গুলাল আবু বকর ‹›

Children Stories

4  

গুলাল আবু বকর ‹›

Children Stories

চাওয়া এবং পাওয়া

চাওয়া এবং পাওয়া

11 mins
545


• চাওয়া এবং পাওয়া.... সবসময় মেলে না •


এ গল্পের পটভূমি করোনা বিভীষিকা শুরু হওয়ার অনেক আগেকার। সেসময় জানুয়ারি মাস চলছে। নতুন বছরের পঠনপাঠন নতুন উদ্যমে সবে শুরু হয়েছে। সাধারণত এসময় ক্লাসগুলো ঠিকমতো হয় না। কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে হৈ হৈ করে সময়টা কাটানো হয়। কারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বইখাতা দেওয়া থোওয়া, রুটিন তৈরি প্রভৃতি নিয়মিত কাজগুলোর সাথে বাৎসরিক স্পোর্টসের প্রস্তুতি চলতে থাকে। অতঃপর আসে স্বরস্বতী পূজো এবং পর্বটি সম্পূর্ণ করার পর যথারীতি পুরোদমে শুরু হয় বিদ্যালয়ের কাজ।

       বড় ভাই সবুজ এবছর ক্লাস এইটের গণ্ডি টপকে ক্লাস নাইনে প্রবেশ করেছে। ফলাফল আশাব্যাঞ্জক না হলেও খারাপ হয়েছে বলা যায় না। কিন্তু গতবছরের তুলনায় কয়েক ধাপ নিচে নামতে হয়েছে তাকে। এরও আগের বছর একইরকম ধারাবাহিকতায় দু'ধাপ নেমে গিয়েছিলো। যত বড় হচ্ছে সে, পড়াশোনার মান ক্রমশঃ অধোগতি হয়ে চলেছে, কিন্তু কেন এমন হচ্ছে অথবা এর প্রতিকার কীভাবে করা যায় সেটা ঠাওর করতে পারছে না কেউই। অথচ ক্লাস সিক্স পর্যন্ত তার রেজাল্ট ছিলো চোখে পড়ার মতো। এক থেকে তিনের মধ্যেই থাকতো। ঠিক ক্লাস সেভেন থেকে পারদ নামছে নিচের দিকে। থার্মোমিটারে পারদ নিচে নামার অর্থ উষ্ণ থেকে শীতলতার দিকে যাওয়া, আর ব্যারোমিটারে পারদের পতন মানে ঝড়ের পূর্বাভাস। কেন যেন, তার কনসেনট্রেশন আগের মতো আর পাঠ্য বইয়ে স্থির হয়ে থাকছে না। বাড়িতে পাঠ্যবই নিয়ে পড়তে বসলে চোখের দৃষ্টি পাতার ওপর নিবদ্ধ থাকে কিন্তু মনের দৃষ্টি বইয়ের পাতা গলে উড়াউড়ি শুরু করে দেয়। কখনো হারিয়ে যায় কোনো গল্পে পড়া কল্পনার রাজ্যে। চলে যায় খেলার মাঠে, ভবঘুরের মতো রাস্তায় রাস্তায়। একা বসে বসে ঝিমুনি ধরে যায় কখনো বা।

       তার ছোট ভাই আলি এবার ক্লাস ফাইভে উঠলো। সে বরাবরই ক্লাসের ফার্স্ট বয় হয়ে আসছে। আলি নামটা তার বাবা নিজে পছন্দ করে রেখেছেন। তাদের বাবা তার নিজের কৈশোরে খেলাধুলায় ভীষণ উৎসাহী ছিলেন। বাল্যে স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে নামকরা ফুটবল প্লেয়ার হবেন। ক্রিকেটও খেলতেন সমানতালে। নিজের পিতার কাছে বিস্তর বকুনি খেয়েছেন সেজন্য কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ফলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেও জীবনে ভালো চাকুরী জোটাতে পারেননি।

       তার সেই ছাত্রজীবনে একজন খুব প্রিয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিশ্ব মুষ্টিযুদ্ধের অন্যতম সেরা নক্ষত্র মহম্মদ আলি। যিনি ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে একসময় মহম্মদ আলিতে পরিবর্তিত হন। মহম্মদ আলির কঠিন পরিশ্রম, জয়ের আকাঙ্ক্ষা ও আত্মবিশ্বাস তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। ....প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন তার স্ত্রী, আর দ্বিতীয় সন্তানের নাম তার দেওয়া— আলি মহম্মদ। মহম্মদের আগে তিনি আলি শব্দটি রেখে দেন। এই আগে পরের ব্যাপারটা নিয়ে তিনি কোনো বিচারে যাননি। মনে হয়েছিলো, তাই রেখেছেন। বড়ছেলে সবুজের অবশ্য অন্য একটি নাম আছে, কাগজে-কলমে।

