Indrani Bhattacharyya

Children Stories Comedy Drama

4.8  

Indrani Bhattacharyya

Children Stories Comedy Drama

পালোয়ানের গল্প

পালোয়ানের গল্প

5 mins
346


হ্যাঁ গো ,হ্যাঁ। আমাদের পাড়াতেই থাকেন সেই ভুবন খ্যাত ষষ্ঠী চরণ। মানে অন্তত গত পরশু অব্দি তো তেমনটাই ছিলেন। হাতি এখন আর তিনি যখন তখন লুফতে পারেন না বটে। হাতি আর জায়গা দুয়েরই অভাব কিনা। তবে তাকে ইদানিং নতুন এক সখে পেয়েছে, গলা সাধার সখ। গুরু আবার সেই ভীষ্মলোচন শর্মা। ফলে আমাদের কারুর বাড়িতেই এখন আত্মীয় স্বজন, চোর ডাকাত মায়ে কাক চিল অব্দি আসে না। সে যদিওএকদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। মাগ্গিগন্ডার বাজারে বাজে খরচ যত কমে ততই ভালো। তবে মাঝে মাঝে দামোদর শেঠ আসেন পালোয়ানের বাড়িতে।তিনি নাকি কি যেন ভীষন রকমের আত্মীয় হন পালোয়ানের।

এ হেন নিরুপদ্রব শান্তিপূর্ণ তারকাশোভিত বেনিয়াটোলা লেনে কিনা শেষ কালে এমন ঝামেলা বাঁধলো! একি ভদ্দরলোকের গায়ে সহ্যি হয়!

ব্যপারটা আরেকটু খুলেই বলি তবে। গেলো হপ্তায় রবিবার দামোদর শেঠ নাকি এসেছিলেন ষষ্ঠী চরণের বাড়ি। এমনিই গল্পগুজব করতে। কাজ কারবার না থাকলে তিনি এমন মাঝে মধ্যেই আসেন। কলকাতা শহরে ষষ্ঠী চরণের মত আপন বন্ধু তার আর কে আছে?

ষষ্ঠী চরণ প্রতিবারের মত বন্ধুকে দেখেই দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে নিয়ে বসেছিলেন। এদিকে তার খাস লোক বিশ্বনাথ ছোটাছুটি করে জলখাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল সকাল সকাল। সেকি আর এমনি সেমনি ব্যপার। যাকে বলে রীতিমত এলাহী খানা পিনা । বিশ্বনাথ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ লোক। যদিও তারও বয়স হল ঢের। তবু যত্ন করে দুজনের জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আসলেন পাঁচ ধামা পেস্তা মেওয়া, কুড়ি হাঁড়ি দই আর মুড়কি আর সেই সাথে দশ ঝুড়ি মুড়কির মোয়া। দামোদর শেঠ তো আয়োজনের বহর দেখে বেজায় খুশি । দেরি না করে শুরু করে দিল খাওয়া দাওয়া। ষষ্ঠী চরণ তখন দাবা খেলায় খানিক মগ্ন। অতঃপর ঘোড়াকে মন্ত্রীর সামনে আড়াই ঘর এগিয়ে রাজাকে গজ দিয়ে কিস্তি দিয়ে ষষ্ঠী চরণ খুশি মনে যেই না হাত বাড়িয়েছে দই মুড়কির দিকে ওমনি নাভি থেকে একটা বিরাট ঢেঁকুর সারা শরীর কাঁপিয়ে গলা দিয়ে উঠে এলো তার। নিজের ঢেঁকুরের শব্দে নিজেই চমকে উঠলেন বেশ। দামোদর শেঠ তো দেখেশুনে বেশ হাসতে লাগলো। এদিকে দেওয়াল বেয়ে একটা টিকটিকি উঠছিল। সে দেওয়াল থেকে খসে পড়ে গেল। আমার দাদু সবে খেতে বসেছিলেন। তার চারটে বাঁধানো দাঁত আপনা থেকেই খুলে পড়লো থালায়, সামনের দাওয়ায় নকুর বাবু ঝিমোচ্ছিলেন। তিনি হঠাৎ সেই শব্দে বাপরে মারে বলে চিৎকার করে উঠলেন। ষষ্ঠী চরণের বাড়ির কার্নিশে একটা ঘুঘু পাখির বাসায় দুটো ডিম ছিল। সেই দুটোই ফেটে গিয়ে ছানারা বেরিয়ে পুটপুটে চোখে চাইতে লাগলো চারপাশ। রাস্তায় দুটো কুকুর খুব ঝগড়া করছিল। তারা ঢেঁকুরের শব্দে একদম চুপ করে লেজ গুটিয়ে বসে পড়লো।

