STORYMIRROR

Rashmita Das

Children Stories Fantasy Children

4  

Rashmita Das

Children Stories Fantasy Children

দিগ্বিজয়

দিগ্বিজয়

34 mins
376

দীর্ঘ ছয় বছর অপেক্ষা করার পর অবশেষে সুবালার কোল আলো করে জন্ম নিল এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান।শ্বশুরবাড়িতে সুবালার বাঁজা বলে এতদিনের লাঞ্ছনা আর গঞ্জনার দিন শেষ হল।এখন সে শ্বশুরবাড়ি কেন,পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলের চোখের মণি হয়ে উঠেছে।নতুন মাকে স্বর্ণালংকারে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলে শাশুড়ি মা বললেন,আমার বংশের প্রদীপ জ্বালিয়েছ তুমি।রাজরাণি হও মা...

তা এমন সুখের দিন সুবালার কপালে খুব বেশি বছর সইল না।কোলের ছেলেটা একটু বড় হওয়ার পরেই সবাই লক্ষ্য করল,ছেলেটা সকলের থেকে আলাদা।অন্যরকম।কেমন জানি অদ্ভুত বা বলা ভালো অস্বাভাবিক।পাঁচ কি ছয় বছরে পা দিতে না দিতেই এটা সকলের কাছেই একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল।ওইটুকু ছেলে এমন সব অসংলগ্ন অর্থহীন প্রলাপ বকে যে ছোট শিশুর প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও সেটা কিছু কিছু সময় মানুষের চোখ কপালে তুলে দেয়।এমন সম চিন্তাভাবনা মাথাতেও আসে কি করে...

একদিন পাড়ার বিশ বর্ষীয়া এক সাদা থান পরা বিধবা রমনীকে সে শুধালো,"তুমি সাদা রংএর শাড়ি পরে থাকলেই বুঝি দিনু খুড়ো খুব শান্তি পাবে?তুমি আজ থেকে লাল নীল সবুজ সব রংএর শাড়ি গয়না এসব পরবে।বুঝলে?"

ছয় বছরের দুধের ছেলের কথা শুনে মা কাকিমারা কপাল চাপড়ে হায় হায় করতে লাগলেন।এ কি অলুক্ষুণে ছেলে রে বাবা...এর মুখে এইসব কেমনধারা কথা!

তারপর যেদিন তাদের ভিটে সংলগ্ন কালী মন্দিরে পাঁঠাবলি হল,সেদিন মন্দির চত্বরের রাস্তাঘাট একেবারে রক্তে মাখামাখি।ছয় বছরের শিশুটি সোজা এসে পুরোহিত মশাইকে জিজ্ঞাসা করে বসল...আচ্ছা এই যে এতগুলো জন্তুকে এইভাবে মারলে,কালী মা কে একবারও জিজ্ঞেস করে দেখেছ মা এইসব রক্ত মাংস তোমার কাছে চেয়েছে কি না...

প্রশ্ন শুনে পুরোহিত মশাই একেবারে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন।পরে তিনি তার বাবা মা সমেত পরিবারটিকে ডেকে সাবধান করে দিলেন।বললেন,"আপনার বাড়িটা যে আসলে অশিক্ষা আর নষ্টামির আখড়া সেটা আমার বুঝতে বাকি নেই।নেহাত দুধের শিশু বলে মাপ করলুম।ছেলেকে ঠিকঠাক শিক্ষা দিয়ে মানুষ করুন নয়তো এই ধরনের কথাবার্তা আর যদি শুনি কোনোদিন তবে শিশু বলে আর রেয়াত করব না।সোজা পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে গিয়ে সালিশি করব।"

সুন্দরপানা মিষ্টি মুখে এক অপামর তেজোদৃপ্ত ঝলকানি দেখে সুবালা ছেলের নাম রেখেছিল দিগ্বিজয়। কিন্তু দিনে দিনে সে ছেলে তো ঘর পরিবারের নাম ডুবিয়ে ছাড়ছে।সে মোটেই আর পাঁচটা বাচ্চা ছেলের মতো খেলাধূলা হইচই নিয়ে মাতে না।সবসময় একমনে কি যেন চিন্তা করে চলে।ক্রমশ সে যত বড় হচ্ছে ততই তার মুখ থেকে এমন সব দুর্বোধ্য এবং অদ্ভুত সব প্রলাপ বেরোতে থাকল যে এবারে সে যে একটি বদ্ধ পাগল সেই বিষয়ে আর কারোর সন্দেহ রইল না।যেভাবে সে এক জায়গায় ধ্যান ধরে বসে থাকে...হাঁ করে একমনে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে কাজকাম সব চুলোদ্দরে দিয়ে...যে সবাই ওকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে।কিন্তু সবথেকে খারাপ অবস্থা হল সুবালার।বংশের প্রদীপ দেবার জন্য যে শ্বশুর শ্বাশুড়ি তাকে মাথায় করে রেখেছিল তারা যখন বুঝল পুত্রবধূ আসলেই একটি পাগল ছেলের জন্ম দিয়েছে তখন বাঁজা বলে দিগ্বিজয়ের জন্মের আগে যে লাঞ্ছনা গঞ্জনা সইতে হত উঠতে বসতে...সেটাই আবার দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এল।সুবালা হাজার বলে কয়েও দিগ্বিজয়ের মতি ফিরিয়ে তাকে স্বাভাবিক পথে আনতে ব্যর্থ হল।এভাবেই দিন,মাস, বছর পার হতে লাগল।দিগ্বিজয়ের বয়স যখন ষোলোর কোঠায়,তখন দিগ্বিজয়ের বাবা একটি দুর্ঘটনায় মারা গেল।সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারটিতে তখন মাথা অনেক বাড়ল।ইতিমধ্যেই দিগ্বিজয়ের বাবার হাঁটুর বয়সী ভাইদুটি বিয়ে করে ঘরে বৌ এনেছে এবং তারা দিগ্বিজয়ের দাদু ঠাকুরমাকে নাতি নাতনীর সুখ দিয়ে ভরিয়ে তুলেছে।সুবালা এতদিন সে বাড়িতে দাসীর মত এককোণে লাঞ্ছিতা অবহেলিতা হয়ে পড়ে থাকলেও রাত্তিরটুকু সে স্বামীর বুকে মাথা রেখে একটু কাঁদতে পারত।এবার স্বামী মারা যাওয়ায় তার শ্বশুরবাড়ির সকলে মিলে একেবারে এক কাপড়ে সুবালাকে লাথি দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিল।


ঝড়জলের রাতে বছর ষোলোর অবোধ পুত্রকে সাথে নিয়ে স্বামী মারা যাওয়ার পরের দিন রাতেই অর্ধচন্দ্র দ্বারা শ্বশুরবাড়ি হতে উৎপাটিত হয়ে একেবারে রাস্তায় এসে দাঁড়াল সুবালা।পথে বেরিয়েই কোনো দিশা খুঁজে না পেয়ে সবার আগে বাপের বাড়ির পথটাই তার আগে মনে এল।কিন্তু তার হাতে তখন একটা নয়া পয়সাও নেই।এতখানি রাস্তা পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা ভাবতেই তার বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল।এখন থেকে যদি সে পথচলা আরম্ভ করে তাহলে পায়ে হেঁটে আগামীকাল দুপুরের আগে পৌছানো সম্ভব নয়।মাঝপথে পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তিকরণের নিমিত্ত কয়েকটি খুচরো পয়সা বই আর কিছুই নেই।কিন্তু যেভাবে গলাধাক্কা খেয়ে তাকে মাঝরাতে বেরিয়ে আসতে হয়েছে তাতে এটুকু সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে,পিছন দিকে ফিরে তাকানোর রাস্তাটাও তার জন্য সারা জীবনের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।অগত্যা কি আর করা...সে দিগ্বিজয়ের হাত ধরে ধীরপায়ে রওনা দিল বাপের বাড়ির দিকে।তিন ছেলের পর যখন সুবালা জন্ম নিল তার মায়ের কোলে তখন থেকেই সকলে তাকে মানুষরূপী লক্ষীজ্ঞান করে বড় আদরে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে।কোনোরকম পথের ধূলো বা মলিনতার ছোঁয়া পর্যন্ত তার গায়ে লাগতে দেয়নি কেউ।সেই ঘরে একবার গিয়ে পা রাখলেই আর সারাজীবনের জন্য তার আর ছেলের বাকি জীবন আর ভাতকাপড় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।সে মনটাকে ঠিকভাবে স্হবির করে নিয়ে ছেলের হাত ধরে বাপের বাড়ির পথ ধরল।পথে যেতে যেতে ক্ষুধার্ত পরিশ্রান্ত সুবালা থেকে থেকে গাছের ছাওয়ায় জিরোনোর জন্য বসছে আর ভাবছে,ক্ষুধা পেলে আজ ছেলেকে কি খেতে দেবে...!আর চিন্তা আসামাত্র আঁচল খুঁটে খুচরো পয়সাগুলো বার করে মনোযোগ সহকারে গুনতে শুরু করত।গুনতে গুনতে ছেলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যেত সুবালা।সে একচোখ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখত,ছেলে ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে আকাশচুম্বি পাহাড়পর্বত আর নীল দিগন্তকে আলিঙ্গনরত উন্মুক্ত নদীবক্ষের দিকে বাপের আত্মার শান্তিকামনার্থে উদাস চোখে তাকিয়ে প্রার্থনা করছে।পথে বেরিয়ে এই ছেলেকে নিয়ে তার বড়ো বেশি চিন্তা ছিল।কিন্তু যখন পথের মধ্যে মায়ের দেওয়া খুচরো পয়সা নিয়ে খাবার আনতে গিয়ে দুহাতে করে অতিস্বল্প কিছু খাবার এনে হাসিমুখে মা কে বলল,"মা গো আমি আমার ভাগেরটা দোকানে বসেই খেয়ে এলুম।তোমার ভাগের খাবারটা নিয়ে এলাম হাতে করে...।

দুচোখ উথলে ওঠা অশ্রুর বেগ সামলাতে গিয়ে সুবালার মনে হল,এই ছেলেকে সবাই অবোধ অকর্মণ্য পাগল ছাগল বলে ত্যাজ্য করল!হা ঈশ্বর! এ তোমার কেমন মায়া!

সে দিগ্বিজয়ের হাতে করে আনা খাবারের বেশিরভাগটাই জবরদস্তি ছেলেকে খাইয়ে নিজে স্বল্প পরিমাণে একটু খেয়ে নিয়ে ক্ষুধানিবৃত্তি করল কোনোমতে।বাপের বাড়ি পৌঁছাতে দুপুর দুটো বাজল।বাড়িতে দাদা বৌদিরা তখন দুপুরের খাওয়া শেষ করে আঁচিয়ে উঠে রবিবারের ছুটিতে একটু দিবানিদ্রার তোড়জোড় করছিল।এমন সময় সাদাথান পরিহিতা ননদকে দেখে তার বৌদিদের মুখখানা বাংলার পাঁচ হয়ে গেল।দাদারা ছোটবোনকে পুত্রসমেত আহাউঁহু করে ঘরে তুলে নিল বটে কিন্তু দিনকয়েক পর থেকেই বাপ মায়ের স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে যাওয়ার পরবর্তী বাপের বাড়িতে ঠারেঠোরে উঠতে বসতে তাকে বোঝানো হতে থাকলব সে বাড়িতে তার জায়গাটা আসলে কোথায়!বিশেষ করে দিগ্বিজয়কে নিয়ে তো এত বিশ্রীভাবে হাসিতামাশা করা হত,তাকে পাগলাছাগলা বলে তার মামাতো ভাইবোনেরা তাকে নিয়ে যেসব কুৎসিত খেলা আর কার্যকলাপে মাতত,তা তাদের বাপ মায়ের কাছে থেকে তাঁদের আস্কারা সমেত আরো দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসত।এরপর দাদা বৌদিরা সবাই মিলে যখন সমস্বরে সুভাগাকে বলত,"এমন ছেলে তো কোনো কম্মেরই নয়।এর মায়া বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।নিজে খেটে যা উপার্জন করতে পারবি তা এই অকর্মন্য ছেলের পেটে দিয়ে তোকে মরতে হবে।ওকে যদি তাড়িয়ে দিস নিজের কাছ থেকে তবেই বাড়িতে ঠিকে ঝি ছাড়িয়ে দিয়ে তোর সারাজীবনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্হা করতে পারি।এটা না পারলে এখান থেকে বিদায় হ..."

