Sayandipa সায়নদীপা

Fantasy Children Stories

4  

Sayandipa সায়নদীপা

Fantasy Children Stories

রাক্ষুসে বোয়াল

রাক্ষুসে বোয়াল

7 mins
1.1K


-খটকাই… এই খটকাই কোথায় তুই?

-এই যে… আমি এখানে…

-কই দেখতে পাচ্ছিনা তো, কোথায় রে?

-ওপরের দিকে তাকা।

-সর্বনাশ! সন্ধ্যে নামতে চললো আর এখনও তুই বুড়োবটে চড়ে ঘুমোচ্ছিস!

-উফফ বড়দের মতো কথা না বলে জলদি বলতো কি বলতে এসেছিলিস।

-আরে শোননা কাল আমি, নোনতা আর ফটকে ঠিক করেছি পিকনিক করবো দনাইয়ের পাড়ে। তুই আর পটকাই কি যাবি আমাদের সঙ্গে?

-পিকনিক! হ্যাঁ হ্যাঁ যাবো যাবো নিশ্চয় যাবো। 

-তাহলে কাল সময় মতো দনাইয়ের ধারে পৌঁছে যাস তোরা। 

পটকাই তো যাবে বলে মনে হয়না তবে আমি নিশ্চয় যাবো।


                  ★★★★★


আম, জাম, কাঁঠাল, বট, অশ্বত্থ, পলাশ, শিমুল সহ আরও কত রকমের ছোটবড় গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা ছবির মত শান্ত গ্রাম দনাই। গ্রামের পাশ দিয়েই কুলকুল করে বয়ে চলেছে দনাই খাল। এই দনাইয়ের তিন বিখ্যাত দুস্টু হলো নোনতা, ফটকে আর বল্টু। দুস্টুমিতে ওদের জুড়ি মেলা ভার, তবে পড়াশুনোতেও ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনা কেউ, কখনও নোনতা পরীক্ষায় সব চাইতে বেশি নম্বর পায় তো কখনও বল্টু আবার কখনও ফটকে। কিন্তু বছর খানেক আগেও পরিস্থিতি এমনটা ছিলো না। ইস্কুলের খাতায় তিনজনের নাম লেখা ছিল ঠিকই কিন্তু ইস্কুলে টিকিও দেখা যেত না তিনজনের। তার চেয়ে বরং ইস্কুলের সময় কেউ যদি বুড়ো বটতলার মাঠ দিয়ে যেত তখন দেখতে পেত এই তিনজন মহা আনন্দে খেলা করতে ব্যস্ত সেখানে। তো এহেন তিনজনের আচমকা পরিবর্তনে মাস্টারমশাই থেকে শুরু করে বাড়ির লোকও হতবাক। নোনতারা তবু কাউকে কিচ্ছুটি বলে না, সবাইকে অবাক হতে দেখে মুখ টিপে টিপে হাসে শুধু। সেই যে যেবার বুড়ো বটতলার মাঠ দখল নিয়েছিল দুষ্ট জটাধর তান্ত্রিক, সেবারেই তো জটাধরকে শায়েস্তা করতে গিয়ে ওদের আলাপ হয় দুই যমজ ভুতুম ছানা খটকাই আর পটকাইয়ের সঙ্গে। খটকাই একটু দুস্টু, ওই নোনতাদেরই মত আর পটকাই হল ততোধিক শান্ত শিষ্ট। সেবার দুষ্ট জটাধর তান্ত্রিককে গ্রাম থেকে তাড়ানোয় খুব সাহায্য করেছিল খটকাই আর পটকাই আর সেজন্যই তো পটকাইকে নোনতারা প্রমিস করেছিল এবার থেকে দুস্টুমির সঙ্গে সঙ্গে পড়াশুনোতেও তাক লাগিয়ে দেবে সবাইকে। কথা রেখেছে ওরা।


        ★★★★★


সক্কাল সক্কাল দনাইয়ের ধারে পৌঁছে খটকাই দেখলো ও আসার আগেই তিনটে ছোটোছোটো ব্যাগ হাতে এসে উপস্থিত নোনতা, বল্টু, ফটকে তিনজনেই। ফটকে তো আবার ছায়া দেখে একখানা শতরঞ্চিও পেতে ফেলেছে। খটকাইকে দেখেই ওরা হৈহৈ করে এগিয়ে এলো। বল্টু বললো, “আহা শীতকালে অন্তঃত একদিন পিকনিক না করলে চলে নাকি!”

