SHUBHAMOY MONDAL

Children Stories Drama Horror

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Children Stories Drama Horror

গল্পদাদুর আসর-নতুনদাদুর কাহিনী

গল্পদাদুর আসর-নতুনদাদুর কাহিনী

7 mins
360



পরদিন বিকেলে খেলতে এসেই তিতাস ও তার বন্ধুরা দেখলো - গল্পদাদু আর নতুন দাদু আগেই এসে, সোসাইটির গেটের পাশে মাঠের ঘাসের ওপর বসে গল্পগুজব করছেন। দেখে তো তারা মহা খুশি হয়ে, মাঠে নিজেদের খেলা ধূলায় মাতলো। তারপর, যথারীতি খেলা শেষে সব একজোট হয়ে হাজির হলো তাঁদের কাছে।

শিশিরবাবু ইশারা করে সকলকে হাতমুখ ধুয়ে এসে বসতে বললেন। আজ নতুন দাদু তাদের জন্য সেই টিফিন কৌটো থেকে বের করলেন - ভারি অদ্ভুত আর একধরণের মিষ্টি। দেখতে বড়ির মত, কিন্তু খেলে বোঝা যায় যে ওটা আসলে মন্ডা - বড়ি মন্ডা!

মনামি - এটা কি মিষ্টি গো দাদু? মন্ডার মত খেতে!

অজিতবাবু - এ হল, বাঁকুড়ার সোনামুখীর স্পেশাল মিষ্টি গো দিদি - বড়ি মন্ডা। ক্ষীর আর নলেন গুড় দিয়ে তৈরী, এই মিষ্টির স্বাদ দারুণ, তাই না? সবাই বলে স্বাদে অতুলনীয়। এই মিষ্টি কেবল ওখানেই তৈরী হয়, অন্য কোথাও কিন্তু পাওয়া যায় না! তাই তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছি, কেমন লাগলো খেতে?

সকলে - দারুণ খেতে গো দাদু। আগে আমরা এত ভালো মিষ্টি কোনোদিন খাই নি। তোমার মেচা সন্দেশেরও জবাব নেই, আর এই বড়ি মন্ডারও।

শিশিরবাবু - কই হে বাহাদুর, এদিকে এসো। এই বড়ি মন্ডা খাও, আর গেটটা আটকে দিয়ে চেয়ারটা নিয়ে না হয় এখানেই বসো। আর দাদুভাই, তোমাদের মিষ্টি খাওয়া হয়ে গেলে জল খেয়ে নাও - বাহাদুর আংকেলের কাছে বোতলে রাখা আছে।

সকলে চটপট খাওয়া, হাতধোয়া পর্ব মিটিয়ে এসে, গোল হয়ে বসে পড়লো দুই দাদুকে ঘিরে। বাহাদুরও গেটটা আটকে দিয়ে তার সামনে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লো সেই গল্পদাদুর আসরে।

অজিতবাবু - মেয়েদের বিয়ে নিয়ে যে চিন্তায় ছিলাম, সেকথা তো আগেই বলেছি। এই একই বিষয় নিয়ে চিন্তায় ছিল আমার আর এক বন্ধুও। তার পারিবারিক অবস্থা অবশ্য আমার মত কঠিন পরিস্থিতিতে ছিল না। কিন্তু তার সমস্যা ছিল আরও ঘোরতর।

ওর দাদু ছিলেন আমাদের ঐ এলাকার মধ্যে অন্যতম এক ধনী ব্যক্তি আর সবথেকে কৃপণ। তাঁর সমস্ত সম্পদের দলিল এবং টাকাপয়সা যে তিনি কোথায় লুকিয়ে রাখতেন - তাঁর ছেলে মেয়ে তো দূর, তাঁর স্ত্রীও জানতেন না।

তাই এত সম্পদ থাকলেও, তাদের অবস্থা এবং জীবন যাপন ছিল অতি সাধারণ। যাই হোক, তো সেই দাদু হঠাৎ দেহ রাখলেন। তাঁর শ্রাদ্ধ শান্তি করলো ও অন্যান্য নিয়ম কানুন অশৌচ পালন করলো সবাই খুব নিষ্ঠা ভ'রে। সবাই ভেবেছিল যে বুড়ো মারা গেছে, এবার তারা সব বিষয় আশয় ভাগ করে নেবে।

