রাঙাবধূ ধরেছে তরবারি (সামাজিক উপন্যাস) রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
রাঙাবধূ ধরেছে তরবারি (সামাজিক উপন্যাস) রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
রাঙাবধূ ধরেছে তরবারি (সামাজিক উপন্যাস)
রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
প্রথম পরিচ্ছেদ
শান্তিপুর গ্রামের শান্ত পরিবেশেই মাধবীর জন্ম। নামের মতোই সে শান্ত, সুশীল, লাবণ্যময়ী। বড় বড় হরিণচোখে স্বপ্ন আর লজ্জা মিশে একাকার হয়ে থাকে। বাবা রাজেনবাবু গ্রামের নামী শিক্ষক, মা গৃহিণী। অভাবের সংসারে মেধা আর নীতিই তাদের একমাত্র অলংকার। মাধবী সবে বি.এ. পাশ করেছে। তার বিয়ের বয়স হয়েছে, কিন্তু সাধ্যের বাইরে গিয়ে কোনো সম্পর্ক খুঁজতে রাজি ছিলেন না রাজেনবাবু। মাধবীও জানত, তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের স্বপ্ন দেখাটা একটু সাবধানেই করতে হয়।
তবু স্বপ্ন সে দেখত, এক শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের, যেখানে স্বামী হবে বন্ধুর মতো, শ্বশুরবাড়ি হবে নিজের বাড়ির মতোই আশ্রয়। তার এই স্বপ্নই যেন একদিন অলৌকিকভাবে বাস্তব হতে চেয়েছিল। একদিন এক ঘটক মারফত খবর এল, পাশের বর্ধিষ্ণু শহর কৃষ্ণগঞ্জের স্বনামধন্য চৌধুরী পরিবার থেকে নাকি মাধবীর জন্য প্রস্তাব এসেছে। চৌধুরীরা বংশানুক্রমিকভাবে জমিদার না হলেও, তাদের অঢেল সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য আর সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল অসীম। বিশেষ করে দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী, বিজয়ের বাবা, তাঁর একাধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো।
রাজেনবাবু প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি। "আমাদের মতো সামান্য ঘরের মেয়ের জন্য অত বড় বাড়ির ছে’লে?" তাঁর কণ্ঠে ছিল বিস্ময় আর সংশয়। কিন্তু ঘটক নিশ্চিত করল, বিজয়ের মা নাকি মাধবীকে এক অনুষ্ঠানে দেখে পছন্দ করেছেন। তাদের নাকি ছিমছাম, শিক্ষিত, সুশীল মেয়েই পছন্দ। মাধবীর বুক ধুকপুক করে উঠল। এ কি তার কল্পনারই প্রতিচ্ছবি? নাকি কোনো অজানা সুতোর ইশারা?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
চৌধুরী পরিবারে মাধবীর বিয়ে সত্যিই হয়ে গেল। এলাহি আয়োজন, চোখ ধাঁধানো জাঁকজমক। গ্রামের মেয়ে মাধবী যেন মেঘে ঢাকা চাঁদ, আজ পূর্ণিমার রূপে উজ্জ্বল। সারা গ্রামের মানুষ অবাক নয়নে দেখল, শান্তিপুরের রাজেন মাস্টারের মেয়ে আজ কৃষ্ণগঞ্জের চৌধুরীদের বড় বউ। সিঁথিতে সিঁদুর, পরনে টুকটুকে বেনারসি, হাতে শাঁখা-পলা, কপালে চন্দনের টিপ – সে যেন সত্যিই এক "রাঙাবধূ"।
বিয়ের পরদিন সকাল থেকেই শুরু হলো নতুন জীবনের মানিয়ে নেওয়ার পালা। চৌধুরী বাড়ির বিশাল অট্টালিকার প্রতিটি দেওয়াল যেন নীরব সাক্ষী। বিজয়ের ঘর, তার পড়ার টেবিল, বইয়ের তাকে সাজানো পুরোনো দিনের উপন্যাস – সবকিছুর মধ্যেই মাধবী খুঁজে পেল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিজয়ের মুখ দেখেই বোঝা যায়, সেও মাধবীর মতোই শান্ত প্রকৃতির। প্রথম কয়টা দিন স্বপ্নের ঘোর কাটতে চায় না। মাধবী মনে মনে ভাবে, তার জীবনের সব চাওয়া যেন পরিপূর্ণ হতে চলেছে।
