সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর
রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
[সূচনা]
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর, এক বেদনার নিবিড়। জীবন নদীর তীরে যে ফুল ফোটে, তার নিথর দেহে ঝরে পড়ে। একদা যে সিঁদুর অমলিন ছিল, আজ তা ধূসর, ছায়া মেশানো। স্মৃতিকাতর মন খুঁজে ফেরে সেই দিন, যখন রঙ ছিল গাঢ়, সবুজে ভরা। নতুন জীবনের স্বপ্নগুলি সব, আজ যেন বিবর্ণ, ভাঙা কাঁচের মতো। তবুও, এই বিবর্ণ সিঁথির রেখায়, লুকিয়ে আছে অকথিত কত কথা। সম্পর্কের টান, ভালোবাসার গভীরতা, আজও সে ধারণ করে, নীরবতায়। এক অসমাপ্ত কাহিনি যেন, অপেক্ষার প্রহর গোনে, বিষণ্ণ নয়নে। সময় বয়ে যায় আপন স্রোতে, স্মৃতিরা থেকে যায়, বিবর্ণ রূপে। সাদা সিঁথির এই বিবর্ণ সিঁদুর, জীবনের রুঢ় সত্যের প্রতিচ্ছবি।
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর, এক বেদনার নিবিড়। জীবন নদীর তীরে যে ফুল ফোটে, তার নিথর দেহে ঝরে পড়ে। একদা যে সিঁদুর অমলিন ছিল, আজ তা ধূসর, ছায়া মেশানো। স্মৃতিকাতর মন খুঁজে ফেরে সেই দিন, যখন রঙ ছিল গাঢ়, সবুজে ভরা। সেই দিন, যখন সিঁথির রেখা ছিল জীবন নদীর স্রোতের মতো চিরচেনা, আর সিঁদুর ছিল আশার রক্তিম আভায় উজ্জ্বল। সেই দিন, যখন প্রতিটি সকাল এসেছিল নতুন স্বপ্নের গান নিয়ে, আর প্রতি সন্ধ্যায় নেমে আসত ভালোবাসার স্নিগ্ধ চাদর।
আজ সেই রং কোথায়? কোথায় সেই জীবনের স্পন্দন? নদীর জল শুকিয়ে গেছে, ফেলে গেছে কেবলই পলিমাটির শুষ্কতা। ফুলেরা ঝরে গেছে সময়ের করাল গ্রাসে, রেখে গেছে কেবলই শুকিয়ে যাওয়া ডালপালা। আর সিঁদুর? সে তো আজ বিবর্ণ, অতীতের স্মৃতিচিহ্ন মাত্র। মনে পড়ে সেই দিনগুলো, যখন রাতের আকাশ তারাদের আলোয় সেজে উঠত, আর সেই তারাদের মাঝে নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজে পেত মন। চাঁদ যেমন নিজের আলোয় আলোকিত করত চারপাশ, তেমনই ভালোবাসাও আলোকিত করত জীবনকে।
কিন্তু আজ, রাতের আকাশ মেঘে ঢাকা, তারাগুলো যেন লুকিয়েছে ভয়ে। চাঁদও যেন আজ বিবর্ণ, তার আলোয় নেই সেই ঔজ্জ্বল্য। জীবনে নেমে এসেছে এক নিবিড় অন্ধকার, যেখানে সব রঙ ফিকে হয়ে গেছে। সেই সবুজে ভরা দিনগুলো আজ কেবলই স্মৃতি, দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় যেন। মনে পড়ে হাসির রেখাগুলো, যা আজ বিলুপ্তপ্রায়। মনে পড়ে স্পর্শের উষ্ণতা, যা আজ কেবলই শীতলতার ছোঁয়া। জীবন নদীর তীরে সে ফুল কি আর কখনও ফুটবে? নাকি এই বিবর্ণ সিঁদুরের মতোই সব রঙ, সব স্বপ্ন একদিন কেবলই স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে? এই প্রশ্ন আজও অনুরণিত হয়, উত্তরহীন এক বেদনার নিবিড়তায়।
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর
[এক]
রঞ্জনা, সদ্য বিধবা, জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা বাড়িয়েছে। তার জীবনে এখন শুধুই স্মৃতির অবশ্য—সাদা সিঁথি আর বিবর্ণ সিঁদুর। অর্ণবের অপ্রত্যাশিত বিদায় তার জগৎটাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। যে হাতটা এতদিন তার ছিল ভরসা, সেই হাত আজ শূন্য। যে হাসিটা ছিল তার আশ্রয়, সেই হাসি আজ কেবলই এক ম্লান স্মৃতি। তবুও, জীবন থেমে থাকে না। সে নিজের নিয়মে চলে।
রঞ্জনার পাশে বসে, একদিন তার মা তার হাত ধরে বলল, "অর্ণব সবসময় চাইতো তুই সুখী হ। তুই যদি ভেঙে পড়িস, তাহলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না। দেখ মা, সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে ঠিকই, কিন্তু মনের সিঁদুর তো অমলিন। অর্ণবের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে, নতুন করে বাঁচার চেষ্টা কর।" মায়ের কথায় রঞ্জনা যেন একটু শক্তি পেল। মনে পড়ে গেল অর্ণবের সেই ভালোবাসার গভীরতা, তার স্বপ্নগুলো।