এইসমস্ত কথা...যন্ত্রনা আর অপমান সবকিছু মুখ বুঁজে সয়ে মাটি কামড়ে বাপের বাড়িতে পড়ে থাকত সুবালা।কিন্তু ক্রমে যখন সে দেখতে থাকল,দিগ্বিজয়ের উপর তার মামা মামী,মামাতো ভাইবোনেদের লাগামছাড়া নির্যাতন সীমাহীন উচ্ছ্বাসে বেড়ে চলেছে এবং এক এক সময় তামাশা- বিদ্রুপ মানবিকতার সমস্ত সীমা 

অতিক্রম করে ছেলেকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতেও কার্পণ্য করছে না,তখন সুবালা বাধ্য হল ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি ত্যাগ করে বেরিয়ে চলে আসতে।


পথে পথে সুবালা তার অবোধ ছেলের হাত ধরে ঘোরে আর কাজ ভিক্ষা করে।কেউ তাদের দূরছাই করে তাড়ায়...কেউ বা দয়াপরবশ হয়ে দু চার পয়সা ভিক্ষা দেয়।তাতে মা ছেলেু দুটি পেটই ঠিকভাবে চলে না...মাথার উপর একটা ছাওয়ার ব্যবস্হা করা তো সেখানে কল্পনাতীত। এইভাবে ক্ষুধার্ত পেটে পথে পথে ঘুরে ঘুরে ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ল সুবালা।কয়েকদিনের মধ্যেই সে গাছতলায় রোগশয্যা নিল।এবার দিগ্বিজয় পড়ল মহা সংকটে...ওকে দেখলেই তো দুনিয়াশুদ্ধ মানুষজন হাসাহাসি করে আর ইট পাটকেল ছুঁড়ে মজা লোটে।এখন ওর এই বিপদের দিনে ওকে কাজ দেবে কে যাতে ও মায়ের অসুখ সারাতে পারে আর দুজনে পেটে দুটি খাবার দিয়ে বাঁচতে পারে...!

রোগশয্যায় শায়িত অসুস্থ মা কে রেখে সারাটা দিন সে মানুষজনের কাজে যাহোক কিছু কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরত আর প্রতিবার ইট পাটকেল খেয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সহ্য করে শুন্য হাতে মায়ের সামনে মাথা নীচু করে যখন ফিরত,তখন অসুস্থ সুবালার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করত শুধু এই ভেবে,সে একবার চোখ বুঁজলে এই অভাগা ছেলেটার কি গতি হবে!অসুস্হতা বা ক্ষুধার যন্ত্রনা তখন তুচ্ছ...তীব্র দুশ্চিন্তায় সুবালার তখন দুচোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা বইত।ক্ষুধার জ্বালা কোনোমতে দিগ্বিজয়ের পেট সয়ে নিলেও সুবালার রোগক্লিষ্ট শরীরটা আর সইতে পারল না।বটগাছের স্নিগ্ধ ছাওয়ার আশ্রয়ে ফ্যালফ্যাল করে আকাশের পানে চেয়ে থাকতে থাকতে যন্ত্রনাক্লিষ্ট দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাথে সুবালার প্রাণটাও শেষমেষ বেরিয়ে গেল।এই এত বড় জগৎ সংসারে এবার একেবারে একা হয়ে গেল দিগ্বিজয়।সে মায়ের মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল।সারাটাদিন এইভাবে পার করার পর তার মনে হল,মায়ের দেহটা সৎকার করা দরকার। কিন্তু দেহ সৎকার করার জন্যও তো টাকা লাগে...এ কথা ভাবতেই কান্নাটা আরো তীব্রবেগ ধারণ করে তার বুক ফুঁড়ে যেন বার হয়ে আসতে চাইল।সে অসহায়ভাবে আকাশ পানে চাইল।এমন সময় চারপাশের বাতাস কাঁপিয়ে হরিনাম সংকীর্তন ভেসে উঠল।সে শব্দের উৎসের দিকে চোখ মেলে চাইতেই বুঝল,রাজপরিবারের কেউ মারা গিয়েছেন।মৃতদেহ এখন সৎকার করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর পাইক বরকন্দাজসহ প্রচুর মানুষ সেই যাত্রায় পা মিলিয়ে চলেছে।দিগ্বিজয় কোনো একটা অজানা আশার সূতো দুইহাতে আঁকড়ে ধরে মায়ের মৃতদেহখানি একটি চাদর দিয়ে সযত্নে ঢেকে দিয়ে সেই যাত্রায় সকলের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলল।অল্পদূরেই শ্মশানঘাট।সেখানে রাজার বৃদ্ধা প্রপিতামহীর অন্তিম সংস্কারের কর্মকান্ড আরম্ভ হয়ে গেল।সেই জায়গা তখন লোকে লোকারণ্য।দিগ্বিজয় সেখানে রাজার সেপাইদের হাতে পায়ে ধরে অন্তিম সংস্কারের টুকিটাকি ফাইফরমাশ খাটার জন্য অনুরোধ করতে লাগল।ওকে দেখে কারোরই বুঝতে কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না,বেশ কয়েকদিনের ক্ষুধার্ত সে।একটু দোনামনা করে তারা দিগ্বিজয় কে কাজে নিয়েও নিল।টুকিটাকি ফাইফরমাশ খাটিয়ে নিয়ে রাজার প্রধান সেপাই তাকে যখন তার মজুরি দিতে গেল,তখন তার মুখ দেখে তার বড়ো মায়া হল।আবার মনে নানান প্রশ্নও এল।সে মজুরি দেবার জন্য তাকে আলাদা করে ডাকল আর তাকে তার বৃত্তান্ত শুধাল।সবটা শুনে তার মনে সামান্য একটু করুণার উদ্রেক হল।সে দিগ্বিজয়কে তার প্রাপ্য মজুরির সাথে অল্প কিছু বখশিশও দিল।বলল,"এই টাকায় তোর মায়ের শেষ কাজটাজ করে নিস..."

টাকা হাতে পেয়ে একছুটে সে চলে এল মায়ের চাদর ঢাতা মৃতদেহের কাছে।সাধ্যমতো মায়ের অন্তিম সংস্কার করে নিল।এখন সে এই এতবড়ো পৃথিবীর বুকে এক্কেবারে একা।সে এবার কি করবে...কোথায় যাবে...কোনো দিশা খুঁজে পেল না।জীবনটাই তার কাছে এখন পুরোপুরি অর্থহীন মনে হতে লাগল।এখন তার কাছে বাঁচামরা দুইই সমান।সে তার স্বল্পকটি ব্যবহারের জিনিস আর কাপড়চোপড়ের ঝোলা কাঁধে নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায়...হাঁটতে শুরু করল।


ছোট্ট ঝোলা কাঁধে নিয়ে সে চলতে লাগল ক্রোশের পর ক্রোশ।তার গলা দিয়ে আপন খেয়ালে বার হতে শুরু করল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া দিলদরিয়া গান।সেই গান ছুঁতে লাগল পথে চলমান সব মানুষজনের মন।তারা খুশি হয়ে অল্পস্বল্প কিছু পয়সা তার দিকে ছুঁড়ে দিত।সেই পয়সায় দিগ্বিজয়ের একার ছোট্ট পেটটি অভুক্ত থাকার যন্ত্রনার হাত থেকে রেহাই খুঁজে নিত।কিন্তু সেইসাথে সবাই তাকে নিয়ে পাগলা ছাগলা বলে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপও করতে ছাড়তে না।জগৎ সংসারের সবাই যখন কাজেকর্মে ব্যস্ত, তাদের মাঝখানে সে একমনে ঠায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত,আর হঠাৎই ধরত কোনো এক মন কেমনের সুর।সবাই বলত,নির্ঘাত এর মাথায় গন্ডগোল রয়েছে।ব্যস্ত পথের মাঝখানে হোক কি শান্ত নদীর কিনারায় কোনো গাছের ছাওয়ায়...পার্থিব জীবনের কোনোরকম তাড়া বা তাড়না তাকে যেন ছুঁতে পারে না।সমস্তরকম চাওয়া পাওয়া,দেওয়া নেওয়া,হিসাব কিতাবের একেবারে উর্ধ্বে সে।একবার তো সে গাঁয়ের মোড়ল ডাকাতি হওয়ার ভয়ে একরাতের জন্য তার স্ত্রীর সমস্ত সোনার গহনা আর কিছু টাকা একটা পুঁটুলিতে বেঁধে দিগ্বিজয়কে রাখতে দিয়েছিল।সে ওই মোড়লের ঘরের সামনের একটি বটগাছের তলাতেই ঘুমোয়।সেই রাতে মোড়লের বাড়িতে যথারীতি ডাকাতি হল।ডাকাতরা মোড়লের বাড়িতে টাকা গহনা কিছুই না পেয়ে প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেল আর যাবার সময় মোড়লের বাড়ির সামনের বটগাছের তলায় ঘুমন্ত দিগ্বিজয়ের মলিন পুঁটুলিটা মাড়িয়ে চলে গেল যেই পুঁটুলিতেই রয়েছে মোড়লের যাবতীয় টাকা আর গহনা।পরে বাকি রাতটা মোড়ল সপরিবারে নিশ্চিন্তির ঘুম দিয়ে উঠল।পরদিন সকাল হতে না হতে মোড়ল গিন্নি বটগাছটির সামনে গিয়ে দেখেন,দিগ্বিজয় ঘুমিয়ে কাদা।পুঁটুলিটা হাতে নিয়ে বুকের কাছটায় ধরে ঘুমোচ্ছে দিগ্বিজয়।মোড়ল দাদু এটা তাকে এটা ভালো করে সামলে রাখতে বলেছেন।মোড়ল গিন্নী আলতো ধাক্কা দিয়ে দিগ্বিজয়কে জাগিয়ে ওর পুঁটুলিটা নিজের ঘরে নিয়ে এসে দেখলের সব টাকা গয়না একেবারে যেমনকার তেমনই রয়েছে। মোড়লগিন্নী খুশি হয়ে একটি স্বর্ণমুদ্রা দিগ্বিজয়ের পুঁটুলিতে রেখে দিয়ে আবার বাঁধাছাঁদা করে ঘুমন্ত দিগ্বিজয়ের পাশে রেখে দিয়ে এলেন।একটু বেলার দিকে দিগ্বিজয় ঘুম থেকে উঠে নদী থেকে মুখ ধুয়ে এসে পুঁটুলি খুলল কালকের গান গেয়ে পাওয়া পয়সাগুলো নেবে বলে।তারপর করবে যা হোক একটা খাবারের বন্দোবস্ত।পুঁটুলি খুলে দ্যাখে...উরিব্বাস...একটা আস্ত সোনার টাকা।সে সাথে সাথে চোঁ চোঁ করে ছুট দিল মোড়লের বাড়ির দিকে।সাথে তারস্বরে চ্যাঁচাতে লাগল..."মোড়ল দাদু...ও মোড়ল দাদু...আপনার গিন্নী ঠিকভাবে গুন্তি করে জিনিস ফেরত নেয়নি...এইটে রয়ে গেছে পুঁটুলিতে..."ওর চিৎকার তখন সারাপাড়া শোনা যাচ্ছে।