শ্বশুর দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী যদিও বেশ রাশভারী প্রকৃতির, কিন্তু মাধবীর সাথে তিনি মিষ্টি কথা বলতেন। শাশুড়ি প্রভাবতী দেবীও প্রথমদিকে স্নেহ করতেন। বিশাল বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকাদেরও মাধবী আপন করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম শীতলতা মাধবী অনুভব করছিল। হাসি-ঠাট্টার মাঝেও একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল, যা ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করা কঠিন। মাধবীর সরল মন প্রথমে সেটাকে নতুন পরিবেশের জড়তা ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
কয়েকটা দিন কাটতে না কাটতেই মাধবী বুঝতে পারল, চৌধুরী বাড়ির আভিজাত্যের আড়ালে চাপা পড়ে আছে এক অন্য জগত। বিজয়ের সাথে তার সম্পর্কটা ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে বটে, কিন্তু বিজয়ের চোখেমুখে সবসময়ই একটা চাপা উদ্বেগের ছাপ। সে যেন কোনো অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা। মাধবী কিছু জিজ্ঞাসা করলেই প্রসঙ্গ পাল্টে দেয়, নয়তো ম্লান হেসে চুপ করে যায়।
শ্বশুর দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীর দোর্দণ্ড প্রতাপ বাড়ির প্রতিটি কোণায় টের পাওয়া যায়। তাঁর প্রতিটি কথায় অমোঘ আদেশ, প্রতিটি পদক্ষেপে অটল আত্মবিশ্বাস। শাশুড়ি প্রভাবতী দেবীও তাঁর স্বামীর ইচ্ছার বাইরে কিছু বলেন না বা করেন না। মাধবী লক্ষ্য করে, বাড়ির পরিচারকেরা তাঁর সামনে সব সময় এক ভীত সন্ত্রস্ত পরিবেশে থাকে। ছোট কোনো ভুল হলেই কঠিন তিরস্কারের শিকার হতে হয়।
মাধবী গ্রামের শান্ত পরিবেশে বড় হয়েছে। সেখানে মানুষের মধ্যে এত দূরত্ব বা ভীতি সে দেখেনি। ক্রমশ তার মনে হতে থাকে, এই বিশাল বাড়িটা যেন একটা সোনালী খাঁচা, যেখানে সবাই এক অদৃশ্য শিকলে বাঁধা। মাধবী নিজে নতুন বউ, তার উপর এখনও তেমন কোনো বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি। কিন্তু সে অনুভব করে, এই বাড়ির বাতাসে একটা চাপা ভয়ের গন্ধ রয়েছে, যা তার রাঙাবধূর স্বপ্নকে ধীরে ধীরে ফিকে করে দিচ্ছে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
একদিন দুপুরে মাধবী বাড়ির পেছনের বাগানে হাঁটছিল। দুপুরবেলায় সাধারণত সবাই বিশ্রামরত থাকে। মাধবী একাকী ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত। সে দেখল, বাগানের এক কোণে, পুরোনো একটি কুয়োর ধারে, একজন বৃদ্ধ মালী কাজ করছে। তার মুখটা কেমন যেন বেদনাময়। মাধবী তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "দাদু, কী করছো এখানে?"
মালী মুখ তুলে তাকাল। তার চোখে জল চিকচিক করছে। "মা ছোট মা, কী আর করব? এই বাগানের মাটিই তো আমাদের প্রাণ। এখন সেই মাটিও বোধহয় থাকবে না।"
মাধবী অবাক হয়ে গেল। "কেন দাদু, কী হয়েছে?"