ষষ্ঠী পালোয়ান এবার নিজেকে সামলে আবার হাত বাড়ালেন খাবারের দিকে । কিন্তু এবারও খাওয়া হল না তার । পেটের ভেতর থেকে যেন গুড়ুম গুড়ুম শব্দে মেঘ ডাকতে লাগল। ষষ্ঠী কিছুক্ষণ মুড়কি নিয়ে নাড়াচাড়া করে ধুত্তর বলে উঠে পড়লেন। তারপর কষে খানিক ডন বৈঠক দিলেন। খানিকক্ষণ ডাম্বেল ঘোরালেন। আর খানিকক্ষণ কপালভাতি করলেন। তারপর খেতে বসলেন গুছিয়ে। কিন্তু এবার আরো অদ্ভুত ব্যপার হল। এত খাবার দেখে ষষ্ঠীর খাওয়ার ইচ্ছেটাই কেমন যেন দমে গেল। উল্টে দইয়ের গন্ধে তার গা গুলিয়ে বমি আস্তে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে পড়লেন। তালগাছের মত বিশাল বপুখানা চিৎপটাং হয়ে আছরে পড়লো পালঙ্কের ওপর। দামোদর শেঠ আর বিশ্বনাথও ঘাবড়ে গেলেন সব দেখেশুনে।

ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল আমরা তখন ক্লাবে ক্যারম খেলছিলাম। বিশ্বনাথ দাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখেই বুঝেছিলাম ষষ্ঠী দার বাড়িতে কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়ই। সব শুনে আমরা বিশ্বনাথ দাকে নিয়ে প্রথমে গেলাম গোপেশ বর্মণের বাড়ি।


পাড়ার উঠতি ডাক্তার গোপেশ বর্মন নাকে চশমা আর কানে স্টেথো এঁটে ষষ্ঠীদার ভুড়ি বাজিয়ে বিস্তর উপদেশ দিয়ে গেলো। যেমন তাকে নাকি খাওয়া কমাতে হবে,আরো বেশি পরিশ্রম করতে হবে , চিরতার জল খেতে হবে, হেলেঞ্চা শাক খেতে হবে, মিষ্টি খাওয়া ছাড়তে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব অলক্ষুণে কথা ষষ্ঠী দার শোনাও পাপ। তাই বিশ্বনাথ দা তার বাবুর কানে লেপ চাপা দিয়ে রইল, যতক্ষণ ওই ছোকরা ডাক্তার কথাগুলো বলল। তারপর ডাক্তার চলে যেতেই ষষ্ঠী দা হুংকার ছাড়লো - "বিশে, তুই অমন করছিস কেনো? ওই গাড়লটা কি বলে গেলো রে?" বিশ্বনাথ দা মিনমিন করে বললো - "আজ্ঞে কত্তা, ডাক্তার বলল আপনার নাকি খিদে চুরি গিয়েছে। চোরকে একবার ধরতি পারলেই আবার সব আগের মত হয়ে যাবে"। ষষ্ঠী দা ফের বলল -" কার এত বড় দুঃসাহস আমার খিদে চুরি করে! দেখছি ব্যাটাদের।"