       মফস্বলের একটি ছোট বাজারে তাদের বাবার একটি মুদিখানার দোকান আছে। সেখানে যা আয় হয় তাতে মোটামুটিভাবে তাদের চারজনের সংসার চলে যায়। দুটো ছেলেকে পড়ানোর জন্য আলাদাভাবে একটা করে টিউশনি দিয়েছেন। সকাল সকাল দু’জনে যে যার মতো টিউশনি পড়তে চলে যায়। ফিরে এসে শুরু হয় স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি। স্কুল ছুটির পর ফিরে এসে আবার বিকেলবেলায় মাঠে যাওয়া। সন্ধ্যায় নিজ নিজ দায়িত্বে বই নিয়ে পাঠ তৈরি করতে বসা। সাধারণভাবে এই তাদের নিত্যদিনের রুটিন। সন্ধ্যায় মা থাকেন রান্নাঘরে ব্যস্ত। তার সেকাজ সম্পূর্ণ হলে তিনি কখনো বসে থাকেন ছেলেদের পাশে আবার কখনো বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখতে থাকেন ছেলেরা পড়ছে, ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে এলেও চোখ টেনে টেনে জেগে থাকেন। তাদের দিকে তাকিয়ে অন্তরে অন্তরে তিনি একপ্রকার সুখের অনুসন্ধান করেন। 

       তাদের মা পড়াশোনা করেছিলেন মাধ্যমিক পর্যন্ত। মায়ের পরিবারে তার জন্য তেমন কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো না। তিনি নিজে যদি জেদ ধরে পড়তে চাইতেন তবে এর পরও পড়া এগিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু এই সমাজের অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে বড় টানাটানি চলে।....

পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর এ থেকে সময়ের দূরত্ব যত বেড়েছে ক্রমশঃ মাথা থেকে সেই জ্ঞান ধুয়ে মুছে গেছে। এখন সময় পেলে শুধু ছোটটাকে সামান্য সাহায্য করতে পারেন, তাও সীমিতভাবে।

       এদিকে বাবা বি. এ. ডিগ্রী উত্তীর্ণ হওয়ার পর আশা করেছিলেন ‘ল’ নিয়ে ওকালতি পড়বেন। তার সেই স্বপ্ন ঘটনার যাঁতাকলে পড়ে হারিয়ে গেছে, পূরণ হয়নি। বহু কষ্ট করে একটা কারখানার অফিসে কেরানির কাজ যোগাড় করেছিলেন। এসময়ের মধ্যে তিনি বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। কিন্তু এই কাজ তার ভাগ্যে বেশিদিন লেখা ছিলো না। দু’বছরের মাথায় কারখানা হঠাৎ লকআউট হলে তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। শুরু হয় নতুন এক সংগ্রামী জীবন। অনেক ভারী চিন্তাভাবনা অতিক্রম করে ধারদেনার মাধ্যমে বর্তমান এই দোকানটি তখন খোলেন। এটি দাঁড় করাতে তার লাগলো আরো একটি বছর।.... এভাবে চারিদিক থেকে হতাশাগুলো যখন কাউকে ঘিরে ধরে তখন তার সামনে কেবল দুটি রাস্তা খোলা থেকে যায়। এক, হাল ছেড়ে দিয়ে একেবারে নিশ্চুপ বসে যাওয়া। দুই, ধৈর্য্য ধারণ ও চেষ্টা দিয়ে শেষকিছু দেখার জন্য অপেক্ষা করা। তিনি দ্বিতীয়টি বেছে নিলেন। একসময় তার সব ধারদেনা শোধ হয়ে গেলো। কয়েকটা বছর তিনি ভালই ব্যবসা করলেন। কিছুটা স্বচ্ছলতা এলো পরিবারে। মুশকিল হলো, তৃতীয় বিশ্বের এই দেশগুলোতে বাজার থাকে বড় অস্থিতিশীল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি অপেক্ষা সংকোচনের প্রবণতা যেন বেশি। যেহেতু কর্মসংস্থান কম, তাই পুঁজির চলাচল কম। বড় শিল্পপতি ও বিনোদনের ঘরগুলোতে পুঁজির আগমন ও সেখানে পুঁজির স্থবিরতা নজরে আসে।