সত্যিই তো, সিঁদূর কেবলই এক প্রতীক। জীবনের গভীরতম ভালোবাসা যে মনে অমলিন থাকে, তার কোনো রঙ বদল হয় না। রঞ্জনা ধীরে ধীরে নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। প্রথমে একটু দ্বিধা, একটু ভয়। কিন্তু অর্ণবের স্মৃতি, আর মায়ের মতো মানুষের সঙ্গ তাকে সাহস জোগালো। সে আবার বাড়ির বাগানে ফুলগাছগুলোর যত্ন নিতে শুরু করলো, অর্ণব যে গাছগুলো খুব ভালোবাসতো। পুরানো বইগুলো আবার উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো, যেখানে অর্ণবের হাতে লেখা কত টুকরো স্মৃতি।
জীবন আবার শুরু হয় নতুন বন্ধুত্ব, নতুন বিশ্বাস দিয়ে। রঞ্জনা জানে, সুখ ফিরবে একদিন। হয়তো অর্ণবের মতো করে ভালোবাসার সুখ নয়, কিন্তু নিজের মতো করে বাঁচবার সুখ। সে আবার নিয়মিত হাঁটতে বেরোতে শুরু করলো। পার্কে অন্য বিধবাদের সাথে তার পরিচয় হলো, যারা একই রকম কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছে। তাদের অভিজ্ঞতা, তাদের লড়াই তাকে নতুন করে ভাবতে শেখালো। সে বুঝতে পারলো, সে একা নয়। এই পৃথিবীতে আরও অনেক রঞ্জনা আছে।
বিবর্ণ সিঁদুর হয়তো তার জীবনের এক কঠিন বাস্তব, কিন্তু রঞ্জনা জানে, সাদা সিঁথির পবিত্রতা তাকে নতুন করে বাঁচার শক্তি যোগায়। সূর্যাস্তের আলোয়, রঞ্জনা খুঁজে পায় এক নতুন জীবনের আশ্বাস। এই আলো কেবলই দিনের শেষ নয়, বরং এক নতুন দিনের শুরু। সে বুঝতে পারে, জীবন মানে কেবল হারানো নয়, জীবন মানে টিকে থাকা, জীবনের পথে আবার আলো খুঁজে নেওয়া। অর্ণবের স্মৃতি তার চলার পথের পাথেয় হয়ে রইলো, কিন্তু সেই পথ এখন আর শুধু ভারাক্রান্ত নয়, বরং নতুন আশার আলোয় উদ্ভাসিত।
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর
[দুই]
একদিন অঞ্জনার মা তার হাত ধরে বলল, "অর্ণব সবসময় চাইতো তুই সুখী হ। তুই যদি ভেঙে পড়িস, তাহলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না। দেখ মা, সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে ঠিকই, কিন্তু মনের সিঁদুর তো অমলিন। অর্ণবের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে, নতুন করে বাঁচার চেষ্টা কর।" মায়ের কথায় রঞ্জনা যেন একটু শক্তি পেল। মনে পড়ে গেল অর্ণবের সেই ভালোবাসার গভীরতা, তার স্বপ্নগুলো।
"হ্যাঁ মা, ঠিক বলেছো। অর্ণবের স্মৃতিগুলোই আমার বেঁচে থাকার সম্বল।" অঞ্জনা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল।
অঞ্জনার মা, মালতী দেবী, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, "তোর অর্ণব যেখানেই থাকুক, শান্তিতে থাকুক। আর তুই আমার লক্ষ্মী মেয়ে, আবার নতুন করে সব শুরু কর। জীবন থেমে থাকে না, মা।"
মালতীর চোখে জল এসে গিয়েছিল। একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। সকাল থেকেই অঞ্জনা শুধু চুপচাপ বসেছিল, যেন এক মূর্তি। শুভ্রর মৃত্যুর পর থেকে সে এভাবে কথা বলাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। আজ মায়ের কথায় একটু হলেও যেন তার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে।
সেদিন রাতে অঞ্জনা অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারল না। বিছানায় শুয়ে শুভ্রর মুখটা মনে করার চেষ্টা করছিল। তাদের কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন সব যেন এক নিমেষে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মায়ের কথাগুলো তার মনে গেঁথে রইল – "মনের সিঁদুর তো অমলিন"। সে কি পারবে সেই অমলিন সিঁদুরকে ধরে রাখতে?
