নীলিমা
নীলিমা


ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এতো জোরে যে মনে হচ্ছে যে আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। প্রলয় শুরু হল বলে। প্রতি রাতের মতো গাড়ি নিয়ে টহল দিতে বেরিয়েছে বরুণ আর দুজন কনস্টেবল গোবিন্দ আর রাকেশ। মহাত্মা গান্ধী রোড পেরিয়ে গাড়ি তখন একটা গলির দিকে ঘুরেছে। এদিকটা বড়লোকদের পাড়া রাস্তার দু পাড়েই বড় বড় বাড়ি কিন্তু রাস্তা শুনশানই থাকে সারাদিন, সন্ধ্যের পর সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে যে কোন লোকের গা ছমছম করবে। বরুণ জানে এইসব রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যেই এমন সব লোক যাতায়াত করে যারা সুস্থ জীবন যাপন করে না। কিছুদিন আগে এইরকম এক পাড়াতেই এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক মহিলা খুন হয়ে গেছেন। কপাল ভালো যে সেই কেস সমাধান করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। ওপর থেকে বলাই আছে সব অলিগলি দিয়েই একবার করে টহল দিতে।
বৃষ্টির জলে ঝাপসা কাচ দিয়ে দেখতে দেখতে বরুণ কিছু ভাবছিল। বরুণ ভাবনায় ডুবে ছিল বলে গাড়ি হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে ও সামনের দিকে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ভাগ্যিস সামলে নিয়েছিল নাহলে কপালটা ঠুকে যেতো। ও রেগে ড্রাইভার চঞ্চলকে ধমকাতে যাচ্ছিলো কিন্তু চঞ্চলের পরের কথাটায় ওর কথা আটকে গেলো। “স্যার সামনে তাকিয়ে দেখুন কে একজন রাস্তার মাঝামাঝি পড়ে আছে। দেখে তো সুবিধার মনে হচ্ছে না”
বরুণ গাড়ি থেকে নেমে এলো তারপর তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গিয়ে দেখলো এক মহিলা পড়ে আছে উপুড় হয়ে। মহিলার পরনে দামী নীল রঙের হাউসকোট। সবথেকে চমকানোর ব্যাপারটা হল মহিলার থেকে একটু দুরেই একটা ছুরি পড়ে আছে। মহিলা কি ছুরিতে আহত না নিহত? আশঙ্কায় বরুণ ওকে উল্টে দিলো। উল্টে দিতেই চেহারার আভিজাত্য আগে চোখে পড়লো ওর। না, মহিলার গায়ে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। হাতে পায়েও নেই, যার মানে উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন। তাহলে ছুরি এলো কোথা থেকে? আর মহিলার পরনে যখন হাউসকোট তাহলে উনি আসেপাশের বাড়িতেই থাকেন বলে মনে হয়। কথাটা চিন্তা করতে করতেই ও গোবিন্দ আর রাকেশকে বলল “তোমরা দুজনে দুদিকের বাড়ি পরীক্ষা করো। মনে হচ্ছে এইসব বাড়ির কোনটায় এই মহিলা থাকেন”
ওরা চলে যেতেই ও মহিলাকে ভালো করে দেখলো। উনি দেখতে এক কথায় ডানাকাটা পরী রং দুধে আলতা। এরকম চেহারা এইরকম বড় বাড়ির সাথেই মানায়। এসব ভাবনার মধ্যেই রাকেশ দৌড়ে এলো। ও মহিলার পায়ের দিকের একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল “স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে। ওই বাড়ির ভদ্রলোক খুন হয়ে গেছেন আর একটা বাচ্চা মেয়েও ঘরে পড়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে ও বেঁচে নেই”
বরুণ লাফিয়ে উঠলো “সে কি! চলো গিয়ে দেখি কিন্তু তার আগে তো একটা কাজ করতে হবে। মহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে” বলেই ও ফোন ডায়েল করতে গেলো কিন্তু বৃষ্টির কারণে কানেকশন পাওয়াই গেলো না। এর মধ্যে গোবিন্দও ফিরে এসেছে। তখন ও ড্রাইভার চঞ্চল আর গোবিন্দকে বলল “এনাকে গাড়িতে তুলে দিচ্ছি। তোমরা এঁকে এখনি হাসপাতালে ভর্তি করো” তারপর মহিলাকে পাঁজাকোলা করে তুলে গাড়ির পেছন সীটে শুইয়ে দিলো ও। গাড়ি চলে যেতেই ও আর রাকেশ দৌড়ালো ওই বাড়ির দিকে। দরজার ওপরেই নাম লেখা ডা আশিস দত্ত। ভেতরে ঢুকেই দেখলো ঘরের আলো জ্বালানো। ও জিজ্ঞেস করলো “দরজা কি খোলা ছিল? আলো জ্বালা ছিলো?”