“ঠিক ঠিক” সায় দিলো ফটকে।

“ইয়েইয়ে…” আনন্দে গোল হয়ে এক পাক ঘুরে নিলো তিনজন। ওরা থামতেই খটকাই এবার মহোৎসাহে জিজ্ঞেস করে উঠল, “কই কই দেখি কি কি খাবার এনেছিস।”

“খাবার! এখনই!” অবাক হল নোনতা।

খটকাই বলল, “কেন পিকনিক তো খাওয়াদাওয়ার জন্যই হয়, তার আবার এখন কি আর তখন কি!”

“হাঃ হাঃ তোকে কে বলেছে রে খটকাই পিকনিক শুধু খাওয়াদাওয়ার জন্যই হয়? আরে বাবা নাচাগানা খেলাধুলা কত কি হয় পিকনিকে…” কাঁধটা নাচিয়ে বলল বল্টু।

বল্টুর কথায় বেশ হতাশ হল খটকাই। ব্যাজার মুখে সে বলল, “ধুরর… খেলাধুলা তো রোজই করি।” 

“আরে বাবা রোজ আর আজকের মধ্যে অনেক পার্থক্য রে, দেখতে থাক শুধু।” খটকাইকে খানিক শান্ত করার চেষ্টা করল নোনতা কিন্তু তাও খটকাই শান্ত হতে পারলো কই! 


কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ডাঙ্গুলি খেলা শুরু করল, ডাঙ্গুলি খেলা শেষ হতেই আবার শুরু হলো দনাইয়ের জলে পাথর ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা; কার পাথর জলে কত বড় তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে এই নিয়ে খেলা। হাতের কাছে পাথর থেকে শুরু করে যা পাওয়া যাচ্ছিল তাই ছুঁড়ে ছুঁড়ে চলছিল প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই খেলায় তো খটকাইকে হারানো মুশকিল তাই অচিরেই রনে ভঙ্গ দিলো নোনতারা। ফটকে বলল, “ধুরর খটকাই এর সঙ্গে এঁটে ওঠাই যাচ্ছেনা। তার চেয়ে চল বরং এবার নাচানাচি হোক খানিক।” এই বলে ফটকে ওর কাকার কাছ থেকে চেয়ে আনা ছোটো মোবাইলটায় গান চালিয়ে দিল, গানের তালে শুরু হল নাচ। এতক্ষণে খটকাইয়ের ব্যাজার মুখটায় খানিক হলেও হাসি ফিরে এলো, নাচতে সে বরাবরই ভালোবাসে, তার ওপর এমন ধীনচ্যাক গান চালিয়েছে ফটকে যে খটকাইকে আর পায় কে! সে এমন ধুলো উড়িয়ে নাচতে শুরু করল যে তার চোটে নোনতারা হেঁচে কেশে একসা। বেগতিক দেখে ফটকে ফট করে বন্ধ করে দিলো গানটা। গান বন্ধ হলেও খটকাইয়ের নাচ বন্ধ হতে লাগলো আরও খানিক্ষণ। নাচ থামিয়ে খটকাই জিজ্ঞেস করল, “গান বন্ধ করলি কেন?”

আমতা আমতা করে ফটকে জবাব দিলো, “আসলে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে তাই।”

“খাওয়া?” খাওয়া দাওয়ার নাম শোনা মাত্রই আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল খটকাইয়ের মুখ।


এরপর একে একে ব্যাগ থেকে খাবার বের করতে লাগলো নোনতারা। কিন্তু একি! এ যে শুধু মুড়ি, শসা, পেঁয়াজ, গাজর, লঙ্কা, টমেটো, ধনেপাতা, আলু সেদ্ধ, চানাচুর, আচার তেল আর খান কতক কতবেল! বড় বড় চোখে খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে খটকাই বলল, “এগুলো কি?”