পরদিন সকালে অঞ্জনা ঠিক করল, সে আর এভাবে ভেঙ্গে পড়বে না। শুভ্রকে সে কথা দিয়েছিল, সবসময় ভালো থাকবে। আজ তার সেই প্রতিজ্ঞা পালনের সময়। সে উঠে স্নান করল, নতুন করে শাড়ী পরল। তার চোখে মুখে এক নতুন দৃঢ়তা।
মালতী দেবী মেয়ের পরিবর্তন দেখে অবাক হলেন। মুখে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল। অঞ্জনা মায়ের পাশে এসে বসল, "মা, আজ থেকে আমি আবার বাঁচব। শুভ্রর জন্য নয়, নিজের জন্য।"
মালতী দেবী মেয়ের হাতটা ধরলেন। সেই হাতে ছিল এক নতুন জীবনের স্বপ্ন। সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর হয়তো তার জীবনের একটা অধ্যায় শেষ করে দিয়েছে, কিন্তু মনের অমলিন সিঁদুর তাকে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা জুগিয়েছে। অঞ্জনা জানত, পথটা সহজ হবে না, কিন্তু সে লড়বে। শুভ্রর স্মৃতিকে সাথে নিয়ে, নতুন আশায় বুক বেঁধে সে জীবনের পথে আবার যাত্রা শুরু করল।
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর
[তিন]
অর্ণবের অনুপস্থিতিটা একটা শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল। সেই শূন্যতা পূরণ করা সহজ ছিল না। কিন্তু রঞ্জনা বুঝতে পারছিল, জীবনের পথে এভাবে থেমে থাকলে চলবে না। অর্ণবও হয়তো এটাই চাইতো। সে চাইতো রঞ্জনা হাসিখুশি থাকুক, জীবনের নতুন মানে খুঁজে নিক।
একদিন, রঞ্জনার মা তাকে বললেন, "তুই কি ভাবছিস? এভাবে একা একা কতদিন? এবার একটু এগিয়ে চল।"
রঞ্জনা মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের চোখে ছিল অপার স্নেহ আর ভরসা। সে মায়ের হাতটা ধরলো। "মা, আমি চেষ্টা করবো। অর্ণবের স্মৃতি আমাকে শক্তি যোগাবে।"
অর্ণবের পুরোনো জিনিসগুলো সে একদিন গোছাতে শুরু করলো। তার বইয়ের তাক, তার লেখা ডায়েরি, তার পছন্দের গান। সবকিছুতেই যেন অর্ণবের ছোঁয়া। প্রতিটি জিনিসের সাথে জড়িয়ে ছিল তাদের স্মৃতি, তাদের ভালোবাসা। ডায়েরির পাতা ওল্টাতে গিয়ে রঞ্জনা হেসে ফেললো, অর্ণবের কিছু মজার মন্তব্য পড়ে। আবার মাঝে মাঝে চোখ ভিজে যাচ্ছিল।
একদিন তার অর্ণবের প্রিয় ফুলটা, সাদা রজনীগন্ধা, তার বারান্দায় ফুটি ফুটি করছিল। ফুলটার মন মাতানো গন্ধ রঞ্জনার মনটাকে ছুঁয়ে গেল। সে ফুলটার পাশে এসে বসলো। মনে হলো, অর্ণব যেন এখানেই আছে, তার পাশে।
তখনই তার মনে পড়ে গেল, অর্ণব তাকে বলেছিল, "রঞ্জনা, তুমি খুব শক্ত। তুমি সব বাধা পেরিয়ে যাবে।"
সেই কথাগুলোই যেন রঞ্জনার মনে নতুন আশার সঞ্চার করলো। সে ঠিক করলো, সে আবার নতুন করে বাঁচবে। অর্ণবের স্মৃতি বুকে নিয়ে, কিন্তু থেমে না থেকে।
একদিন সে তার পুরানো হারমোনিয়ামটা বের করলো। অনেকদিন পর সে আবার গান গাইতে বসলো। প্রথমে একটু হাত কাঁপছিল। কিন্তু তারপর অর্ণবের মুখটা মনে পড়তেই, তার হাত সাবলীল হয়ে উঠলো। সে গান গাইতে শুরু করলো অর্ণবের পছন্দের সুরে, অর্ণবের হাসিমুখটা মনে করে।
গান গাইতে গাইতে তার মনে হলো, জীবনের রংগুলো হয়তো একটু ফিকে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একেবারে মুছে যায়নি। নতুন করে রং মেশালে, জীবনের ক্যানভাস আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে।
সেইদিন রঞ্জনা বুঝতে পারলো, সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর কেবলই বাইরের একটা পরিবর্তন। ভেতরের ভালোবাসা, ভেতরের শক্তিটা অমলিন থাকলে, জীবন আবার নতুন রঙে সেজে উঠতে পারে। আর এই নতুন জীবনের লড়াইয়ে তার মা এবং অর্ণবের স্মৃতিই হবে তার সবচেয়ে বড় শক্তি।
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর
[চার]
সূর্যাস্তের আলো রঞ্জনার মুখে এসে পড়লো। গঙ্গার ঘাটে বসে ছিল সে। গঙ্গার স্রোতের দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল, সময় যেন বয়ে চলেছে অবিরাম। অর্ণবের স্মৃতিগুলো ঢেউয়ের মতো আসছে আর যাচ্ছে।
অর্ণবের মা তার হাত ধরে বলেছিলেন, "অর্ণব সবসময় চাইতো তুই সুখী হ। তুই যদি ভেঙে পড়িস, তাহলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না। দেখ মা, সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে ঠিকই, কিন্তু মনের সিঁদুর তো অমলিন। অর্ণবের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে, নতুন করে বাঁচার চেষ্টা কর।"
