরুদ্র চৌধুরীরনামটা এর আগেও সে শুনেছিল, কিন্তু তার আসল রূপ সম্পর্কে সে ততটা অবগত ছিল না। আজ তাদের কথা শুনে বহ্নিশিখার মনে এক অজানা ভয় উঁকি দিল। এই প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর সাথে কি নীলকান্তর কোনো সম্পর্ক আছে? এই প্রশ্নটাই তার মনকে অস্থির করে তুলল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
রাতের খাবার পর সুমিত্রা দেবী যখন ঘুমিয়ে পড়লেন, বহ্নিশিখা আর নীলকান্ত উঠোনে শীতল পাটি পেতে বসলো। জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক ঝলমল করছিল। বহ্নিশিখা আর থাকতে পারলো না। সে নীলকান্তকে জিজ্ঞেস করলো, "কী হয়েছে গো তোমার? কেন মনমরা হয়ে আছো আজকাল? আমাকে কি এতটুকুও বিশ্বাস করো না যে তোমার দুঃখটা আমাকে বলতে পারো?"
বহ্নিশিখার চোখে জল দেখে নীলকান্ত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, "আর বলিস না বহ্নিশিখা। এক কঠিন বিপদে পড়েছি।" নীলকান্ত বহ্নিশিখাকে জানালো তাদের পারিবারিক ঋণের কথা। তার বাবা মারা যাওয়ার আগে প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর কাছ থেকে জমি বন্ধক রেখে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেই ঋণের সুদ বাড়তে বাড়তে এখন এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, তা শোধ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। প্রতাপরুদ্র চৌধুরী বারবার টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে, আর সে দিতে না পারলে জমিটুকুও যাবে।
কথাগুলো শুনে বহ্নিশিখা স্তম্ভিত হয়ে গেল। এত বড় একটা কথা তার কাছ থেকে এতদিন লুকানো হয়েছিল। তার চোখে ভেসে উঠলো প্রতাপরুদ্রের সেই নির্মম মুখ, যা সে পুকুর ঘাটে শুনেছিল। বহ্নিশিখার চোখের সামনে তাদের সাধের সংসারটা ভেঙে পড়ার ছবি ভেসে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, সে যেন এক গভীর খাদে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভেতরে এক দৃঢ়তা জন্মালো। রাঙাবধূ বহ্নিশিখা, যে কিনা এই সংসারে নতুন আলো আনতে এসেছিল, সে কিভাবে তার স্বামীকে এমন বিপদে একা ফেলে রাখবে?
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বহ্নিশিখার কাছে স্বামীর ঋণের কথা শুধু একটি সংবাদ ছিল না, ছিল এক দুঃস্বপ্নের হাতছানি। পরের দিন সকালে নীলকান্ত যখন মাঠের কাজে বেরিয়ে গেল, বহ্নিশিখা তখন সুমিত্রা দেবীর কাছে ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলো। সুমিত্রা দেবী কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বললেন। কিভাবে তারা চেষ্টা করেও ঋণ শোধ করতে পারেননি, কিভাবে প্রতাপরুদ্র চৌধুরী তাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। সুমিত্রা দেবীর সরল চোখে অসহায়তার ছাপ দেখে বহ্নিশিখার মনটা আরও ভারী হয়ে উঠলো।
সেদিনই দুপুরে প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর এক পেয়াদা এসে নীলকান্তকে ডেকে পাঠালো। নীলকান্ত তখন মাঠে ছিল। পেয়াদা সুমিত্রা দেবী আর বহ্নিশিখাকে উদ্দেশ্য করে অভদ্র ভাষায় কথা বলতে শুরু করলো। "কই রে নীলকান্ত! চৌধুরী মশাই ডেকেছে। টাকা জোগাড় হয়েছে? না হলে ভিটেবাড়ি ছাড়তে হবে!" সুমিত্রা দেবী ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন। কিন্তু বহ্নিশিখা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে পিয়াদার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললো, "কথা বলার একটা সীমা থাকে! নীলকান্ত বাড়ি নেই। সে এলে যা বলার তাকে বলবেন।" বহ্নিশিখার এমন অপ্রত্যাশিত দৃঢ়তা দেখে পিয়াদা কিছুক্ষণ থমকে গেল, তারপর মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল।