বিশ্বনাথ দা তখনকার মত তার মনিবকে সামলালেও আসল সমস্যা মিটলো না কিছুতেই। আমরা সকলে মিলে অনেক চেষ্টা চরিত্তির করলেও কিছুতেই খিদে ফেরত এলো না ষষ্ঠীর। ব্যপারটা ভালো ঠেকলো না আমাদের। ষষ্ঠী চরণ আমাদের পাড়ার গর্ব। তার এমন বেহাল দশা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। এমন সময় আবার একদিন দামোদর শেঠ এলেন বন্ধুর খোঁজ খবর করতে। দেখেশুনে বললেন - " ভাবছি ষষ্ঠীকে একবার আমার দেশের বাড়ি মুরুগুমা থেকে কিছুদিনের জন্য ঘুরিয়ে নিয়ে আসব। তাতে কিছু লাভ হলেও হতে পারে।" হাওয়া বদলের এমন প্রস্তাব মনে ধরল ষষ্ঠী দারও। একদিন তারপর পাড়ার সকলে মিলে ষষ্ঠী ডাকে তুলে দিলাম পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে।

সেখানে গিয়ে ষষ্ঠী চরণ কিছুদিনের মধ্যেই তার খিদে ফেরত পেলো। কি করে? ব্যপারটা কিছুই নয়। পালোয়ানের যা কাজ সেটাই সে দীর্ঘদিন বাদে সেখানে করার সুযোগ পেয়েছিল। অর্থাৎ কিনা পালোয়ানি। পুকুরের মাছ, গাছের টাটকা শাক সবজি, খাটি গরুর দুধ, এসব খেয়ে তাগদ ও হয়েছিল খাসা। সেখানেই সে এত জায়গা জমি পেয়ে মনের আনন্দে কুস্তির আখরা খুলে বসলো। গাঁয়ে এই বিদ্যে শেখার জন্য ছাত্রও তেমন মন্দ হলো না। তাদের তিনি রোজ গায়ে মাটি মেখে মুগুর ভাজান, প্যাঁচ পয়জার শেখান। শহরে এসব সুখ তার বহুকাল আগেই গত হয়েছিল। একে তো জায়গার অভাব তায় ছেলেদের মধ্যে কুস্তির চাহিদাও কম। তাই আখরায় যাওয়া একসময় ছেড়েই দিয়েছিল প্রায়। ফলে বসে বসে রাতদিন এত এত খাবার খেয়ে গায়ে গতরে বাত ধরে গিয়েছিল। সেই সাথে খাবার দাবারে দিনের পর দিন ভেজালের পরিমানও বাড়ছিল। ফলে একটা সময় স্বাভাবিক ভাবেই অরুচি আসে রসনায়। তারই ফল এই ক্ষুধামান্দ্য।


আমাদের যদিও বেনিয়াটোলা লেনে সকলেরই খুব মন খারাপ।আমরা পাড়ার কয়েকজন মিলে গত পরশুই গিয়েছিলাম মুরুগুমায়, ঘরের ছেলেকে আবার ঘরে ফিরিয়ে আনবো বলে। সেখানে ষষ্ঠী দার পাড়াতুত ভাই হিসেবে ভালই খাতির যত্ন পেলাম। কিন্তু ষষ্ঠী দা গ্রামের বাড়ি, আখড়া ছেড়ে আসতে রাজি হল না কোনো মতেই। অগত্যা খালি হাতেই ফিরতে হল আমাদের। সুকুমার রায় মহাশয়ের সঙ্গে দেখা হলে মনে করে বলতে হবে ব্যপারটা। আবোল তাবোল এর পরবর্তী সংকলনে পালোয়ানের বাড়ির ঠিকানাটা ঠিক করে বেনিয়াটোলার বদলে লিখে দিতে হবে মুরাগুমা।


Rate this content
Log in