কথাগুলো রঞ্জনার কানে এখনও বাজছে। মায়ের বলা শেষ লাইনটা তাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে - "জীবন আবার শুরু হয় নতুন বন্ধুত্ব, নতুন বিশ্বাস দিয়ে।" রঞ্জনা জানে, সুখ ফিরবে একদিন। সময় লাগবে, হয়তো অনেক সময়, কিন্তু আলো আসবেই।
বিবর্ণ সিঁদুর হয়তো তার জীবনের এক কঠিন বাস্তব, কিন্তু রঞ্জনা জানে, সাদা সিঁথির পবিত্রতা তাকে নতুন করে বাঁচার শক্তি যোগায়। সূর্যাস্তের আলোয়, রঞ্জনা খুঁজে পায় এক নতুন জীবনের আশ্বাস।
হঠাৎ, কেউ একজন এসে তার পাশে দাঁড়ালো। রঞ্জনা মুখ তুলে দেখলো, শুভ্র। অর্ণবের খুব কাছের বন্ধু ছিল শুভ্র। অর্ণবের মৃত্যুর পর শুভ্রই রঞ্জনাকে সবথেকে বেশি সাহস জুগিয়েছে।
"এখানে একা বসে কি করছিস?" শুভ্র জিজ্ঞেস করলো।
রঞ্জনা হালকা হেসে বলল, "এমনিই। ভালো লাগছিল তাই।"
"চল, উঠি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে।"
দুজনে একসাথে হাঁটতে শুরু করলো। গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে রঞ্জনা দেখলো, দূরে একটা ছোট ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ছেলেটার মুখে আনন্দের ঝিলিক। রঞ্জনা আপন মনে হাসলো।
শুভ্র বলল, "কি দেখছিস?"
"কিছু না। ভাবছিলাম, জীবনটা হয়তো এমনই। দুঃখের পরেই আনন্দ আসে।"
শুভ্র রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বলল, "ঠিক বলেছিস। আর সেই আনন্দটাকে খুঁজে নিতে হয়, তৈরি করতে হয়।"
কয়েকদিন পর, রঞ্জনা একটা নতুন চাকরি শুরু করলো। একটা NGO-তে যোগ দিয়েছে সে। সেখানে সে দুঃস্থ শিশুদের জন্য কাজ করবে। রঞ্জনা মনে মনে ভাবলো, অর্ণব হয়তো এটাই চাইতো। মানুষের জন্য কিছু করা, তাদের মুখে হাসি ফোটানো।
কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিল রঞ্জনা। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারলো, দুঃখকে জয় করার একটাই উপায় - নিজেকে ব্যস্ত রাখা, অন্যের জন্য কিছু করা।
একদিন, রঞ্জনা দেখলো, শুভ্র অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
"কি ব্যাপার? এখানে কি করছিস?" রঞ্জনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
শুভ্র হেসে বলল, "তোকে নিতে এসেছি। আজ আমরা একটা অনাথ আশ্রমে যাবো। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাবো।"
রঞ্জনা খুশি হয়ে রাজি হলো। অনাথ আশ্রমে গিয়ে রঞ্জনা দেখলো, শুভ্র বাচ্চাদের সাথে খেলছে, গল্প করছে। বাচ্চাদের হাসিতে চারিদিক মুখরিত। রঞ্জনাও তাদের সাথে যোগ দিল।
সেদিন রাতে, রঞ্জনা ডায়েরি লিখতে বসলো। আজ তার মনে একটা অন্যরকম শান্তি। সে লিখলো, "অর্ণব, জানি তুমি আমাকে দেখছো। আমি ভালো আছি। তোমার স্বপ্নগুলো আমি পূরণ করবো। আর হ্যাঁ, আমি আবার বাঁচতে শিখেছি।"
ডায়েরি বন্ধ করে রঞ্জনা আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে অজস্র তারা মিটমিট করে জ্বলছে। রঞ্জনা অনুভব করলো, তার জীবনেও আবার আলো এসেছে। সেই আলো অর্ণবের ভালোবাসার, শুভ্রর বন্ধুত্বের, আর নিজের নতুন করে বাঁচার ইচ্ছের।
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর
[পাঁচ]
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর, এক বেদনার নিবিড়। জীবন নদীর তীরে যে ফুল ফোটে, তার নিথর দেহে ঝরে পড়ে। অঞ্জনা লাল বেনারসি পরে, হাতে শাখা-পলা আর কপালে সিঁদুর নিয়ে যখন সুদীপের পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন তার চোখেমুখে এক নতুন জীবনের আলো ঝলমল করছিল। সুদীপ নিজের হাতে রঞ্জনার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে অঞ্জনা অনুভব করে, তার জীবনের সাদা সিঁথি আবার রঙিম হয় উঠেছে ভালোবাসার রঙে।
আগের সব দুঃখ, সব কষ্ট যেন এক নিমেষে দূর হয়ে গেল। যে বৈধব্য রেখা জীবনের শুরুতে এক গভীর বিষাদের সুর বাজিয়েছিল, আজ সেই সিঁথি রক্তিম আভা ধারণ করে এক নতুন স্বপ্নের সূচনা করল। সুদীপের হাতের স্পর্শে, তার দেওয়া সিঁদুরের প্রতিটি কণা যেন অঞ্জনা’র মনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করল। ঘর জুড়ে এক আনন্দের গুঞ্জন, আত্মীয়স্বজনের শুভকামনা আর নতুন জীবনের স্বপ্ন।
কিন্তু এই নতুন জীবনের পথ কি এতই মসৃণ হবে? অতীতে যে গভীর ক্ষত আর চাপা কষ্টগুলো অঞ্জনা’র মনে লুকিয়ে ছিল, তা কি সত্যিই মুছে যাবে? সুদীপ কি পারবে অঞ্জনা’র জীবনের সবটুকু শূন্যতা ভরিয়ে দিতে? নাকি এই নতুন শুরু কেবল অতিতের ছায়া থেকে মুক্তির এক ক্ষণস্থায়ী প্রয়াস?