ঘটনাটি ছোট হলেও, বহ্নিশিখার মনে এক গভীর রেখাপাত করলো। সে বুঝতে পারলো, এই লোকগুলো কেবল টাকাই চায় না, তারা মানুষের সম্মানও কেড়ে নিতে চায়। তার ভেতরের রাঙাবধূটি ধীরে ধীরে এক অদম্য শক্তিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করছিলো।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
সেই দিন সন্ধ্যার পর বহ্নিশিখা নীরবে বসে থাকলো। তার মাথায় যেন সহস্র চিন্তার জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। কিভাবে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? স্বামীর কষ্ট সে আর দেখতে পারছিল না। সমাজের চোখে নীলকান্তকে ছোট হতে দেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের এই সামান্য জমিটুকু, যা তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, তা হারাবার ভয়ে বহ্নিশিখা অস্থির হয়ে উঠলো।
সে সুমিত্রা দেবীর কাছে জানতে চাইলো, প্রতাপরুদ্র চৌধুরী কি সত্যিই এতটাই প্রভাবশালী যে তার কথার বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারে না? সুমিত্রা দেবী কাঁপা গলায় বললেন, "ও মা, তার কথা! তার বিরুদ্ধে কথা বললে তো গ্রামে থাকা দায় হয়ে যাবে! সে মস্তান রেখেছে, পুলিশ তার হাতের মুঠোয়। যার ওপর তার চোখ পড়ে, তাকে শেষ না করে ছাড়ে না।" বহ্নিশিখা মায়ের কথা শুনলো, কিন্তু তার ভেতরের আগুন দাপিয়ে উঠল। সে ভাবলো, একজন মানুষ এত শক্তিশালী হতে পারে কিভাবে? একজন সাধারণ দরিদ্রের ওপর তার অত্যাচার কি কেউ দেখবে না?
বহ্নিশিখার মনে প্রথম প্রশ্ন জাগলো, ন্যায়বিচার কি শুধু ধনীদের জন্যই? এই প্রশ্ন তাকে ভেতর থেকে আন্দোলিত করতে শুরু করলো। তার নরম মন কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে ঝুঁকতে শুরু করলো।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
পরের দিন সকাল থেকেই প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর চাপ আরও বেড়ে গেল। এবার আর পেয়াদা নয়, স্বয়ং প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর এক বিশ্বস্ত গুণ্ডা, শম্ভু, এসে হাজির হলো। তার মস্ত শরীর, রুক্ষ চোখ দেখে সুমিত্রা দেবী ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। সে নীলকান্তকে অশালীন ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করলো, আর শেষবারের মতো হুমকি দিয়ে গেল যে, এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা শোধ না হলে তাদের ভিটেমাটি সব কেড়ে নেওয়া হবে।
শম্ভু চলে যাওয়ার পর নীলকান্ত ভেঙে পড়লো। সে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। বহ্নিশিখার সামনেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। "আর পারা যায় না বহ্নিশিখা। মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে গেল। জমিটুকুও যাবে। আমাদের আর আশ্রয় থাকবে না।" নীলকান্তের এই অসহায় রূপ দেখে বহ্নিশিখার চোখ জলে ভরে উঠলো। কিন্তু এইবার সে আর নিজেকে দুর্বল হতে দিলো না। সে অনুভব করলো, তার ভেতরের শক্তি জেগে উঠছে। সে শান্ত কণ্ঠে বললো, "ছি ছি, এমন কথা বলতে নেই। আমরা কিছু একটা উপায় বের করবোই। আমি আছি তো তোমার পাশে।"
নীলকান্ত বহ্নিশিখার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। তার শান্ত অথচ দৃঢ় চোখে যেন এক নতুন আলো দেখতে পেল। বহ্নিশিখা যেন এক ঝলক আশার আলো নিয়ে এল তার জীবনে। কিন্তু নীলকান্ত তখনও জানতো না, রাঙাবধূ বহ্নিশিখার ভেতরে এক তেজস্বিনী দুর্গা ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছে।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
