SHUBHAMOY MONDAL

Children Stories Drama Horror

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Children Stories Drama Horror

গল্পদাদুর আসর-কর্ণেল দাদুর ভূত

গল্পদাদুর আসর-কর্ণেল দাদুর ভূত

6 mins
259



সেদিন সন্ধ্যে বেলা হঠাৎ ঝির ঝির করে বৃষ্টি নামল। তিতাস আর তার বন্ধুদের খেলাধূলা সব পণ্ড হয়ে গেল। তার থেকেও বেশি কষ্ট হল তাদের এই ভেবে যে, আজ বুঝি দাদুর গল্পের আসরটাও মাটি হল!

শিশিরবাবু সময় মতই এসেছিলেন, কিন্তু বৃষ্টির পূর্বাভাস পেয়ে আগেই আসরের ব্যবস্থা করেছিলেন। সোস্যাইটির গেটের পাশে, যেখানটায় পাঁচিলটা গঙ্গার দিকে খোলা, একটা পাকা ছাউনিয়ালা বসার জায়গা আছে সেখানে। দারোয়ানকে বলে, কমিউনিটি হল থেকে একটা ত্রিপল এনে, তিনদিক ঘিরে দিয়ে তাকেই একটা বেশ সুন্দর ঘরের মত বানিয়ে নিয়েছিলেন!

তিতাসরা মুখ গোমরা করে, খেলা ফেলে ফেরার সময় দেখে - দাদু হাসিমুখে সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছ! সবাই তো খুব খুশি হয়ে, হৈ হৈ করে এসে ঢুকলো সেখানে। দেখে - শিশিরবাবু সেখানে একটা শতরঞ্চি পেতেছেন, খাবার জল আনিয়ে রেখেছেন। আর? একটা খবরের কাগজে মোড়া ঝুড়িতে রাখা ছিলো, গরম গরম বেগুনী আর জিলিপি!

তাদের আনন্দ আর দেখে কে? দাদুকে হাত ধরে টেনে এনে বসায় তাদের মাঝে। বলে - তুমি ভাগ করে দাও আমাদের। শিশিরবাবু বললেন - সবার জন্য একটা করে আনা হয়েছে। সবাই একটা করে তুলে নাও। আর দারোয়ান আংকেল এ'সব ব্যবস্থা করেছেনে তোমাদের জন্য, তাই ওনাকেও দিও।

সকলে বললো - হ্যাঁ দাদু ওনাকে তো দেবোই। কিন্তু আগে তুমি নাও। বলে শিশিরবাবুর হাতে একটা বেগুনী আর জিলিপি দিয়ে, মিঠাই গেলো সেই দারোয়ানের কাছে। মিঠাই ফিরে এসে দেখে - সবাই দাদুকে ঘিরে বসে পড়েছে, তাঁর পাশে বসার আর কোন জায়গাই খালি নেই!

তার মুখটা কালো হয়ে গেলো দেখে, শিশিরবাবু বললেন - দাদুভাই, তুমি আমার কোলের কাছে এসো। এই মিষ্টির ঝুড়িটা সরিয়ে দিচ্ছি, এখানে বসো। মিঠাই দাদুর একবারে কোলের কাছে এসে, হাসিমুখে বসে পড়লো। মিঠু বললো - আচ্ছা দাদু, তোমাদের অপিসে রাগী স্যার আছে, আমাদের হেডস্যারের মত? যিনি কথায় কথায় লাঠি ধরেন, ঠ্যাঙাবেন বলে!

শিশিরবাবু - হাঃ হাঃ হাঃ, না অমন মারমুখো স্যার নেই বটে, তবে একসময় আর্মি থেকে আসা, এক সিনিয়র অপিসারের পোস্টিং হয়েছিলো আমাদের অপিসে। তিনি ছিলেন খুব ভয়ানক রাগী।

মনামি - আর্মির অপিসার তোমাদের পুলিশের অপিসে আসবে কেন, দাদু?

শিশিরবাবু - আসলে, তিনি আগে আর্মিতে ছিলেন। জঙ্গীদের সাথে ক্রস ফায়ারিংএর সময়, গোলাগুলির কারণে তিনি শারীরিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই সেনাবাহিনীর কাজ থেকে স্বেচ্ছাবসর নেন। পরে, সিভিল সার্ভিস পাস করে আবার পুলিশের চাকরিতে ঢোকেন।

তিতাস - ও দাদা, গত বছর শালবনি থেকে ফেরার সময়, মাইন বিস্ফোরণে মারা গেলেন যে কর্ণেল দাদু, তুমি কি তাঁর কথা বলছো?

শিশিরবাবু - হ্যাঁ দিদি, আমি তোমার ঐ কর্ণেল দাদুর কথাই বলছি। তিনি মানুষটা খুব ভালো, খুব নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন। কাজে কোন রকম কোন ফাঁকি দেওয়া তাঁর ছিলো ভীষণ অপছন্দের। তো তাঁর গল্প শুনবে নাকি তোমরা?