সুদীপের চোখে ছিল এক গভীর স্নেহ আর দায়িত্ববোধ। সে অঞ্জনা’র অতীতের সবটা জেনেও তাকে আপন করে নিতে দ্বিধা করেনি। অঞ্জনা’র মনের কোণে এখনো একটুকু সংশয় ছিল, অতীতের স্মৃতির কাঁটাগুলো কি সত্যিই বিঁধবে না এই নতুন পথে? সে সুদীপের দিকে তাকাল, তার দৃঢ় হাত ধরে থাকা সুদীপের স্পর্শে এক অমোঘ আশ্বাস খুঁজে পেল।
বিবাহের পর তাদের দিনগুলো কাটছিল এক অন্যরকম ভালোবাসায়। সুদীপ অঞ্জনা’র প্রতি যত্নশীল, তার সবটুকু খেয়াল রাখে। কিন্তু মাঝে মাঝে সুদীপের চোখে এক অন্যরকম ছায়া দেখা যায়, যা অঞ্জনা’র দৃষ্টি এড়ায় না। সেই ছায়া কি কোন অতীতের স্মৃতি, নাকি অন্য কোন কারণ? অঞ্জনা জানতে চায়, কিন্তু সুদীপ কেবলই হাসে আর বলে, "সব ঠিক আছে অঞ্জনা, তুমি আমার পাশে আছ, এটাই আমার সব।"
একদিন, সুদীপ যখন বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, অঞ্জনা তার টেবিলের উপর একটি পুরনো ডায়েরি দেখতে পায়। কৌতূহল বশে সে ডায়েরিটি খোলে। সেখানে লেখা ছিল সুদীপের প্রথম স্ত্রী, রঞ্জনার কথা। ডায়েরির পাতায় পাতায় ছিল তাদের ভালোবাসার গল্প, তাদের স্বপ্ন, আর রঞ্জনার অকাল মৃত্যুর মর্মান্তিক কাহিনি। সুদীপের চোখে সেই ছায়া কি রঞ্জনার স্মৃতির? অঞ্জনা বুঝতে পারে, সুদীপের এই নতুন জীবন কেবল তার জন্য নয়, সে রঞ্জনার অসমাপ্ত ভালোবাসাকেও পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ডায়েরি পড়তে পড়তে অঞ্জনা’র চোখ ভিজে আসে। সে বুঝতে পারে, সুদীপের এই গ্রহণ কেবল ভালবাসার এক মহান দৃষ্টান্ত। তার নিজের জীবনের অতীত তাকে যেমন কষ্ট দিয়েছিল, সুদীপের জীবনেও তেমনই এক অপূরণীয় শূন্যতা ছিল। এই সহমর্মিতা আর ভালবাসা তাদের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। অঞ্জনা অনুভব করে, সে শুধু সুদীপের স্ত্রীই নয়, সে রঞ্জনার স্বপ্নেরও কিছুটা অংশীদার। তাদের পথচলা এখন কেবল দুজনার নয়, অতীতের ভালবাসাও তাদের সাথে মিশে এক নতুন সুর তৈরি করছে।
...