বহ্নিশিখা এরপর গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলতে শুরু করলো। তার লক্ষ্য ছিল প্রতাপরুদ্র চৌধুরী সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা। সে বুঝতে পারছিল, কেবল ব্যক্তিগতভাবে ভয় পেয়ে ঘাপটি মেরে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। গ্রামের হাট-বাজার, পুকুর ঘাট, এমনকি মন্দিরের পুজোতেও সে কান পেতে রাখতো।
সে জানতে পারলো, কেবল নীলকান্তরাই নয়, গ্রামের আরও অনেক পরিবার প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর ঋণের জালে জড়িয়ে আছে। অনেকেই তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছে, অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছে। প্রতাপরুদ্র চৌধুরী সুদের ওপর সুদ চাপিয়ে মানুষকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেত যে, তাদের পক্ষে ঋণ শোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠতো। এরপর সে জোর করে তাদের জমিজমা কেড়ে নিতো। গ্রামের নিরীহ মানুষরা ভয় এবং অজ্ঞতার কারণে কোনো প্রতিবাদ করতে পারতো না।
একদিন বহ্নিশিখা দেখলো, এক বৃদ্ধা, যার নাম রাধামণি, প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর বাড়ির সামনে বসে কাঁদছে। বহ্নিশিখা এগিয়ে গিয়ে কারণ জানতে চাইলো। রাধামণি জানালেন, তার একমাত্র ছেলের চিকিৎসার জন্য তিনি প্রতাপরুদ্রের কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা ধার করেছিলেন। এখন ছেলে সুস্থ হলেও, প্রতাপরুদ্র তার ভিটেমাটি কেড়ে নিতে চাইছে, কারণ তিনি সুদের টাকা দিতে পারেননি। এই ঘটনা বহ্নিশিখার মনে গভীর রেখাপাত করলো। তার ব্যক্তিগত সমস্যা এখন আর শুধু ব্যক্তিগত রইলো না, তা যেন গ্রামের সকল অসহায় মানুষের সম্মিলিত আর্তনাদে পরিণত হলো। বহ্নিশিখার মনে হলো, এই অন্যায় আর সহ্য করা যায় না।
নবম পরিচ্ছেদ
বহ্নিশিখার মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঝড় বইতে লাগলো। একদিকে স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা, ভিটেমাটি হারানোর ভয়, অন্যদিকে গ্রামের নিরীহ মানুষের ওপর প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর লাগাতার অত্যাচার। তার মন বলছিল, এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু সুমিত্রা দেবী বারবার তাকে সাবধান করছিলেন। "মা বহ্নিশিখা, ওসব ঝামেলার মধ্যে যেও না। পুরুষ মানুষের ব্যাপার, তারাই সামলাক। মেয়েরা কি আর এসব পারে?"
সুমিত্রা দেবীর কথা মিথ্যে নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর স্থান বরাবরই ছিল ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে। প্রতিবাদ করা, সমাজ সংস্কার করা, বিচার চাইতে যাওয়া – এসব ছিল পুরুষের কাজ। কিন্তু রাধামণির কান্না, নীলকান্তের অসহায় মুখ বহ্নিশিখাকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল, এই নীরবতা আরও বড় অন্যায়ের জন্ম দেবে।
বহ্নিশিখা একদিন গ্রামের মন্দিরে গেল। সেখানে বসার পর তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি এলো। মন্দিরের দেয়ালে আঁকা দশমহাবিদ্যার ছবি, বিশেষত মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাদেবীর প্রতিমা তাকে গভীর চিন্তায় মগ্ন করলো। দুর্গা দেবী, যিনি নারী হয়েও অসুর নিধন করেছিলেন, শৃঙ্খলমুক্ত করেছিলেন দেব ও মানবের জগতকে। বহ্নিশিখা নিজেকে জিজ্ঞেস করলো, কেন নারী দুর্বল হবে? কেন সে শুধু নীরব দর্শক হয়ে থাকবে? তার ভেতরের রাঙাবধূটি এবার যেন সত্যসত্যই ত্রিশূল ধারণের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলো।
দশম পরিচ্ছেদ
বহ্নিশিখা স্থির করলো, সে আর চুপ থাকবে না। কিন্তু কিভাবে প্রতিবাদ করবে? সে তো কোনো পুরুষের মতো শক্তিমান নয়, তার পিছনে কোনো আর্থিক বা সামাজিক বলও নেই। তার একমাত্র সম্বল তার বুদ্ধি আর সাহস। বহ্নিশিখা এরপর গ্রামে কিছু সমমনা মানুষকে খুঁজতে শুরু করলো। যারা প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ, কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে পারে না।
