STORYMIRROR

Laxman Bhandary

Others

4  

Laxman Bhandary

Others

ভূত চতুর্দশীতে ভূতেদের গল্প (প্রথম অধ্যায়) কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভূত চতুর্দশীতে ভূতেদের গল্প (প্রথম অধ্যায়) কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

3 mins
7

ভূত চতুর্দশীতে ভূতেদের গল্প (প্রথম অধ্যায়)
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভূত চতুর্দশীর রাতে, ঘন অমাবস্যার অন্ধকারে, গ্রামের শেষ প্রান্তে, এক পরিত্যক্ত কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কুটিরের দেওয়ালগুলো ক্ষয়ে যাওয়া, ছাদ প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। চারদিকে এক গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক আর দূরে কোথাও কুকুরের কান্নার আওয়াজ এই নীরবতা ভাঙছে।

আমার নাম লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী। পেশায় আমি একজন কবি ও লেখক। কবিতা লেখার মাঝেও রহস্য, রোমাঞ্চ আর অলৌকিক কাহিনীর প্রতি আমার এক অদম্য আকর্ষণ। তাই প্রতি বছর ভূত চতুর্দশীর রাতে আমি এইরকম কোনো পরিত্যক্ত বা অভিশপ্ত জায়গায় যাই, সেখানকার পরিবেশ অনুভব করতে এবং লোকমুখে প্রচলিত ভূতের গল্পগুলো সংগ্রহ করতে।

আজ আমি এসেছি এই কুটিরের গল্প শুনতে। গ্রামের লোকেরা বলে, বহু বছর আগে এই কুটিরে এক দরিদ্র পরিবার বাস করত। তাদের একমাত্র মেয়েকে গ্রামেরই এক বিত্তশালী যুবক ভালোবাসত। কিন্তু মেয়েটির বাবা-মা তাদের এই সম্পর্কে অসম্মতি জানায়। এক রাতে, সেই যুবক আর মেয়েটির মধ্যে তীব্র ঝগড়া হয়। গ্রামের লোকেরা বলে, সেই রাতেই মেয়েটির মৃত্যু হয়। কেউ বলে, সে আত্মহত্যা করেছিল, আবার কেউ বলে, তাকে খুন করা হয়েছিল। তারপর থেকেই নাকি রাত হলেই এই কুটির থেকে ভেসে আসে এক নারীর কান্নার আওয়াজ।

আমি সাবধানে কুটিরের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজাটা পুরানো, ভাঙা। সামান্য ধাক্কাতেই খুলে গেল। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। স্যাঁতসেঁতে মাংস আর ধুলোর এক বিশ্রী গন্ধ নাকে এসে লাগল। হারিকেনটা জ্বালিয়ে নিলাম। হারিকেনের আলোয় চারপাশটা দেখতে লাগলাম।

কুটিরের ভেতরটাও বাইরে থেকে যেমন দেখাচ্ছিল, তেমনই করুন। আসবাবপত্র সব জরাজীর্ণ। দেওয়ালে শেওলা জমেছে। এক কোণে একটা ভাঙা চৌকি, আর তার ওপর একটা ছেঁড়া চট। মনে হলো, এখানে কেউ বহু বছর ধরে বাস করে না।

আমি হারিকেন হাতে নিয়ে কুটিরের চারিদিকে ঘুরতে লাগলাম। প্রতিটা কোণে, প্রতিটা ধুলোর স্তুপে যেন লুকিয়ে আছে কোনো অজানা রহস্য। হঠাৎ, আমার হাত ধরে একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভূত হলো। আমি চমকে হারিকেনটা সরিয়ে নিলাম। কিন্তু সেখানে কেউ নেই! শুধু এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা বাতাস। আমার গা ছমছম করে উঠল।

ভেবেছিলাম, হয়তো মনের ভুল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই, আমি একটা ক্ষীণ কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ঠিক যেন পাশের ঘর থেকে আসছে। আমি হারিকেন নিয়ে সেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঘরটা ছিল আরও অন্ধকার। সেখানে একটা পুরনো আলমারি। মনে হচ্ছে, কান্নার আওয়াজটা সেই আলমারি থেকেই আসছে।

আমার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে লাগল। আমি আলমারির দিকে এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে, সাহস সঞ্চয় করে আলমারির দরজাটা খুললাম।

আর সাথে সাথেই, আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক মূর্তিমতী আতঙ্ক!

আলমারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক নারীর ছায়ামূর্তি। তার মুখটা অস্পষ্ট, চুলগুলো এলোমেলো, পরনে সাদা শাড়ি। তার চোখ থেকে কেবলই ঝরে পড়ছে অসীম বেদনা আর হতাশা। সেই কান্নার আওয়াজটা আরও তীব্র হয়ে উঠল। মনে হলো, সে যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।

আমি ভয়ে জমে গেলাম। হারিকেনটা হাত থেকে পড়ে গেল, নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে, কেবল সেই ছায়ামূর্তির চোখের আলো আমাকে দেখতে লাগল। আমার মনে হলো, সে আমার কাছে কিছু চাইছে। তার সেই আর্তনাদ, সেই নীরব কান্না – আমার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দিচ্ছিল।

কতক্ষণ আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, জানি না। তারপর, ধীরে ধীরে, সেই ছায়ামূর্তিটা মিলিয়ে যেতে লাগল। কান্নার আওয়াজটাও কমে এলো, মিলিয়ে গেল রাতের বাতাসে।

অন্ধকারে বসে আমি হাঁপাতে লাগলাম। আমার শরীর কাঁপছিল। বুঝলাম, গ্রামের লোকেরা এই কুটির নিয়ে যা বলে, তা মিথ্যে নয়। এই কুটিরে সত্যিই এক অতৃপ্ত আত্মার বাস।

সেই রাতে, আমি আর কোনো শব্দ করিনি। কেবল অন্ধকারে বসে সেই অতৃপ্ত আত্মার বেদনা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম। ভূত চতুর্দশীর রাতের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমাকে আজও তাড়া করে ফেরে। আজ পর্যন্ত, আমি যা কিছু লিখেছি, তার মধ্যে এই রাতের স্মৃতিই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি বাস্তব আর রোমাঞ্চকর।

ভূত চতুর্দলীর ভূতের গল্প শুধু গল্প নয়, তা এক গভীর বেদনার প্রতিচ্ছবি, যা হয়তো চিরকালের জন্য এই পরিত্যক্ত কুটিরের দেওয়ালে আটকে আছে।


Rate this content
Log in