মালী প্রথমে ইতস্তত করল, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "ছোট মা, আমাদের এই চৌধুরী বাড়ির মালিকের নামে অনেক সম্পত্তি। কিন্তু সেসবের বেশিরভাগই তো গরীব চাষীদের থেকে জোর করে নেওয়া। এই যেমন বাগানের পাশেই যে ধানের জমিটা দেখছো, ওটা একসময় ছিল হরিপদ মণ্ডলের। তার বাপ-ঠাকুরদার জমি। কিন্তু ছোটসাহেব সে জমি কেড়ে নিলেন, হরিপদ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে বেদম মারধর করা হলো। শেষমেশ সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল।"
মাধবী স্তব্ধ হয়ে শুনল। তার মনে হলো, এক বিষাক্ত সাপের শীতল ছোঁয়া তার মন ছুঁয়ে গেল। সে এতদিন যে বাড়ির সুখের স্বপ্ন দেখেছিল, তার ভিত্তিই তবে এমন পঙ্কিল? মালী আরও অনেক কথা বলতে শুরু করল, চৌধুরীদের অত্যাচার, গরীবদের উপর তাদের শোষণ, প্রভাব খাটানো – সব। মাধবীর কান গরম হয়ে উঠল। তার স্বপ্নের প্রাসাদের চূড়ায় যেন চিড় ধরল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
মালীর মুখে শোনা সেই ঘটনা মাধবীর মনকে বিষিয়ে তুলল। সে আর স্থির থাকতে পারল না। রাতে বিজয়ের ঘরে ঢুকতেই মাধবী দেখল বিজয় জানালার ধারে চুপচাপ বসে আছে। তার মুখ ভার।
"কী হয়েছে তোমার?" মাধবী জিজ্ঞাসা করল।
বিজয় চমকে উঠল। "কিছু না। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।"
মাধবী আর চুপ থাকতে পারল না। "শোনো, আজ মালীর সাথে আমার কথা হয়েছে। হরিপদ মণ্ডলের জমি... এসব কি সত্যি?"
বিজয় যেন এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মুখটা সাদা হয়ে গেছে। "কার কথা বলছ? ওসব বাজে কথা। মালীদের কথা শুনো না তুমি। তুমি নতুন বউ, এসব বিষয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।" তার কণ্ঠে ছিল চাপা আতঙ্ক আর বিরক্তি।
"কিন্তু কেন? যদি অন্যায় হয়, তবে তো সে সম্পর্কে কথা বলতেই হবে।" মাধবী দৃঢ়ভাবে বলল।
বিজয় এবার প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, "মাধবী, তুমি কিছুই জানো না। বাবা যা করেন, বাড়ির ভালোর জন্যই করেন। তুমি এ বাড়িতে নতুন এসেছো, ধীরে ধীরে সব বুঝবে। প্লিজ, এসব ব্যাপার নিয়ে আর কথা বলো না। বাবার কানে গেলে সমস্যা হবে।"
বিজয়ের ভীরুতা মাধবীকে অবাক করল। সে যেন তার পরিচিত বিজয় নয়, এক ভীতু, অসহায় যুবক। মাধবী বুঝতে পারল, এই বাড়ির দেয়ালের আড়ালে শুধু সম্পত্তি নয়, আরও অনেক কিছুর উপর দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীর প্রভাব রয়েছে – এমনকি তার নিজের ছেলের উপরও। মাধবীর মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বিজয়ের সাথে সেদিনকার কথোপকথনের পর মাধবী অনুভব করল, সে একা। এই বাড়ির ভিতরের মানুষগুলো প্রত্যেকেই দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীর ইচ্ছার কাছে বলিপ্রদত্ত। শাশুড়ি প্রভাবতী দেবীও যেন এক জীবন্ত পুতুল, স্বামীর অঙ্গুলি হেলনে ওঠাবসা করেন। মাধবী চেষ্টা করল তার সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু তিনিও বিজয়ের মতোই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন, নয়তো চোখ রাঙিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।
"নতুন বউ হয়েছ, সংসার সামলাও। বাইরের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিও না", শাশুড়ির এই কথাগুলো মাধবীর কানে বিঁধেছিল। মাধবী বাইরে থেকে শান্ত থাকলেও তার মনের মধ্যে ঝড় বইছিল। সে আর চুপ করে থাকতে পারল না। রাতের বেলা বিজয় ঘুমিয়ে পড়ার পর সে উঠে পড়ল। তার চোখ পড়ল বিজয়ের পড়ার টেবিলে, যেখানে কিছু পুরোনো বই এবং কাগজপত্র স্তূপ করে রাখা।
কৌতূহলবশত মাধবী একটা পুরোনো খাতা টেনে বের করল। দেখে মনে হল, এটা একটা পুরোনো লেনদেনের খাতা। পাতা উল্টাতেই তার চোখ আটকে গেল। তাতে অনেক গরীব মানুষের নাম আর তাদের কাছ থেকে নেওয়া জমির হিসাব লেখা রয়েছে। সেগুলোতে কোনো আইনি কাগজপত্র দেখানো নেই, শুধু জোর করে নেওয়া বা কম দামে কিনে নেওয়ার বিবরণ। কিছু জায়গায় মারধরের কথাও লেখা আছে। মাধবীর হাত কাঁপতে শুরু করল। এ তো শুধু হরিপদ মণ্ডলের ঘটনা নয়, এ এক বিশাল জাল!