মোড়ল দাদু হাঁকডাক শুনে বেরিয়ে এলেন দেখতে,ব্যাপারখানা কি!দিগ্বিজয়ের কথা শুনে হো হো করে হেসে তিনি দিগ্বিজয়ের কাকের বাসা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,"ওটা তুই রেখে দে নিজের কাছে।তোর মা ঠাকরুন ওটা দিয়েছেন তোকে।দিগ্বিজয় তা শুনে খুশি হয়ে স্বর্ণমুদ্রাটি নিয়ে বিদায় হল।তারপর পুঁটুলি খুঁটে জমা পয়সাগুলো বার করে খাওয়ার কিছু ব্যবস্হা করতে যাবে,এমন সময় তার চোখে পড়ল,এক ছিন্নবস্ত্রা মা তার কোলের অসুস্থ ছেলেটিকে নিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে উদাস বসে রয়েছে।তিনদিন ধরে সে ওইভাবেই বসে রয়েছে ঠায়...নাওয়া খাওয়া রসাতলে দিয়ে।কোলের বছর পাঁচেকের শিশুটি অসুস্হ হতে সে স্বামীর কাছে চিকিৎসার জন্য নিজের বাঁদীগিরির টাকা কেড়ে না নেওয়ার জন্য পায়ে পড়ে কাকুতি মিনতি করলেও সেই পাষাণের এতটুকুও মন গলেনি।সে সব টাকা কেড়েকুড়ে নিয়েছিল মদ খাওয়ার জন্য।তখন সে আর কি করবে!শুন্য হাতে অসুস্থ ছেলে কোলে পথে পথে ভিক্ষা করছে কদিন হল।কবিরাজ দেখাতে হলে তা মেলা টাকার ব্যাপার।ওই টাকা এক দুদিন ভিক্ষা করে যোগাড় করা সম্ভব নয়...তায় ছেলেটা ক্রমে আরও নেতিয়ে যাচ্ছে।দিগ্বিজয় নিজে কম খেয়ে তাকে এক দু পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে বটে...কিন্তু মনে শান্তি হচ্ছিল না তার।তাই স্বর্ণমুদ্রাটি হাতে পেয়েই সে তারই খোঁজ করছিল।এখন তাকে দেখতে পেয়ে সে ছুটে এসে তার হাতে মোহরখানা দিয়ে বলল,"এই নাও...আজ একটা সোনার টাকা পেয়েছি।এ দিয়ে ছেলেকে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাও।"

কাঙালিনী মা তখন দু হাত তুলে দিগ্বিজয়কে আশীর্বাদ করে বলল,"সার্থক হোক তোমার নাম...ভগবান তোমার সহায় হোন..."

দিগ্বিজয়ের হাতে মোড়লের সোনার টাকা তুলে দেবার দৃশ্যটি মোড়লের ঘরের এক ভৃত্য দেখেছিল।এখন সে বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এই দৃশ্য দেখে মনে মনে বলল,"একটা সোনার টাকা বাবু যদি আমার হাতে দিতেন ও দিয়ে আমি কত কিছু করে নিতুম...এ ব্যাটা পাগল তো বটেই...একটা আস্ত রামছাগল।"

মনে মনে গজগজ করতে চলে গেল সে...একটু যদি সে দাঁড়াত,তাহলে দেখত...এমন একটা রামছাগলের মতো কাজ করার পর সে কেমন ভাবমেশহীন স্ফূর্তির মেজাজ নিয়ে আপন খেয়ালে শিষ দিতে দিতে পুঁটুলি খুঁটে পয়সা বার করছে খাওয়ার বন্দোবস্ত করার জন্য...।হাজারো মানুষের হাজারো চাওয়া পাওয়া আর লাভক্ষতির চুলচেরা হিসাব,দুশ্চিন্তা,ঝগড়া বিবাদ চুলোচুলি এবং এগুলি থেকে সৃষ্ট ক্রোধ অসন্তোষ যখন দিগ্বিজয়ের চারপাশে সব মানুষজনের মন মস্তিষ্ক জুড়ে সাম্রাজ্য চালিয়ে তাদের হাতের মুঠোয় পুরে চালিত করে চলেছে,তখন ছেঁড়াফাঁটা বিদীর্ণ ও পরিশ্রান্ত মনগুলি বাহ্যিক পরত নিজেদের চেহারার উপরে চাপিয়ে চলাফেরা করার সময়ে যখন আপন খেয়ালের সাগরে মুক্ত নোঙর তোলা দিগ্বিজয়কে দেখে,তখন তাদের কারোর কারোর কোথাও যেন একটা উপলব্ধি হয়,পাগল ছাগল ও নয়,বরং জীবনে ওই হয়তো সবথেকে বেশি বুদ্ধিমান।

দিন যায় এইভাবেই...দিগ্বিজয়ের ক্রমে এই এক গাঁয়ে আর মন টেকে না।সে তার এই চেনা আকাশের সীমা পেরিয়ে আরো দূরের আকাশ দেখতে চায়।গাঁয়ের এই চেনা পাহাড়ের উল্টোদিকটা কেমন দেখতে খুব জানতে ইচ্ছা হয় ওর।নদীর ওপারটা খুব দেখতে মন চায়।ভিতরের এই ক্ষিদেটা যেন চাগাড় দিয়ে উঠল।গাঁয়ের কেউ কিচ্ছু টের পর্যন্ত পেল না...হঠাৎ করেই এক সকালে চারপাশের সব লোকজন ক্রমে লক্ষ্য করল,বটতলা খালি।পাগলাটা পোটলা পুঁটলি নিয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছে অন্য কোথাও...।


দুচোখ,তৃষ্ণার্ত মন তাকে যেদিকে নিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দিগ্বিজয় সে পথের অভিমুখেই পা মেলাচ্ছে বিহ্বল চিত্তে...।সে জানে না পথঘাটের নাম বা নেই কোনোরকম পরিচিতি।সে মনের আনন্দে পথের সাথে তাল মিলিয়ে চেনা আকাশের বাইরে আকাশ দেখছে,পাহাড় পর্বত নদীনালা তার কাছে ভিন্ন নামে ভিন্ন রূপে ধরা দিচ্ছে।মনে তার পুলক জাগছে।মনের খুশিতে ধরছে দিলদরিয়া গান।সে গান পথমাঝারে ক্লান্ত অথবা ব্যস্ত পথিকদের হৃদয়ে গিয়ে মোচড় দিচ্ছে।দিগ্বিজয় সকলের কাছে হাসিতামাশার পাত্র হলেও গান শুনে সকলেই তার উপর খুশি হয়ে ছুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে পয়সা।সেগুলো কুড়িয়ে দিগ্বিজয়ের পেট ঠিকই চলে যাচ্ছে।আর এর বেশি কোনো চাহিদাও নেই তার।দিন চলে যায় তার খেয়ালে...।এইভাবে পথ চলতে চলতে একসময় সে লক্ষ্য করল,ক্রমেই সে লোকালয় পার করে ফেলেছে।আর পথঘাট ক্রমে রূপান্তরিত হচ্ছে ঘন জঙ্গলে।চিন্তাভাবনা-ভয়ডরহীন দিগ্বিজয় তবু বিনা দ্বিধায় পথ চলতে লাগল।ক্রমে জঙ্গল ফেলেছেনআরো গাঢ় হচ্ছে। নির্লিপ্ত দিগ্বিজয় এগিয়ে চলেছে অজানার সন্ধানে।ধীরে ধীরে এমন পরিস্থিতি এল যে জঙ্গল ভেদ করে সূর্যের আলো পর্যন্ত ঢুকতে যেন সংকোচ বোধ করছে।আলোআঁধারির জংলা ঝোপঝাড় ভেদ করে দিগ্বিজয় সামনের অভিমুখে শুধু এগিয়ে চলেছে।জনমানবহীন আদিমতার এক ভয়াল এক সর্বগ্রাসী আতঙ্ক সেখানকার বাতাসের প্রতিটি কণায় যেন পরতে পরতে মাখানো।কিন্তু দিগ্বিজয়ের কাছে এই ভয় যেন এক অমোঘ নেশার বস্তুতে রূপান্তরিত হল যা নিয়ে জুয়া খেলতে সে নিজের জীবন বাজী রেখে আরো গভীর জঙ্গলে এগিয়ে যেতে থাকল।কদিন বুনো গাছের ফলমূল খেয়ে দিন কাটল।এর কদিন পর সে প্রবেশ করল আরো গভীর অরণ্যে।সেখানকার গাছগুলো যেন আকাশচুম্বী। কোনো ফলমূলের সন্ধান আর সে পেল না।এবার তার অভুক্ত দিনের সূচনা হল।মোটামুটি দুই তিন দিনের মাথায় ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় সে পথ চলার ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলল।সুবিশাল আঁধারঘন নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে একাকী দিগ্বিজয় একটা প্রকান্ড বৃক্ষ দেখতে পেয়ে তার তলায় নিজের শ্রান্ত শরীরখানা এলিয়ে দিল।ক্রমে দিনের আলো নিভে জঙ্গল জুড়ে নেমে এল ঘোর তমসা।তীব্র পিপাসায় দিগ্বিজয়ের গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ।এই আলকাতরার মতো নিকষ গাঢ় অন্ধকারে চোখ মেলে কোনোকিছুই সে ঠাহর করে উঠতে পারছে না,তো এই পুকুর অথবা খালবিলের অস্তিত্বশুন্য ঘন জঙ্গলটিতে এখন কিভাবে কোনো পাহাড়ী ঝর্ণার সন্ধান করে তেষ্টা মেটাবে সেটা ভাবতে বড়ো আকূল আর অস্হির হয়ে পড়ল দিগ্বিজয়।হঠাৎ তার মায়ের কথা মনে পড়ে মনের ভিতরটা এক অজানা ব্যথায় কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।সে দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়ল একটি দৈত্যাকৃতি বৃক্ষের তলায়।এমন সময় হঠাৎ চতুর্দিকে শুরু হল এক অপার্থিব প্রলয়ের পৃথিবী তোলপাড় করা ঝনঝন মড়মড় শব্দ।সে যারপরনাই চমকে গিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।তারপর যা দেখল,তাতে তার পায়ের তলার জমি এবং মাথার উপরে আকাশ যেন এক লহমায় সরে গেল।সে দেখল,যে বৃক্ষটির গায়ে ঠেস দিয়ে সে নিজের শ্রান্ত শরীরখানা এলিয়ে দিয়েছিল,সেই বৃক্ষটির মাঝখানটা চিরে গিয়ে ক্রমে সেটা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে আর তার ভিতর দিয়ে নির্গত হচ্ছে অপার্থিব মায়াবী আলোর রেখা।ক্রমে সেই আলোর রেখা চওড়া হতে থাকল।আর সেই মায়াবী আলোর পরিসর ক্রমেই স্হূল হতে থাকল।আর সেখান থেকে নির্গত হতে থাকল এক কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া।দিগ্বিজয় কিছুক্ষণ সেদিকপানে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।ক্রমে সেই কুন্ডলীকৃত ধোঁয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল কিছু প্রেতাত্মা। দিগ্বিজয় ভয় না পেয়ে বরং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।সে অবাক দৃষ্টিতে সেদিক পানে তাকিয়ে রইল হাঁ হয়ে।

---"কে তুমি?এই পথে কি জন্য এসেছ?"


বাজখাই কন্ঠে ভয়াল দর্শন সেই প্রেতাত্মা শুধালো দিগ্বিজয়কে।

তখন এই বিশাল বৃক্ষের তলায় শরীর এলিয়ে দেওয়া...জল পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ার কথা দিগ্বিজয়ের মাথায় ঠিকভাবে চাগাড় দিয়ে উঠল।সে নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল,


---আমার ভীষণ জল পিপাসা পেয়েছিল।জল খুঁজতে খুঁজতে আমি এ গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।আমায় একটু জল দিতে পারো?