সাদা সিঁথির বিবর্ণ সিঁদুর
[সমাপ্তি]
আজ অমাবস্যা। আজ মন্দিরে কালী মায়ের পূজা ও আরতি হবে। অঞ্জনাও আজ মন্দিরে এসেছে। অঞ্জনা জানে সাদা সিঁথির সিঁদুর আজ মলিন হয়ে গেছে।
আজ অমাবস্যার রাতে মন্দিরে কালী মায়ের পূজা ও আরতি হবে। অঞ্জনাও আজ মন্দিরে এসেছে। অঞ্জনা জানে সাদা সিঁথির সিঁদুর আজ মলিন হয়ে গেছে। তবুও কাছে সে বসে প্রার্থনা করে। মা তোমার কালী নামের ডাকে, হৃদয় উন্মুখ হয়, ভয়ঙ্করের রূপে, তুমি অভয় দাও মা।
পূজা শুরু হয়ে গেছে। পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করছেন। ধূপের গন্ধে চারপাশ ম ম করছে। ভক্তদের ভিড়ে মন্দির প্রাঙ্গণ গমগম করছে। কিন্তু অঞ্জনা যেন নিজের মনেই মগ্ন। তার চোখের জল গাল বেয়ে পড়ছে। সে মায়ের চরণে নিজের সব দুঃখ উজাড় করে দিতে চায়।
আরতির ঘন্টা বেজে উঠল। উলুধ্বনিতে ভরে গেল চারপাশ। অঞ্জনা চোখ বন্ধ করে মায়ের রূপ ধ্যান করছে। সে জানে মা সব দেখতে পান, সব শুনতে পান। তার সব কষ্ট মা দূর করে দেবেন। এই অমাবস্যার রাতে, এই কালী মায়ের চরণে, অঞ্জনা খুঁজে পেল এক নতুন শক্তি, এক নতুন আশা।
মা তোমার কালী নামের ডাকে, হৃদয় উন্মুখ হয়, ভয়ঙ্করের রূপে, তুমি অভয় দাও মা। শ্মশান ভূমি তোমার বাস, প্রেত আত্মা সব সৃজন, তুমিই তো মা কালী, মহাকালীর প্রকাশ। তারা রূপে তুমি তারা, জ্ঞানের আলো ছড়াও, অন্ধকারের মাঝে, আশার প্রদীপ জ্বালাও। তিন রূপে তুমি বিরাজ, তারা, কালী আর মহামায়া, তোমার চরণে লভি মুক্তি, এই মোর কাম্য হে মা। ভুবন আলো করা, অপার মহিমা তোমার, কে পারে বল মা তোমায় ধরা? ভুলি সকল দুঃখ কষ্ট, শ্রীচরণে শরণ নিও, জয় মা তারা, জয় কালী, এই বেলা কৃপা করো।
তোমার এই আহ্বান, যেন এক বিদ্যুৎপ্রবাহ, শিরে মুকুট, ত্রিনয়ন, করাল বদনে ভয়াল রূপ, তবু শান্ত মুখচ্ছবি। রক্ত বসন, অশুভের বিনাশিনী, তুমি তো মা আমার মুক্তি। হাতে খড়্গ, ছিন্ন মুণ্ড, যেন সকল আসুরিক শক্তি তোমার চরণে বিলীন। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর রূপের আড়ালে যে স্নেহের আভা, সে তো কেবল তোমার ভক্তরাই অনুভব করতে পারে।
কত রাত কেটেছে মা, তোমার ধ্যানে, তোমার নামে। কত আশা, কত প্রার্থনা। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কি সত্যিই তোমার যোগ্য? আমার পাপ তাপ কি ধুয়ে মুছে যাবে তোমার এই পবিত্র নামে? কিন্তু যখনই এই সংশয় মনে আসে, তখনি শুনি তোমার সেই করুণ আহ্বান, "ভয় পেয়ো না, আমি আছি।"
মন্দিরের সেই পবিত্র মাটি, যেখানে তোমার অধিষ্ঠান। সেখানে আসা লাখো ভক্তের আকুল প্রার্থনা। কেউ চায় মুক্তি, কেউ চায় সিদ্ধি, কেউ বা চায় কেবল তোমার একটুখানি কৃপা। আমি জানি, তুমি সবার কথাই শোনো, মা। তোমার স্নেহ তো সবার জন্য উন্মুক্ত।
আজও আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে, মা। এই ভুবন ভরা তোমার লীলা। তুমিই সৃষ্টি, তুমিই স্থিতি, তুমিই লয়। তোমার ইচ্ছাতেই সব হয়। আমার যা কিছু আছে, সব তোমার দান। আমার এই জীবন, এই শ্বাস-প্রশ্বাস – সবই তোমার। মাগো জীবনে চেয়েছি অনেক, দাও নি কিছুই। শুধু একটাই প্রার্থনা মাগো আমার, আমার ভালো করো, না করো ক্ষতি নাই, তুমি সবার মঙ্গল করো মা। জয় মা কালী, জয় তারা মা। জয় তারা! জয় তারা!
আজও আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে, মা। এই ভুবন ভরা তোমার লীলা। তুমিই সৃষ্টি, তুমিই স্থিতি, তুমিই লয়। তোমার ইচ্ছাতেই সব হয়। আমার যা কিছু আছে, সব তোমার দান। আমার এই জীবন, এই শ্বাস-প্রশ্বাস – সবই তোমার। মাগো জীবনে চেয়েছি অনেক, দাও নি কিছুই। শুধু একটাই প্রার্থনা মাগো আমার, আমার ভালো করো না করো ক্ষতি নাই, শুধু সবার মঙ্গল করো মা। জয় মা কালী, জয় তারা মা। জয় তারা! জয় তারা!