সপ্তম পরিচ্ছেদ
পরের কয়েকটি দিন মাধবীর কাটল এক গভীর মানসিক দ্বন্দ্বে। সে দিনের বেলা সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও, রাতের অন্ধকারে বিজয়ের পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে খুঁজে বের করতে লাগল আরও তথ্য। তার মনে প্রশ্ন জাগল, বিজয় কি এই সব জানত? জেনেও কেন সে নীরব? কেন তার বাবা এত নিষ্ঠুর?
এই সময়েই একদিন খবর এল, শান্তিপুর গ্রামের এক পুরোনো প্রতিবেশী, সুরেশ হালদারের বাড়িতে দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীর লোকজন চড়াও হয়েছে। সুরেশ হালদার একজন গরিব চাষী, তার ছোট একটি ধানের জমি ছিল, যা দিয়ে কষ্টে সৃষ্টে সংসার চলত। চৌধুরীরা জোর করে তার জমিটা কেড়ে নিতে চাইছে একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নামে। গ্রামের মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও, চৌধুরীদের টাকার জোর আর প্রভাবের কাছে তারা অসহায়।
মাধবীর বুক মুচড়ে উঠল। সুরেশ হালদারের মেয়ে রেবা মাধবীর ছোটবেলার সখী। তাদের বাড়িতে কতবার মাধবী মায়ের কোলে বসে রেবার সাথে খেলা করেছে। তাদের জমি কেড়ে নিলে রেবাদের আর কিছুই থাকবে না। মাধবীর মনে হলো, এই অন্যায় তার নিজের পরিবারের ওপর অন্যায়ের মতোই। রাঙাবধূর অন্তরে যেন এক অজানা আগুন জ্বলে উঠল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
সুরেশ হালদারের বাড়ির খবর মাধবীর মনকে তীব্রভাবে আঘাত করল। সে আর চুপ থাকতে পারল না। ভরদুপুরে দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী যখন তার অফিস ঘরে বসে দলিলপত্র দেখছিলেন, মাধবী সরাসরি সেখানে গিয়ে হাজির হলো।
"বাবা, একটা কথা ছিল," মাধবী ইতস্তত করে বলল।
দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী চোখ তুলে তাকালেন। "কী কথা?"