কিন্তু মুশকিল হল তাঁর ঘরে ঢুকতে গিয়ে। তাঁর ঘরের দরজা খুলে দেখে - বুড়ো ঘরের ভেতরে চেয়ারে দিব্যি বসে আছে। তাঁর অন্য ছেলেরা, পরে বৌমা এবং নাতি নাতনিরাও গিয়ে দরজা খুলতেই ঐ ঘরে সেই একই দৃশ্য দেখল! তাই, তাঁর ঘরে ঢোকার সাহস আর কেউ করল না।

গ্রামের বিজ্ঞজনেরা পরামর্শ দিল - এত নিষ্ঠার সঙ্গে অশৌচ পালন করে, সম্পূর্ণ বিধিমাফিক শ্রাদ্ধ শান্তি করার পরও যখন বুড়ো ঘর ছাড়ছে না, তো কোন ওঝাকে ডেকে এনে ভূত ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে। সেই কারণেই তারা ভূত তাড়াতে ওস্তাদ এক তান্ত্রিককে তাদের বাড়িতে ডাকলো একদিন।

আমরা চার বন্ধু সেই ঘটনা স্বচক্ষে দেখবো বলে, হাজির হলাম গিয়ে ওদের গ্রামের সেই বাড়িতে। সেই তান্ত্রিক তো সারাদিন কতরকম আগডুম বাগডুম, তন্ত্র মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক কত কি যে করল তার ইয়ত্তা নেই। তারপর বললো - বুড়োর ভূত নাকি ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।

সবাই তো শুনে মহা খুশী, কিন্তু আমাদের চার জনের মনে তখনও একটু সন্দেহ ছিল। ঐ কিপটে বুড়োর ভূত কি সত্যিই এত সহজেই চলে গেল? আর গেলই যে তারই বা প্রমাণ কি? গ্রামের দিকে সেই সময় ভূত ছাড়াতে আসা ওঝারা তাদের কাজ সফল হবার প্রমাণ দিতো। ভূত যে গাছে থাকতো তার ডাল ভেঙে পড়া দেখিয়ে, বা যে বাড়িতে ভূত থাকতো তার কোন অংশ ধ্বসে পড়তো, এইসব আরকি!

তাই আমরাই ঠিক করলাম, সেদিন রাতে বুড়োর ঘরের সামনে দূর্গামণ্ডপে শুয়ে থাকবো চারজনে মাদুর পেতে। দেখা যাক, বুড়োর ভূত সত্যিই গেলো কিনা! যা ভাবা তাই কাজ। রাত তখন একটা দেড়টা হবে, হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি - বুড়ো তার সেই ঘরের দাওয়ায় বসে, দিব্যি পা দোলাচ্ছে!

চোখ বুজে বাকি বন্ধুদের আসতে করে ধাক্কা দিতে লাগলাম। তারাও একে একে চোখ খুললো এবং জোৎস্নার আলোয় বুড়োকে সেই বারান্দায় বসে থাকতেও দেখলো। তারপর যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতেই, চারজনে ওখান থেকে মাদুরটা গুটিয়ে নিয়ে, টেনে দৌড় দিলাম ওদের বসত বাড়ির ভিতরে।

পরে গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান করে আসার পর, আরও কিসব আচার অনুষ্ঠান করে, তবে সেই বুড়োর আত্মার মোহমুক্তি ঘটাতে সক্ষম হয় তারা। তখন দেখে - বুড়ো যা সম্পদ জমিয়ে রেখে গেছে, তা'তে তারা সাতপুরুষ বসে খেয়েও বোধ হয়, সব ফুরোতে পারবে না!

মেঘা - আচ্ছা দাদু, ভূত পেত্নীদেরকে কি শুধু রাতেই দেখা যায়? দিনে দেখা যায় না?

অজিতবাবু - হ্যাঁ, সেও দেখা যায়। তবে কিনা তাদের চিনে নিতে হয়, রাতের মত অমন করে পরিবেশ বদলে দিয়ে, দিনের বেলা সাধারণত তাদের আবির্ভাব হয় না। অনেক সময় তো দেখা না দিয়েও তারা যা খেল দেখায় তাই কম নাকি?

