STORYMIRROR

Sourya Chatterjee

Children Stories Others Children

4  

Sourya Chatterjee

Children Stories Others Children

হ্যারি পটার

হ্যারি পটার

4 mins
395

উত্তেজনায় ঘুম ভেঙে গেল রিন্টুর। কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসল ও। বাইরে থেকে আলো ঢুকছে জানালা দিয়ে, তার মানে সকাল হয়ে গেছে তো। ঘড়ির দিকে তাকালো রিন্টু। ছোট কাঁটাটা পাঁচ আর ছয়ের মাঝখানে আর বড় কাঁটাটা নয় পেরিয়ে দশের কাছাকাছি। নয় মানে তো পঁয়তাল্লিশ। তার মানে এখন বাজে হচ্ছে পাঁচটা আটচল্লিশ মত, কিন্তু রিন্টু তো কোনদিনও আটটা, সাড়ে আটটার আগে ঘুম থেকেই ওঠে না। আজ আগেই ঘুম ভেঙে গেছে। বন্ধুর জন্মদিনের নিমন্ত্রণ আছে আজ, যেতে হবে। সেই উত্তেজনাতেই হয়ত ভেঙে গেছে ঘুম। পাশে রিন্টুর মা শুয়ে আছে, ঘুমাচ্ছে। রিন্টুর বিছানা থেকে খুব নামতে ইচ্ছে করছে। শুধু একবার গিয়ে ওর দেখে আসতে ইচ্ছে করছে আকাশে মেঘ করেছে কিনা। মেঘ থাকলে যদি বৃষ্টি নামে তবে তো ভীষণ মুশকিল। আনন্দটা মাঠে মারা যাবে। গিয়ে টুক করে দেখে আসতে ইচ্ছে করছে আকাশটা কিন্তু কোনোভাবে যদি মায়ের ঘুম ভেঙে যায় তবে তো আবার বকে ঘুম পারিয়ে দেবে মা। খুব আস্তে আস্তে সন্তর্পণে জানালার কাছে গেল রিন্টু। পর্দা সরিয়ে দেখল, না মেঘ তো নেই। বরং হরেক রকম পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রিন্টু। আজ তবে খুব আনন্দ হবে।

পরিশীলিত, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রিন্টু ক্লাস ওয়ানে পড়ে শহরের একটা বড় নামকরা স্কুলে। বাবা মায়ের পরম স্নেহে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে সে। ছোটবেলা থেকে কোনোদিনও এক মুহূর্তের জন্যও রিন্টুকে কষ্ট পেতে দেয়নি ওর বাবা মা। রিন্টু বড় হবে, খুউউব বড় হবে, সেই স্বপ্ন চোখে নিয়ে ঘুমাতে যায় তারা।

ঘরে এ.সি চলছে বলে জানালাগুলো বন্ধ। পর্দা সরিয়ে কাঁচের শাটার দেওয়া জানালা দিয়েই রিন্টু বাইরের আকাশ দেখল। হরেক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে বটে, কিন্তু পাখির কিচিরমিচির শব্দের সুমধুর কলি রিন্টুর কানে বন্ধ জানলা ভেদ করে পৌঁছাতে পারল না। ঘরে পৌঁছাচ্ছে না ভোরের গন্ধ, পৌঁছাচ্ছে না সুরেলা বাতাস। রিন্টু হয়তো কোনোদিনও শোনেই নি মুক্ত বিহঙ্গের গান, গ্রহণ করেনি প্রকৃতির ঘ্রাণ, পায়নি ভোরের বাতাসের স্পর্শ।

চার দেওয়ালের বদ্ধ ঘরে বাবা মায়ের তৈরি স্বপ্নজালে বন্দী রিন্টু বাইরের পৃথিবীটার স্বাদই তো তেমন করে পায়নি। তাই পাখি দেখেও কাঁচের জানলা খুলে পাখির গান শুনতে ইচ্ছে করে নি, ইচ্ছে করেনি ভোরটাকে গায়ে মাখতে। শুধু আকাশে মেঘ নেই দেখেই সে খুশি। 

তবে ওর বাবা মা নিজেদের মতন করে রিন্টুকে সবই দিচ্ছে। এই তো, গত পরশুই ওরা সবাই বাইরে ডিনারে গেছিল। এসে ফিরে একসাথে বসে “হ্যারি পটার” দেখল। রিন্টুর খুব পছন্দ হয়েছে মুভিটা। কি সুন্দর ওরা ম্যাজিক দেখায়, এখান থেকে হুস করে অন্য জায়গায় চলে যায়। দেওয়াল ভেদ করেও চলে যেতে পারে। আবার একটা লম্বা ঝাড়ু চড়ে উড়ে উড়ে কিসব খেলে। বেশ মজা পেয়েছে রিন্টু। তারপরও রাতে এক কান্ড করে বসেছিল পরশু মুভি দেখার পর। সোজা গিয়ে ধাক্কা মেরে বসছিল দেওয়ালে। উফফ! তারপর বরফ লাগাও, মলম লাগাও, কি কান্ড! যাক! আস্তে লেগেছে বলে বাঁচোয়া। গতকাল আবার দিব্যি সেসব ভুলে হ্যারি পটারের মত একটা চশমা আবদার করেছে মায়ের কাছে। 