"শান্তিপুরের সুরেশ হালদার... তার জমিটা আপনারা কেন কেড়ে নিচ্ছেন? তারা তো খুব গরিব মানুষ।" মাধবীর কণ্ঠে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক চাপা প্রতিবাদ।
দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন। "এটা বাড়ির ভিতরের ব্যাপার নয়, বাইরের ব্যাপার। তুমি নতুন বউ, এসব বিষয়ে তোমার নাক গলানোর দরকার নেই। আর তাছাড়া, ওসব জমি ওদের থাকতে পারে না। ওগুলো আমাদের বংশের সম্পত্তি, ওরা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছিল।" তার কণ্ঠে ছিল চূড়ান্ত দৃঢ়তা।
"কিন্তু গ্রামবাসী তো অন্য কথা বলছে! আর ওরা তো বহু প্রজন্ম ধরে ওই জমিতেই চাষ করছে!" মাধবী মিনতি করল, "দয়া করে ওদের জমিটা ফিরিয়ে দিন বাবা। ওদের আর কিছু রইবে না।"
দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী এবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন। "মাধবী, তুমি বড্ড ছেলেমানুষ। ব্যবসা আর সমাজের দস্তুর বোঝো না। জমি ফিরিয়ে দিলে আমরা কি আর চৌধুরী পরিবার থাকব নাকি? যাও তুমি, নিজেদের কাজে মন দাও।" তার কথায় ছিল বিদ্রূপ আর উপেক্ষা। মাধবী অসহায় দৃষ্টিতে দেখল, তার শ্বশুরমশাই একজন হৃদয়হীন মানুষ, যার কাছে টাকা আর প্রভাবই সব।
নবম পরিচ্ছেদ
দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীর কঠিন কথা মাধবীকে আরও হতাশাগ্রস্ত করল। সে বুঝতে পারল, অনুরোধ বা মিনতি করে লাভ নেই। এই মানুষটির মনে কোনো দয়া নেই। বিকেলবেলা বিজয় বাড়ি ফিরলে মাধবী তাকে সব কথা খুলে বলল।
"বিজয়, তুমি কিছু একটা করো। সুরেশ জ্যেঠুর জমিটা বাঁচাও। তোমার বাবা শুনছেন না কিছুতেই।" মাধবীর চোখে ছিল জল।
বিজয় মুখ নিচু করে বসে রইল। তার চোখেও ছিল অসহায়তা। "আমি কী করব বলো? বাবা যখন কিছু সিদ্ধান্ত নেন, তখন আর কারো কথা শোনেন না। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। বরং বকাবকি শুনতে হয়েছে।"
"তোমার বাবা তোমার কথাও শুনবেন না? তুমি তো তার ছেলে!" মাধবী অবাক হলো।
বিজয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "মাধবী, তুমি এখনো বাবাকে চেনো না। তিনি যা চান, তা যেকোনো মূল্যে আদায় করেন। তার কথার বিরুদ্ধে গেলে কী হয়, তা আমাদের পরিবারের অনেককেই ভুগতে হয়েছে। আমাকেও অনেকবার শাসিয়েছেন।" বিজয়ের কণ্ঠে ছিল গভীর ভয় আর হতাশা। "বাবা যা করেন, তা শুধু তার নিজের সুবিধার জন্যই।"
বিজয় আরও বলতে শুরু করল, কিভাবে তার বাবা বহু বছর ধরে গরীবদের শোষণ করে আসছেন, কিভাবে তার অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বিশাল সাম্রাজ্যের আকার ধারণ করেছে। কীভাবে তার দাদু, বিজয়ের ঠাকুরদা, সত্যবাদী মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দুর্গাপ্রসাদ সব পাল্টে দিয়েছেন। বিজয়ের কথা শুনে মাধবীর মাথার মধ্যে সব ঘটনা যেন স্পষ্ট হতে লাগল। সে দেখল, এই বাড়ির প্রতিটি ইট, প্রতিটি পাথরের ভাঁজে লুকিয়ে আছে কত হাহাকার আর কত অসহায় মানুষের চোখের জল।
দশম পরিচ্ছেদ
বিজয়ের স্বীকারোক্তি মাধবীর হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিল। সে কেবল জানতে পারল না, বরং দেখল, তার স্বামীও এই অন্যায় সাম্রাজ্যের এক নিরব শিকার। বিজয়ের চোখেমুখে যে ভয় আর অসহায়তা ছিল, তা মাধবীকে ভাবিয়ে তুলল। সে তার স্বামীর প্রতি সহানুভূতি অনুভব করল, কিন্তু তার অক্ষমতা মাধবীকে আরও বেশি বিচলিত করল।
মাধবী সারা রাত ঘুমোতে পারল না। তার মনের মধ্যে এক তীব্র আলোড়ন চলছিল। সে যখন শান্তিপুরের মাধবী ছিল, তখন তার জীবনের স্বপ্ন ছিল ভিন্ন। আজ সে চৌধুরীদের রাঙাবধূ, কিন্তু তার হাতে শাঁখা-পলার সাথে যেন এক অদৃশ্য শিকলও পরানো হয়েছে। এই সোনার খাঁচায় বসে সে কি কেবলই নিজের চোখের সামনে অন্যায় হতে দেখবে? তার ছোটবেলার সখী রেবার পরিবারের সর্বনাশ কি সে কেবলই নীরব দর্শক হয়ে দেখবে?