গ্রামের মণ্ডপ সংলগ্ন বটগাছ তলায় বহ্নিশিখা একদিন এক বৃদ্ধের সাথে কথা বললো। বৃদ্ধের নাম মহাদেব মণ্ডল, গ্রামের প্রাক্তন শিক্ষক। মানুষজন তাকে 'মাস্টারমশাই' বলে ডাকতো। মাস্টারমশাই প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর অনেক কুকীর্তি সম্পর্কে জানতেন। বহ্নিশিখা তার কাছে গিয়ে সব খুলে বললো, নীলকান্তের ঋণের কথা, রাধামণির দুর্দশার কথা, এবং তার নিজের প্রতিবাদের ইচ্ছার কথা।
মাস্টারমশাই মনোযোগ দিয়ে বহ্নিশিখার কথা শুনলেন। তিনি বহ্নিশিখার চোখে নির্ভীকতা দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, "অনেকদিন ধরে এই গ্রামের মানুষ প্রতাপরুদ্রের অত্যাচারে পিষ্ট হচ্ছে। কেউ সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারেনি। আজ তোমার মুখে এমন কথা শুনে আমার মনে আশার আলো জ্বলছে, মা। কিন্তু পথটা খুব কঠিন।" বহ্নিশিখা বললো, "কঠিন হোক, তবুও আমাকে চেষ্টা করতে হবে, মাস্টারমশাই। আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?" মাস্টারমশাই কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, "আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা আর যতটুকু বুদ্ধি আছে, তা দিয়ে তোমাকে সাহায্য করবো।" এই প্রথম বহ্নিশিখা তার সংগ্রামের পথে একজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী খুঁজে পেলো। রাঙাবধূ এবার সত্যি সত্যিই ত্রিশূলের প্রথম প্রান্ত স্পর্শ করলো।
একাদশ পরিচ্ছেদ
মাস্টারমশাইয়ের সহায়তায় বহ্নিশিখা গোপনে গ্রামের কিছু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে একত্রিত করতে শুরু করলো। প্রথম দিকে অনেকেই ভয়ে বহ্নিশিখার ডাকে সাড়া দিতে চাইছিল না। প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর ক্ষমতার ভয়ে তারা এতটাই ভীত ছিল যে, প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে কথা বলতেও তাদের বুক কাঁপতো।
বহ্নিশিখা তাদের বোঝালো, "একলা হয়তো আমরা কিছুই করতে পারবো না। কিন্তু আমরা যদি একজোট হই, তাহলে আমাদের শক্তি বহুগুণ বেড়ে যাবে। প্রতাপরুদ্রের মূল শক্তি তার একাধিপত্য আর আমাদের বিভাজন। আমরা যদি সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াই, তাহলে সে একা হয়ে পড়বে।" বহ্নিশিখা তাদের উদাহরণ দিল রাধামণির, বিশু সর্দারের, আরও অনেকের, যারা প্রতাপরুদ্রের অত্যাচারে ভিটেমাটি হারিয়েছে। সে বললো, "আজ আমাদের এই দশা, কাল হয়তো আপনাদেরও হবে। আর কতকাল আমরা ভয়ে ভয়ে বাঁচবো?"
বহ্নিশিখার কথা তাদের মনে দাগ কাটতে শুরু করলো। তাদের চোখে আশার ক্ষীণ আলো দেখা দিল। অনেকেই হয়তো সরাসরি কিছু বলতে পারছিল না, কিন্তু বহ্নিশিখার পাশে দাঁড়ানোর একটা নীরব সম্মতি অনেকেই দিলো। এই গোপন বৈঠকগুলো বহ্নিশিখা সাধারণত গভীর রাতে বা সকালেই সেরে ফেলতো, যাতে প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর চরদের চোখে না পড়ে। এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই বহ্নিশিখাকে তার লক্ষ্য পূরণে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর লোকজনের কান পর্যন্ত বহ্নিশিখার এই তৎপরতা পৌঁছাতে বেশি দেরি হলো না। যখন গ্রামের সাধারণ মানুষ বহ্নিশিখাকে নিয়ে গুঞ্জন করতে শুরু করলো, তখন প্রতাপরুদ্রের কানেও খবরটা গেল। সে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারলো না যে, নীলকান্তের মতো এক দুর্বল চাষীর বউ তার বিরুদ্ধে এমন কিছু করার সাহস পাবে।