হঠাৎ বটবৃক্ষের ফাঁক হয়ে যাওয়া চেরা অংশটি একেবারে দুভাগ হয়ে দুইদিকে এলিয়ে পড়ল।আর তার মধ্যভাগ হতে নির্গত হতে থাকল এক আকাশচুম্বী মায়াবী আলোর লেলিহান জ্বলন্ত শিখা।আর সেই শিখাগুলি থেকে নির্গত হতে থাকল অসংখ্য বিকট দর্শন প্রেতাত্মা।তারা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে এক হৃদয়বিদারক বিকট অপার্থিব ধ্বনিতে ওই নিকষ আলকাতরা অন্ধকারের বন্য নিস্তব্ধতা একেবারে খানখান করে সমস্বরে উল্লাস করতে শুরু করল।

"আমাদের রাজা এসে গেছেন।ওরে কে কোথায় আছিস!চোঙা বাজা...শৃগালধ্বনি দে... শুঁটকি মাছ পোড়ানোর ধোঁয়া আর হাড়মাংসের কুচি থালায় করে সাজিয়ে আন।আমাদের নতুন রাজাকে বরণ করার ব্যবস্হা করতে হবে যে..."

ব্যাপার স্যাপার দেখে দিগ্বিজয়ের তো ভিরমি খাওয়ার যোগাড়।সে কিছু বুঝে ওঠবার আগেই ওই চেরা বটবৃক্ষ হতে নির্গত হওয়া আকাশচুম্বী মায়াবী অগ্নিশিখা হতে শয়ে শয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল কদাকার আর বিকৃতদর্শন বিম্ভুত কিমাকার সব প্রেতাত্মার দঙ্গল আর তারা দিগ্বিজয়কে মাথার উপর তুলে নিয়ে পরম উল্লাসে  বিকট নৃত্য আরম্ভ করে দিল।দিগ্বিজয় এবার সত্যিই ভীষণ ভয়ে অস্হির হয়ে পড়ল।এইসব হচ্ছে টা কি!তারা অনেক্ষণ ধরে তাদের এইসব নাচকেত্তন করে নিয়ে তারপর তারা যখন দিগ্বিজয় কে কাঁধ থেকে নামাল,তখন সে বুঝতে পারল এই চোখ ধাঁধানো নাচগান চলার সাথে সাথে সে কোথায় এসে পৌঁছেছে। কারণ একটা কানফাটা ঘড়ঘড় শব্দ অনুসরণ করে সে যখন উপর দিকে তাকাল, সে দেখল,মাথার অনেকটা উপরে একখান ফাঁপা গাছের গুঁড়ির চিরে যাওয়া দুইপাশ ধীরে ধীরে একমুখী হতে হতে শেষটায় এক্কেবারে জোড়া লেগে গেল।আর নীচে তাকিয়ে সে দেখল,সে এখন বসে রয়েছে একটা রাজকীয় কারুকার্যখচিত মখমলে সিংহাসনের মধ্যে।আর তার চারপাশে পদানত ভৃত্যের ন্যায়ে হাতজোড় করে বসে রয়েছে সমস্ত বিকটদর্শন প্রেতাত্মা।দিগ্বিজয় বুঝতে পারল সে এখন ওই গাছের গুঁড়ির ভিতরে অবস্হান করছে আর বাইরে বেরোনোর রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।সে এবার বেশ রেগে গেল।রেগে লাল হয়ে সে বলল,"এইসব কি বুজরুকি হ্যাঁ?আমায় কোথায় এনেছ?শিগগির আমায় এখান থেকে বার কর।তখন থেকে বলছি আমার জলতেষ্টা পেয়েছে তোমরা কি সেটা বুঝছ না?"


সাথে সাথে চতুর্দিকে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল।ওরে কে কোথায় আছিস...মহারাজের জল পিপাসা পেয়েছে। শিগগির ওনাকে জলপান করানোর ব্যবস্হা কর।সেই ভূতের দলের একজন চেঁচিয়ে বলে উঠল আমি আমার হাত বাড়িয়ে নদী থেকে জল তুলে এনে মহারাজকে অর্পণ করছি।এই বলে সে হঠাৎ তার ঢেঙা হাতটা প্রসারিত করল আর সাথে সাথে সেটা ঘতঘত করে বেশ বিঘতখানেক বেড়ে গেল আর সেটা সেই বন্ধ গাছের গুঁড়ি ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল।আর নিমেষের মধ্যেই সেই হাতের তালপাতার আকৃতিসমান তালুর কোঁচড় একেবারে টাপটুপ ভর্তি হয়ে এল নদীর জল।জল দেখে দিগ্বিজয়ের যেন প্রাণে বাতাস লাগল।সে তার কোমরে বাঁধা থলে থেকে পিতলের গেলাসখানা বার করে প্রেতাত্মার প্রসারিত তালুর কোঁচড়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে পরম তৃপ্তির সাথে জলপান করতে লাগল।জলটল খেয়ে নিয়ে শান্তির শ্বাস ফেলে দম নিয়ে এবারে সে ভূতেদের শুধালো।"ব্যাপারখানা কি হে?এটা কোন জায়গা?আর আমাকে এইখানে নিয়ে আসারই বা অর্থ কি? আমাকে এখান থেকে বার হওয়ার পথ বাতলে দাও।শুঁটকিপোড়া গন্ধে আমার বমি পাচ্ছে।"

---" ও কি কথা মহারাজ! আমাদের সব শুভ অনুষ্ঠানে আমরা তো এই সুবাস দিয়ে বাতাস মুখরিত করে তুলি।এই গন্ধ তো সুখ শান্তি আর সম্বৃদ্ধির বার্তা বহন করে মহারাজ।

এবার আরো কিছু প্রেতাত্মা মখমলে লাল কাপড়ে জড়ানো দুই তিনটি থালা নিয়ে এসে দিগ্বিজয়ের পায়ের সামনে সসম্মানে রেখে জোড়হাত করে একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়াল।একজন সর্দার গোছের ভূত এসে দিগ্বিজয়ের সামনে গড় করে উঠে বলল,"মহারাজ!সামান্য কিছু ভোগের আয়োজন করেছি।আপনি গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করুন..."

দিগ্বিজয়ের সত্যিই খুব ক্ষিদে পেয়েছিল।তিনটি বড় বড় লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা থালা দেখে সে সত্যিই ভারি আনন্দিত হল।সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে খুশিমনে থালার উপরের ঢাকা দেওয়া কাপড় সরাতেই সে এমন ভিরমি খেল যে তার সাতজন্মের অন্নপ্রাশনের ভাত একেবারে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল।থালাভর্তি সাজানো যেসব সুস্বাদু পদ সেগুলির নাম এক এক করে শুনল দিগ্বিজয়।পচা হাড় আর মাংসকুচির পোলাও,ধেড়ে ইঁদুরের পচানো মাংসের কালিয়া,সাপের খোলসের ভিতর পচা বিছে ব্যাঙের পুর ভরা চপ,হায়নার রক্ত দিয়ে স্যুপ আর বিছুটি পাতার "সুস্বাদু"পান।এইসমস্ত আয়োজন চাক্ষুস করে আর মেনুর বহর শুনে তো দিগ্বিজয়ের হৃদযন্ত্রটি ধরে বসে পড়বার মতো উপক্রম হল।সাথে ভীষণভাবে বমি পেতে লাগল।এবার ভূতের সেই সর্দারটি জোরে হাঁক দিয়ে বলে উঠল...আহা তোরা যে কি আহাম্মকের মতো কাজ করিস...আমাদের জন্য যেটা অমৃততুল্য মহারাজের কাছে যে সেটা বিষতুল্য এইটা বোঝার ক্ষ্যামতা হল না তোদের...

এরপর সেই সর্দার ভূত গদগদ কন্ঠে বলে উঠল,বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে মহারাজ...এদেরকে লঘুজ্ঞানে ক্ষমা করে দিন...আমি এক্ষুনি আপনার সঠিক আহারের ব্যবস্হা করছি।এই বলে সে ওই অখাদ্যগুলোকে ফের লাল কাপড় দিয়ে চাপা দিয়ে দিল আর তার উপরে তার বিকটদর্শন হাতের তালুখানা রেখে বিড়বিড় করে কিসব যেন বলল।তারপর সে হাঁক দিয়ে উঠে বলল,"ওরে কে আছিস!থালার ওপরের কাপড়খান সরিয়ে মহারাজকে রাজভোগ পরিবেশন কর...

সাথে সাথে দুইটি ক্ষয়াটে প্যাংলা আর বিকটদর্শন ভূত তিড়িং তিড়িং করে এসে হাজির হয়ে থালার উপরের কাপড়খানি ফের সরালো।এবার দৃশ্য দেখে দিগ্বিজয়ের চক্ষু চড়কগাছ।থালার পচা হাড় মাংসে কুচি র পোলাও রূপান্তরিত হয়েছে ঘিএর গন্ধ ওঠা চমৎকার বাসন্তী পোলাওতে।ধেড়ে ইঁদুরের পচা মাংসের কালিয়া হয়ে গিয়েছে সুগন্ধি পাঁঠার মাংসের কালিয়া।সাপের খোলসের ভিতর পচা বিছে ব্যাঙের চপ এখন হয়ে গিয়েছে চিংড়ির পুর ভরা পটল কষা আর রক্তের স্যুপ এখন হয়ে গিয়েছে কাঁচা আমের টক।আর বিছুটি পাতার পান হয়ে গিয়েছে সুপারি ভরা স্বাদু মিষ্টিপান।দিগ্বিজয় এ জীবনে এত ভালো ভালো খাবার খাওয়া তো দূরের কথা...চোখেও দেখেনি।শিশুকাল হতে এ ওর মুখ থেকে শুনে শুনে এইসব ছিল তার কাছে ছেলেভুলানো কল্পকাহিনী।আজ এত ভালো ভালো খাবার তারই খাওয়ার জন্য এইভাবে থালায় সাজানো রয়েছে দেখে আর ক্ষিদে সামলে রাখতে পারল না দিগ্বিজয়। সে জামার হাতা পটপট করে গুটিয়ে নিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া আরম্ভ করল।


এই কটাদিনের অভুক্ত পেট খাবারের জায়গায় এমন রাজভোগসম আহার পেয়ে এমনই পরিতৃপ্ত হল যে সেই তৃপ্তির রেশএ বিহ্বল হয়ে দিগ্বিজয় ভাতপাতের পাশেই একেবারে নাসিকা গর্জনের সাথে নিদ্রার সাগরে অবগাহন করল।যখন ঘুম ভাঙল সে দেখল,সে একটি মখমলে রাজশয্যায় শুয়ে রয়েছে আর তার চারপাশে চামরের পাখা নিয়ে বাতাস করছে দুই বিকট দর্শন কদাকার ভূত।সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এবার বলল,আ...আমি কোথায়?

চামর দোলানো দুই ভূতেদের একজন আরেকজনকে বলল,ওরে...সর্দারকে খবর দে রে...মহারাজ ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন...সাথে সাথে উল্টোদিকের ভূতটা বাতাসে মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।এবার দিগ্বিজয় চোখ কচলাতেই হঠাৎ তার সামনে বাতাসে দুটো আলো টলমল করে ভেসে উঠে সে দুটির একটি চামরধারী ভূত আর অপরটি সেই সর্দার ভূতের রূপ নিল।এবার দিগ্বিজয় বেশ ঝাঁঝের সাথেই বলল,"আচ্ছা তোমরা আমাকে কোথায় এনেছ বলো তো...আমি মানছি খাবারগুলো অতি চমৎকার ছিল।আর এমন মখমলে রাজশয্যায় তো আমি শোয়া দূর...চোখে দেখারও সৌভাগ্য হয়নি এ জীবনে।কিন্তু তোমরা তো কিছুতেই বলছ না এ কোন জায়গা...আমায় এখানে তোমরা কেন নিয়ে এলে...আমায় যে বিনা কারণে কেউ খপ করে ধরে সিংহাসনে বসালেও আমি বেশিক্ষণ সেখানে থাকি না।বুঝেছ?"