বাবা মা চশমার আবদার মিটিয়ে দেবে এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে, কিন্তু ওইটুকুতে মনের সম্পূর্ণ আশ মিটছে না রিন্টুর। ওকে তো সম্পূর্ণ হ্যারি পটার হতে হবে। অনেক জিনিসপত্র লাগবে, রিন্টু ঠিক করেছে একে একে সব জিনিস জোগাড় করবে। বাবা মায়ের কাছে তো আর সব আবদার করা যায় না। যখন মা ওকে বই কিনতে নিয়ে যাবে তখন জিজ্ঞেস করবে দোকানে ম্যাজিকের বই খাতা আছে কিনা। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে পড়াশুনা করে ও ভর্তি হবে হ্যারি যেখানে পড়ে সেখানে।

চশমার আবদার মিটিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি তো ইতিমধ্যেই বাবা মা দিয়েছে। হ্যারি পটার হবার দ্বিতীয় উপকরণও যে এত সহজে মিলে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি রিন্টু। চারতলার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে মেঘ দেখতে এসে দ্বিতীয় উপকরণের হদিশ পেল রিন্টু। ওই যে, নিচে হ্যারি পটারের ঝাড়ুটার মত লম্বা একটা ঝাড়ু নিয়ে একজন আঙ্কেল রাস্তা ঝাড় দিচ্ছে। ঠিক ওরকমই একটা ঝাড়ু চাই তো রিন্টুর আকাশে উড়বার জন্য। পাবে কি করে ঝাড়ুটা, প্ল্যান করতে থাকে রিন্টু। যে আঙ্কেলটার কাছে ঝাড়ুটা আছে তাকে তো কোনোদিনও দেখেই নি রিন্টু, তাকে চেনে না। মা বাবাকে বলবে? না, আগে বরং চশমার আবদারটা মিটুক, তারপর বলা যাবে। কিন্তু ঝাড়ু নিয়ে এই আঙ্কেলটা রোজ আসবে তো? 

বাবা মায়ের তৈরি স্বপ্নজালের বাঁধন ছিড়ে অমূলক স্বপ্নের জাল বোনা শুরু করে রিন্টু। কল্পনা আর বাস্তব জগতের সীমারেখা মুছে যায়। 

টুডু মিউনিসিপালিটির ঝাড় দেবার চাকরিটা পেয়েছে বছর দেড়েক হবে। পয়সা রোজগারের জন্য রাস্তার ময়লা ঝাড়ু দেবার কাজ বেছে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার জীবনটাও সভ্য নাগরিকদের চোখে রাস্তার ময়লার মত হয়ে গেছে সেটা কিছুদিনের মধ্যেই টের পেয়েছে বছর সাতাশের এই যুবক। তাই হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারে না কেউ তাকে মনে মনে হলেও আঙ্কেল বলে সম্বোধন করবে। ইস! রিন্টুর মনের খবরটা কোনো দূত যদি টুডুর কানে পৌঁছে দিত, কি যে ভালো হত! 

বেশি সময় নেয়নি রিন্টু, সকাল ন’টা নাগাদ ব্রেকফাস্টের টেবিলেই বাবা মা কে জানায় ওরম ঝাড়ুর হদিশ যে ও পেয়েছে। একটু যদি ওর জন্যও জোগাড় করে দেয়। বাবা মা অবশ্য রেগেই যায় তাতে। রিন্টুর অপটু হাতে গড়া অমূলক স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে ফেলতে বেশি সময়ও নেয়নি তারা। রিন্টু একটু বেশি জোড়াজুড়ি করতেই বন্ধুর জন্মদিন বাড়িতে নিয়ে যাবে না বলে বকা দিতেই চুপ হয়ে যায় রিন্টু। সত্যিই তো, ওরা চায় রিন্টু বড় ডাক্তার হোক, সায়েন্টিস্ট হোক! তা না। উল্টে ঝাড়ুদারের ঝাড়ু চাইছে রিন্টু। এমতাবস্থায় যদি শক্ত হাতে হাল না ধরে তবে বিপদ বাড়বে বই কমবে না।

সময় পেরোয়, দিন পেরোয়, রিন্টুর মাঝে মাঝে ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায়। ও ছুটে জানলার কাছে গিয়ে দেখে আসে টুডু আঙ্কেলকে। সেই ঝাড়ুটা, রিন্টুর স্বপ্নের ঝাড়ুটা। শীঘ্রই হয়তো রিন্টু ভুলে যাবে ঘটনাটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে, শীঘ্রই বাস্তব আর কল্পনা জগতের সীমারেখা স্পষ্ট হয়ে উঠবে রিন্টুর কাছে। তবুও কল্পনার ডানায় ভর করে কয়েকদিনের জন্য হলেও এই যে একটা মনের সম্পর্ক তৈরি হল টুডু আঙ্কেলের সাথে সেই অপরূপ স্বাদ তো আস্বাদন করতে পারল কেবল রিন্টুই। সেটাও তো কম কিছু নয়।


Rate this content
Log in