Indrani Bhattacharyya

Children Stories Drama Fantasy

4.8  

Indrani Bhattacharyya

Children Stories Drama Fantasy

সাইকেল আর ছেলেটা

সাইকেল আর ছেলেটা

5 mins
280



গত সপ্তাহেই এক মাসের ছুটি কাটিয়ে ফিরলাম দেশ থেকে। আবার কবে ছুটি পাবো, যেতে পারবো জানি না। বাবাকে এর পরের বার গিয়ে দেখতে পাবো তো? কে জানে? ছোটবেলার কত অভ্যাসই তো ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর ঘুড়ি ওড়াই না, নুড়ি পাথর জমাই না, কাগজের নৌকো বানাইনা, হা করে কোনো অচেনা লোকের দিকে তাকিয়ে থাকি না, কোনো মহিলার দিকে তো নয়ই। কিন্তু ছাড়তে পারিনি শুধু এই ডায়রি লেখার অভ্যাসটা।

আজ রবিবার। অফিসের তাড়া না থাকায় খুলে বসলাম ল্যাপটপটা। শুরু করলাম লেখা।

'মা তো অনেক আগেই চলে গেছেন। সেই কলেজে পড়ার সময়ই। বাবাকেও দেখে মনে হল বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। কর্কট রোগ তার জাল ভালো রকমই ছড়িয়ে দিয়েছে। শিরায় উপশিরায় মজ্জায় মজ্জায় এখন ওত পেতে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর দূত। বাবা এখন ভাই আর ভাইয়ের বউ রিমার কাছে ঢাকুরিয়ার বাড়িতেই থাকেন। ওরা যথাসাধ্য করছে। আমি তো মাস গেলে ডলার পাঠানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়।

গেলো মাসে দেশে থাকাকালীন এক সপ্তাহের জন্য বাবাকে নিয়ে কলকাতা থেকে দেশের বাড়ি ঘুরতে গেছিলাম। হয়ত বাবার এই শেষ বারের মত যাওয়া। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল। ভাইই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমাকে কোনো রকম মাথা ঘামাতে হয়নি।

আমাদের গ্রামের বাড়ি বহরমপুরের কাছে। গ্রামটা আমার দেখে আগের মতোই শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট মনে হল। বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুতের আলো আর কলের জল ছাড়া শহুরে জীবনযাত্রার তেমন কোনো ছাপ এখানে এখনো তেমন পড়েনি। অন্তত আমার তেমনটাই মনে হল। ওখানে এখনো কিছু দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি আত্মীয় স্বজন থাকেন। সকলেই খুব খুশি হয়েছিলেন আমরা যাওয়াতে।

বাড়িটা এখন আর অত বড় নেই। মাঝে মাঝে পাঁচিল উঠে তিন টুকরো হয়ে গেছে। বেশ কিছু অংশ আর পুকুরটা বিক্রি হয়ে গেছে। আমাদের অংশটা যদিও একই রকম আছে। তবে লোকজন না থাকায় আর দেখভালের অভাবে অনেক জায়গা থেকেই চাঁই খসে পড়েছে, দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় নোনা ধরেছে। এখানে ওখানে আগাছার জঙ্গল।

আমার একতলার ছোট ঘরটা তালাবন্দীই ছিল। এই ঘরেই তো আমার ছোটবেলাটা বন্দী হয়ে আছে। আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার পর পরই বাবা প্রমোশন পেয়ে বদলি হয়ে যান বারাসাতে। ভাই তখন সিক্সে পড়ে। তারপর বাকি কর্মজীবন বাবা কলকাতার আশেপাশেই চক্কর কেটেছেন। ছুটি-ছাটায় কালেভদ্রে বাবা বা ভাই এখানে এলেও আমার আর পড়াশোনা আর নানা ব্যস্ততায় আসা হয়ে ওঠেনি এখানে। আমি প্রায় আঠেরো বছর পর এলাম এখানে। 

আমার আবদারে রাঙা জ্যাঠামশাই সেদিনই লোক ডাকিয়ে তালা ভেঙে খুলে দিলেন দরজাটা। ভেতরে চাপা অন্ধকার আর ভ্যাপসা ভাবটা কেটে যেতেই চোখে পড়ল দেওয়ালের এক কোণে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা সাইকেলটা। দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ায় বাবা ক্লাস সেভেনে আমাকে দেওয়া কথা মত কিনে দিয়েছিলেন সাইকেলটা। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় নিয়ে যাওয়ার অসুবিধার কারণে এখানেই রেখে যাওয়া হয়েছিলো সেটা। আজ আবার আঠেরো বছর পর দেখছি আমার প্রিয় বন্ধুকে। ধুলোর পুরু চাদরে ঢেকে গেছে লাল সিটটা। আমি কাছে দাঁড়িয়ে হাত বুলিয়ে পরিষ্কার করে দিলাম সেটা। সাইকেলটাও যেনো মনে হল আমার হাতের স্পর্শে খুশি হয়ে উঠল। তারপর কি মনে হতে ছোট্ট একটা লাফে চেপে বসলাম তার ওপর আর সাইকেলটাও যেনো সেই মুহূর্তেরই অপেক্ষায় ছিল। বলা নেই, কওয়া নেই, হুশ করে ডানা মেলে উড়িয়ে নিয়ে চলল আমাকে।