মনের গভীরে এক দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিতে শুরু করল। মাধবী বুঝতে পারল, এই লড়াইটা আর কেবল সুরেশ হালদার বা হরিপদ মণ্ডলের নয়, এটা তার নিজের আত্মসম্মান আর নীতির লড়াই। তার গ্রামের মানুষের প্রতিনিধি হয়ে সে এই পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু কীভাবে? কোথায় সেই শক্তি?
একাদশ পরিচ্ছেদ
পরের দিন সকালে মাধবী এক অন্য মাধবী। তার চোখে আর ভয় বা হতাশার চিহ্ন নেই। বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে। সে প্রথমেই তার নিজের বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য আবদার করল। দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী প্রথমে রাজি না হলেও, বিজয়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন।
শান্তিপুর গ্রামে ফিরে মাধবী তার বাবা-মা এবং রেবার সাথে দেখা করল। রেবার চোখ ফোলা, তাদের জমি কেড়ে নেওয়ার খবরে তারা দিশাহারা। মাধবী তাদের আশ্বাস দিল, "আমি তোমাদের পাশে আছি রেবা। যা হয় হোক, তোমরা একা নও।" মাধবীর বাবা রাজেনবাবু সব শুনে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি জানতেন তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি খুব প্রভাবশালী, কিন্তু এই অন্ধকার দিকটা তিনি জানতেন না।
মাধবী তার বাবাকে সব খুলে বলল, বিজয়ের দুর্বলতা, দুর্গাপ্রসাদের নিষ্ঠুরতা, এবং তার নিজের সংকল্পের কথা। রাজেনবাবু প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু মেয়ের চোখে যে দৃঢ়তা দেখেছিলেন, তা দেখে যেন তার শিক্ষক সত্তা নতুন করে জেগে উঠল। তিনি মাধবীকে সমর্থন জানালেন। "যা করবি ভেবেচিন্তে করিস মা। কিন্তু অন্যায় মেনে নেওয়াটা কোনো বীরত্ব নয়।" এই কথাগুলো মাধবীকে আরও শক্তি জোগাল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
চৌধুরী বাড়িতে ফিরে মাধবী যেন নতুন শক্তি লাভ করল। সে আর চুপচাপ নেই। সে বাড়ির পুরোনো পরিচারকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল, যারা দীর্ঘকাল ধরে এই বাড়িতে কাজ করছে। তাদের মুখ থেকে সে আরও অনেক পুরোনো দিনের ঘটনা জানতে পারল, যা দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীর অন্যায়ের জালকে আরও বিস্তৃত করল। অনেক গরীব পরিবার কীভাবে তাদের জমিজমা, ভিটেমাটি হারিয়েছে, সেসব কথা।
মাধবী এবার শুধু বিজয়ের খাতা নয়, আরও পুরোনো কিছু নথি খুঁজতে শুরু করল। বাড়ির লাইব্রেরিতে পুরোনো বইয়ের স্তূপে সে খুঁজে পেল কিছু তারিখ বিহীন দলিল, কিছু ফাঁকা স্ট্যাম্প পেপার যেখানে শুধু স্বাক্ষর বসানো। বোঝা গেল, দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীর প্রতারণার জাল কত গভীরে বিস্তৃত। এইসব প্রমাণ তার হাতের মুঠোয় আসতে শুরু করল।
মাধবী প্রতিটি মানুষের গল্প শুনল, তাদের চোখের জল দেখল। সে বুঝল, এই নীরব অত্যাচার বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। আর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে সাহস পায়নি, কারণ দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী এতটাই শক্তিশালী। এখন মাধবীকে তার এই শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, কিন্তু কীভাবে? তার রাঙাবধূর অবয়ব যেন ভাঙতে শুরু করেছে, তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক যুদ্ধংদেহী সত্তা।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
সুরেশ হালদারের বাড়ির সমস্যা এখন চরম পর্যায়ে। দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী তাদের উচ্ছেদ করার জন্য নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং তার গুন্ডাবাহিনী দিয়ে তাদের চাপ দিচ্ছে। গ্রামের মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে আছে। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না।
মাধবী এই খবর শুনে আর স্থির থাকতে পারল না। সে বিজয়ের কাছে গিয়ে আবার অনুরোধ করল, "বিজয়, তুমি তোমার বাবাকে বোঝাও। এটা চূড়ান্ত অন্যায় হচ্ছে। তোমার রক্তে কি একটুও ন্যায়বোধ নেই? তুমি কেন কিছু করছো না?"