       তিনি এখন লক্ষ্য করছেন, গত কয়েকবছরে তার আয় খানিকটা হ্রাস পেয়েছে। বিক্রিবাটা কমে গেছে। বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। তার কয়েকজন নিয়মিত ক্রেতা আর এমুখো হন না, খাতায় কিছু বাকি পড়ে আছে তাদের। কাজের ফাঁকে আগে তিনি বড় একটা ফুরসৎ পেতেন না, এখন প্রায়ই বসে থেকে রাস্তায় লোকজন চলাচল দেখার সময় পান।

       নিজের সংসারের জন্য অনেককিছু কেনাকাটা লাগে। আছে অন্যান্য আরো কিছু খরচ। সুতরাং টেনেটুনে চলেছেন তিনি। আশা করে আছেন—ছেলে দুটো একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে। এবছর ছোটটা একদম ঠিক আছে, কিন্তু বড়টার রেজাল্ট তেমন আশানুরূপ হয়নি। ছেলেটা কেন পিছু হটছে, বুঝতে পারছেন না। কয়েকদিন বেশ চিন্তায় আছেন তিনি। আচ্ছা— তার জন্য কি আরো একজন গৃহশিক্ষক দরকার! পারবেন তিনি, অত সব খরচাপাতি বহন করতে! .... এই ভাবনাগুলো মনের আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরি করতে থাকলে হঠাৎ কেমন নিজে থেকেই চুপসে যান। 

       তার ইচ্ছা, কঠোর পরিশ্রম করে ছেলেদুটোকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। বড়টার ব্যাপারে ঈশান কোণে হতাশার মেঘ জমতে শুরু করলেও ছোটটার ব্যাপারে আশান্বিত তিনি। অপেক্ষা করে দেখতে চান বড়টা যদি আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। .... অতঃপর যদি না হয়, কী আর করবে সে.... দোকানে সাহায্য করবে, ব্যবসা শিখবে। একসময় কতো আশা তৈরি হতো, দু'জনে যে যার নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ক্লাসে দু’জনেই উজ্জ্বল রেজাল্ট করছে তখন। তিনি নিজের স্বপ্নকে ছুঁতে পারেননি তাই ছেলেগুলো তার মুখে সেই খুশির হাসি ছড়িয়ে দেবে, এই আশা। সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর রাতে ব্যবসা থেকে বাড়ি ফিরে তাদের পড়াশোনায় খানিকক্ষণ নজর দেন। পড়া ধরেন, পড়া তৈরি করিয়ে নেন।

       দেখতে দেখতে স্কুলের একটি টার্মের পরীক্ষা চলে এলো। পরীক্ষা হলো, পরীক্ষার ফলাফল বের হলো। প্রথম প্রান্তিক পরীক্ষার ফল দেখে সবুজের বাবা স্পষ্টতঃই হতাশ হয়ে পড়লেন। ছেলেকে বললেন, 

‘তোর কী এমন হলো, সবুজ? কত ভালো ছাত্র ছিলি তুই! মাস্টাররা একবাক্যে তোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো।’

তিনি খানিকক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবেন এবং যোগ করেন,

‘কি আর করবি, শেষে আমার দোকানে গিয়ে বসবি। আমার স্বপ্ন ছিলো তোরা দু'টো, জীবনে নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবি, বড় হবি... আমার কপাল বোধহয় মন্দ!’

সবুজ লক্ষ্য করে তার বাবার মুখ অন্ধকারময় মলিন। মুহূর্তে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। সে তার বাবার কথায় অনেক কষ্ট পায়। নিজে যেন বুঝতে পারছে বাবার কষ্ট, কিন্তু সে কষ্ট শুষে নিয়ে ওর মনকে হাল্কা করার মতো কিছু যে জানা নেই। বাবা সেখান থেকে উঠে চলে যান।

       কষ্টে বুকের কাছটায় চাপ বোধ হয় তার। মাথার ভেতরটা মনে হয় নিরেট। বেশি কিছু আর ভাবতে পারছে না। মাথাখানা পাশের দেওয়ালে ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। অল্পক্ষণ পরে কিছুটা ধাতস্থ হলে সে চিন্তা করে, কেন তার আর আগের মতো লেখাপড়ায় মন বসতে চায় না, কেন মনটা সদা চঞ্চল হয়ে থাকে ....। ভাবনার মধ্যে ভেসে থাকে খেলার সবুজ মাঠ, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আলোচিত বিষয়, লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া গল্পের বই, মোবাইল খুলে কিছু দেখার দুর্নিবার আকর্ষণ.... এমন কত কি!