অঞ্জনার চোখ দুটি জলে ভরে আসে। শুভ্রর কথা বারে বারে মনে হয়। শুভ্র, যে কিনা সব পরিস্থিতিতেই মায়ের উপর ভরসা রাখত। যে বলত, "মা সব ঠিক করে দেবেন, তুমি শুধু তাঁর চরণে মন রাখ।" অঞ্জনার আজ শুভ্রর কথাই সত্যি মনে হচ্ছে। এত জ্বালা, এত কষ্ট, এত অনিশ্চয়তা – সবকিছুর মধ্যেও এক অদ্ভুত শান্তি যেন তাকে ঘিরে রেখেছে।
কতদিন পর সে আবার এই মন্দিরে এসেছে! কত বছর হয়ে গেছে! সেই কবে শুভ্র জোর করে তাকে এখানে টেনে এনেছিল। সেদিন অঞ্জনার মন ছিল ভারাক্রান্ত। কিছুতেই সে মায়ের উপর ভরসা রাখতে পারছিল না। কিন্তু শুভ্রর কথায়, শুভ্রর বিশ্বাসে সে এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। আর আজ, শুভ্রর অনুপস্থিতিতেও তার সেই বিশ্বাসই যেন তাকে আবার এই মন্দিরে টেনে এনেছে।
অঞ্জনা প্রণাম করে ওঠে। মায়ের বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের মুখে সেই শান্ত অথচ দৃঢ় ভাব। মনে হয় যেন মা সব জানেন, সব বোঝেন। অঞ্জনা জানে, তার জীবনে অনেক ঝড় গেছে। গেছে অনেক হারানো, অনেক না পাওয়া। কিন্তু মায়ের চরণে এসে দাঁড়ালে সব কিছু কেমন যেন হালকা হয়ে যায়।
শুভ্রর কথা ভাবতে ভাবতে অঞ্জনার মনে পড়ে, শুভ্রও তো আজ এখানে নেই। সে কবেই চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু তার এই বিশ্বাস, তার এই প্রার্থনা আজও অঞ্জনার স্মরণে অমলিন। অঞ্জনা দুহাত জোড় করে আবার বলে, "মা, তুমি শুধু সবার মঙ্গল করো। আমার কথা তুমি ভেবো না। আমি ভালোই থাকব তোমার দয়ায়।"
মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়ায় অঞ্জনা। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। কিন্তু ভোরের প্রথম আলোয় চারপাশটা কেমন যেন নবীন লাগছে। অঞ্জনা অনুভব করে, তার মনের ভারটাও যেন অনেক হালকা হয়ে গেছে। শুভ্রর সেই শেষ কথাগুলো মনে পড়ে যায় তার, "অঞ্জু, যখনই তোমার খুব কষ্ট হবে, এই মন্দিরে আসবে। মায়ের কাছে সব বলে দেবে। দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
হ্যাঁ, শুভ্র, আজ সব ঠিক হয়ে গেছে। আজ আমি আবার মায়ের কাছে এসেছি। আর তুমি যেখানেই থাকো, আশা করি তুমিও ভালো আছো। অঞ্জনা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর নতুন দিনের আলোয় পথ চলতে শুরু করে। তার মনে এক অদ্ভুত আশা, এক নতুন শক্তি। সে জানে, মা কালী তার পাশে আছেন।
অঞ্জনার চোখ দুটি আবার গভীর জলে ঝাপসা হয়ে আসে। সেই জল কেবল দুঃখের বা বেদনার নয়, বরং এক অমলিন স্মৃতি আর গভীর অনুভূতির মিশ্রণ। শুভ্রর কথা বারে বারে তার মনে ভাসে, তার কণ্ঠস্বর যেন আজও কানে বাজে। শুভ্র, সে যেন ছিল এক নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি। সব পরিস্থিতিতেই মায়ের উপর তার বিশ্বাস ছিল অটুট। ছোট ছোট কথায়, সরল সরল অভ্যাসে সে মাকে বলত, "মা সব ঠিক করে দেবেন, তুমি শুধু তাঁর চরণে মন রাখ।" কী আশ্চর্য, শুভ্রর সেই কথাগুলোই আজ অঞ্জনার জীবনে যেন এক নতুন অর্থ বহন করছে।
আজ অঞ্জনার জীবনে যে ঝড় বয়ে চলেছে, যে দুঃখ, কষ্ট আর অনিশ্চয়তার ঘনঘটা – সবকিছুর মধ্যেও সে শুভ্রর সেই কথাগুলোই আঁকড়ে ধরেছে। এই অসহ্য যন্ত্রণা, এই অন্তহীন পথ চলা, ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গভীর সংশয় – এতকিছুর মাঝেও এক অদ্ভুত শান্তি যেন তাকে ঘিরে রেখেছে। এই শান্তি বাইরের নয়, এ যেন অন্তরের গভীর থেকে উঠে আসা এক অনাবিল প্রশান্তি। মনে হচ্ছে, শুভ্রর বিশ্বাস আজ সত্যি হয়েছে। মায়ের চরণে মন রেখে, তাঁর উপর সম্পূর্ণ ভরসা করেই সে এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার শক্তি খুঁজে পাচ্ছে। শুভ্রর বলা কথাগুলোই আজ তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর তাঁর অপার করুণা যেন তাকে এই আঁধার পেরিয়ে আলোকের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে।