রাকেশ বলল “না স্যার। দরজা ভেজানো ছিল। আমি হাত দিতেই খুলে যাওয়াতে পা টিপে ভেতরে ঢুকি তারপর আলো জ্বালি। সামনের ঘরে কাউকে না পেয়ে ভেতর ঘরে পা দিতে দেখি এই কাণ্ড”
কথা বলতে বলতে ওরা ভেতর ঘরে এলো। পুরুষটি বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল। ওপরের অঙ্গে কাপড় থাকলেও নীচের অঙ্গে কিছু নেই। পাশেই বাচ্চাটার নিরাবরণ শরীর পড়ে রয়েছে। এক দেখায় বরুণের মন বলল লোকটা বাচ্চাটার সাথে কিছু খারাপ করতে যাচ্ছিলো যখন খুন হয়। বরুণ হাতে গ্লাভস পড়ে বাচ্চাটার শরীরটার কাছে গিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করলো। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলো নিঃশ্বাস পড়ছে, তার মানে বেঁচে আছে। তাড়াতাড়ি পাশে পড়ে থাকা কাপড় দিয়ে ওকে মুড়ে পকেট থেকে ফোন বার করলো এ্যামবুলেন্স ডাকতে। এরপর থানায় যোগাযোগ করে ইন্সপেকটার অজয় সামন্তকে বলল আরও লোক নিয়ে আসতে। এ্যামবুলেন্স এসে পৌঁছালে বাচ্চাটাকে গাড়িতে চাপিয়ে দেওয়া হল। তারপর খেয়াল করলো পুরুষটাকে। পেছন থেকে সজোরে ধারালো কিছু সম্ভবত ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, একবার নয় বারেবারে তবে অপটু হাতে, যার মানে পেশাদার খুনি নয়। এ্যামবুলেন্স বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই ইন্সপেকটার অজয় সামন্ত দলবল নিয়ে হাজির। সব কাজ শেষ করে দেহ বের করে দিয়ে বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে সিল মেরে বরুণ চলল হাসপাতালে।
হাসপাতালে পৌঁছে সোজা ডাক্তারের ঘরে ঢুকে খবর নিলো পাঠানো দুই পেসেন্টের। মহিলার জ্ঞান ফিরেছে, বাচ্চাটা ভয়ে আতঙ্কে অজ্ঞান। ওর জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। বরুণ জিজ্ঞেস করলো “মহিলার কি হয়েছিল বলে আপনার মনে হল?”
ডাক্তারবাবু বললেন “উনি মনে হয় মানসিক আঘাত পেয়েছেন কোনভাবে। ওটাই ওর অজ্ঞান হওয়ার কারণ। আরও কিছু আছে। উনি বোধহয় ড্রাগসও নেন”
“ওনার সাথে কথা বলা যাবে?”
“হ্যাঁ তা যাবে তবে বেশি মানসিক চাপ দেবেন না যেটুকু নিজে থেকে বলে বলুক। বাকিটা সুস্থ হওয়ার পর”
“ঠিক আছে”
বরুণ মহিলাকে যে ঘরে রাখা হয়েছে সেখানে উঁকি মেরে দেখলো মহিলা জেগে শুয়ে আছেন। ও ঘরে ঢুকে বলল “নমস্কার। আমি পুলিশ অফিসার বরুণ তরফদার। এখন কেমন আছেন আপনি?”