অয়ন - দেখা না দিয়ে, দিনের বেলায় কি করে ভূতেরা ভয় দেখাবে, মানে তাদের কাজ করবে দাদু?

অজিতবাবু - তাহলে, আমার আর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি শোনো। আমি যে স্কুলে মাস্টারী করতাম সেটা ছিল - মাঠপথে প্রায় ধরো পাঁচ ছয় কিমি দূর। রোজ, আমাদের গ্রামের তাল ডাংরা নামে একটা পুকুর আছে, তার পাড় ধরে এগিয়ে গিয়ে সামনের বিরাট মাঠটা পেরিয়ে স্কুলে যেতাম আমি।

তো যাই হোক, ঐ তাল ডাংরার খুব বদনাম ছিলো, এখনও আছে - ওখানকার ভুলো ভূতেদের জন্য। আমি একবার স্কুল যাওয়ার সময় পড়লাম তাদের খপ্পরে। সেদিনও রোজকার মতই ঐ তাল ডাংরা পেরিয়ে মাঠে নেমে আলপথে হাঁটছি তো হাঁটছিই, স্কুল আর আসে না।

অনেক দূর হাঁটার পর দেখি - এসে পৌঁছেছি দোনামনার (দো মোহনা) ঘাটে। সে প্রায় দশ কিমি হেঁটেছি উল্টো দিকে, ভাবো! তো, আর কি করা, ওখানেই চোখে মুখে জল দিয়ে, হাত পা সব ভালো করে ধুয়ে, আবার উঠে সোজা স্কুলের রাস্তা ধরলাম।

বুঝতেই পারছো, অনেক দেরি হলো সেদিন স্কুল পৌঁছাতে আমার - যেটা আমার কখনও হয়নি সারাজীবনে আর। যাই হোক, সকলেই দেখলাম বেশ চিন্তায় পড়েছিলো - আমি স্কুল শুরুর এতক্ষণ পরেও আসছি না দেখে।

তাই সব ঘটনা তাদের বলতেই, আমায় তারা মনে করালো - তাল ডাংরার ঐ ভুলো ভূতের কথা, যেটা আমি জেনেও ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন, আর তাই সারা দিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেরিয়েছিলাম পথ ভুলে।

মিঠু - একা থাকলে কি ভূতেরা বেশি বাগে পায় দাদু? তোমায় কখনও একা রাতের বেলা দেখা দিয়েছিলো তেনারা?

অজিতবাবু - হ্যাঁ, তা' তো পায়ই। আমায় তো একবার ছেঁকে ধরেছিলো সকলে মিলে। শুধু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ সন্তান বলে, আর পূর্বপুরুষের অনেক পুণ্য ও আশীর্বাদের ফলে সেদিন বেঁচে ফিরেছিলাম, নইলে আর কি?

মেঘা আর তিতাস - তাহলে, সেই কাহিনীটাই বলো দাদু। এটা তো শুনেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

অজিতবাবু - আমাদের গ্রামের শ্মশানটা নদীর ধারে, তার পাশ দিয়ে গ্রামে আসার মেঠো রাস্তা, আর ঐ রাস্তার যে পাশে শ্মশান ঠিক তার উল্টোদিকে ছেলেপোঁতা মাঠ। আগেকার দিনে শিশুমৃত্যু খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল, তো তাদের দাহ না করে, ওখানেই মাটিতে পুঁতে দেওয়া হতো - তাই ঐ মাঠের অমন নাম।

যাই হোক, আমার সেই স্কুলের একটা কাজের জন্য, গ্রামের সমস্ত লোকজনদের নিয়ে একটা আলোচনা সভা ছিল একদিন। সব কাজ মিটিয়ে ফিরতে ফিরতে সেদিন আমার খুব রাত হয়ে গেলো! ফিরছিলাম ঐ ছেলেপোঁতা মাঠের ওপর দিয়েই হেঁটে।

মাঠ পার হয়ে এসে রাস্তায় উঠে হাঁটছি, আর আমার কানে আসছে অসংখ্য ছুঁচোর কিচমিচ শব্দ! ঠিক যেন তারা দল বেঁধে আমার পিছু নিয়েছে। আমি কিন্তু না থেমেই হাঁটতে থাকি।