       একদিন শেষ বিকেলে সূর্য যখন পাটে গেছে, ধরিত্রীর বুকে আধোছায়া তখনো নামেনি দুই ভাই খেলার মাঠ ছেড়ে রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিয়েছে। মাঝপথে রাস্তা যেখানে ভাগ হয়ে একটি অন্যদিকে চলে গেছে, চৌধুরী কাকুর মুখোমুখি হলো সেখানে। অপর একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চৌধুরী সাহেব হাঁটছিলেন। চাকুরি সূত্রে বর্তমানে কলকাতায় থাকেন। তার আর্থিক অবস্থা এখন অনেক ভালো হয়েছে। একসময় তিনি তাদের বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন, সবুজ তখন ছোট, বাড়িতে কাকু আসা-যাওয়া করতেন। একটি গ্রামের ব্যবধানে ওঁর পৈতৃক বাড়ি। তিনি এপথে ইদানিং তেমন আসেন না। কারণ তাদের অবশ্য জানা নেই, হয়তো দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। দূর থেকে আগেই তারা কাকুকে দেখতে পেয়েছে। সবুজ উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠে,

“কাকু—উ, ভালো আছেন... এদিকে কোথায় এসেছিলেন?”

কথা থামিয়ে চৌধুরী সাহেব তাদের দিকে হাসিমুখে তাকান। জিজ্ঞেস করেন,

“কই কেমন আছো তোমরা...আজ ছুটির দিনে একটা কাজ সারতে বেরিয়েছিলাম...সময় পাইনা বড় একটা—”

দুই ভাই আগে পিছে দাঁড়িয়ে কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সবুজ থাকে সামনে। সবুজ বলে,

“ভালো আছি কাকু—”

চৌধুরী সাহেব বলেন,

“তা— কেমন পড়াশোনা হচ্ছে তোমাদের? ...এই যে আলির খবর কি!”

লাজুক হেসে আলি এবার অল্পকথায় উত্তর দেয়,

”ভালো হচ্ছে, কাকু।”

“সবুজের খবর কি... এবারে র‌্যাঙ্ক কেমন হলো?” 

সবুজের মনে হলো, কাকুর সাথে থাকা ভদ্রলোকের মুখে মৃদু হাসিমুখ কৌতূহল। ভালো কিছু শুনতে চান।

সবুজের মুখের ওপর এবার আশঙ্কার মেঘ জমে। কাকু জানতেন সে পড়াশোনায় বেশ ভালো ছাত্র। মুখ তার থমথম করে।

ছুটির দিন হলেও চৌধুরী সাহেব একজন ব্যস্ত মানুষ। উত্তর শোনার আগ্রহ নিয়ে তিনি অপেক্ষা করেন।

সবুজের আর যেন উচ্ছ্বাস নেই। নিস্পৃহতা নিয়ে সে বলে,

“লাস্ট পরীক্ষা ভালো হয়নি কাকু....”

“কেন, তুমি পড়াশোনায় বরাবরই তো ভালো ছিলে! যাইহোক, ভালো করে পড়াশোনা করবে আর বাবাকে বলবে, চৌধুরী কাকুর হাতে আজকাল বড় একটা সময় থাকেনা তাই এদিকটা আসা হয়না। কোনোদিন সময় পেলে আসবো—”

এই বলে সেই ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে তিনি পা চালালেন।

এরপর সবুজের মন খচখচ করতে থাকে। ইস‌্— চৌধুরী কাকু জেনে গেলেন তার রেজাল্ট ভালো হয়নি। সবুজের থমথমে মুখ দেখে আলির কেমন যেন খারাপ লাগে। সে ভাবলো, একটু হাসলে বোধহয় সবুজের অস্বস্তি কেটে যাবে। সে হাসিমুখ করে। সবুজ এবার রেগে ওঠে। 

“তুই হাসিস কেন রে, মজা পেয়েছিস?”

