পাশবালিশ
পাশবালিশ
এক চিলতে প্রদীপের আলো যেমন নিকষ কালো অন্ধকার দূর করে ঘর আলোতে ভরে দেয়, কিন্তু সেই প্রদীপের নীচে অন্ধকার থেকেই যায়। তেমনিই কোলকাতা শহরের ঝা... চকচকে চোখ ধাঁধানো আলোর নীচে অন্ধকার আছে। আর কোলকাতার বুকে সেই অন্ধকার ঘুপচি গলির নাম ট্যাংরা বস্তি। এখানে এক সাথে অনেক মানুষের বসবাস কিন্তু তারা প্রত্যেক দিনের জীবন সংগ্রামে পরিপূর্ন। তাদের সমম্ত কিছু লড়াই করে আদায় করে নিতে হয়। তাদের জীবনের প্রত্যেক দিনের প্রত্যেক মুহুর্ত চালিয়ে যেতে হয় যুদ্ধ, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ।
আর এই যুদ্ধের একজন খুদে সদস্য হল ভোলা। বয়স খুব জোড় চার থেকে পাঁচের কাছাকাছি। ভোলা মায়ের সাথে সবসময় লেগে থাকে কাজে। যেটুকু পারে ওর ঐ... দুটো ছোট ছোট হাত দিয়ে করার চেষ্টা করে। ভোলাকে এই বস্তির মোটামুটি সবাই ভালোবাসে আর এই ভালোবাসার প্রধান কারন হলো, ভোলার টুকটকে গায়ের রং, মোটামোটা চোখ আর নাদুসনুদুস চেহারা, আর মিষ্টি মিষ্টি বুলি।
ভোলা তখনও ওর মায়ের পেটে এই পৃথিবীর সুন্দর আলো দুচোখ মেলে দেখেনি, তখনই ওর বাবা ওর মাকে ছেড়ে অন্য কারোর সাথে দূরে কোন শহরে চলে যায়। ভোলা জন্মের পর থেকে কোনদিনও বাবাকে দেখেনি তবে এই বস্তির ক্লাবের মেম্বার কালু সর্দার মাঝে মাঝে ভোলাদের বাড়ি যায়, আর ভোলাকে তখন পাশের ঘরের কাকিমা কোলে করে নিয়ে যায়। কালু সর্দার মাঝে মাঝে ভালো ভালো খাবার দাবার নিয়ে আসে ওদের জন্য।
প্রত্যেক মাসের শেষ সপ্তাহে এন.. জিও... থেকে একটা ট্রাক আসে ট্যাংরা বস্তির সামনে। আর সেই ট্রাকে করে কখনও পুরনো জামা কাপড়, কখনও শীতের পোষাক, আবার কখনও কম্বল, চাদর, বিছানা, বালিশ এইসবও আসে। আর ট্রাকের ডালা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে একেবারে হুটোপুটি লেগে যায়, যে... যেরকম পারে নিজের পছন্দ মত জিনিষ বেছে নিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যায়।
আর এইবার ট্রাক আসার সাথে সাথে বস্তির সবার সাথে ভোলাও ওখানে হাজির হয়, আর সবার সবকিছু পছন্দ করে নিয়ে যাবার পর ট্রাকের মধ্যে পড়ে থাকে শুধু একটা পাশবালিশ। ভোলা ওটা পেয়েই যেন খুব খুশি হয়ে যায়, নিজের ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল নিজেদের ঘরের দিকে।আর সবাই ভোলার কান্ড দেখে হাসতে লাগল কারন ভোলার থেকে ভোলার পাশবালিশ বড়। ঘরের কাছে এসে ভোলা মাকে ডাকতে থাকে
---------মা... ওমা.... দেখ, কিইই.... এনেচি!
-----------ভোলার মা ছেলের গলা শুনে বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখে, ভোলা পাশবালিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভোলার মা.... ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলে ওঠে, এটা দিয়ে কি.... হবে?
----------ভোলা বলে ওঠে কেনে...মা... আরাম করে শোবো! দেখ কেনে কি.... নরম!
ছেলের কথা শুনে ভোলার মা হাসতে হাসতে ভোলা আর ওর আনা পাশবালিশ নিয়ে ঘরের ভীতরে ঢুকল।
কালের নিয়মে প্রকৃতির বুকে রাত নেমে এল। আর ঘরের এক কোনে ভাঙ্গা চৌকির ওপরে পাতা ছেঁড়া তোষকের বিছানায়, মাথায় শক্ত বালিশ আর পায়ে সাধের পাশবালিশে দিয়ে ভোলা শান্তিতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিল। আর ভোলার চোখে পাতায় হয়তো নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন ভীড় করে এল।