---হাতজোড় করে ভূতের সর্দার বলল,"মহারাজ...আপনি এখন এক বৎসরকালের জন্য এই প্রেতরাজ্যের রাজাধিরাজ।আমাদের দুনিয়াটা ঠিক আপনাদের ধরিত্রীর নীচ থেকেই আরম্ভ যার কয়েকটি দরজার একটি হল ওই বৃক্ষটি যার গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।ওই গাছটির গুঁড়িতে যে পিঠ ঠেকিয়ে বসে তাকে এক বৎসর কালের জন্য এই প্রেত রাজ্যের রাজসিংহাসনে বসিয়ে তার শাসনাধীনে আমাদের থাকতে হয়।গতকালের পর হতে এই প্রেতের রাজত্ব আপনার মহারাজ।আমরা সবাই আপনার দাস।"

এই বলে মাথা নত করল সর্দার। 

বেশ ক্রোধান্বিত হয়ে দিগ্বিজয় বলল,আমি কোনো রাজত্ব বা সিংহাসন চাই না।এখান থেকে বেরোবার পথ আমায় বাৎলে দাও।আমি এই ধরিত্রীর দর্শনের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করেছিলুম।খামোখা তোমাদের মতো উজবুকদের মাঝখানে রাজা হয়ে বসে একটি বছর নষ্ট করব!কাঁচকলা।সেটি হবে না।এক্ষুনি এখান থেকে বেরোনোর দরজা খুলে দাও।"

ভূতের সর্দার হাতজোড় করে বলল,"সেটা তো আর সম্ভব নয় মহারাজ...এক বছর শেষ হওয়ার আগে তো এই দরজা খোলার সাধ্যি আমাদের কারোর নেই।"

এই কথা শুনে এবার দিগ্বিজয় মাথায় হাত দিয়ে বসে কপাল চাপড়াতে আরম্ভ করল।হা ভগবান!এই ছিল কপালে!জঙ্গলে ভর্তি এত গাছ থাকতে বেছে বেছে ওই গাছের গুঁড়িকেই কেন সে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করার জন্য বাছতে গেল!সে নিজের উদ্দেশ্যে নিজেই গাল পাড়তে লাগল।তা দেখে ভূতের সর্দার হাঁক দিয়ে সবাইকে বলে উঠল..."ওরে...মহারাজের মন মেজাজ খারাপ হয়েছে। তোরা দাঁড়িয়ে কেন!মহারাজের মন চাঙ্গা করতে হবে তো...নাচ গান সার্কাস এইসবের ব্যবস্হা কর...

সাথে সাথে চতুর্দিকে অদ্ভুত সব বাদ্যযন্ত্রের বিকট সুরমূর্ছনা শুরু হয়ে গেল।দিগ্বিজয় চোখ কচলে ভালো করে চারদিকে তাকাতেই দেখল,চতুর্দিকে কিম্ভুত সব প্রেতাত্মা বিচিত্র নৃত্য আর কানে তাক লাগানো সঙ্গীত আরম্ভ করে দিয়েছে।মাঝে চলছে বিভিন্ন প্রকার সার্কাস।এক একটা ভূত পেটের উপর থেকে গোটা শরীর আলাদা হয়ে যাচ্ছে আর তারপর দুটো পা এক তালে আর দুটো হাতশুদ্ধ বাকি শরীর শুন্যে ভেসে ভেসে নাচ্ছে।কেউ কেউ নিজের মাথা কেটে সেটা হাতে নিয়ে নাচন কোদন করে মাথাখানা আবার তার ঘাড়ের উপরে টুপি রাখবার মতো করেই জুড়ে দিচ্ছে আগের মতো।কেউ কেউ শুন্যে উঠে ভেসে বেড়াচ্ছে আর ডিগবাজি খাচ্ছে।এইসব চোখ ধাঁধাঁনো কান্ডকারখানা দেখতে দেখতে আর বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র সহকারে এইসব অপার্থিব উদ্ভট সঙ্গীত শুনতে শুনতে কখন যে এসব দিগ্বিজয়ের ভালো লাগতে শুরু করেছে সে নিজেই সেটা টের পায়নি।টানা ঘন্টাদেড়েক ধরে এইসব ভৌতিক কান্ডকারখানা চলার পর অবশেষে যখন থামল আর সমস্ত কিম্ভূত কলাকুশলীগণ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দিগ্বিজয়কে লম্বা কুর্নিশ দিতে থাকল তখন আপনা হতেই কিভাবে দিগ্বিজয়ের দুইহাত উচ্ছ্বসিত তালি দিতে শুরু করল সে নিজেই সেটা টের পায়নি।যখন পেল,তখন হট করে সে তালি বাজানো বন্ধ করে হাঁ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরেসুস্হে বলল,তোমাদের এইসব রংতামাশা আর নাচগান দেখেশুনে ভারী আনন্দ পেলুম হে।আমাদের পাড়াগাঁয়ে খোকাকাল থেকে বহু তামাশা দেখেছি আর নাচগানও শুনেছি।এমনভাবে মনের মধ্যে স্ফূর্তির ফড়িং ওড়াউড়ি কোনোদিন করেনি।

গদগদ হয়ে ভূতেদের সর্দার করজোড়ে বলে উঠল।আপনাকে আমরা আমোদ দিতে পেরেছি এ তো আমাদের সৌভাগ্য। এবার তাহলে মহারাজ দয়া করে সিংহাসনে বসেন...আমরা অভিষেকের বন্দোবস্ত করি...


"আরে ধুর...কিসের রাজা আর কিসেরই বা প্রজা অ্যা?বেরোনোর দরজা খুলে দিতে বলেছিলুম...তা তোমরা তো সেইটে পারবে না।তা এখন দেখছি তোমাদের এখানে কিছুকাল থাকলে নেহাৎ মন্দ মজা হবে না।ওসব রাজা রাজসিংহাসন গুলি মারো।নেচে গেয়ে আনন্দ করে কটা মাস এইখানেই কাটিয়ে দিই।"

এই বলে সে রাজশয্যা থেকে লাফিয়ে নেমে প্রেতের দঙ্গলের মাঝখানটায় একেবারে থেবড়ে বসে গেল।আর তাকে ঘিরে চারপাশে সব প্রেতের দল হইহই করে উল্লাস করতে থাকল।

এরপর থেকে দিগ্বিজয় রয়ে গেল এই ভূতের রাজ্যে এদেরই একজন হয়ে।রাজার জন্য বরাদ্দ আয়েশ বা আনন্দ স্ফূর্তির ধারেপাশেও সে গেল না।বরং তাদের সাথে তাদেরই একজন হয়ে দিনযাপন করতে লাগল স্ফূর্তির সঙ্গেই।

প্রেতের রাজ্যে বাস করতে করতে দিগ্বিজয় দেখল,এখানকার রকমসকম সবই দুনিয়াদারির রকমসকমের থেকে ষোলোআনাই উল্টো।এখানে কোনো ঝগড়া বিবাদ নেই,নেই কোনো প্রতিহিংসা,প্রতিযোগিতা অথবা সার্থান্বেষণ।এখানে কোনোকিছুই যার যার তার তার নয়।বরং এখানে একে অপরের জন্য সকলেই নিজেদের দরজা সবসময় উন্মুক্ত করে রেখেছে।এদের মনেও কোনো প্যাঁচ নেই।এরা মুখে আর মনে একদম এক।মিথ্যাভাষণ,জোচ্চুরি অথবা লোক ঠকানো এইসবের কোনো চিহ্নমাত্র এখানে নেই।সবাই এখানে দিলখোলা হাসি নিয়ে এক সুখের আর শান্তির জীবন বাঁচে।কে কার ঘরে খায় আর কে কার ঘরে শোয়ের তার কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না।এই পাতালপুরীতে সূর্যের আলো না থাকলেও সমস্ত প্রেতের গা থেকেই এমন উজ্জ্বল আলো ঠিকরে বেরোয় সবসময় যে সেই আলোতেই যেন এই প্রেতপুরী ঝলমল করে সবসময়।তাদের মাঝে রাজা হয়ে দিগ্বিজয় রাজসিংহাসন আর সমস্ত বিলাসব্যসন দূরে ঠেলে প্রেতপুরীর মাঝে এক নির্জন জায়গা বেছে আপন মনে দিলদরিয়া গান ধরে।ক্রমশ সেই নির্জন স্হান আর নির্জন থাকে না।দিগ্বিজয়ের মন তোলপাড় করা সে গান শুনে ক্রমশ তার চারপাশে একটি দুটি করে ভূতের আনাগোনা হতে আরম্ভ করে।এরপর প্রতিদিন তার এই গানের আসর একেবারে জমে ওঠে।এখানে কেউ তাকে পাগল ছাগল বলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে না।বরং সেখান ক্রমশ তার প্রতি সকলের শ্রদ্ধা,ভালোবাসা আর আস্হা বাড়তে থাকে।সে ক্রমশ এই প্রেতের দলেরই একজন হয়ে ওঠে।একসময় সে লক্ষ্য করে,এখানে আলাদা করে কারোর জীবিকা বা কর্মসংস্থানের কোনো ব্যাপার নেই প্রত্যেকটি ভূতের একটিই কাজ।এই প্রেতপুরীর মাঝবরাবর একটি প্রকান্ড কূপের মতো গর্ত রয়েছে।সেই গর্তের গভীরে রয়েছে একটি প্রকান্ড শিলাখন্ড।এই প্রেতপুরীর রাজ্যে যত ভূত রয়েছে সবাই মিলে পালা করে করে ওই প্রকান্ড কূপের মতো গর্তের চারপাশ ঘিরে হাতে একটা করে শক্ত বিরাট দৈর্ঘ্যের লাঠি নিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একটি ওই শিলাখন্ডটিকে একবার ডানপাশে সরিয়ে ধরে তো একবার বাঁম পাশে।আর ওই শিলাখন্ডটি ডানপাশে বা বাঁমপাশে যেদিকেই সরানো হোক,তার অপর প্রান্ত হতে নির্গত হতে থাকে ঘন কালো এক প্রকার ধোঁয়া।আর ওই ঘন কালো ধোঁয়ার কুন্ডটি খানিক ওপরে উঠেই যেন বাতাসে মিশে অদৃশ্য হয়ে যায়।দিগ্বিজয় একদিন তাদের জিজ্ঞেস করেছিল ব্যাপারখানা কি!তারা উত্তরে বলেছিল,ওই পাথরখন্ডটি হল তাদের প্রেতপুরীর অভিশাপ।ওই পাথরখন্ডটি সবাই মিলে তাদের প্রত্যেককে ঠেলে যেতে হবে চিরকাল।কারণ ওই পাথরখন্ড দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে তাদের জীবনদায়ী ধূম্রকুন্ডের একমাত্র উৎসকে।ওই ধূম্রকুন্ড বাতাসে এসে মেশে বলেই এই প্রেতের রাজ্য টিকে রয়েছে।এই পাথরকুন্ডে একমাত্র কোনো রক্তমাংসের হাতের শক্তি টানা তিনশো পঁয়ষট্টি দিন পড়লে তবেই এই পাথর চিরতরে সরে যাবে।তাইতো রক্তমাংসের মানুষের জন্য কোনো কোনো সময় আমাদের এই প্রেতপুরীর দরজা খুলে যায়।আমরা তাকে রাজার আসনে বসাই।খাতির যত্ন করি আর তার পদসেবা করি।আর তার কাছে আমাদের এই শাপমোচন করার জন্য অনুনয় বিনয় করি।কিন্তু যে রক্তমাংসের মানুষ আমাদের এই প্রেতপুরীতে আসে সে শুধুই আমাদের শোষণ আর নিপীড়ন করে।লোভ করে আর পরিশেষে মরে।তাই আমরা এখন অনুনয় বা অনুরোধ উপরোধ করা ছেড়ে দিয়েছি।যেমন চলছে চলুক...ভাগ্যে থাকলে আমাদের ঠিক শাপমুক্তি ঘটবে একদিন। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভূতেদের সর্দার।

