লক্ষী যখন লক্ষীবাঈ
লক্ষী যখন লক্ষীবাঈ


সকালবেলা মেয়ে তিতলিকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রুপা সবে বেরোতে যাবে ঠিক তখনই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সেটা বন্ধ। কাল রাতে মনের ভুলে চার্জ'টাই দেওয়া হয়নি ফোনে। কাল রাতে আবার মেয়েটার শরীরটাও খারাপ হয়েছে। প্রত্যেক মাসেই এই তিন-চারটে দিন তিতলি কিরকম কুঁকড়ে যায়। আর এতে ওরও বা কি দোষ! তেরো বছরের ছোট্ট মেয়ে। বয়স্ক মহিলারাই কাহিল হয়ে পড়ে এই সময়ে। তাই রুপা ভেবেছিল আজকে মেয়েটাকে বাসের বদলে ক্যাবে করেই নিয়ে যাবে, কিন্তু এখন তো সে উপায় নেই। এদিকে মেয়েটার ক্লাস সেভেনের ফাইনাল টার্ম চলছে, স্কুল তো ছুটি নেওয়া যাবে না। অগত্যা রুপা মেয়েকে নিয়ে রিক্সা করে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালো। তিতলির বাবাও তো বাইরে কাজ করে। টাকা পাঠানো, আর ফোনে খোঁজ নেওয়ার থেকে বেশী সেও তো কিছু করতে পারে না। কাজেই তিতলির পুরো দায়িত্বই রুপার ওপর।
উফ্ফ! আজকেও বাসটাতে এত ভিড় যে, ঠিকমত পা রাখার জায়গা নেই, বসার জায়গা তো দূরের কথা। এ দিকে আবার কনডাক্টার বলেই যাচ্ছে-
------"পিছনে চলে যান। অনেক জায়গা আছে।"
তিতলির হাতটা শক্ত করে ধরে রুপা কোনরকমে ঠেলে ধাক্কে একটু ভেতরের দিকে গিয়েই দাঁড়ালো। তাও তো প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা বাসে। এইদিকে জানালার পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলার কোলের বাচ্চাটা সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। এই শীতেও সবাই দরদর করে ঘামছে। বড়রা'ই এই স্কুল-অফিস টাইমের দূরাবস্থা সহ্য করতে পারছে না, ছোট্ট দুধের শিশু'টা কিভাবে সহ্য করবে! এরই মধ্যে আরেকজন ঐ মহিলার উদ্দেশ্যে বলে উঠল-
------"আরে দিদি, বাচ্চাটাকে চুপ করান।"
ওইদিকেও জানলার পাশে বসে থাকা মাঝবয়সী ছেলেটা আবার বমি করছে। আজকে বাসের মধ্যে যেন যা তা অবস্থা! এরই মধ্যে আবার রুপার উদ্দেশ্যে কনডাক্টারের কথায়-
------"দিদি ভাড়াটা,,"
রুপার একহাতে তিতলির ব্যাগ আর একহাতে ও তিতলির হাতটা শক্ত করে ধরে রয়েছে। পার্সটাও তিতলির ব্যাগের ভেতর। রুপা কোনোরকমে তিতলিকে বাসের একটা সিট শক্ত করে ধরে দাঁড়াতে বলে, পার্সটা বের করে বাস ভাড়া দেয়। তারই মধ্যে তিতলির বয়সী আরেকটি মেয়ে রুপার পাশে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটির পরনে সাদা শার্ট, নীল স্কার্ট। স্কুলব্যাগটাকে সামনে নিয়ে কোনরকমে বাসের হ্যান্ডেল'টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি একাই উঠেছে বাসে। অবশ্য এই সময়টায় অনেক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই বাসে করে তাদের স্কুলে যায়। আজ বাসের মধ্যে ভিড় বেড়েই চলেছে, কিন্তু কনডাক্টটারের কথায় তো বাসে ভিড়ই নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন বয়স্ক লোক রুপার পাশে দাঁড়ানো তিতলির বয়সী ওই মেয়েটির পেছনে এসে দাঁড়ায়। এইপাশে তিতলিটাও কিরকম মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রুপা বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারছে না। বাড়ি থেকে আসার সময় তো রাস্তাতে একটা হলুদ ট্যাক্সিও দেখা গেল না।