তাদের আওয়াজ অনুসরণ করে, একবার আমার ডান পায়ের পাশে মাটির দিকে তাকাই। কিন্তু আওয়াজ শুনে বুঝলাম, তারা আমার বামদিকে সরে গেছে। আবার বামদিকে নজর দিতেই, দেখি তারা সরে গেল ডানদিকে।

আমি দ্রুত পা চালিয়ে আমাদের বড়পুকুর পর্যন্ত এসে পৌঁছাতেই, মনে হল তারা আমার পিছু ধাওয়া ছেড়ে, ওখানেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে! গ্রামের বসতির জন্য রক্ষিত অঞ্চলে, তাদের আসার ক্ষমতা নেই! রামায়ণের লক্ষ্মণ রেখার মতই গ্রামেরও একটা সুরক্ষা বেষ্টনী থাকতো তখন সব গ্রামেরই। তাই, সাহস ফিরে পেয়ে বললাম - কি রে আয়, থামলি কেন? এই জুতোর তলায় সবকটাকে পিষে মারবো, আয়।

যাই হোক, তারপর বাড়ি পৌঁছে দেখি - বাবা দাওয়ায় বসে গা হাত পা সব টেপাচ্ছেন, আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে! আমি আসতেই, আমার দিকে এমন ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, মনে হল যেন তিনি জানতে চাইছেন আমার কি হয়েছে?

তাঁকে সব বলতেই, তিনি আমায় জামা কাপড় বাইরেই খুলে রেখে, তখনই স্নান করে নিতে বললেন। আর লোক দিয়ে ডাকতে পাঠালেন আমাদের পণ্ডিত মশাইকে! সব শুনে তিনি দেখি কার উদ্দেশ্যে যেন গালাগাল করতে করতে, আমাদের বাড়িতে এলেন।

এসেই বেশ করে ঝাঁটাপেটা করলেন আমায়। তারপর বললেন - এই রাতে কেউ ঐ মাঠ পাড়িয়ে আসে? ছুঁচো নয়, ওগুলো ওখানে পোঁতা ছেলেদের ভূত ছিলো। নেহাত বামুনের ছেলে, পৈতে আছে, পুজো আর্চা করো ভক্তির সঙ্গে, তাই খুব বেঁচে গেছো আজ। নররা আর কাঞ্চনপুরের শ্মশানে যেতে অতিবড় তান্ত্রিক সাধকও রাতে সাহস পায় না। আর তুমি একা একা সেই শ্মশান পেড়িয়ে এসেছো এই রাতে - চাট্টিখানি কথা?

সত্যি বলতে কি, আমি সত্যিই ঐসব শ্মশানে রাতে আগেও গেছি, শুয়ে থেকেছি রাতভর, কিম্তু কোনদিন কিছুই হয়ওনি, কখনও কিছু দেখিওনি।

শিশিরবাবু - চলো চলো এবার ওঠো সবাই। অনেক গল্প হলো। এবার সবাই ঘরে গিয়ে পড়তে বসো। পাত্রদাদু যদি কাল থাকেন, তবে আরও গল্প শোনাবেন তোমাদের। আজ আর নয়।

সকলে - ও দাদু, কালকের দিনটাও থেকে যাও না। আমরা এই রকম কাহিনী আগে শুনিইনি কখনও। তুমি আরও এমন সব কাহিনী বলবে আমাদের?

অজিতবাবু - বেশ, কাল একটা কাজে যেতে হবে আমায় কলকাতায়, একজনকে দেখতে হাসপাতালে। যদি ফিরতে পারি সন্ধ্যের মধ্যে, তবে শোনাবো আরো সব কাহিনী। তোমরা মন দিয়ে বরং এবার পড়াশুনা করো গে, কেমন?

সকলে এক এক করে সোসাইটির দিকে গেল। বাহাদুর জলের বোতলগুলো কমিউনিটি হলে রাখতে গেলো। সেখান থেকে উঠে সোসাইটির ভিতর দিয়ে, শিশিরবাবুর সাথে অজিতবাবুও হাঁটা দিলেন তাঁর ফ্ল্যাটের দিকে।


Rate this content
Log in