বিজয় এবার মুখ তুলে তাকাল। তার চোখে জল। "আমি কী করব মাধবী? আমি বাবার বিরুদ্ধে গেলেই উনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করবেন। আমি তখন কোথায় যাব? তোমাকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াব?" তার কণ্ঠে ছিল চূড়ান্ত অসহায়তা।
মাধবী দেখল, বিজয়ের ভয় তার ভালোবাসার চেয়েও বেশি। তার স্বামীর এই কাপুরুষতা মাধবীকে হতাশ করল। মাধবী বুঝল, সে এই লড়াইয়ে একাই। তার স্বামী তার পাশে দাঁড়াবে না। এই মুহূর্তে মাধবীর মনে হলো, তার রাঙাবধূর আবরণ খসে পড়ছে, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক অপ্রতিরোধ্য সত্তা, যা অন্যায়কে আর মেনে নিতে রাজি নয়।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
চৌধুরী বাড়িতে আজ এক জরুরি পারিবারিক বৈঠক বসেছে। দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী, তার ভাইপো এবং তার আইনজীবী উপস্থিত। সুরেশ হালদারের জমি দখল প্রক্রিয়াকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্যই এই বৈঠক। মাধবী দূর থেকে তাদের কথা শুনছিল। সে বুঝতে পারল, আজই সুরেশ হালদারের শেষ দিন।
হঠাৎ করেই মাধবীর চোখ পড়ল বৈঠক ঘরের এক কোণে সাজানো একটি পুরোনো সিন্দুকের উপর। বংশের ঐতিহ্য হিসেবে ওটা রাখা আছে। মাধবী ছোটবেলায় তার ঠাকুরমার কাছে শুনেছিল, কোনো কোনো পরিবারে পুরোনো দিনের অস্ত্রশস্ত্র পরম যত্নে রাখা হয়। কৌতূহলবশত, মাধবী সিন্দুকটির কাছে গেল। সিন্দুকের ঢাকনা খুলতেই তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
ভেতরে একটি মরচে ধরা তরবারি, উজ্জ্বল লাল মখমলের আবরণে মোড়া। তার গায়ে খোদাই করা প্রাচীন নকশা। এই তরবারি যেন শতাব্দীর পুরোনো কোনো যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। মাধবী থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হলো, এই তরবারি শুধু একটি অস্ত্র নয়, এটি ন্যায় ও অন্যায়ের প্রতীক, এটি প্রতিবাদের ভাষা।
বাইরে তখন দুর্গাপ্রসাদের আইনজীবীর কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, "সব কাগজপত্র ঠিক আছে। সুরেশ হালদারকে কাল সকালেই উচ্ছেদ করা হবে।"
মাধবীর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। তার রাঙাবধূর পোশাকের নিচে যেন এক বিদ্রোহী নারী জেগে উঠল। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে, মাধবী তার কাঁপতে থাকা হাতে সিন্দুক থেকে সেই পুরোনো, ঝলমলে তরবারিটা তুলে নিল। তার পরনে লাল বেনারসি, কপালে সিঁদুর, মুখ রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত – কিন্তু হাতে তার জ্বলজ্বলে তরবারি। বৈঠক ঘরের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সেই রাঙাবধূ, যেন এক রণচণ্ডী। দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীর চোখে পড়ল সেই দৃশ্য, তিনি পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলেন। মাধবীর চোখে তখন প্রতিশোধের আগুন, সে যেন এক নতুন যুদ্ধের সূচনা করতে চলেছে।