মহিলা বলল “নমস্কার। আমার শরীর ভালো তবে মন ভালো নেই। কারণ আমার মেয়ে বোধহয় আর বেঁচে নেই”
“কি হয়েছে আপনার মেয়ের?”
“মেরে ফেলেছে, জানোয়ারটা মেরে ফেলেছে। তবে আমিও আজ জানোয়ারটাকে পালাতে দিইনি। মেরে ফেলেছি। এই হাত দিয়েই মেরে ফেলেছি কিন্তু তাতে আমার একটুও দুঃখ নেই”
বরুণ মহিলার কথা শুনে চমকে উঠলো একি পাগলের প্রলাপ নাকি কিছু সত্যতা আছে কথাটার মধ্যে। আচ্ছা যে মৃত আশিস দত্তকে মর্গে পাঠালো সেই খুনের সাথে কি এ জড়িয়ে আছে? কারণ যেভাবে রাস্তায় পড়েছিল তাতে মনে হচ্ছে যেন ওই বাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে এসে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পরে গেছে। ও বলল “আপনি আজ বিশ্রাম নিন কাল কথা হবে” মহিলা আর কিছু না বলে চোখ বুজলো। বরুণ ঘরের বাইরে দুটো কনস্টেবল রেখে গেলো পাহারায়। থানায় আরও কাজ পড়ে আছে। মৃতদেহের পোষ্টমর্টাম হওয়ার পর কি রিপোর্ট আসে দেখতে হবে। মৃতের আত্মীয়স্বজনকেও খবর দিতে হবে। তবে এতো ভাবনার মাঝে ওর মনে হয় এই মহিলার ওই মৃত পুরুষটার সাথে কোন যোগ আছে।
পরেরদিন হাসপাতালে গিয়ে দেখলো মহিলা অনেকটাই সুস্থ। ও সুপ্রভাত বলতেই উনি বললেন “আজ সত্যি সু-প্রভাত। আপদ বিদেয় হয়েছে। বসুন পুলিশবাবু আজ আপনাকে আমি কিছু জানাতে চাই আপনি প্রশ্ন করার আগেই। আমার নাম নীলিমা দত্ত। কাল নিশ্চই আশিস দত্তর বডি পেয়েছেন। আমি ওর স্ত্রী আর আমিই মেরেছি ওকে”
এই কথায় বরুণ ভীষণ রকম চমকে উঠলো। কোন আসামী এভাবে দোষ স্বীকার করে না। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে মহিলার কথা বলায় বাধা সৃষ্টি করলো না। নীলিমা বলছেন “আমি জানি আপনি কথা শুনে চমকে উঠেছেন। যে কেউ চমকাবে তবে পেছনের ইতিহাস শুনে আপনি যা ইচ্ছে ব্যবস্থা নেবেন। বিজ্ঞান শাখায় পড়ে আমি মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলাম, আশিস আমার থেকে দু বছরের সিনিয়ার। আলাপ হল প্রেম জমলো বিয়েও হয়ে গেলো তাড়াতাড়ি। কিন্তু বিয়ের পর পড়াটা আর চালিয়ে যেতে পারলাম না। আশিস বন্ধ করিয়ে দিলো। কারণ শ্বাশুড়িমা শয্যাশায়ী। তাকে দেখাশোনার লোক আছে তবে মনের কথা বলার লোক নেই। আমাকে সেই জায়গা নিতে হবে এবং হল। আশিস সারাদিন রাত কাজে ব্যস্ত। তার যখন ইচ্ছে বাড়ি ফিরতো আর ফিরতো যখন তখনই তার শারীরিক চাহিদা মেটাতে হত, কোন অসুবিধার কথা শুনত না। যে সময় ও আসতো মা যাতে আমাদের কাউকেই ডাকতে না পারে তাই মাকে ঘুমের ওষুধ দিতো একটু বেশি পরিমাণে। একদিন ঘুমের ঘোরেই শ্বাশুড়িমা মারা গেলেন। আমার