কোথায় ঘর, কোথায় দেওয়াল। চারপাশ দিয়ে শনশন করে যেনো সরে যেতে লাগলো বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ঝোপঝাড়। রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা কোনো পক্ষীরাজ ঘোড়া থুড়ি সাইকেলের পিঠে চেপে উড়ে যেতে লাগলাম কোনো নিরুদ্দেশের পথে। গায়ে এসে লাগছে ভোরের মিষ্টি ঠান্ডা হওয়ার ঝাপটা। তাতে যেনো মৌয়ের গন্ধ। কাছেই বুঝি ডেকে উঠলো এক জোড়া বসন্তবৌরি। মাঝে মাঝেই শিশির ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীর, আরামে বুজে বুজে আসছে চোখের পাতা। প্রেমিকার মত বারবার ডালপালা মেলে সামনে এসে আলিঙ্গন করতে চাইছে পথের দুপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ারা।

যতই এগোতে লাগলাম, মনে হতে লাগলো ,এ পথ তো আমার চেনা! আমার স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে বারবার, অবচেতনে খেলা করে আমার বর্তমানের ব্যস্ত দিনগুলোর সাথে আবার কখনো স্বপ্নে আমায় হাত ধরে পৌঁছে দেয় আমার শৈশবে। এতো সেই পথ যে পথ দিয়ে প্রতিদিন আমি সাইকেল চালিয়ে বাড়ি থেকে স্কুলে যেতাম। মনে পড়ছে, এই তো সেই বৈচি ফলের গাছ। এখনো কি সুন্দর লাল হয়ে থোকা ধরে রয়েছে। ঝোপেঝাড়ে ফুটে রয়েছে অসংখ্য ভাট ফুল। আর ঐ তো করিম চাচার সূর্যমুখী ক্ষেত। আমি করিম চাচাকে দেখতে পেলে এখানেই সাইকেল রেখে দিয়ে বায়না জুড়তাম - "দাও না কয়েকটা ফুল।" সব মনে পড়ে যাচ্ছে ছবির মতন।


আকাশে মেঘ জমছে ঈশান কোণে। বৃষ্টি আসতে পারে। আমাকে যে তার আগেই পৌঁছতে হবে নদীর পারে। ওখানে আমার জন্য নিশ্চয়ই আজও অপেক্ষা করে আছে গফুর মিঞা। গ্রাম ছাড়ার আগে ওকে যে আমি কথা দিয়েছিলাম, আমি গাঁয়ে ঠিক একদিন ফিরে আসবো। আর গফুর মিঞাও বলেছিল আমাকে তখন খেয়া পার করে বৈরাগীর হাটে গাজনের মেলায় নিয়ে যাবে ।আজই তো সেই দিন। আমি গতি বাড়ালাম। পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক শালি ধান, বিন্নি ধানের ক্ষেত। আমাকে আরো তাড়াতাড়ি প্যাডেল করতে হবে। গফুর মিঞা ফিরে যাবে না হলে। আরো জোরে ছুটতে হবে। আরো ,আরো...


কিন্তু আমার পাশে পাশে দুদ্দারিয়ে সাইকেল ছুটিয়ে চলা এই ছেলেটা কে? এতক্ষণ তো ছিল না। বেশ একা একা চলছিলাম। যত স্পিড বাড়াচ্ছি ততই ঘাড়ের ওপর যেনো নিঃশ্বাস ফেলছে। খুব চেনা চেনা লাগছে ছেলেটাকে। সেই একইরকম নীল হাফ প্যান্ট, সাদা শার্ট। একদম আমাদের স্কুল ইউনিফর্মের মত। মাথায় সেই একইরকম ছোট করে কাঁটা বাবরি চুল, পায়ে হওয়াই চপ্পল আর চোখে মোটা কাঁচের চশমা। প্যাডেল করতে করতেই ডাকলাম - "এই ছেলে এই...। "ছেলেটি বিরক্ত হয়ে ব্রেক কষে মুখ তুলে তাকালো । আমি চমকে উঠলাম। এই ছেলেটি যে আমার ভীষন চেনা। না না। ঠিক তাও নয়। এত আমি। মানে আমার ছোটবেলার আমি। কেমন যেনো মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব। আমিও জোরে ব্রেক কষতে চাইলাম। কিন্তু আমার ব্রেক তো কাজই করছে না। পিছনে পড়ে থাকা ছেলেটার মুখ ছোট ছোটো হতে হতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটায় ঝাপসা হয়ে আসছে আমার দৃষ্টি। তবু তাকিয়ে রইলাম সেদিকে।

সম্বিত ফিরল জ্যাঠামশাইয়ের ডাকে - "কিরে বুলা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছিস কেনো? টেনে দে জানলাটা।"

চেয়ে দেখলাম শুধু আমি নই, ভিজে গেছে আমার সাইকেলটাও।'


Rate this content
Log in