Sayandipa সায়নদীপা

Children Stories

1  

Sayandipa সায়নদীপা

Children Stories

তাতাই আর ভীম সিং

তাতাই আর ভীম সিং

10 mins
918


---- জানিস তাতাই আমার না ভীষণ ইচ্ছে করে ফড়িং হয়ে যেতে।


---- ফড়িং!!


----হ্যাঁ রে। ফড়িং হলে কি সুন্দর উড়তে পারতাম বলতো আকাশে, উড়তে উড়তে পৌঁছে যেতাম সূর্যের কাছে, কত আলো কত আশা আর শুধু ভালো থাকা সেখানে। নেই কোনো হতাশার অন্ধকার বিবাদ....


                   ★★★★★


জানালার দিকে তাকাতেই দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তাতাইয়ের চোখ দিয়ে। এখন গভীর রাত। পাশেই ঠাম্মি ঘুমোচ্ছেন অকাতরে। কিন্তু তাতাইয়ের চোখে ঘুম নেই। সে এক মনে তাকিয়ে আছে শিউলি গাছটার দিকে। বাইরে আজ একটুও বাতাস দিচ্ছেনা, তাই গাছটা দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। মনো মামা এখনও ফিরল না…! মনো মামা কি তবে সত্যিই ফড়িং হয়ে গেল। মনো মামা সম্পর্কে মায়ের খুড়তুতো ভাই, তবে মায়ের চেয়ে বয়েসে অনেক ছোটো। তার ভালো নাম মনোময়। মামা এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। খানিক খামখেয়ালি গোছের লোক সে। সারাদিন আপন মনে কিসব যেন ভাবতে থাকে, তখন এই দুনিয়ার কোনো কিছুর দিকেই তার হুঁশ থাকে না। মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলে সে, সবটুকু বুঝতে পারেনা তাতাই। তবুও মনো মামার পাশে বসে সেসব কথা শুনতে ভারী ভালো লাগে তার। মামা এমনিতে মেসে থেকে পড়াশুনো করেন কিন্তু হঠাৎ মেসে কি যেন এক সমস্যা হওয়ায় সে কদিন আগে এসে উঠেছিল তাতাইদের বাড়িতে। নিজের জন্য বেছে নিয়েছিল তিনতলার ওই চিলেকোঠার ঘরটা। মায়ের কোনো বারণই শোনেনি সে। কিন্তু আজ ইউনিভার্সিটি গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি মামা। রুমের ভেতর ব্যাগটা ছাড়া বই খাতা, এমনকি ফোনটাও পড়ে আছে। মামার মেস,বন্ধুবান্ধব সবাইকে ফোন করে দেখা গিয়েছে কোথাও নেই সে। 


                   ★★★★★


আজ স্কুলে এসেও মন মেজাজ একটুও ভালো লাগছে না তাতাইয়ের। মামা ফেরেনি আজও। কোথায় যে গেল মানুষটা…!


---- এই কাল কি হয়েছে জানিস? বলল তটিনী।


---- কি রে? জানতে চাইল রিম।


---- কাল আমার বাবার দোকান থেকে ভীম সিং এর ছেলে কিডন্যাপ হয়ে গেছে।


---- বলিস কি! কিডন্যাপের ব্যাপারটা জানতাম কিন্তু তোর বাবার দোকান থেকে!


---- হ্যাঁ রে, তবে আর বলছি কি। কাল বিকেলের দিকে তখন দোকানে খুব একটা ভীড় নেই, ভীম সিং এর ছেলে হঠাৎ স্কুল ড্রেস পরেই আমাদের দোকানে এলো। এসে একটা কমিক্স তুলে দেখছিল। কিন্তু আচমকা একটা কালো মুখোশধারী লোক এসে ছুরি দেখিয়ে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে গেল। 


---- ওরে বাবা! তোর বাবা লোকটার মুখ দেখতে পায়নি? জানতে চাইল দিঠি।


---- উম্ম বাবা বলছিল একবার নাকি লোকটার মুখ থেকে মুখোশটা আলগা হয়ে গিয়েছিল, তখন বাবা দেখেছে ওর মুখটা। স্পষ্ট না হলেও দেখেছে। একটা বাইশ তেইশ বছরের ছেলে ছিল আসলে।


---- সেকি! আচ্ছা ভীম সিং এর ছেলের সঙ্গে তো সবসময় বডি গার্ড থাকে। তার মধ্যে থেকে তাকে কিডন্যাপ করল কি করে? 