এই আঁধার কেবলই রাত নয়, এ যেন এক অনন্ত প্রতীক্ষার প্রহর। রঞ্জন বিগত কয়েক মাস ধরে এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করে আছে। প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত, তার মনে মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর তার অপার করুণা যেন তাকে এই আঁধার পেরিয়ে আলোকের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে। সে জানে, আজ সবকিছুর অবসান হবে।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। ভিড় ঠেলে রঞ্জন প্রবেশ করলো মণ্ডপে। তার হাতে দুটি রজনীগন্ধার ফুলের মালা, শুভ্র এবং সৌরভিত, ঠিক অঞ্জনা যেমন। পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করে পাঠ সমাপ্ত করলেন। সেই মন্ত্রের শব্দে যেন এক নতুন জীবনের সূচনা হলো। তারপর, ধীরে ধীরে, পরম মমতায়, রঞ্জন অঞ্জনা সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে বললো, "জীবনে মরণে আজ থেকে তুমি আমার।"
এই কথাগুলো শুধু শব্দ ছিল না, ছিল এক অঙ্গীকার। এই আঁধারের গভীর থেকে উঠে আসা এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতির ঘোষণা। রঞ্জনের চোখে শুধু অঞ্জনা ছিল না, ছিল অগণিত বাধা পেরিয়ে আসার ক্লান্তি আর এক নতুন জীবনের স্বপ্ন। মায়ের ভালোবাসার মতো, এই ভালোবাসাও নিঃস্বার্থ, এই করুণা অনন্ত। তাদের একসাথে পথচলার শুরুটা ছিল ঠিক এমনই, আঁধার পেরিয়ে আলোকের পথে।
অঞ্জনার জীবনে আলো এসেছিল অনেক দেরিতে। একসময় সে ভেবেছিল, তার পৃথিবীটা বুঝি চিরকালের জন্য অন্ধকার হয়ে গেছে। শুভ্রের মৃত্যু তার কাছে ছিল এক ঝড়, যার সবটুকু কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। এতদিন সে শুধুই বেঁচে ছিল, কিন্তু বাঁচার মানেটা বুঝতে পারছিল না। প্রতিটা দিন ছিল আগের দিনের পুনরাবৃত্তি – শূন্যতা আর হাহাকার।
কিন্তু জীবন বড় অদ্ভুত। যখন মনে হয় আর কিছু পাওয়ার নেই, তখনই সে তার হাত বাড়িয়ে দেয়। অঞ্জনার জীবনে সেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল রঞ্জন। প্রথমদিকে অঞ্জনা রঞ্জনের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলতে চেয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, শুভ্রের স্মৃতিকে সে কোনওভাবেই ম্লান হতে দিতে চায় না। কিন্তু রঞ্জনের মধ্যে ছিল এক অন্যরকম টান। তার শান্ত স্বভাব, তার সহমর্মিতা, আর সেই অটুট বিশ্বাস যে জীবন থেমে থাকে না – এই সবকিছু ধীরে ধীরে অঞ্জনার বরফ ঢাকা হৃদয়টাকে গলিয়ে দিচ্ছিল।
অঞ্জনা আবার হাসতে শিখলো। সেই হাসিটা আগের মতো উচ্ছল ছিল না, কিন্তু তাতে ছিল এক নতুন সারল্য, এক নতুন আশা। সে বুঝতে পারলো, শুভ্র তার জীবনের একটা অংশ ছিল, সে ছিল তার প্রথম প্রেম, তার প্রথম ভালোবাসা। কিন্তু সে তার পুরো জীবনটা ছিল না। জীবনের মানেটা আরও অনেক বড়, আরও অনেক বিস্তৃত।
রঞ্জন তার জীবনে এসেছে নতুন আলো নিয়ে। সে অঞ্জনার জীবনের অন্ধকার কোণগুলোতে আলো ফেলেছে, সেখানে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনেছে। অঞ্জনা জানে, শুভ্র সবসময় তার হৃদয়ে থাকবে, তার স্মৃতিগুলো থাকবে অমলিন। কিন্তু রঞ্জনের সাথে সে নতুন করে বাঁচতে শিখছে। রঞ্জনই তাকে শিখিয়েছিল জীবনের মানে। সে বলেছিল, "জীবন একটাই, অঞ্জনা। একে ধরে রাখতে হয়, এর প্রতিটি মুহূর্তকে ভালোবাসতে হয়। প্রিয়জনদের হারিয়েও তাদের স্মৃতিকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, কারণ তারাই আমাদের শক্তি হয়ে বাঁচে।"
রঞ্জনের কথায় ছিল গভীর প্রজ্ঞা। অঞ্জনা সেই প্রজ্ঞাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করলো। সে বুঝতে পারলো, শোক কাটানো মানে প্রিয়জনকে ভুলে যাওয়া নয়, বরং তাদের ভালোবাসা আর স্মৃতিকে পাথেয় করে নতুন পথে চলা। রঞ্জন ছিল তার জীবনে সেই নতুন পথের দিশারী, আর অঞ্জনা ছিল সেই পথের প্রতিধ্বনি।
আজ অঞ্জনা আবার হাসতে শিখেছে, বাঁচতে শিখেছে। তার জীবনে এখন কেবল শূন্যতা নেই, আছে রঞ্জনের ভালোবাসা, আছে নতুন দিনের স্বপ্ন। সে জানে, শুভ্র তার হৃদয়ে থাকবে, কিন্তু জীবন তাকে ডাকছে – বাঁচতে, ভালোবাসতে, এগিয়ে যেতে। আর অঞ্জনা সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছে।