পরে মনে হয়েছিল অসুধের পরিমাণ বোধহয় বেশি হয়ে গিয়েছিল। আশিসের কোন সমস্যাই হল না। এরপর আমি মা হলাম এক ফুটফুটে মেয়ের। আমার খুব আনন্দ হল। তারপর যা হয় মেয়েকে নিয়েই আমার সারাদিন রাত কেটে যেতে লাগলো। আশিসের চাহিদা সবসময় মিটতো না। ও ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারলো না। হাসপাতালে বাচ্চাদের ডাক্তার হিসেবে কাজ করতো। এবার সুযোগ বুঝে বাচ্চাদের শিকার করতে লাগলো। প্রথম প্রথম ব্যাপারটার কিছুই জানতাম না কিন্তু যেবার এক বাচ্চা রোগিণীর বাড়ির লোক ধরে ধোলাই দিলো তখন ব্যাপারটা রাষ্ট্র হয়ে গেলো। চারদিকে ছিঃ ছিৎকার। তখন যদি আমিও চলে যেতাম মেয়েকে নিয়ে তাহলে ওকে এভাবে হারাতে হত না। মেয়ে বড় হচ্ছে হায়নার চোখের সামনেই। এবার ওর ওপর কুদৃষ্টি পড়লো। আমাকে শ্বাশুড়িমায়ের মতো দুধের মধ্যে ঘুমের ওষুধ দিয়ে তারপর মেয়ের ওপর অত্যাচার চালাতো। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা এরকম হতে পারে আমি ভাবতেই পারিনি তবে মেয়েকে দিন দিন শুকিয়ে যেতে দেখে আমার সন্দেহ দৃঢ় হচ্ছিলো। কাল আর আমি ওষুধ দেওয়া দুধ খাইনি। কায়দা করে ফেলে দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তারপর যখন পিশাচটাকে দেখলাম তখন আর কিছু ভাবিনি। ফল কাটার ছুরি তুলেছি আর সোজা পিঠ লক্ষ্য করে চালিয়ে দিয়েছি। মেয়ের দিকে ছুটে গিয়েছিলাম কিন্তু শ্বাস পড়ছে না দেখে বেরিয়ে এসেছিলাম আপনাদের ডাকবো বলে কিন্তু তারপর আর কিছু মনে নেই। আমার একটাই দুঃখ আমার মুন্নিকে বাঁচাতে পারলাম না”
বরুণ এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাস গল্প শুনছিল। এবার বলল “আপনার মুন্নি বেঁচে আছে”
নীলিমা লাফিয়ে উঠলো “সত্যি বলছেন...সত্যি...আমি ওকে দেখতে পারি?”
“হ্যাঁ পারেন। তবে আপনাকে আমাদের অ্যারেস্ট করতে হবে। খুনের ঘটনা তো”
“আমার কোন আপত্তি নেই। তবে একটা প্রশ্ন করতে চাই এরকম ঘটনা আপনার পরিচিতের সাথে হলে কি করতেন বরুণবাবু। আমি একটুও দুঃখিত নই। মুন্নি বেঁচে আছে, আমি তাতেই খুশি। তবে আমার একটাই ভুল হয়েছে ওকে প্রথমেই আটকে দিতে পারলে এতোগুলো শিশুর জীবন নষ্ট করতে পারতো না। এটার জন্য আমি দুঃখিত। এরপর আপনারা যেমন বলবেন আমি করতে রাজি”
আকাশ কালো করে এখনো সমানে বৃষ্টি পড়ছে। বরুণ থানায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিল সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল আজও পড়ছে। কিন্তু দুটো দিনের মধ্যে কত পার্থক্য, ওর অভিজ্ঞতা ভাবনা চিন্তা কত বদলে দিয়েছে ওই মহিলা।