মিনিক দশেকের মধ্যে ঐ তিতলির বয়সী মেয়েটা কিরকম এদিক ওদিক সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। অনেকবার তো রুপার পায়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রুপা আর কি বলবে, ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে, ভিড়ের ঠেলায় আর কি করে! মেয়েটি অনেকবার রুপাকে "সরি আন্টি" বলে। রুপা এবার একটু লক্ষ্য করে দেখে মেয়েটা ভিড়ের অসুবিধার তুলনায় অস্বস্তিতে ভুগছে বেশী। মেয়েটির পেছনে দাঁড়ানো ঐ বয়স্ক মত লোকটি তার পুরুষাঙ্গ দিয়ে মেয়েটিকে সুযোগ বুঝে ধাক্কা দিচ্ছে। অত লোকের মাঝেও মেয়েটি ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে রয়েছে। তাই ও অনেকক্ষণ ধরেই এদিক ওদিক করার চেষ্টা করছে, কিন্তু এত ভিড়ে সে আর কি করে সম্ভব!
এই ঘটনা দেখামাত্রই রুপার মাথার মধ্যে যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেও রুপার সাথে এরকম একটা জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল।
*********
সেদিন কলেজ শেষ করে গানের ক্লাস থেকে ফিরতে বেশ অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল রুপার। বৃষ্টিও হচ্ছিল মুশলধারে। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি কিছুই ওর বাড়ির পথে যেতে চাইছিল না। তারপর অনেক কষ্টে একটা শাটল গাড়ি পাওয়া গেছিল। গাড়িটিতে অবশ্য লোক ছিল। মারুতি ভ্যানটার একপাশে একজন
মহিলা, আর আরেক পাশে এক দম্পতি বসেছিল। ওদের কথাবার্তাতেই সেটা স্পষ্ট ছিল। রুপা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যতটা ভয় পাচ্ছিল, গাড়িতে উঠে অত লোকজন দেখতে পেয়ে রুপার ভয়টা একটু কমেছিল। কিন্তু গাড়িতে উঠে রুপাকে বাধ্য হয়ে লোকটির পাশের সিটটাতে বসতে হয়। মানে বউটির স্বামীর পাশে। ঐদিকের মহিলা সিটে একা বসে থাকলেও ব্যাগপত্র ছড়িয়ে বসে পুরো জায়গাটাই দখল করে নিয়েছে। তবে ঐ মহিলাও এই দম্পতির কোনো আত্মীয়ই হবে। গাড়িটা খানিক রাস্তা যাওয়ার পরই ঐ লোকটা হঠাৎ রুপার ব্লাউজের নীচে খালি জায়গাটায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর রুপার পা'য়ে নিজের পা'টা দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করে। রুপা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। ও তারপর বাধ্য হয়ে ঐ দুই মহিলাকে জানায়। লোকটির স্ত্রী'টি ছিল একেবারে পতিব্রতা। স্বামীর কুকর্মের কথা সে তো শুনলোই না, উল্টে রুপাকে দুটো বাজে কথা বলে দিল। আর ঐপাশের সিটে বসে থাকা মহিলা, সে তো রুপার উদ্দেশ্যে বলল-
------"এই মেয়েগুলো রাত্রিবেলা অসভ্যতা করতেই বেরোয়, এই করে যদি কোনো বড় মাছকে ছিপে আটকানো যায়! যে ছেলেই এদের ফাঁদে পা দেবে না, সেই ছেলেকেই বদনাম করতে চায়।"