একদিন বিকেলে প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর পেয়াদা আর দুই গুণ্ডা এসে নীলকান্তের বাড়িতে হাজির হলো। নীলকান্ত তখন মাঠে ছিল, সুমিত্রা দেবীও বাইরে ছিলেন। বহ্নিশিখা একাই ছিল ঘরে। পেয়াদা দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, "কই রে নতুন বউ, বেরিয়ে আয়! চৌধুরী মশাই তোকে একবার দেখা করতে বলেছেন।" বহ্নিশিখা দরজা খুললো না। সে ভেতর থেকেই দৃঢ় কণ্ঠে বললো, "কিসের জন্য দেখা করতে বলেছেন? যা বলার নীলকান্তকে বলবেন।"
গুণ্ডারা দরজা ভেঙে ফেলার হুমকি দিল। বহ্নিশিখা ভয়ে ভয়ে ঠাকুরের ছবিটার দিকে তাকালো। তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করলো। সে জানতো, এখন ভয় পেলে চলবে না। দরজা না খুলে সে পাল্টা চিৎকার করে উঠলো, "গ্রামের মধ্যে এ কি তাণ্ডব করছেন আপনারা? আপনাদের সাহস হয় কিভাবে একজন নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করার চেষ্টা করতে? আমি এখনই গ্রামের সবাইকে ডাকছি!" বহ্নিশিখার এমন অপ্রত্যাশিত তীব্র স্বর শুনে গুণ্ডারা কিছুক্ষণ থমকে গেল। তারা গ্রামের মানুষের ভয়ে আর ভেতরে ঢুকলো না, শুধু দূর থেকে হুমকি দিয়ে চলে গেল। এই ঘটনা বহ্নিশিখার মনে এক নতুন আত্মবিশ্বাস যোগ করলো। সে বুঝতে পারলো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলে সবাই ভীত হয় না, বরং ভয় পায় অন্যায়কারী নিজেই।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
গুণ্ডাদের ফিরে যাওয়ার পর নীলকান্ত বাড়ি ফিরলে বহ্নিশিখা তাকে সব ঘটনা খুলে বললো। নীলকান্ত ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। "তুমি কেন তাদের সাথে কথা বললে? তুমি কেন নিজেকে বিপদের মুখে ফেলছো? ওরা খুব খারাপ লোক, বহ্নিশিখা।" নীলকান্তের এই অসহায়তা বহ্নিশিখাকে আরও দৃঢ় করলো। সে বললো, "তুমি চুপ করে থাকলে ওরা আমাদের আরও সুযোগ নেবে। আমি আর চুপ করে থাকবো না। ওরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, কারণ আমি তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছি।"
পরদিন প্রতাপরুদ্র চৌধুরী গ্রামে এক সালিশি সভার আয়োজন করলেন। গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং ভয়ে কাঁপতে থাকা কিছু মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিল। প্রতাপরুদ্রের উদ্দেশ্য ছিল, এই সালিশিতে নীলকান্তকে প্রকাশ্যে অপমান করে ভয় দেখানো এবং বহ্নিশিখার এই প্রতিবাদী মনোভাবকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা। নীলকান্তকে ডাকা হলো, তার ঋণ শোধ করার শেষ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলো, আর সাথে জুড়ে দেওয়া হলো আরও এক মাসের সুদ।
কিন্তু এবার বহ্নিশিখা নীরবে তা মেনে নিতে পারলো না। সালিশি সভায় সকলের সামনে বহ্নিশিখা নির্ভয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার পরনে ছিল একটি সাদা তাঁতের শাড়ি, কপালে লাল সিঁদুর। সে যেন এক শান্ত অথচ দৃঢ় প্রতিমূর্তি। বহ্নিশিখা সকলের সামনে প্রশ্ন তুললো, "মহাজন, আপনি যে সুদ চাপিয়েছেন, তা আইনত বৈধ কিনা? একজনের ঋণের জন্য তার ভিটেমাটি কেড়ে নেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? গ্রামের কত পরিবারকে আপনি সর্বস্বান্ত করেছেন, তার কি কোনো হিসাব আছে?" বহ্নিশিখার এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নবাণে প্রতাপরুদ্র চৌধুরী স্তম্ভিত হয়ে গেল। গ্রামের মানুষও অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। বহ্নিশিখার এই পদক্ষেপ ছিল তার প্রথম সরাসরি আক্রমণ, যা রাঙাবধূর হাতে ত্রিশূল থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