ওদের কথা শুনে বড় মায়া হল দিগ্বিজয়ের।সে প্রেতগুলোর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,তোমরা চিন্তা কোরো না।আমি প্রতিদিন এ ঠেলে এই পাথর সরিয়ে তোমাদের শাপমুক্তি ঘটাবো।তার কথা শুনে প্রেতের দলের দীর্ঘশ্বাস আরও ভারি হল।এরপর থেকে সত্যিই দিগ্বিজয় একেবারে কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়ল পাথর সরানোর কাজে।সে যে এখানে রাজা,এ কথা আর কারোরই মাথায় রইল না।সে এখন প্রেতের দলেরই একজন হয়ে উঠেছে।এই প্রেতপুরীতে তার জন্য পাতা রয়েছে রাজ সিংহাসন,বরাদ্দ রয়েছে সেবা আর সুখ-ভোগের আয়োজন,সেটা ক্রমেই সকলের মন থেকে মুছে গেল ধীরে ধীরে।সে এখন প্রতিদিন মুটে মজুরের মতো শ্রম দিয়ে দিয়ে একটু একটু করে পাথর সরাতে মগ্নপ্রাণ।পাথর সরিয়ে কালো ধোঁয়াখানি বার করে করে সমস্ত প্রেতের বুকে শ্বাস নেওয়ার বাতাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য সে পণ করে বসে রয়েছে নিজের জীবন।ধীরে ধীরে এই অমানুষিক পরিশ্রমের দরুণ তার শরীর ক্রমে ভেঙ্গে পড়তে থাকল।প্রকান্ড কূপসদৃশ ওই গর্ত থেকে নির্গত উত্তপ্ত কালো ধোঁয়ার সংস্পর্শে তার মুখেচোখে এবং সর্বশরীরে রোগক্লিষ্টতার যন্ত্রনার ছাপ পড়তে থাকল ধীরে ধীরে।তবু সে একদিনের জন্যও এই কাজে বিরতি দিয়ে একবার রাজসিংহাসনের গদির আরামের দিকে ছুটে যায় না।প্রেতের দল ইতিতধ্যেই খুব ভালোবেসে ফেলেছে দিগ্বিজয়কে।তারা এবার একদিন সমস্বরে সবাই মিলে বলল,"আমাদের শাপমোচনের জন্য তোমার এমন কষ্ট আমরা আর দেখতে পারছি নে।কপালে লেখা থাকলে নাহয় আমরা সবাই মরব।কিন্তু এইভাবে আমরা আর তোমায় তিল তিল করে মরতে দেখতে পারব না।এ কাজ আজ থেকে তুমি বন্ধ করে রাজসিংহাসনে বসো।অনেক কষ্ট গেছে তোমার উপরে।এবার আমরা একটু তোমার পদসেবা করি।"

দিগ্বিজয় তাদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,"ভাইসব...তোমরা সবাই এত ভালো...এত সুন্দর মন তোমাদের...এমনতরো আমি পৃথিবীর মাটিতে কখখোনো দেখিনি।যে আমাকে পৃথিবীর সবাই চিরকাল দুরছাই করেছে,তাকেই তোমরা এমন মাথায় তুলে রেখেছ...তোমাদের সকলের নির্বংশ হওয়ার চাইতে যদি শুধুমাত্র একখানা প্রাণ যায়...তাহলে ক্ষতি কি!তোমাদের বাঁচাতে পারলে আমার মরণও সার্থক।"

সে প্রেতের দলের কোনো বারণ শুনল না।সে দ্বিগুণ উদ্যম নিয়ে আবার লেগে পড়ল পাথর সরানোর কাজে।

ক্রমশ তার শরীর ভাঙতে থাকল।তার হৃষ্টপুষ্ট শরীরটি ক্রমশ একটি মাংসহীন রোগক্লিষ্ট কঙ্কালে রূপান্তরিত হতে থাকল।সে ক্রমশ ওই কালো ধোঁয়ার অন্তরালে এমনভাবে অদৃশ্য হতে থাকল যে ওই ঘন কালো ধোঁয়ার উদরে চলে যাওয়া দিগ্বিজয়কে আর প্রেতের দল দেখতে পেল না।দিগ্বিজয় অনেকখানি পাথর সরিয়ে ফেলার পরে এভাবে যে ওই কালো ধোঁয়ার অতল গর্ভে হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো সেটা প্রেতের দল দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।তারা বুঝতে পারছে,ওই অন্ধকূপের ধোঁয়ার উৎসস্হল থেকে পাথর এখনো সরছে...আর দিগ্বিজয় ক্রমশ বিলীন হয়ে চলেছে ওই মারণ গর্তের উদরে।ওকে যে আর বাঁচানো যাবে না এটা বুঝতে তাদের বাকি রইল না।তারা সবাই এখন আক্ষেপ করতে শুরু করল একটাই কথা ভেবে...তাদের এই বিপদের কথাটা এভাবে খোলাখুলি তাকে না বললে আজ এমন একটি ভালো মানুষের এমন যন্ত্রনার মৃত্যু তাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হত না।প্রেতপুরীতে নেমে এল শোকের ছায়া।তারা মনেপ্রাণে শুধু প্রার্থনা করতে থাকল...শুধুমাত্র দিগ্বিজয় যেন জীবিত অবস্হাতে ফিরে আসতে পারে ভালোয় ভালোয়...


এইভাবে কেটে গেল আরো দীর্ঘকাল সময়।দিগ্বিজয় এবার পুরোপুরি ওই পাথরের আড়ালের অতল ভূগর্ভে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।আর তাকে দেখতে পায় না প্রেতপুরীর বিদঘুটে,তিতকুটে,মিশকালো,সাদা কালো,পিপে কলেবর,কঞ্চিসদৃশ, ক্ষয়াটেমার্কা কোনোপ্রকার প্রেত।এই কয়েকদিনেই তাদের পেতে দেওয়া রাজসিংহাসনের আরাম আয়েশ আর প্রভুত্ব অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দিগ্বিজয় প্রেতেদের মনের সিংহাসনে এমনভাবে রাজত্ব করছে যে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে দিগ্বিজয়ের অনুপস্থিতি তাদের কাঁদিয়ে তুলছে।তার অমঙ্গলের আশঙ্কায় তাদের মনের ভিতরে যেন বজ্রাঘাত হয়ে চলেছে।

ওদিকে দিগ্বিজয় এতদিনের কঠোর পরিশ্রম দিয়ে কালঘাম ছুটিয়ে অবশেষে পাথর সরাতে সক্ষম হতে পেরেছে।কিন্তু সে পাথর সরাতে গিয়ে ক্রমশ নিজেই এমনভাবে ওই অতল গর্তের কালগর্ভে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে যেখান থেকে তার নিজের ফেরার রাস্তাখানাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।এটা যখন সে বুঝতে পারল তখন এতটাই দেরী হয়ে গিয়েছে যে সবকিছু তার হাতের বাইরে চলে গেছে।পাথর সরিয়ে প্রেতপুরীর সকলের জীবন বাঁচানোয় কৃতকার্য দিগ্বিজয় যখন আনন্দে ডগমগ,তখনই তার প্রথম খেয়াল হল যে তার ফেরার রাস্তাখানা পুরোপুরি বন্ধ।এখন ওই আলকাতরা কালো গর্তের উদরে আটকা পড়ে নিজেকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দেওয়া ভিন্ন আর কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই।সে এবার ডুকরে কেঁদে উঠল।হা ঈশ্বর! এই ছিল কপালে!সে দু পা ছড়িয়ে বসে পড়ে কপাল চাপড়ে হায় হায় করতে লাগল।ক্রমে সে দেখল,একটি সুবিশাল ছায়ামূর্তি তার সামনে ক্রমশ ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে।তার অবয়ব হতে এমন এক তীব্র দ্যুতি আসছে যে তার চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে।তবে ভয় সে পেল না।আর কিসেই বা ভয় আর কাকেই বা ভয়!আসন্ন মৃত্যু যেখানে তার অদৃষ্টে এসে কড়া নাড়ছে তখন আর নতুন করে কোনো বিস্ময় বা ভয় আর জায়গা পেল না দিগ্বিজয়ের মনে।সে ভালো করে দুইচোখ কচলে নিয়ে তাকাল তার সামনে দন্ডায়মান অবয়বটির নিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।সে বেশ বুঝতে পারল,আকার আর আকৃতিতে এই ছায়ামূর্তিটির সঙ্গে প্রেতপুরীর সকল প্রেতেরই যথেষ্ট সাদৃ‌শ্য রয়েছে।শুধু আকৃতিতে এই অবয়বটি প্রেতপুরীর সকল প্রেতেদের প্রায় দশগুণ।কয়েক মূহুর্তের নীরবতার পর প্রায় স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কাঁপানো কন্ঠে বলে উঠল সেই ছায়ামূর্তি।

"আমার মহলে তোমায় স্বাগত জানাই মানুষের পো...।"


---"আ...আ...আপনি ক্কে..এ?

ভগ্নকন্ঠে কোনোমতে বলল দিগ্বিজয়।


---"আমি হলাম ওই প্রেতপুরীর রাজা"।


---"আ...আপনি প্রেতপুরীর রাজা?কি করে সেটা সম্ভব!ওরা সবাই তো আমাকে ধরেবেঁধে রাজ সিংহাসনে বসিয়েছিল...।


---"হ্যাঁ তা বটে"।


---"প্রতিবার ওরা ওদের নতুন রাজার জন্য অপেক্ষা করে।পেলে তাকে সিংহাসনে বসিয়ে তার পদসেবা করে।তার প্রভুত্বের নীচে নিজেদের ধূলোকাঁকড়ের মতো বিলিয়ে দেয়।তাদের যদি রাজা থাকবে তাহলে তারা এভাবে নতুন কারোর আগমনের জন্য প্রহর কেন গুনবে!"


দিগ্বিজয়ের কন্ঠে কৌতূহল স্পষ্ট।


দীর্ঘাবয়ব তার অপার্থিব গমগমে কন্ঠে চতুর্দিক কাঁপিয়ে বলে উঠল,


"বহুদিন আগে আমি প্রেতপুরীর সিংহাসনে রাজত্ব করতাম।তাদের নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতাম।তারাও আমায় ভগবানের মতোই ভক্তি শ্রদ্ধা করত।একদিন সমস্ত প্রেতপ্রজারা একত্রিত হল।কারণ তাদের মনে হঠাৎ দেখা দিল এক যুক্তিহীন চিন্তা।তাদের হঠাৎ মনে হতে লাগল,এই প্রেতপুরীতে তারা ভালো নেই।এর চেয়ে ঢের সুখে আর ভোগে দিনযাপন করছে পৃথিবীর মানুষেরা।তাই তারা আমার কাছে অনুমতি নিতে এল,যে তারা সকলে এই প্রেতপুরী ছেড়ে পৃথিবীর মাটিতে নিজেদের আবাসস্থল তৈরি করবে আর পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে হয় হত্যা করবে না হয় দাস বানাবে।ধরিত্রীর বুকে তারা "হিংসা"কে আরাধ্য দেবতা হিসাবে পূজো করবে আর ভোগ বিলাসে কাল যাপন করবে।আমি তাদের এই ভয়ংকর ভুল সিদ্ধান্ত হতে তৎক্ষণাৎ সরিয়ে আনবার চেষ্টা করলাম।তাদের বললাম,হিংসা দিয়ে ভালো কিছু জয় করা যায় না।পৃথিবীর মানুষগুলোকে দেখলে মনে হয় তারা মহাসুখে আর ভোগে মহানন্দে কালযাপন করছে।কিন্তু এদের মনে এতটুকুও শান্তি নেই।সব সময় এর বিরুদ্ধে হিংসা ওর বিরুদ্ধে চক্রান্ত,পার্থিব স্বার্থান্বেষণ,এই করে ওরা দগ্ধে দগ্ধে মরছে আর অপরকে মারছে।তোরা কারোর ক্ষতি করার চিন্তাতেও যাস না।যেমন শান্তির জীবন কাটাচ্ছিস..

তেমনই কাটা...