সকলে - হ্যাঁ হ্যাঁ দাদু। বলো বলো।

শিশিরবাবু - তোমরা বেগুনী খেয়েছো, জিলিপি খেয়েছো অনেকক্ষণ হলো। এখন হাত ধুয়ে জল খেয়ে নাও সবাই, তারপর গল্প শুরু করব।

সবাই তো হাত মুখ ধুয়ে, জল খেয়ে চটপট এসে, নিজের নিজের জায়গায় বসে পড়লো, দাদুর কাছে গল্প শোনার জন্য।

শিশিরবাবু - কর্ণেল দাদুর কাহিনী তো অনেক, তা তোমরা কেমন গল্প শুনবে?

মেঘা - ও দাদু, ঐ কর্ণেল দাদু কখনও ভূতের খপ্পরে পড়েনি - তোমার মত? তাহলে সেই গল্পই বলো। আগের দিন তোমার পাঁচু পাগলার ভূতের গল্পটা হেভী লেগেছিলো। হে হে...

সকলে - হ্যাঁ হ্যাঁ, দাদু। মেঘা ঠিক বলেছে, ভূতের গল্প বলো।

শিশিরবাবু - ওরে, বললাম না, উনি ছিলেন খুব ভয়ানক রাগী! ওঁকে কি আর কারোর সাহস হয় জিগ্গেস করার, যে ভূতের খপ্পরে তিনি পড়েছেন কিনা কখনও? তবে হ্যাঁ, তিনি নিজে ভূত হবার পর, তাঁর পাল্লায় পড়েছিলাম আমি। সেই গল্পই বরং বলি তোমাদের?

সকলে - বলো বলো দাদু, তোমার সঙ্গে কিভাবে ঐ কর্ণেল দাদুর ভূতের দেখা হলো, সেই গল্পই শুনবো, শুনবো।

শিশিরবাবু - আচ্ছা, আচ্ছা, সেই কাহিনীই বলছি তোমাদের। তিনি গোর্খা রেজিমেন্টের এক সেনা অপিসার ছিলেন প্রথমে। পুলিশে থাকাকালীন তাঁর মৃত্যুর পর, আমরা অপিসের কয়েকজন গেলাম তাঁর বাড়ি। তোমরা কেউ দার্জিলিং বা কালিম্পং গেছো, কখনও?

অয়ন - আমি গেছি দাদু। গতবছর পুজোর ছুটিতে বাবা পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু দার্জিলিং না, কালিম্পং থেকে একটু অন্যদিকে, একটা গ্রামে ঐ যে বলে না, হোমস্টে তে ছিলাম আমরা।

শিশিরবাবু - বাঃ, দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে তো তাহলে তোমাদের? আমাদের ঐ কর্ণেলের বাড়ি ছিলো, ঐরকমই একটা পাহাড়ী গ্রামেই। তিনি আর্মি থেকে অবসর নিলেও, রোজ বিকেলে তাঁর বন্দুকটা নিয়ে ফায়ারিং প্র্যাক্টিশ করতেন। পুলিশে যোগ দেবার আগে রোজ, ঠিক বিকাল চারটেয় তিনি তাঁর ঘরের দেরাজ খুলে, বন্দুকটা বের করে বুলেটগুলো ভরতেন। তারপর সেটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে, বেরিয়ে পড়তেন কাছেই রাজপুত রেজিমেন্টের ফায়ারিং রেঞ্জের দিকে - প্র্যাক্টিশের জন্য। একদম ঘড়ি ধরে চলা, এটাই ছিলো তাঁর ডেলী রুটিন। পরেও, বাড়ি আসলেই, তিনি এই রুটিন মেনেই চলতেন।

তাঁর মৃত্যুর পর, কফিনে করে বডিটা ওখানেই পাঠানো হয়েছিলো। ওখানেই তাঁকে কবরও দেওয়া হয়। যাই হোক, আমরা ওনার বাড়িতে গিয়েছিলাম কিছু অপিসিয়াল কাজ করার জন্য। সঙ্গে ওনার পরিবারের লোকেদের খবরও নেওয়ার ছিলো। আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেলো। মধ্যাহ্ণভোজনের পর বসে গল্প করছিলাম ওনার নাতি নাতনিদের সাথে।

এমন সময়, কর্ণেল সাহেবের ঘরের দরজার শেকলটা ঝনাৎ করে খুলে পড়লো! আমাদের এক কলীগ গিয়ে, আবার শিকলটা তুলে আটকে দিয়ে এলো। কারণ, ওনার ঐ ঘরেই আমরা তাঁর সমস্ত দরকারী সরকারী কগজপত্রগুলো রেখেছি। আমাদের ব্যাগপত্রও ঐ ঘরেই রাখা ছিলো, তাই সতর্কতা নিতেই হচ্ছিলো! যাই হোক, ঐ সহকর্মী বন্ধুটি এসে বসতে না বসতেই, সশব্দে আবার খুলে গেলো শিকলটা।