---- ওটাই তো রহস্য রে। কাল ছেলেটা একাই ছিল। আর ওর জন্য এখন আমাদের রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছে।


---- কেন কেন?


---- বাহ্ রে আমার বাবার দোকান থেকে কিডন্যাপ হল আর ভীম সিং আমাদের সহজে ছেড়ে দেবে। কাল তো ঘটনাটার একটু পরেই সে এসে হাজির, বাবার কলার ধরে শাসিয়ে গেছে। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে ছেলেকে খুঁজে না পেলে দেখে নেবে আমাদের।


---- এই তাতাই খবরটা জানতিস তুই? 

জিজ্ঞেস করল দিঠি। ঘাড় নেড়ে না বলল তাতাই। ভীম সিংকে তাতাই দেখেছে কয়েকবার, দশাসই চেহারার একটা লোক। সবসময় গাড়ি আর বডি গার্ড নিয়ে ঘোরে লোকটা। উনি ঠিক কি কাজ করেন তাতাই জানেনা, মানে বোঝেনা আর কি। তবে দেখেছে এ চত্বরের সবাই ডরায় লোকটাকে। লোকটার একমাত্র ছেলে নীলাদ্রি। তাতাইয়ের চেয়ে বয়েসে খানিক বড়। ভীম সিং তাকে সবসময় গৃহ বন্দি করে রাখে বললেই চলে; ছেলেটার বাইরে বেরোনো বলতে স্কুলে যাওয়া, সেখানেও বাড়ির গাড়িতে যায় আসে। আর এমনি কোনোকারণে বাইরে বেরোলে সবসময় সঙ্গে থাকে দুজন বডিগার্ড। কিছুদিন আগেই পয়লা বৈশাখে পাড়ার ক্লাবে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেই ভীম সিং এর সঙ্গে নীলাদ্রি এসেছিল। একটু সুযোগ পেতেই নীলাদ্রি কথা বলেছিল তাতাইয়ের সঙ্গে। সেটুকু স্বল্প সময়েই তাতাই বুঝেছিল ছেলেটার খুব দুঃখ। ওর বাবার অনেক টাকা কিন্তু ওর মনে শান্তি নেই। ছেলেটা মুক্তি চায় এই রুটিনে বাঁধা বন্দি জীবন থেকে, ছেলেটা রোজ ঠাকুরকে বলে তাকে পাখি করে দিতে। তাহলে সে ফুড়ুৎ করে জানলা গেলে পালিয়ে যাবে আকাশে।


   স্কুল থেকে ফেরার সময় তাতাই অবাক হয়ে দেখল ওদের গেটের সামনে ভীম সিং তার সাঙ্গপাঙ্গ সুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে হঠাৎ করে তটিনীর বাবাকেও দেখতে পেল তাতাই। তিনি হাত নেড়ে তাতাইদের বাড়ির দিকে কিসব ইশারা করে দেখাচ্ছেন। তাতাই তাড়াতাড়ি রিক্সা থেকে নেমে এগিয়ে গেল ওদের দিকে,

---- কি ব্যাপার কাকু?

তাতাইয়ের গলা পেয়ে ঘুরে তাকাল ভীম সিং। তারপর আচমকা ওর মোটামোটা আঙ্গুল দিয়ে তাতাইয়ের গালটা সজোরে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চিপে বলল,

---- কি ব্যাপার? তোর সেই দুষ্ট মামাটা কই?


---- আহা স্যার, ও তো বাচ্চা মেয়ে ও কি করে জানবে! ওকে ছেড়ে দিন…

মিনমিন করে বলল তটিনীর বাবা। তাকে ধমকে উঠল ভীম সিং,


---- তুমি চুপ করো, আমার কাজ আমাকে বুজে নিতে দাও।


এদিকে বাইরে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তাতাইয়ের মা,

---- কি ব্যাপার?