কিন্তু ওরা আমার কথা শুনলে তো!আমি বুঝলাম রক্তের নেশায় এরা তৃষ্ণার্ত হয়ে টগবগ করে ফুটছে।শেষমেষ ওরা সবাই মিলে বিদ্রোহ ঘোষণা করল।আমাকে সবাই মিলে ধরে এই অন্ধকূপে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওরা সদলবলে অগ্রসর হল পৃথিবী জয় করে সেখানে রাজ করার যাত্রায়।আমি তখন এই গর্তের ভিতরে অবস্হান করে আমার মন্ত্রবলে ওদের সেই ক্ষীপ্র মত্ত যাত্রার রাস্তাখানি চিরতরে বন্ধ করে দিলাম এবং অভিশাপ দিলাম,যে গাছের গুঁড়ি দিয়ে ওদের যাত্রাপথ আমি বন্ধ করেছি,ওই গাছের গুঁড়িতে যদি কোনো মানবসন্তান বিশ্রাম নেয়,তাহলে তাকে আমার রাজ সিংহাসনে বসিয়ে তার পদসেবা করতে হবে যাতে সে দয়াপরবশ হয়ে তাদের জীবনদায়ী বাতাসকে আমার দন্ডস্বরূপ এই সুবিশাল শিলাখন্ডটি নিজ বাহুবলে সরিয়ে চিরতরে মুক্ত করে তাদের জীবনদায়ী এই ধূম্রপ্রবাহকে।কিন্তু আজ পর্যন্ত যত মানুষ এসে বসেছে এই রাজ সিংহাসনে তারা কেউই এদের কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করেনি তারা শুধুই বিলাসব্যসনে মত্ত থেকেছে আর এদের যারপরনাই শোষণ আর নিপীড়ন করে শেষে লোভের পথে পা বাড়িয়েছে।প্রেতপুরীর প্রতিটি ধূলিকণাও যে সোনার আর প্রতিটি পাথর আর শিলাখন্ড যে আসলেই বহুমূল্য কোহিনূর হীরা জহরত বই আর কিছুই নয় সেটা বুঝতে কারোরই বাকি থাকেনি।তারা এখান থেকে বেরোনোর সময় থলে বোঝাই করে এইসব যতটা সম্ভব নিয়ে বেরোতে গিয়েছে।কিন্তু এটা তো কেউই আজ পর্যন্ত জানে না...এখান থেকে বেরোনোর পথে হাত যদি শূন্য না থাকে তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য।আর সেই কারণেই যে আজ পর্যন্ত কত মানুষের পো যে মরল তার হিসাব রাখে কে!বহু বছর আগে প্রেতপুরীর উপরের রাজ্যে এক জ্যোতিষী যবে থেকে বলে গিয়েছেন,এই জঙ্গলের ভিতরে ঢুকলে বিপুল ধনরাশি পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, তবে থেকে বহু মানুষের পো এই জঙ্গলে ঢুকেছে।আর বৃক্ষকান্ডটির অমোঘ টান উপেক্ষা করতে না পেরে এই গাছের নীচেই অচৈতন্য হয়ে ঘুমিয়েছে আর পরিশেষে এই প্রেতপুরীর রাজ সিংহাসনে রাজা হয়ে বসেছে।কিন্তু হায়!একটাও জ্যান্ত ফিরতে পারল না স্রেফ লোভের ফাঁদে পা দিয়ে।এই দীর্ঘকাল ধরে তো আর মানুষের পো'র অকাল মরণ তো আর কম দেখলুম না...আজ পর্যন্ত আমি তোমার মতো একজনকেও দেখলুম না,যার এই প্রেতপুরীর বালি কাঁকড় পাথরের প্রতি কোনো লোলুপ দৃষ্টি নেই...রাজ সিংহাসনের বিলাস ব্যসনের প্রতি কোনো টান নেই...পায়ের তলায় নত দাসেদের নিপীড়ন করার কোনো বাসনা নেই...উপরন্তু তাদের সাথে এভাবে এক হয়ে গিয়ে তাদের হৃদয়ের সিংহাসনে রাজ করছ তুমি।উপরন্তু তাদের শাপমোচন করে প্রাণে বাঁচানোর জন্য নিজেকে এইভাবে ঠেলে দিয়েছ মৃত্যুর অতল গর্ভে।তুমি কে গো?কোন স্বর্গ হতে তোমার আগমন?


অতল আঁধারকালোর বুকে প্রবল প্রতাপের সাথে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায়ে দন্ডায়মান মূর্ত অবয়বের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে তার কন্ঠ নিঃসৃত বজ্রনিনাদের সমান ধ্বনিতে নিঃসৃত তার কথাগুলো একমনে শুনছিল দিগ্বিজয়। সে এখন জীবন মৃত্যু,ইহকাল পরকাল সম্পর্কে সমস্ত চেতনালুপ্ত হয়ে এমন একটা ঘোরে চলে গিয়েছিল যে বিপরীত প্রান্ত হতে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বলবার মতো আর কোনো ভাষাই খুঁজে না পেয়ে বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে নিশ্চুপে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।তারপর ধীরকন্ঠে জোড়হস্তে বলল,"প্রভু...আমি এক অভাগা অনাথ ছেলে।আমার তিনকূলে কেউ নেই। দুনিয়ায় আমার যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই,ফেরারও কোনো জায়গা নেই।আমি তাই গোটা দুনিয়া জগৎটাকেই আমার ঘরবাড়ি বানিয়ে নিয়েছিলাম।ইচ্ছা ছিল,যতদিন বাঁচব...ধরিত্রীর বুকে ঘুরে ঘুরে তাকে একেবারে কাছ থেকে জানব...চিনব।তাই তো ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়েছিলাম এক গভীর জঙ্গলের ভিতরে।ইচ্ছা ছিল,জঙ্গলটা কোথায় গিয়ে শেষ হয় সেটা দেখার।ক্ষুধা তৃষ্ণা কোনোকিছুরই পরোয়া করিনি...।একবার ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।ঘুমিয়েই পড়েছিলাম বোধহয়...।তারপরে চোখ মেলেই দেখি আমি প্রেতপুরীতে।সব প্রেতের দল আমাকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে আমার ভারি খাতির যত্ন করল।আমিও বড় ভালোবেসে ফেলেছি তাদের।আমার মনে হয় ওরা এবারে নিজেদের ভুলটা বুঝতে পেরেছে।দয়া করে যদি ওদের ক্ষমা করে ওদের অভিশাপমুক্ত করে দেন তাহলে আমি সারাজীবন আপনার ঋণী হয়ে থাকব।"

বিপরীত প্রান্তের দীর্ঘ অবয়ব গম্ভীর কন্ঠে পুনরায় চারপাশ কাঁপিয়ে বলল,


---সবই তো বুঝলাম...তুমি যেভাবে নিজেকে তিল তিল করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে ওই সুবিশাল শিলাখন্ডটা একটু একটু করে সরিয়ে ওদের জীবনদায়ী ধূম্রকুন্ডের নির্গত হওয়ার পথ পরিষ্কার করে ওদের প্রাণ বাঁচিয়েছ,তাতে ওরা এখন অভিশাপমুক্ত।কিন্তু সেই পাথর সরাতে সরাতে যে ভুলবশত হলেও তুমি এখানে...আমার এই নির্ঝঞ্ঝাট বিশ্রাম কক্ষে এসে উদয় হয়েছ...।তুমি তো এখন আমার বন্দী।তোমার তো মুক্তি নেই..."


এ কথা শুনে মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল দিগ্বিজয়ের।তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল।সে প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে ভীতকন্ঠে বলল,


---"কেন প্রভু...।আমি কি দোষ করেছি?আমি তো ধরিত্রীর দর্শনের যাত্রাপথে অনিচ্ছাকৃতভাবে এখানে এসে পড়েছি।আমার বড় সাধ...পাহাড় দেখব...কল্লোলিনী নদীর সৌন্দর্য দুচোখ ভরে অনুভব করব...সমুদ্রের ঢেউ গুনব...আমায় ছেড়ে দিন প্রভু..."

দিগ্বিজয়ের কন্ঠে কাতরতা স্পষ্ট।

প্রেতপুরীর রাজা বোধহয় বিবেচনা করার জন্য খানিক সময় নিলেন।দিগ্বিজয়ের বুকের ভিতর যেন কামার তার হাতুড়িতে শান দিচ্ছে।এইভাবে বেশ কিছুটা নিশ্চুপ মূহুর্ত কাটল।হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে ফের চারপাশ কাঁপিয়ে প্রেতপুরীর রাজা বলে উঠলেন,


"তোমার মুক্তির উপায় একটা আছে।যে পাথরটা তুমি এতটা দীর্ঘ সময় নিয়ে পরিশ্রম করে সরিয়েছ,ওটা যদি আমি আগের জায়গায় ফেলে ধূম্রকুন্ডের বেরোনোর রাস্তা ফের বন্ধ করে দিই তাহলেই তোমার জন্য খুলে যাবে সেই রাস্তা যেই রাস্তা ধরে তুমি সোজা পৃথিবীর মাটিতে পৌঁছে যেতে পারবে।তুমি যদি ওই শিলাখানি সরানোর জন্য আমাকে অনুমতি দাও,তাহলেই একমাত্র তোমার মুক্তি সম্ভব।


যারপরনাই বিচলিত হয়ে দিগ্বিজয় বলল,

---না...না...তা কি করে সম্ভব!আমি সকল প্রেতেদের জীবন বাঁচাব বলে তাদের কথা দিয়েছিলাম।এখন নিজের জীবন বাঁচাতে কি করে তাদের কথার খেলাপ করি আপনি বলুন....!"


---সবই তো বুঝলাম...কিন্তু তুমি নিজের অজ্ঞাতেই এ এমন জায়গায় ঢুকে পড়েছ...এখন এ ছাড়া তো তোমার এখান থেকে জীবিত বেরোনোর আর কোনো উপায় নেই..."

কম্পিত কন্ঠে জোড়হস্তে কাঁপা কাঁপা গলায় দিগ্বিজয় বলল...


---এ আমার পক্ষে অসম্ভব প্রভু...শুধু যে কথার খেলাপ করতে আমি অপারগ তা-ই নয়,আমি তাদেরকে বড় ভালোবেসে ফেলেছি।যতদিন পৃথিবীর মাটিতে ছিলুম...সকল মানুষের কাছে শুধুমাত্র তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর অবহেলাই পেয়ে এসেছি জন্ম ইস্তক।আপন বাপ মা র পর জীবনে এই প্রথম আমি এত ভালোবাসা পেলুম।আমি ওদের মারতে পারব না।আমাকে দয়া করুন প্রভু...আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন!"

দিগ্বিজয়ের কন্ঠে আকুতি স্পষ্ট।

প্রেতের রাজা নির্বিকার কন্ঠে বলল..."ওই শিলাটা যদি না সরানো হয় তাহলে তোমার বাঁচার কোনো উপায় নেই এ কথাটা পরিষ্কারভাবে বুঝে নাও।দেখো তুমি কি করবে এখন...সত্যিই...কম তো আর দেখলুম না এই মস্ত আয়ুর জীবনে...এমনতরো আমি বাপের জন্মে দেখিনি বাপু...এখন তাড়াতাড়ি বলে ফেলো দেখি...বাঁচবে নাকি মরবে...কোনটা পছন্দ?তাড়াতাড়ি বলে ফেলো বাপু...আমার প্রচুর কাজ আছে।অনেক্ষণ তোমার সাথে বকবক করেছি।আর ফালতু ভ্যাঁজোড় ভ্যাঁজোড় করার সময় আমার নেই।

বেচারা দিগ্বিজয় কি আর করে...।বিশ্বাসঘাতকতা তার রক্তে নেই।আর তার ওপর এই প্রেতের দুনিয়াতে এসে এমনই এক নিখাদ ভালোবাসা আর অমোঘ মায়ার বাঁধনে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গিয়েছে যে সে তাদের বিনাশ ঘটাতে পুরোপুরি অপারগ।সে একেবারে চুপ হয়ে গেল।শেষমেশ চোখের জল মুছে বলল,"দয়া করে ওই পাথর দিয়ে আর ধোঁয়ার মুখখানা চাপা দেবেন না।তাতে আমার যা হয় হবে।আমার কপালে যদি মরণ লেখা থাকে তাহলে সে খন্ডায় কার সাধ্যি!"

বলে ধপ করে বসে পড়ল দিগ্বিজয়।ভগ্নহৃদয়ে দুইহাত কপালে ঠেকিয়ে সে তাকাল উপরের দিকে।


---যেমন তোমার ইচ্ছা।তবে তাই হোক...আমার প্রজাদের প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। ওরা এতদিনে নিশ্চয়ই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে।ওরা হয়তো আমার সামনে আসতে চাইছে।আমি এখন বরং ওদের কাছেই যাই গে...।

এই বলে প্রেতের রাজা দিগ্বিজয়ের চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন।আর তার সাথে সাথেই চারপাশটা একেবারে কাঁপিয়ে দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল এই অতলপুরীর একমাত্র দরজা।অতল কালো অন্ধকারের হাঁয়ের ভিতর নিজেকে সঁপে দিয়ে নিস্পৃহ চিত্তে দিগ্বিজয় সেখানে তার ভারাক্রান্ত দেহখানি লুটিয়ে দিল শুধুমাত্র মৃত্যুর প্রতীক্ষা নিয়ে...।

সূর্যের কিরণের স্নিগ্ধ পরশে দিগ্বিজয়ের চোখের পাতা ধীরে ধীরে খুলল।অবাক কান্ড!এ সে কোথায় রয়েছে! এই তো সবুজ ঘাস...চারপাশে ঘন জঙ্গল...আর সামনে ওটা কি!সে আস্তে আস্তে গায়ের ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল...সে একটি পাহাড়ের চূড়োর একেবারে ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে যার চারপাশ ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা কিন্তু সামনের দিকে পাহাড়ের সীমা শেষ হয়ে গিয়েছে আর সেই নীচু ভূমি গিয়ে মিশেছে অদূরেই এক লোকালয়ের দিকে।দিগ্বিজয় এতক্ষণ এইটাই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে সে বেঁচে আছে।এখন সামনে লোকালয় দেখে মনে বড় আনন্দ পেল সে।প্রেতের রাজা নিষ্ঠুর নন।নিজের প্রজাদের প্রতি যেমন প্রজাবৎসল...তেমনই এক অপরিচিত আগন্তুকের জন্যও তিনি সদয়।সে মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল।তারপর তার পোঁটলা কাঁধে তুলে নিয়ে সামনে দৃশ্যমান লোকালয়ের দিকে উৎফুল্ল চিত্তে এগিয়ে চলল।চলতে গিয়ে হঠাৎ তার মনে হল...কাঁধের ঝোলাটা বড্ড বেশি ভারি।যেন ভারি ভারি পাথর কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে...তবে দিগ্বিজয় আর সেদিকে আর না তাকিয়ে আগে লোকালয়ের পথটাই ধরল।এমন সময় তার হঠাৎ নজরে পড়ল,এই ঘন জঙ্গলের একটি বটগাছের তলায় অচৈতন্য অবস্হায় লুটিয়ে পড়ে রয়েছে এক সালঙ্কারা পরমাসুন্দরী নারী।নিটোল ছাঁচে গড়া মুখের মধ্যে কেউ যেন পরম আদরে আর যত্নে তুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে অমন ছবির মতো সুন্দর আর রূপকথার মতো জীবন্ত চোখ আর সিক্ত অধর।দিগ্বিজয় তার গন্তব্য ভুলে গেল এক নিমেষে। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই অপরিচিতা নারীর দিকে এগিয়ে চলল।এই নারী যে রাজপরিবারের কন্যা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।রাজকন্যা হওয়াটাও একেবারেই আশ্চর্যের নয়।সে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটু মুড়ে বসল অপরূপ সেই নারীর লুটিয়ে থাকা অবয়বের পাশে।সে বুঝতে পারল,মেয়েটি জ্ঞান হারিয়েছে।তার জ্ঞান ফেরানোটা এখন সবার প্রথমে দরকার।হাতের কাছে একটু জল হলে ভালো হয়...কি যে করবে কিছু ভেবেই পেল না দিগ্বিজয়। এমন সময় হঠাৎ আকাশ কালো করে এল।তারপর হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি আরম্ভ হল।সেই দামাল বারিধারার স্পর্শ পেয়ে চেতনা ফিরে এল অপরূপা সুন্দরী মেয়েটির।তার লাস্যময়ী চোখদুটি কোনো এক অজানা তৃষ্ণা নিবারণের আবেদনে যেন হরিণীর মতো চঞ্চলা হয়ে উঠল।সেই দৃষ্টির সাথে নিজের দৃষ্টি একাকার করে দিয়ে দিগ্বিজয় যেন কয়েক লহমাতেই তাদের সাত জন্মের সুরমূর্ছনার স্বরলিপির লিখে ফেলল।নিষ্পলক কিছু মূহুর্ত কেটে গেল এভাবেই।বৃষ্টি থামল...অপরিচিতার মুখে কথা ফুটল..."তুমি প্রেতপুরী থেকে জীবন্ত ফিরে এসেছ।তাই তো?"

প্রচন্ড অবাক হয়ে দিগ্বিজয় শুধাল," তুমি এ কথা জানলে কেমন করে?"


"ওই প্রেতপুরীর খোঁজে কত মানুষ যে ধনসম্পদের লোভে এই জঙ্গলে এসে মরেছে...তার কোনো ইয়ত্তা নেই।আমার জন্মলগ্নে আমার ভাগ্যগনণার সময়ে জ্যোতিষী নিদান দিয়েছিলেন,"ওই প্রেতপুরী হতে যে মানুষ জীবন্ত ফিরে আসবে...আমার তার সাথেই বিয়ে হবে।আমার বিয়ের বয়স হওয়ার সাথে সাথেই পিতা চতুর্দিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করেছিলেন..."ওই প্রেতপুরী হতে জীবিত যে ফিরে আসবে তার গলাতেই রাজকন্যা মালা দেবে।তারপর থেকে কত মানুষ এসেছে এই জঙ্গলে রাজার জামাই হওয়া আর প্রেতপুরীর ধনসম্পদের লোভে...কিন্তু একজনও এই জঙ্গল থেকে জীবিত ফেরেনি।কোনো না কোনোভাবে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমি যে কৈশোর হতেই একটি মুখই দেখে এসেছি স্বপ্নে যাঁকে আমি আমার মনপ্রাণ সমস্তকিছু সঁপে দিয়ে রয়েছি।পিতা আমার সমস্ত মনোবাসনা ভ্রান্ত করে যখন বললেন...যে এই জঙ্গল হতে জীবিত ফিরে আসতে পারবে উনি তার সাথেই কেবল আমার বিবাহ দেবেন...আমি সেটা মানতে পারিনি।আমি শুধু তার...যার মুখ আমি স্বপ্নে দেখেছি।এ কথা প্রকাশ করাতে সবাই বলল আমার নাকি মাথার ব্যামো হয়েছে। তারা আমাকে ধরেবেঁধে চিকিৎসা করতে বসে গেল।আমি পরশু মাঝরাতে লুকিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি।অন্ধকারে পথ ভুল করে এখানে চলে এসেছি।ক্ষুধায় তৃষ্ণায় অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলাম।চোখ মেলতেই যে আমার প্রতিটি সুরের সাথে সুর এসে মিলে গেল...তোমার মুখখানিই যে আমার স্বপ্নে আসে প্রতিপলে..."

রাজকন্যা এ কথা বলে দুহাত দিয়ে ঢাকল নিজের লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠা মুখখানি।

দিগ্বিজয়ের বুকে যেন কোনো অজানা এক তুফান মোচড় দিয়ে উঠল।সে রাজকন্যার দুইহাত নিজের দুহাতে সরিয়ে পলকে তাকে নিজের বুকে টেনে নিল।ক্রমে রাজকন্যার খোঁজ করতে করতে রাজার সেপাইরা চলে এল সেখানে।এসেই সবার প্রথমে তারা দিগ্বিজয়ের উপর যারপরনাই ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে বন্দী করে রাজার কাছে নিয়ে গেল।পরে রাজকন্যার কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে রাজা দিগ্বিজয়কে সসম্মানে রাজদরবারে আহ্বান জানালেন আর অবিলম্বে রাজকন্যার সঙ্গে দিগ্বিজয়ের বিবাহ স্হির করলেন।পরে যখন তিনি দিগ্বিজয়কে জিজ্ঞাসা করলেন যখন পরিবারে তার কে কে আছে...

তখন দিগ্বিজয়ের কাকা জ্যাঠা জেঠিমা আর তার মামা মামী আর মামাতো সেই ভাইবোনেরা,যারা দিগ্বি্জয়কে আর তার মাকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল,তারা এখন বুক চিতিয়ে রাজার সামনে চলে এসে গলা উঁচু করে তীব্রভাবে দাবী জানাতে লাগল...যে দিগ্বিজয় তাদের কতখানি আপন...।তবে তাদের এই আশায় জল পড়ল কারণ রাজা আগেই জেনেছেন যে এই দুনিয়ায় দিগ্বিজয়ের কেউ নেই।কাজেই তাদের কথাকে রাজা ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন এবং প্রবল তিরস্কার করে রাজসভা থেকে অপমান করে বার করে দিলেন।দিগ্বিজয় তা জানতেও পারল না।শুভদিনে রাজকন্যার সাথে দিগ্বিজয়ের বিবাহ সম্পন্ন হল।রাজকন্যা রাজার একমাত্র মেয়ে।আর রাজারও বয়স হয়েছে।তাই তিনি তার সিংহাসনে নতুন অভিষেকের মাধ্যমে দিগ্বিজয়কে রাজা করলেন।হঠাৎ একদিন দিগ্বিজয়ে তার কাঁধের সেই পুরোনো ঝোলাটা খুঁজে পেল।সে সেটা খুলে দেখল,তার ভিতরে জ্বলজ্বল করছে বহুমূল্য ধনরত্ন।কিছুদিন রাজমহলে বাস করার অভিজ্ঞতায় এটা বুঝতে তার কোনো অসুবিধা হল না,যে এই ধনরত্ন দিয়ে অর্ধেক পৃথিবী কেনা যায়।সে এমনিতেই কখনো রাজসিংহাসনে বসেনি কখনো।সেখানে বসলে তার গা হাতপায়ে যেন ব্যামো ধরে।সে সাধারণ প্রজাদের সাথে মাটিকাদা মেখে এক হয়ে গিয়ে তাদের ঘরের ছেলে হয়ে তাদের ভালোমন্দ দেখে তার রাজধর্ম পালন করে।আর এখন এই বহুমূল্য ধনসম্পদ পেয়ে সে এমন ব্যবস্হা করার কাজে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হল,যে তার রাজ্যের কোনো প্রজা যেন অনাহারে অথবা রোগেক্লেশে না মরে।অচিরেই রাজ্যের সমস্ত দুঃখ দুর্দশা ঘুচল আর রাজ্যজুড়ে সকল মানুষ তাকে ধণ্য ধণ্যবাদ করতে লাগল।দেশবিদেশে ছড়িয়ে গেল তার সুখ্যাতি। যারা এককালে তাকে দেখলেই ছ্যা ছ্যা ফ্যা ফ্যা করত,এখন তার নাম শুনলেই আপনা থেকেই তাদের হাত কপালে গিয়ে ঠেকে।রাজকন্যা তার গভীর ভালোবাসা দিয়ে দিগ্বিজয়ের জীবন ভরিয়ে রাখে আর আগামীর পথ চলার অনুপ্রেরণা হয়ে সবসময় থাকে তার পাশে।দিন কাটতে থাকে সুখে স্বচ্ছন্দে...।


--------------সমাপ্ত-----------


Rate this content
Log in