তার এখন ইচ্ছা হচ্ছে আলিকে সপাটে একখানা চড় কষিয়ে দেয়। তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলে,

“চল, তাড়াতাড়ি বাড়ি চল।”

ধাক্কা দেওয়ার কারণ আলি বুঝতে পারে না, গোমড়ামুখে সে সামনে সামনে হাঁটতে থাকে।

       সেদিন রাতে যথারীতি পড়তে বসে সবুজ। বসার খানিকক্ষণ পর থেকে তার হাই উঠতে থাকে। চোখের পাতায় আলস্য জড়িয়ে ধরে।... সকালে টিউশনি পড়া, দুপুরে স্কুল, বিকালে খেলার মাঠ। এভাবে সারাটা দিন তার অর্জিত এনার্জি রোজ ঝরে যায়। দিনশেষে ক্লান্তি তার কাছে আশ্রয় নেয় ও বিশ্রাম নেওয়ার আর্জি জানায়। সে আর্জি তাকে প্রায়ই জোর করে খারিজ করতে হয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন ছাত্রের কাছে এই একই রুটিন চলে আসছিলো বরাবর।.... করোনাকালীন ও করোনা-উত্তর পরিস্থিতি ছাত্রদের সেই বাঁধাগৎ জীবনযাত্রায় বাধ সেধেছে মাত্র। এখন একটা করে মোবাইল সেট তাদের সবার ধ্যানজ্ঞান, নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম, পড়াশোনা যেন আগের সেই সেই জায়গায় আর নেই। আমার এই গল্প যে এর আগের সময়ের, তা আগেই উল্লেখ করেছি।

.... সন্ধ্যাবেলায় পড়া শুরুর আগে তার প্রয়োজন ছিলো ঘন্টা খানেকের বিশ্রাম। তার ফলে দৈহিক ক্লান্তি কেটে গিয়ে শরীর ঝরঝরে হয়ে ওঠে। সেটা হয়নি যখন, পাশের দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে শ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করে সবুজ। চোখ টেনে টেনে আধো জাগার দূরূহ চেষ্টা করে ও ভাবে, ‘পড়া হচ্ছে না অথচ তাকে পড়তে হবে, ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়ছে স্কুলে’। ইচ্ছেগুলো মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে হারিয়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে দেওয়ালের গায়ে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখে। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে এমনিভাবে আধা ঘন্টা পার হয়ে যায়। অন্যদিকে মুখ করে গভীর পাঠে নিমগ্ন ছিলো আলি। হঠাৎ করে পড়া থামিয়ে দাদার দিকে ফিরে দেখে দাদার মুখ হাঁ হয়ে চোয়াল ঝুলে পড়ার অপেক্ষায় আছে। সে মৃদু ঠ্যালা দিয়ে দাদাকে বলে,

“এই দাদা, ওঠ...এই দাদা!”

দাদা নড়েচড়ে বসে কিন্তু পরক্ষণেই সামনের টেবিলে রাখা পাতা-খোলা বইয়ের ওপর মাথার সমস্ত ভার চাপিয়ে দেয়।

       বিগত দিনগুলোতে উজ্জ্বল হয়ে থাকা এক ছাত্রের স্বপ্নগুলো ঘুমের মধ্য হতে বাইরে বেরিয়ে এসে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সবুজের তাজা সবুজ কল্পনা এভাবে বিবর্ণ হওয়ার দিকে এক ধাপ এক ধাপ করে গুটি গুটি অগ্রসর হতে থাকে। দিন দিন স্কুলপাঠ্যে পেছানোর সাথে সাথে বাইরের গল্প পড়ার অন্য এক নেশা তাকে পেয়ে বসে। স্কুলের লাইব্রেরীতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বইগুলো তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেসব পড়তে পড়তে তাকে অন্যজগতে নিয়ে যায়। বছর ঘুরে চলে, দেখতে দেখতে শরতের ছুটি শেষ হয়ে গিয়ে বাৎসরিক পরীক্ষা এসে দরজায় কড়া নাড়ে।

       পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র পেয়ে ভেবে ভেবে লিখতে তার এবার কষ্টবোধ হয়, যা এর আগের কোনো পরীক্ষায় হয়নি। মনের মতো উত্তর সে লিখতে পারছে না, কলমের ডগা আগের মতো গড়গড়িয়ে চলছে না, ভিতরে ভিতরে দারুণ ঘেমে ওঠে। এখন ঠাণ্ডাকাল চলছে তবু গরমবোধ হচ্ছে। ভালো লিখতে না পারার দুশ্চিন্তা তাকে ভীত করে তোলে।

       পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল যথাসময়ে যথারীতি বের হলো। ছোটভাই আলি এইবারেও ফার্স্ট। খুশি তার ধরে না। মার্কশিট নিয়ে ছুটতে ছুটতে হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি ফিরলো। তার ইচ্ছা, কতক্ষণ আগে সে আম্মু ও আব্বুকে খবরটা পৌঁছিয়ে দেবে। রেজাল্ট দেখে ছেলের গর্বে তাদের হৃদয় ভরে যাবে! .... এদিকে নিজের ফলাফল হাতে পেয়ে সবুজ বেশ হতাশ হয়ে পড়লো। তার নম্বরগুলো যেন তাকে দেখে উপহাস করছে। তারা বলছে,

“আমাদেরকে তুই এতদিন এড়িয়ে যেতে চাইতিস— লাভ হলো কিছু?....হা_হা_হা।” 

ইচ্ছা করছে মার্কশিটের কাগজটা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। স্কুলে বন্ধুদের এড়িয়ে তাড়াতাড়ি অন্যত্র সরে পড়ার তাল খুঁজতে থাকে। বাড়ি গিয়ে মায়ের বিষণ্ণ মুখ দেখার অনুভূতি তাকে অন্যমনস্ক করে দেয়। নিস্পৃহভাবে একা হাঁটতে থাকে, একসময় পথের পাশে একটা নির্জন স্থানে একা দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঝাউ গাছের পাশে বসে পড়ে। 

       স্কুল পুনরায় খোলা হলে, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সবুজের বাবাকে অফিসে ডাকলেন। সবুজ সেখানে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান শিক্ষক সরাসরি বললেন,

“সবুজের ফলাফল দেখেছেন তো...এত ভালো মাথা ছিলো ছেলেটার! আগের বছরগুলোতে শ্রেণী শিক্ষকরা সবাই এসে আমার কাছে ওর মাথা খাটানোর প্রশংসা করতেন। বলতেন, ও ভবিষ্যতে কিছু একটা করবে। আর এখন বেশ অবাক হচ্ছি! তার অসুবিধা কি? আমাদের খুলে বলুন...”

সবুজ মাথা হেঁট করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

সবুজের বাবাও হেডমাস্টার মশাইয়ের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকতে পারছেন না। টেবিলের ওপর স্তূপ করে রাখা খাতা ও কাগজপত্রের ওপর তার চোখ ঘোরাঘুরি করতে থাকে। তারপর ক্ষীণ হয়ে আসা গলায় শুধুমাত্র বলতে পারেন,

“স্যার, আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না, ওকে তো দু’টো টিউশনি দিয়ে রেখেছি।”

এরপর সামান্য কিছু কথাবার্তা হয়। চিন্তামগ্ন সবুজের বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে তাঁর কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নেন।

       যেতে যেতে বুকের ভিতর একধরনের উথাল পাথাল হচ্ছে সবুজের। মন ভীষণ খারাপ, নিজেকে বড় বিপন্ন মনে হচ্ছে।.... 

       পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে একটা গল্পের বই হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। অক্ষরগুলোর ওপর চোখ চলছে না মোটেও। বিকালে দোকানের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে তার বাবা সবুজের খোঁজ করলেন। সে তখনও ঘরের মধ্যে একা আবদ্ধ হয়ে আছে। সবুজকে ডেকে সামনাসামনি বসিয়ে তিনি অতি ধীরকন্ঠে বললেন,

“আমি ঠিক করেছি শুধু আলিকে পড়াবো। তোমার বোধহয় পড়ে লাভ নেই। হেডমাস্টারের সামনে আমি খুব অসহায় বোধ করেছি। তুমি আমার দোকানের কাজে সাহায্য করতে আসবে। অল্প অল্প করে কাজটা শিখে নাও....দেখি, পরের সপ্তাহে হয়তো সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। তোমার মা-কেও বলেছি কথাটা। বলো কী করবে?”

উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে তিনি বেরিয়ে পড়েন।

সবুজ স্থবির হয়ে বসে আছে। তার অন্তরের কষ্ট কেউ বোঝেনি। নিজেও পারছে না ঠিকভাবে কাউকে কিছু বলতে। ছোট ভাইকে কাছেপিঠে কোথাও দেখতে পাচ্ছেনা। আম্মুও হয়তো এদিকটায় নেই।

দুঃখের পরিমাণটা কারো সাথে ভাগ করে নিলে হালকা লাগতো এখন। তার অনুভূতিগুলো সরিয়ে রাখার কোনো জায়গা যে নেই। গোটা আকাশ যেন তার মাথায় ভেঙে পড়েছে।


Rate this content
Log in