কথাগুলো শোনার পর রুপার গলার কাছটা যেন কিরকম ধরে আসে। প্রতিবাদের ভাষা তো দূর, ওর নিজের প্রতিই কিরকম একটা রাগ হতে থাকে। একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়েকে কি করে দোষারোপ করে ওর মাথাতেই আসে না।
বাড়ির রাস্তায় আসার আগের স্টপেজটাতেই ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থেকে নেমে যায় রুপা। সেখানে রাস্তায় একজন ট্রাফিক পুলিশও ছিল, কিন্তু ও তো ভয়ে মুখের কথার ওপর লাগাম দিয়েছিল। ব্যাগ থেকে আর সেদিন ছাতাটাও ও খোলেনি। ভিজতে ভিজতে বাড়ি গিয়ে ও বাবা-মা'র কাছে খুব কেঁদেছিল। কারণ ওর সাথে এরকম ঘটনা সেদিন প্রথমবার ঘটেছিল। তবে সেদিন মেয়ের মুখে এসব ঘটনা শুনে রুপার মা চুপ করে থাকলেও রূপার বাবা কিন্তু প্রতিবাদ করার কথা মেয়েকে বলেছিল। কারণ এরকম বিপদে মেয়েরা বারবার পড়তে পারে, তবে এতে ভয় পেয়ে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেললে চলবে না। প্রতিবাদ করলেই ঐ বারবার ঘটে যাওয়া ভিন্নমুখী শয়তানের কার্যকলাপ শেষবারে এসে পৌঁছাবে। রুপা সেদিন ওর বাবার কথাটা একেবারে মাথায় গেঁথে নিয়েছিল। তারপর থেকেই রুপার মত ঘরের লক্ষী মেয়ে, সময় বিশেষে ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈ'ও সেজে উঠতে শুরু করলো।
********
আজও পঁচিশ বছর পর রুপার পাশে দাঁড়ানো ছোট্ট মেয়েটির সাথেও একই ঘটনা ঘটছে। রুপা সঙ্গে সঙ্গে কনডাক্টরকে, কাছাকাছি কোনো থানার সামনে বাস থামানোর কথা বলে। রুপা ঐ মেয়েটার হাতটা টেনে ধরে তিতলির কাছে দাঁড় করায়। তারপরই পায়ের থেকে ও জুতোটা খুলে দুমদাম বয়স্ক মানুষটাকে মারতে শুরু করে। প্রথমে অবশ্য অনেকেই বলেছিল, বয়স্ক মানুষটাকে বিনাদোষে রুপা মারধর শুরু করেছে। তারপর অবশ্য কারোর কিছু বুঝতে বাকি থাকেনি। মানুষ যদি অভদ্রতামি করে তাহলে তার শাস্তি পাওয়াটা উচিত, সেটা বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটি নাতনীর বয়সী বাচ্চার সাথে উনি তখন থেকে অসভ্যতামি করে চলেছে, তার বেলা উনার বয়সের শিক্ষা কোথায় গেল! অনেক হৈ হট্টোগোলের পর বাসেরই কতগুলো ভদ্রলোক বুড়োটাকে ঘাড় ধরে বাস থেকে নামিয়ে দিল। থানায় যাওয়ার কথা যদিও রুপা ভেবেছিল, কিন্তু তা করতে গেলে মেয়েগুলোর আজ স্কুলই যাওয়া হত না, তাই শয়তান লোকটাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। বাসের সকলেই তখন রুপার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেউ বলছে-' একদম ঠিক করেছেন', কেউ বলছে-'আরও কয়েকটা ঘা দিলে ভালো হত', আবার কেউ কোনো কথা না বলে পুরো বিষয়টা ক্যামেরাবন্দী করে সোশ্যাল সাইটে দিতে ব্যস্ত। তবে রুপার আর এইসবে কিছু এসে যায় না। কারণ আজকালকার যুগে যে চুপ করে থাকবে, তাকে সমাজ আরো পিষে মেরে ফেলতে চাইবে। যেটা কিনা কয়েক বছর আগে রুপার সাথেও ঘটেছিল। তবে রুপা আজ নিজেকে ভালোবেসে বদলে গেছে। তাই আজ ও যেমন নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে, ঠিক তেমনই অন্য কারোর সাথে অন্যায় হলে তার পাশে দাঁড়িয়ে লড়তে পারে।