“খা...বার… উফফ টেস্টি টেস্টি…” জিভ দিয়ে চকচক করে আওয়াজ করল নোনতা।

“যা জম্পেশ করে মুড়ি মেখে খাবো না…!”

আর তারপর কয়েতবেল মাখা...! উফফ…” লোভের চোটে জিভ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বল্টুর মুখ থেকে। 

“কিন্তু আমি কি খাবো! মাছ কই?” কেঁদে ফেলল খটকাই।

“একটা দিন মাছ না খেলে কি হয়ে যাবে! তুই মশলা মুড়ি আর কয়েতবেল খেয়েই দেখ না একবার...উফফ…” আবার জিভ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল নোনতার।

“আরে তোরা বুঝিস না কেন! আমি কি তোদের মত মানুষ যে এসব খাবো? আমি তো ভুত আর ভূতেরা আমিষ ছাড়া কিছু খায় না যে।” ধপ করে ধুলোয় বসে পড়ল খটকাই। নোনতাদেরও হাত পড়ল মাথায়।

“এখন তাহলে কি হবে!” দুঃখী দুঃখী মুখে বলে উঠল ফটকে। পিকনিকে আসার আনন্দের চোটে এসব কথা তো মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের।


কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পরেই নোনতা বলে উঠলো, “আইডিয়া। খটকাই তুই পারবিনা দনাই থেকে মাছ ধরে নিতে?” 

“আরে এটা তো তুই দারুণ বলেছিস।” আনন্দে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো খটকাই, “দনাই এর বোয়াল মাছ তো আমার সবসময় প্রিয়…” কথাটা বলতে বলতেই এক্কেবারে একলাফে দনাইয়ের কিনারে পৌঁছে গেল সে। তারপর লম্বা করে হাতটা ডুবিয়ে দিলো জলে। খানিকক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পরেই আচমকা চিৎকার করে উঠল খটকাই, “ওরে বাবা রে … গেলুম রে ...গেলুম রে…”

ওর চিৎকারে মুড়ি মাখতে মাখতে চমকে উঠল নোনতারা। “কিরে কি হল?” জিজ্ঞেস করল নোনতা।

“ওরে আমার আঙুলে কে যেন কামড়ে দিয়েছে!” 

“ধুরর ভুতের আঙুলে আবার কেউ কামড়াতে পারে নাকি!” অবাক হয়ে বলল ফটকে।

ফটকেকে কোনো জবাব না দিয়ে তৎক্ষণাৎ এক ঝটকায় হাতটা জল থেকে তুলল খটকাই, আর তাতেই যা দৃশ্য দেখলো ওরা তাতে শুধু নোনতারা কেন খটকাইয়েরও অজ্ঞান হওয়ার জোগাড় হল। ওরা দেখলো একটা অস্বাভাবিক রকমের বড় বোয়াল মাছ কামড়ে ধরে আছে খটকাইয়ের আঙ্গুল। খটকাই সমানে চিৎকার করতে করতে হাত নেড়ে যাচ্ছে কিন্তু তাতেও কিছুতেই আঙ্গুলটা ছাড়ছে না সেই রাক্ষুসে বোয়াল।

“ওরে বাবা এতো বড় বোয়াল মাছ!” ভয়ে ভয়ে বলে উঠল বল্টু।

নোনতা বল্টুর হাতটা চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “সেই তো দেখছি রে!”

খটকাই যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠল, “ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও…”

আর আশ্চর্যজনক ভাবে মাছটাও পরিষ্কার গলায় বলে উঠল, “ছাড়লে তো চলবে না বাপু, তোমরা বড় দুস্টু।”

“দুস্টু! আমরা আবার কি করলাম?” অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল নোনতা।

“করোনি? এই একটু আগেই তো পাথরসহ আর যা যা নোংরা পাচ্ছিলে সামনে জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিলে। জানোনা ওতে কত কষ্ট হয় আমাদের? 