বহ্নিশিখার চ্যালেঞ্জ প্রতাপরুদ্র চৌধুরীকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করলো। তার দীর্ঘদিনের দাপট, তার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে একজন সামান্য গৃহবধূ সকলের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করলো – এটা সে মেনে নিতে পারলো না। সালিশি সভা পণ্ড হয়ে গেল। প্রতাপরুদ্র চৌধুরী রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
পরের দিন থেকেই বহ্নিশিখার বিরুদ্ধে প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর প্রতিশোধ শুরু হলো। প্রথমে তাদের মাঠে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো। প্রতাপরুদ্রের গুণ্ডারা মাঠে গিয়ে নীলকান্তকে কাজ করতে বাধা দিল। এরপর গ্রামের দোকানে তাদের ধারে জিনিসপত্র দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো। বহ্নিশিখার পরিবারকে একঘরে করার চেষ্টা করা হলো। গ্রামে গুজব ছড়ানো হলো যে বহ্নিশিখা খারাপ মেয়ে, স্বামীর মাথা খাচ্ছে, গ্রামের শান্তি নষ্ট করছে। এমনকি সুমিত্রা দেবীর কাছেও কিছু বয়স্ক মহিলা এসে বহ্নিশিখাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, সে যেন চুপ থাকে, ঘরের কাজ করে।
কিন্তু বহ্নিশিখা এসবের কোনো কিছুতেই বিচলিত হলো না। বরং এসব দেখে তার রাগ আরও বাড়িয়ে দিল। সে বুঝতে পারলো, প্রতাপরুদ্র তার শেষ চেষ্টা করছে তাকে দমন করতে। কিন্তু বহ্নিশিখা এবার আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো। সে মাস্টারমশাইয়ের সাথে বসে আরও পরিকল্পনা করতে শুরু করলো। গ্রামের যেসব মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল, তাদের সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করলো। বহ্নিশিখা জানে, এই পথ সহজ নয়, বরং কাঁটা বিছানো। কিন্তু একবার যখন সে ত্রিশূল ধরেছে, তখন পথ থেকে সরে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চোখে এখন শুধু একটাই লক্ষ্য – অন্যায়ের বিনাশ।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
বহ্নিশিখার সাহসী পদক্ষেপ এবং প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর প্রতিশোধমূলক কার্যক্রম সুন্দরপুর গ্রামে এক নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। গ্রামের মানুষ দ্বিধায় বিভক্ত হয়ে পড়লো। একদল প্রতাপরুদ্র চৌধুরীর ভয়ে বহ্নিশিখাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো, এমনকি তার সমালোচনা করতেও ছাড়লো না। অন্যদিকে, যারা প্রতাপরুদ্রের অত্যাচারে নীরব যন্ত্রণা ভোগ করছিল, তাদের মনে বহ্নিশিখাকে দেখে নতুন আশার আলো ঝলমল করতে লাগলো। তারা হয়তো প্রকাশ্যে বহ্নিশিখার পাশে দাঁড়াতে পারছিল না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার প্রতি তাদের সমর্থন ছিল অবিচল।
বহ্নিশিখা এখন আর কেবল নীলকান্তের 'রাঙাবধূ' ছিল না। সে হয়ে উঠেছিল গ্রামের নিপীড়িত মানুষের নীরব কণ্ঠস্বর। তার মনে ভয় থাকলেও, সে তা প্রকাশ হতে দিত না। সে জানতো, এবার পিছু হটলে কেবল তার পরিবার নয়, গ্রামের আরও অনেক মানুষ ভরসা হারাবে। মাস্টারমশাই তাকে আইনের কিছু দিক বোঝালেন, বললেন যে, প্রতাপরুদ্রের এই সুদের কারবার এবং জোর করে জমি দখলের পেছনে কোনো আইনগত বৈধতা নেই।
বহ্নিশিখা স্থির করলো, সে এবার আইনি পথেই এগোবে। সে মাস্টারমশাইয়ের কথা মতো গ্রামের জেলা শহরে গিয়ে আইনজীবীর সাথে দেখা করার পরিকল্পনা করলো। পথটা দুর্গম, ব্যয়সাপেক্ষ এবং বিপজ্জনক। কিন্তু বহ্নিশিখা জানে, এই ত্রিশূল সে এক হাতে নিয়েছে, তাই এই লড়াই তাকে শেষ পর্যন্ত লড়তেই হবে। তার চোখে এখন ভবিষ্যতের এক নতুন স্বপ্ন, যেখানে সুন্দরপুর গ্রামের আকাশে আর কোনো কালো মেঘ থাকবে না, থাকবে শুধু ন্যায় আর শান্তির স্নিগ্ধ আলো। রাঙাবধূ এখন আর শুধু বধু নয়, সে এক অদম্য যোদ্ধা, যার হাতে ধরা ত্রিশূল।