---- কি ব্যাপার জানেন না?

চিৎকার করে উঠল ভীম সিং, 

---- আপনাদের তো ভদ্রলোক বলেই জানতাম বৌদি। এইসব কাজকারবার কবের থেকে করছেন?


---- আপনি কি বলছেন সিং বাবু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা!!!


---- বুঝতে পারছেননা না?


---- নাহ


---- আপনার গুণধর ভাইটি কোথায়?


---- আমার ভাই?


---- হ্যাঁ যে কাল আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করেছে বিকেলবেলা।


---- কি যা তা বলছেন আপনি? আমার ভাই কিডন্যাপ করবে! আপনার কি মাথা খারাপ?


---- আমার মাথা খারাপ নয় বৌদি। এই যে এই লোকটা নিজে চোখে আপনার ভাইকে দেখেছে আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করার সময়। 

এই বলে ভীম সিং তটিনীর বাবার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো। অবাক হয়ে গেলেন মা,

---- আপনার মেয়ে তো আমার তাতাইয়ের সাথে পড়ে না? আপনি কেন এরকম করছেন আমাদের সাথে? মিথ্যে কেন বলছেন?


---- মিথ্যে বলে আমার কি লাভ বৌদি। কাল যে এনার ছেলেকে কিডন্যাপ করেছে তাকে আমি একদিন দেখেছিলাম আপনার মেয়েকে আনতে যেতে। ও বলেছিল এটা ওর মামা। কালকে পুরো ঘটনায় হতভম্ব হয়েছিলাম ঠিক মনে পড়েনি, তবে কিডন্যাপারের মুখটা খুব চেনা চেনা ঠেকেছিল। আজকে হঠাৎ সব মনে পড়ে গেল।


---- অসম্ভব এ হতে পারেনা। আমার ভাই একজন ভালো ছাত্র, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে সে। সে কেন শুধু শুধু এরকম কাজ করতে যাবে? আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।


---- ঠিক ভুলের বিচার নাহয় আপনার ভাইয়ের সঙ্গেই হবে। ডাকুন তাকে। 

গম্ভীর গলায় নির্দেশ দিল ভীম সিং।

মা একটা ঢোঁক গিলে বললেন,

---- মনো বাড়ি নেই এখন।


---- কোথায় গেছে বলুন, আমরা সেখানেই যাচ্ছি।


---- আ… আমি জানিনা।


---- আপনার থেকে আমি কিন্তু সহযোগিতা আশা করেছিলাম বৌদি। সেটাই যখন পেলাম না তখন…

এই বলে ভীম সিং কি যেন ইশারা করল তার লোকেদের। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো গেট পেরিয়ে মাকে ঠেলে হুড়মুড় করে ঢুকে গেল তাতাইদের বাড়ির ভেতর। ভেতরে ঠাম্মি পিচাইকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। এতগুলো লোককে ঢুকতে দেখে ঘাবড়ে গেল ঠাম্মি,

---- এই কে আপনারা? কি ব্যাপার?

আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল ঠাম্মি। লোকগুলো ঠাম্মিকে পাত্তা না দিয়ে ঘরে ঢুকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো মনো মামাকে। যত না খুঁজে পাচ্ছিল তত ঘরের জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করে দিচ্ছিল। এইভাবে প্রায় আধঘন্টা ধরে চারিদিকে খোঁজার পর লোকগুলো হাল ছেড়ে ভীম সিং কে গিয়ে বলল,

---- নেই ঘরে। 


---- থাকবে না যাবে কোথায়? ছোকরার মেস থেকে কোনো খবর এলো?


---- হুঁ। সেখানেও যায়নি অনেকদিন।


---- হুমম…

ভীম সিং আর কিছু বলার আগেই হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল পিচাই। ভীম সিংয়ের এবার নজর গেল ওর দিকে। চোখ ছোটো ছোটো করে সে খানিক্ষণ দেখল পিচাইকে, মুখে বিড়বিড় করল কিছু। তারপর আচমকা গলায় নির্দেশ দিলো, 

---- এই বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে চল।

মা আর ঠাম্মি আর্তনাদ করে উঠলেন,

---- নানানাআআআ…..


---- না নয় হ্যাঁ। এবার তো ছোঁড়াকে আসতেই হন আমার সামনে। ওকে বলবেন ও আমার কাছে ধরা দিলে তবে আপনার ছেলে ছাড়া পাবে।

এই বলে ভীম সিং জোর করে ঠাম্মির কোল থেকে পিচাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা লোকের হাতে দিয়ে দিল। চিৎকার করে উঠে ভীম সিংয়ের কাছে গিয়ে পিচাইকে ছাড়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন মা। কিন্তু ভীম সিং তাতে ভ্রূক্ষেপ না করে ওর লোকেদের নির্দেশ দিল ওখান থেকে বেরিয়ে যেতে। তাতাই এতক্ষণ চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল সব কিছু। এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল তার। সে দেখল পিচাই খুব জোরে জোরে হাত পা নেড়ে কাঁদছে বলে যে লোকটা ওকে কোলে নিয়েছে সে বাকিদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে খানিকটা। এই সুযোগটাই নিলো তাতাই। বিকেলের জলখাবার বানাবেন বলে টেবিলের ওপর মা বেলন চাকি রেখেছিলেন। বেলনটা তুলে নিয়ে তাতাই সজোরে সেটা মারল লোকটার মাথায়। যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠল লোকটা, তার হাত থেকে আলগা হয়ে গেল পিচাই। তাতাই পিচাইকে টেনে নিয়ে ছুটল সিঁড়ির দিকে। বাকি লোকগুলো অবাক হয়ে পেছন ফিরে দেখল আহত লোকটাকে, তারপর তারা পুরোটা বুঝতে বুঝতেই লুকিয়ে পড়ল তাতাই। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন ভীম সিং। তিনি চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন যে করে হোক তাতাইকে খুঁজে বের করতে। লুকিয়েছে তো সেই বাড়ির মধ্যেই। যাবে আর কোথায়!!!



     এদিকে তাতাই পিচাইয়ের মুখটা চেপে ধরে সোজা চলে এসেছে তিন তলার ঘরে। তারপর অনেক কসরৎ করে একহাতে এখানে ডিভানের সাইডের একটা পাল্লা খুলে ঢুকে পড়েছে সেখানে। এই ঘরের ডিভানটার ভেতর জিনিসপত্র থাকেনা বিশেষ, কাজেই জায়গা আছে যথেষ্ট। তাতাই জানে পিচাইয়ের এভাবে খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এ ছাড়া তো আর উপায় নেই। ডিভানের ভেতর তাতাইয়েরও ঘাড়ে ব্যাথা লাগছে খুব, তবুও পিচাইয়ের মুখ চেয়ে সহ্য করে যাচ্ছে সব ব্যাথা। পিচাই বেচারা হতভম্ব হয়ে গেছে পুরো ব্যাপারটায়, সে তো বুঝতেই পারছেনা কি ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে তার দিদিভাই। শ্বাস নেওয়ার জন্য ডিভানের পাল্লাটা একটু খুলে রেখেছিল তাতাই। আচমকা ঘরের দরজায় আওয়াজ হতেই তাতাই ঘাড় ঝুঁকিয়ে দেখলো দুটো মুশকো লোক এসে ঢুকে পড়েছে ঘরে। তাতাই পাল্লাটা যতটা সম্ভব টেনে দিল, যাতে বাইরে থেকে কেউ না বুঝতে পারে যে ওটা আসলে খোলা। সামান্য ফাঁক দিয়ে তাতাই দেখতে পাচ্ছে লোকদুটোকে। লোক দুটো তন্ন তন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে গোটা ঘর, ডিভানের ভেতর রুদ্ধশ্বাসে ওদের লক্ষ্য করে যাচ্ছে তাতাই। লোকদুটো যদি একবার টের পেয়ে যায় তাহলে আর রক্ষা নেই।


---- কি ব্যাপার বলতো জগা! বাচ্চাটা লুকাবে কোথায়? একটু আগেই তো সব ঘরগুলো আমরা দেখে গেছি। সেরকম তো…


---- আছে আছে কোথাও এমন একটা জায়গা নিশ্চয় আছে যেখানে লুকিয়েছে বিচ্ছু মেয়েটা। উফফ আমাদের হয়েছে যত জ্বালা…!