আবার একটু পরেই তো খাওয়া দাওয়া হলে এইসব কাগজপত্র প্লাস্টিক গুলো ফেলবে এই জলে। তোমরা ভুলে যাও আমরা এখানে থাকি, আমাদের কষ্ট হয় এসবে।”

“সত্যিই আমরা বুঝতে পারিনি বোয়াল মশাই যে এতে আপনাদের কষ্ট হবে।” বলল নোনতা।

“সে তোমরা কখনোই বুঝতে পারোনা। জানো দিনকতক আগে পিকনিক করতে আসা একদলের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক ভুল করে গিলে ফেলেই আমি অক্কা গেছি।”

“ওরে বাবা তারমানে তুমি ভূত…!” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ফটকে।

“মাছ ভুত! এমন তো জন্মে শুনিনি!” বলে উঠল বল্টু। আর তাতেই আরও ক্ষেপে উঠল মাছটা,

“তা আর শুনবে কেন বাপু তোমরা মানুষরা তো ভাবো মানুষরাই এই জগতের সব, জগতের শ্রেষ্ঠ জীব আর বাকি প্রাণীরা যেন কিচ্ছু নয়। তোমরা যেমন করে খুশি পারো অত্যাচার করো তাদের। ডাঙ্গায় থাকে যারা সেই কুকুর বিড়ালদের ইচ্ছে মত পিটিয়ে মারো কখনো, আবার জল নোংরা করে আমরা যারা জলে থাকি তাদেরকে মেরে ফেলছো। এ কেমন তর শ্রেষ্ঠ জীব হে তোমরা?”

বোয়াল মাছের কথায় মাথা নামিয়ে নিলো ওরা তিনজনেই, কথা সরল না কারুর গলায়। সত্যিই তো আমরা মানুষরা নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবি সবসময়, কখনও তো ভেবে দেখিনা এই প্রকৃতিতে আরও প্রাণ আছে, তাদেরও ভালো করে বাঁচার অধিকার আছে। অনেকসময় তো নিছক আনন্দ পাওয়ার জন্যই আমরা তাদের কষ্ট দিয়ে বসি। বেশ খানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর হাত জোড় করে নোনতা বলল, “বোয়াল মশাই আমাদের ক্ষমা করুন, ভুল হয়ে গেছে আমাদের। কথা দিচ্ছি আর কখনও দনাইয়ের জলে নোংরা ফেলবো না। এবার দয়া করে আমাদের বন্ধুর আঙ্গুলটা ছেড়ে দিন।”

“তোমরা ছোটো, তোমরা কথা দিলে কথা রাখবে এ আমার বিশ্বাস আছে কিন্তু বড় মানুষরা…! তারা তো নোংরা করবে দনাইয়ের জল।” রাগী রাগী গলায় বলে উঠল বোয়ালটা।

“আপনি চিন্তা করবেন না বোয়াল মশাই, আমি কথা দিচ্ছি গ্রামে গিয়ে সব মানুষকে বোঝাবো যাতে তারা দনাইয়ের জল নোংরা না করে। তারা নিশ্চয় আমাদের কথা শুনবে, আপনি দেখবেন।” দৃঢ় গলায় বলল নোনতা।

“বলছো?” 

“হ্যাঁ বলছি, কথা দিচ্ছি আমরা।”

“তাহলে বিশ্বাস করলাম তোমাদের। কথাটা মনে থাকে যেন।” এই বলে খটকাইয়ের আঙ্গুলটা ছেড়ে দিয়ে ঝুপ করে জলে নেমে গেল সেই রাক্ষুসে বোয়াল। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে নোনতারা সব সার বেঁধে ছুটল গ্রামের দিকে। নাহ...অনেক হয়েছে আর নয়, আর কাউকে তারা এই বোয়াল মাছটার মত বেঘোরে প্রাণ দিতে দেবে না দনাইয়ের জলে...।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy