সার সত্য
সার সত্য


"বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"
উদাত্ত কণ্ঠে আপন মনে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করছিলেন বিশ্বনাথ বাবু। এমন সময়েই কখন যেন ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর বছর পাঁচেকের ছোট্ট নাতি অর্ক। সে তার দাদুকে মাঝ পথে থামিয়েই শুধল - " দাদু, কি বলছ?"
বিশ্বনাথ বাবু হেসে বললেন - " আমি নয় গো দাদুভাই, কথাগুলো বলে গেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।"
- " কিন্তু এর মানে কি দাদু" ?
-"মানে হল দাদুভাই এই জগতে ছেলে আর মেয়ে দুজনে মিলেই সব কিছু বানিয়েছে, কেউ বড় নয়, কেউ ছোট নয়।"
-"সব?"
-"হ্যাঁ দাদুভাই, সব। "
-"এই যে চাঁদ, সূর্য, পৃথিবী, মানুষ, পাখি সব ?"
-"হ্যাঁরে, তুই যা যা দেখতে পাচ্ছিস আর যা যা চোখে দেখা যায় না, সবই দুজনে মিলে তৈরি করেছে। পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে যা যা হয়ে চলেছে, তাতে দুজনেরই সমান অবদান।তোকে একটা গল্প বলি শোন। আমি যখন তোর মতই ছোট ছিলাম তখন আমাকে গল্পটা বলেছিলেন আমার বুড়োদাদু।"
-"বুড়োদাদু কে?"
-"বুড়োদাদু ছিলেন আমার ঠাকুরদাদার বন্ধু। বাড়ি ছিল সেই পুরুলিয়ায়। "
-"যেখানে জয়চন্ডী পাহাড় আছে, আর ছৌ নাচ হয়?"
-"হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। সেখানেই বাঘমুন্ডিতে ছিল সেই দাদুর বাড়ি। দাদু সেখানেরই এক প্রাইমারি স্কুলে তোর মত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের পড়াতেন। আর মাঝে মাঝে মধ্যে আমাদের কলকাতার বাড়িতে এলে আমাদের সেই পুরুলিয়ার জঙ্গল পাহাড়ের অনেক গল্প বলতেন। এই গল্পটা তেমনই এক গল্প - পিলচু হারাম আর পিলছু বুড়ির গল্প।"
-"বলো বলো"
-"পুরুলিয়ায় অনেক আদিবাসী এবং সাঁওতাল জনজাতির বাস। সাঁওতালরা বিশ্বাস করেন সৃষ্টির আদিতে চারপাশে শুধুই জল আর জল ছিল। তার ফলে ভগবান তো পড়লেন ভারি মুশকিলে। শুধু জল থাকলে মানুষ থাকবে কোথায়? তাদের থাকার জন্য তো কিছু অন্তত মাটি দরকার। অনেক ভেবে শেষে তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন। প্রথমে তিনি সকল রকমের উভচর প্রাণীদের জন্ম দিলেন। উভচর কাকে বলে জানো তো তুমি?"
-"হ্যাঁ, পড়েছি তো। যারা স্থলে এবং জলে দুই জায়গাতেই থাকতে পারে।"
-"ঠিক বলেছ। তার পর তিনি সাত রকম প্রজাতির প্রাণী সৃষ্টি করলেন। এরা হল - কাঁকরা, কুমির, ঘড়িয়াল, কেঁচো , কচ্ছপ, বানমাছ আর গুটিপোকা। তারপর তিনি এই সকল প্রাণীর নিজ নিজ প্রধানকে ডাকলেন মাটি তৈরির ব্যপারে কি করা যায়, তা নিয়ে পরামর্শ করার জন্য। কেউই কিছু করতে পারলো না একজন ছাড়া। সেটা হল কেঁচো। সে সাতদিন সাত রাত্রি ধরে কচ্ছপের পিঠের ওপর মাটি জমা করলো। তাই সাঁওতালরা অনেকেই আজও বিশ্বাস করে সেই কচ্ছপ ব্যাটা বেশি নড়া চড়া করলেই ভূমিকম্প হয়। "
-"আর মানুষের কি হল।"
-"তাদের কথাই বলবো এবার। সেই প্রথম দিকে যখন গোটা পৃথিবী জুড়ে শুধু জল ছিল সেই সময় ভগবান তার মাথার চুল থেকে জন্ম দেন একটা হাঁস আর একটা হাঁসলি। সেই দুজনে দুটি ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে ছেলে আর একটি ফুটফুটে মেয়ে। ছেলেটির নাম ছিল পিলচু হারাম আর মেয়েটির নাম ছিল পিলচু বুড়হি। তাদের সাতটি ছেলে আর সাতটি মেয়ে ছিল। এরা আবার নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে। এদের সন্তান সন্ততিদের হাত ধরে ধীরে ধীরে বংশপরম্পরায় মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই হল গে গপ্পো। সুতরাং বুঝলে তো দাদুভাই ভগবান কিন্তু দুজনকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করেছিল। সে তোমাদের স্কুলের বইতে পড়া অ্যাডাম আর ইভের কথাই বল আর এই মাটির গন্ধ মাখা লোককথাই বল।"
-"কিন্তু দাদু এগুলোতো গল্পই আসলে। সত্যি তো নয় একটাও।"
-"হক কথা। কিন্তু এটা তো ভাবো যে এই গল্পগুলো যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে কেনো ফেরে, কেনো পড়ায় স্কুলে?"
-"কেনো?"
-"যাতে মানুষ ভুল না করে, ছেলে মেয়েতে কোনো প্রভেদ না করে। ঈশ্বরের চোখে, প্রকৃতির কাছে সকল মানুষই সমান। মানুষের মহত্ব লুকিয়ে থাকে শুধু তার কাজের মধ্যে। আর কিছুতে নয়। এটাই হল সার সত্য। আর সেই কথাই তো কবিতায় বলে গেছেন বিদ্রোহী কবি।"
- " আমাকে কবিতাটা শিখিয়ে দেবে দাদু?"
-" নিশ্চয়ই। আমার সাথে বলো -
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!"