---- আচ্ছা জগা এমন হয়নি তো যে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো দরজা আছে ঘরে, যেটা দিয়ে বাচ্চাটা বেরিয়ে পালিয়েছে?


---- কথাটা মন্দ বলিসনি, তবে হরি বলছিল ও যখন যন্ত্রনায় ছটফট করছিল তখন মেয়েটাকে সিঁড়ির দিকেই আসতে দেখেছে।


---- ওই যন্ত্রণার মুখে হরির ভুলও তো হতে পারে।


---- তা পারে বটে… তাহলে কি একবার নীচে গিয়ে দেখবি সেরকম কোনো দরজা আছে কিনা?


---- আমায় তো মনে হচ্ছে তাই করা উচিৎ। নাহলে তুইই বল কোথায় যাবে মেয়েটা!


---- হুমম চল।


উফফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তাতাই, ঘরটা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। এভাবে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর, হয়তো আরও বেশ কিছুক্ষণ ওকে লুকিয়ে থাকতে হবে কিন্তু তাও পাল্লাটা ফাঁক করে একটু ভালো করে শ্বাসটা তো নেওয়া যাবে। 

---- আহহহ…

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আচমকা আওয়াজটা বেরিয়ে গেল তাতাইয়ের মুখ দিয়ে। পিচাই অনেকক্ষণ থেকে চুপচাপ দেখছিল সবকিছু, কোনো রকম প্রতিবাদ জানায়নি। কিন্তু দিদির তো তাকে এই অন্ধকার জায়গাটা থেকে বের করার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না, উল্টে আবার ওর মুখটা জোর করে টিপে রেখেছিল সে। তাই তো পিচাই ওর সদ্য বেরোনো দু'জোড়া দাঁত দিয়ে কুচ করে কামড়ে দিয়েছে দিদির আঙ্গুল। আর আকস্মিক যন্ত্রনায় তাতাইও সামলাতে পারেনি নিজেকে। শুধু যে মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে গেছে তা নয়, ডিভানের পাল্লাটাও সশব্দে গেছে খুলে। লোকদুটো চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ডিভানের দিকে চোখ যেতেই তাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। সাময়িক হতভম্ভ ভাবটা কাটিয়ে উঠেই জগা নামের লোকটা বলে উঠল, "তবে রে পাজি মেয়ে আমাদের নাস্তানাবুদ করে তুই এখানে লুকিয়ে আছিস! আজ আর তোর রক্ষা নেই। বস তোর কি করবেন সে শুধু বসই জানেন।"

এই বলে লোকদুটো একটু একটু করে এগিয়ে আসতে লাগলো তাতাইয়ের দিকে। চোখ ফেটে জল চলে এলো তাতাইয়ের। এতো কিছুর পরেও তবে শেষ রক্ষা হল না…!


   কিন্তু লোকটা হাত বাড়িয়ে তাতাইকে যেই ধরতে যাবে সেই সময় হুড়মুড় করে সিঁড়িতে কয়েকজনের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। লোকদুটোও আওয়াজ শুনে একটু থমকে গেল। আর তখনই দরজা দিয়ে যে ভেতরে ঢুকলো তাকে দেখে চমকে গেল তাতাই। আনন্দে সে চিৎকার করে উঠল, "মনো মামা…!"

মামার পেছন পেছন যে ঢুকলো তাকে দেখে আরও চমকে গেল তাতাই, নীলাদ্রি… নীলাদ্রির পেছন পেছন এক এক করে ঢুকলো ভীম সিং, মা, ঠাম্মি, আর অন্য লোকগুলো। এবার ডিভানের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো তাতাই। মা ধরে নিলো পিচাইকে। তাতাইকে ধরে নিলো ঠাম্মি। মনো মামা এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নীলাদ্রি ওদের সবাইকে একবার দেখে নিয়ে অপরাধীর মত মুখ করে বলল, 