সে নিশ্চয়ই ভালো করে আটকায় নি ভেবে, অন্য আর একজন যে কলীগ বন্ধু ছিলো, সে গিয়ে শিকলটা ভালো করে আবার আটকে দিয়ে এল। কিন্তু এবারও সে এসে বসতেও পারেনি, আবার ঝনঝনিয়ে খুলে পড়লো শিকলটা! এবার আমিই আর থাকতে না পেরে, উঠে গেলাম দরজাটার কাছে। ভালো করে লাগাবার পরেও শিকলটা কে খুলছে - তবে কি ভিতরে কেউ আছে? যেই কথাটা মনে হলো, হাট করে খুলে দিলাম দরজাটা।

দরজাটা খুলে দিয়ে তো, যা দেখলাম তা'তে চক্ষু ছানাবড়া হবার জোগাড় আমার! দেখি - কর্ণেল সাহেব বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে, ঘর থেকে বেরোবেন বলে! আমার বুকের দিকেই লক্ষ্য করা বন্দুকের নলটা! তাঁর অব্যর্থ লক্ষ্যের কথা আমাদের পুরো ডিপার্টমেন্ট জানতো! তবে কি এবার কর্ণেল সাহেবের ভূতের গুলি খেয়ে মরতে হবে আমায়? শীতকাল বলে, তখন সন্ধ্যেও হয়ে আসছিলো, আর আমিও ভয়ে দুচোখে অন্ধকার দেখলাম।

বেশিক্ষণ স্থির থাকতে না পেরে, অবশেষে জ্ঞান হারিয়ে বারান্দায় লুটিয়ে পড়লাম। সম্পূর্ণ অচেতন হবার আগে দেখলাম - কর্ণেল সাহেব ঘর থেকে বন্দুক হাতে বেরিয়ে গেলেন। আমার পড়ে যাবার আওয়াজে সবাই দৌড়ে আসে, আমার চোখে মুখে জলের ছিটা দিয়ে দ্রুত জ্ঞান ফেরায় তারা। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, সোয়া চারটে বাজে! মানে, কর্ণেল সাহেব রুটীন মেনেই ফায়ারিং প্র্যাক্টিশে গেলেন? বাকিরা কেউ যে তাঁকে দেখেনি, সেটা তাদের হাবভাব দেখেই বুঝলাম।

উঠে বসে, একটু ভেবে তাঁর ঘরে ঢুকলাম, তাঁর দেরাজটা খুলে দেখি - বন্দুকটা সেখানে নেই! অথচ দুপুরে খাবার আগেও সেটাকে ওখানেই দেখেছিলাম আমরা সবাই। তাঁর অন্যান্য বাকি সব জিনিসপত্র, কাগজ, ফাইল সব আছে, শুধু বন্দুকটাই নেই। আমি কথা না বাড়িয়ে, আমার দুই সহকর্মীকে ইশারা করে, তখনই ফেরার জন্য রওনা দিলাম। ওনারা থাকার জন্য বললেন খুব, কিন্তু কাজের অজুহাত দেখিয়ে, ওখান থেকে বের হয়ে এলাম।

জীপটা চালিয়ে ফিরে আসছি, স্পষ্ট শুনতে পেলাম - সেই রাজপুত রেজিমেন্টের ফায়ারিং রেঞ্জ থেকে আসা, ফায়ারিংএর আওয়াজ। ওহো, বলে রাখি তোমাদের, কর্মরত মিলিটারীরা কিন্তু ফায়ারিং প্র্যাক্টিশ করে এক্কেবারে সাত সকালে উঠে, বিকালে নয়!

সকলে - বাবা রে। দাদু, এবারে তুমি জ্ঞান হারিয়ে খুব বেঁচে গেছো। নাহলে, ঐ কর্ণেল দাদুর ভূতটা বোধ হয়, গুলিই করে দিতো তোমায়।

শিশিরবাবু হেসে বললেন - সেই জন্যই তো বলি তোমাদের, ভয় পাওয়া মোটেই খারাপ জিনিস না। সেদিন ভয় পেয়েছিলাম বলেই না, আজ তোমাদের সেদিনের গল্প শোনাতে পারছি? চলো চলো, রাত হয়ে আসছে, এবার সবাই বাড়ি গিয়ে পড়তে বসবে চলো। ঐ দেখো বৃষ্টিটাও কেমন ধরে এসেছে, চলো চলো।

সকলে মিলে সেখান থেকে বের হয়ে, হৈ হৈ করে স্যোসাইটির ভিতরের দিকে দৌড় দেয়। আর সেই দারোয়ান আংকেল গিয়ে ত্রিপলটা খুলতে থাকেন।



Rate this content
Log in