মহাভারতের অনুগল্প
মহাভারতের অনুগল্প
নল দময়ন্তীর গল্পের মতোই মহাভারতের বনপর্বে আমরা সমতুল হাজারো অনুগল্প দেখতে পাই। অর্জুন ইন্দ্রলোকে দেবতাদের সঞ্চিত অস্ত্র লাভের সাধনায়। বাকি চার ভাই দ্রৌপদীকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়েছেন তীর্থ করতে। দক্ষিণে অগ্যস্ত মুনির আশ্রম থেকে শুরু করে পর্যটন প্রায় শেষের পথে অধুনা কাশ্মীরে এসে।সংগে আছেন লোমশ মুনি।জায়গায় জায়গায় থামছেন তিনি।স্থান মাহাত্ম্য গল্পতে তুলে ধরছেন।খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন সেই গল্পগুলি ট্যুর গাইডের আজগুবি গপ্প নয় বরঞ্চ এক ভাবি রাজাকে আশু বৃহত্তর এক দায়িত্বের জন্য তৈরি করার প্রচেষ্টা - যাতে এই মহা-ভারতের বর্ন-গন্ধ- রূপ যুধিষ্টির চিনতে পারেন সমাজের রাস্তার ধুলো গায়ে মেখে। বেদ-শাস্ত্র পাঠ অনেক হলো এবার ভাবী রাজার কাজ যা শিখেছেন তার ফলিত প্রয়োগ সমাজের বিভিন্ন আধারে নিজেকে অভিযোজন করে।
কাশ্মীরী উপত্যকা অঞ্চলে এসে লোমশ মুনি যুধিষ্ঠির কে দেখালেন -ওই দেখুন ঔশীনরী শিবির।রাজা উশিনরের দান যজ্ঞ হয়েছিল ওখানে।ব্যস-এইটুকুই কাফি যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন তোলার জন্য !লোমশ মুনিকে পাণ্ডবরা জিজ্ঞেস করলেন এই উশিনরের গল্পটা যদি একটু বলেন।
লোমশ শুরু করলেন গল্পদাদুর আসর- সাথে আমিও
উশিনর রাজা র সুনাম ছিল তিনি ধার্মিক এবং সুশাসক। একদিন তাকে যাচাই করার জন্য ইন্দ্র সজল বাজপাখি আর অগ্নি হলেন একটি পায়রা। ছোট্ট পায়রা বাজপাখি র শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিল সিংহাসনে আসীন রাজার কোলে। বাজপাখি এসে বলল মহারাজ আপনি আমার মুখের খাবার এভাবে নিয়ে নিতে পারেন না।আপনি ধার্মিক মানুষ এরকম অধার্মিক কাজ কীভাবে করবেন আপনি?রাজা বললেন এই ছোট্ট পাখিটি আমার শরণাগত। তাকে ত্যাগ করা ব্রহ্ম হত্যার সমতুল্য পাপ।এবার শুরু হল বাজপাখির সাথে রাজা উশিনরের তাত্বিক লড়াই।বাজপাখি বলছে রাজা আপনি শুধু আপাত কালের ধর্মটাই দেখলেন কিন্তু এর পরিণাম দেখলেন না।আমি শিকার করে জীবজগতের ভারসাম্য বজায় রাখি।আমার এই শিকারে অন্ন মেলে আমার স্ত্রী সন্তান -এর।আপনি যে শুধু জীবজগতের ভারসাম্য অর্থাৎ food cycle র ecological balance নষ্ট করলেন তা নয় উল্টে আমার কর্তব্য থেকে বঞ্চিত করলেন আমাকে-আমি কি জবাব দেব আমার স্ত্রী পুত্রকে যখন তারা খেতে চাইবে।
খেয়াল করে দেখুন আপাত অর্থে যা ধর্ম তারই বিপ্রতীপ ব্যাখ্যা দিচ্ছে একটি বাজপাখি আর সত্যি রাজার কাছে সিলেবাসের rulebook দর্শন।ছাড়া উত্তর ও নেই। যে এক অদ্ভুত ধর্ম সংকট। এই জায়গায় বাজপাখি একটা মোক্ষম কথা বলেছেন রাজা কে - "ধরমং য়ো বাধতে ধর্মো ন স ধর্মঃ কুধর্ম তৎ " অর্থাৎ যে ধর্ম অন্য ধর্মকে বাধা না দিয়ে , নষ্ট না করে চলতে পারে সেটাই ধর্ম । কি অসীম তাৎপর্য এই কথাটির-বিশেষ করে আজকের দিনে যখন ধর্ম স্থাপন মানে সংখ্যালঘুর ধর্মে আঘাত আনা। বস্তুত এখানে ধর্ম মনে আর religion নয় , এখানে ধর্ম মানে সেই বোধবৃত্ত যা আমাদের ধারণ করে -সত্য , ধৈর্য, অহিংস, করুণা।
এখানে বিরোধ বেঁধেছে সেই দুই ধর্মের সংজ্ঞার।একদিকে পায়রার প্রাণ অন্যদিকে শিকার বঞ্চিত যুক্তিবাদী বাজপাখি। রাজা বুঝলেন এ যুক্তি অকাট্য। বাজপাখিকে বললেন তোমার শিকারের দরকার আমি তোমাকর শুয়োর হরিণ এসব এনে দিচ্ছি।তুমি তাই দিয়ে নিজের আর সংসারের ক্ষুধা নিবারণ কর।উত্তরে বাজপাখি বললেন আপনার ধর্মরক্ষার জন্য আমি তো আমার খাদ্যাভ্যাস পাল্টাব না রাজা। ওটি আমার শিকার।ছেড়ে দিন ওকে।
এমন অবস্থায় দরকার ছিল মহাকাব্যিক প্রতিবচনের। ঠিক সেই কাজ করলেন কবি। রাজা ঘোষণা করলেন সমতুল পরিমাণের মাংস আমি আমার শরীর থেকে কেটে দেব বাজপাখিকে। রাজা যতই ক্ষত বিক্ষত করেন নিজেকে পায়রার দিকের পাল্লা ভারী ই থেকে যায়।অবশেষে ইন্দ্র আর অগ্নি স্বরূপ ধারণ করে রাজা উশিনর তথা শিবি কে ভরিয়ে দিলেন অনেক অনেক প্রশংসায়। উশিনর কে চরম ত্রাতা র ভূমিকায় প্রতিষ্টা করেছ এই গল্পটি।আর যুধিষ্ঠির শিখেছেন ধর্ম অধর্মের সূক্ষ বিচারের নিদান বই পড়ে হয়না। হয় সময় এবং পারিপার্শ্বিক-এর নিক্তি বিচারে