---- আমাকে আপনারা প্লিজ ক্ষমা করে দিন। এই সবকিছু গন্ডগোল হয়েছে আমার জন্য। আমার বাড়িতে বন্দি থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ঠাম্মার জন্যও ইদানিং খুব মন খারাপ করছিল। এরই মাঝে ক্লাবের পার্টিতে আলাপ হয় মনোময় দাদার সঙ্গে। দাদাকে খুব ভালো লেগেছিল আমার। দাদার ফোন নাম্বারটাও নিয়েছিলাম সেদিন। দাদা বলেছিল আমার যখনই একলা লাগবে তখন যেন দাদাকে ফোন করি। সেই থেকে দাদার সাথে ফোনে কথা হত। এরই মাঝে একদিন দাদাকে আমার মনের ইচ্ছেটা বলে ফেলি, দাদা তখন প্রমিস করে আমাকে ঠাম্মার কাছে নিয়ে যাবে। সেই মতো কাল প্ল্যান করে ঘটেছিল সব কিছু। ইচ্ছে করে বাবাকে ভয় দেখানোর জন্য কিডন্যাপের নাটকটা করেছিলাম আমি। দাদা প্রথমে রাজি ছিলনা, পরে রাজি হয় আমার অনুরোধে। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি পরিস্থিতি এরকম হয়ে যাবে বলে। আয়াম সরি।


---- নীলের খুব একটা দোষ নেই। আইডিয়াটা তো আদপে আমার ছিল। আসলে… নিজেকে জাস্টিফাই করবো না। আমার উদ্দেশ্য ছিল নীলকে তার ঠাম্মার সাথে দেখা করানো, হয়ে গেছে সেটা। এবার আপনারা যা শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেব।


---- প্লিজ ড্যাডি, আমি অন্যায় করেছি। তুমি মনো দা'কে শাস্তি দিও না। প্লিজ ড্যাডি…

কথাগুলো বলতে বলতে নীলাদ্রি এগিয়ে গেল ওর বাবার দিকে। সবাই অবাক হয়ে দেখলো ভীম সিং এর মতো লোকেরও আজ ঠোঁট দুটো কাঁপছে, চোখদুটো টলটল করছে জলে…



                  ★★★★★


হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো…

হাঁচতে হাঁচতে চোখ দুটো খুলল তাতাই। কে যেন ওর নাকের কাছে সুড়সুড়ি দিচ্ছে পালক দিয়ে। ভালো চোখ মেলেই চমকে গেল সে, ---- মনো মামা…! আর আমি ঘুমোলাম কখন! এই তো জেগেছিলাম এক্ষুণি তো ভী…


---- এক্ষুণি তো কি? আমি তো বাড়ি ঢুকে থেকে দেখছি ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছিস।


---- তা কি করে হয়… মানে আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে কেমন। তুমি কোথায় গিয়েছিলে?


---- আমি? আমি প্রত্যেক পনেরো দিন অন্তর এই শহরের বাইরের একটা অনাথ আশ্রমে যাই। বাচ্চাগুলোর সাথে কাটাই একটা দিন, খুব মজা করি ওদের সাথে। নিজেকে তখন জানিস তো ঠিক ফড়িং এর মতো লাগে, আর বাচ্চাগুলোকে মনে হয় সূর্য।


---- কিন্তু…


---- সরি ডিয়ার। আমার বলে যাওয়া উচিত ছিল। ট্রেনে চেপে খেয়াল হয় মোবাইল ছেড়ে গিয়েছি। আর ওখানে পৌঁছেই খেলতে লেগে গিয়েছিলাম তাই ভুলেই গিয়েছিলাম ফোন করার কথা। জানিসই তো আমি একটু ভুলো মনের আছি।


   মামার কথা শুনে আর কি বলবে খুঁজে পেলোনা তাতাই। তার মানে এতক্ষণ ও স্বপ্ন দেখছিল! ওই ভয়ানক ঘটনাগুলো একটাও সত্যিই নয়… উফফ ভগবানকে অজস্র ধন্যবাদ। কিন্তু, সেই সঙ্গে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল তাতাইয়ের, নীলাদ্রি দাদাও যদি মামার মতো ফড়িং হওয়ার সুযোগ পেতো একদিন…!!!


Rate this content
Log in