বিশ্বাসঘাতক....
বিশ্বাসঘাতক....
সকালে বাজার থেকে ফেরার পথে একটা মুখ দেখে আঁতকে উঠেছিল সঙ্গীতা। হৃদয়ের মধ্যে জমে থাকা পুরনো ক্ষতটা আবার যেন তাজা হয়ে উঠেছিল এবং তার থেকে রক্ত ক্ষরন শুরু হয়ে গেছিল। মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে একটা কথা বেড়িয়ে এসেছিল বিশ্বাসঘাতক। সঙ্গীতা পাথরের মূর্তির মত রাস্তার এক কোনে দাঁড়িয়ে, মনে মনে ভাবতে লাগল, ছিঃ আমি কোনদিনও কল্পনা করতে পারিনি তুমি আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে। আগে যে মুখ না দেখে থাকতে পারতামনা এখন সেই মুখ দেখলে ঘৃনা হয়। সারা শরীর ঘিন ঘিন করে তোমার সাথে কাটানো সময় এবং তোমার ছোঁয়া গুলো মনে করলে। কেন করলে এই রকম জানতে বড্ড ইচ্ছা করে কিন্তু তোমার মত বিশ্বাসঘাতক নীচ মানুষের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে।
কোন রকমে বাড়ি ফিরে এসে সঙ্গীতা নিজের তানপুরাটা নিয়ে ঘরের মেঝেতে চুপটি করে বসে সুর তুলতে লাগল। আসলে এই তানপুরা এখন একমাত্র সঙ্গী সঙ্গীতার নিঃসঙ্গ জীবনে। সঙ্গীতার যখন খুব কষ্ট হয় মন নীরবে অশ্রু ফেলে চলে তখন সঙ্গীতা তানপুরা নিয়ে গান গেয়ে মনটাকে হাল্কা করে। সত্যি গান হল জীবন দায়ি ওষুধের মত। সব রকম পরিস্থিতিতে মনকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
সঙ্গীতা মনের গভীরে রাখা স্মৃতির পাতা উল্টাতে শুরু করল, এই গানের সূত্র ধরেই সঙ্গীতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পলাশের। পলাশ খুব ভালো তবলা বাজাতো। ওদের গানের স্কুল থেকে কোন প্রোগ্রাম হলে সঙ্গীতা আর পলাশ একসাথে থাকত। ওদের এই গানের জুটি সবাই খুব পছন্দ করত। গানের জগতে জুটি বাঁধার সাথে সাথে ওরা সারা জীবনের জন্য একে অপরের জুটি হয়ে উঠল। ওদের বিয়েতে কোন রকম আপত্তি আসেনি পরিবারের তরফ থেকে। কিন্তু সঙ্গীতা বুঝতে পারেনি এই বিয়ে সুখের হবেনা বরং ওর জীবন কে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
গান, বাজনার পাশাপাশি ওদের বৈবাহিক জীবন বেশ ভালোই চলছিল হঠাৎ করে ওদের জীবনের ছন্দ কাটতে শুরু করল। সঙ্গীতা চোখের সামনে পলাশকে একটু একটু করে পাল্টে যেতে দেখতে লাগল। সঙ্গীতা বহু চেষ্টা করেছিল এই পাল্টে যাওয়ার কারন জানার কিন্তু জানতে পারেনি। সঙ্গীতা সবদিক থেকে চেষ্টাও করেছিল সম্পর্কটাকে আগের মত করে তোলার কিন্তু সেটাও হয়নি। সঙ্গীতা আর পলাশের বিবাহবার্ষিকির দিন সঙ্গীতা পলাশকে সারপ্রাইজ দেবে বলে সমস্ত রকম ব্যবস্থা করেছিল যাতে পলাশ খুশি হয়,কিন্তু সঙ্গীতা বুঝতে পারেনি যে, ওর জন্য আরও বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল।
বিবাহ বার্ষিকির দিন পলাশ সঙ্গীতার সব চেয়ে প্রিয় বান্ধবী মোনালিশাকে সঙ্গে নিয়ে এসে, সঙ্গীতাকে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিয়ে বলে ছিল আমার মুক্তি চাই, আমি তোমার সাথে থাকতে পারবনা আমি মোনালিশাকে ভালোবাসি।
এক মুহুর্তের মধ্যে সঙ্গীতার পায়ের নিচ থেকে মাটি যেন সরে গিয়ে ছিল। সঙ্গীতা দুই হাত দিয়ে নিজের কান ঢেকে চিৎকার করে বলে উঠেছিল কি বলছ তুমি পলাশ। আমি জানি তুমি আমার সাথে মজা করছ। প্লিজ এইসব বিষয় নিয়ে মজা করোনা। আমার খুব কষ্ট হয়।
পলাশ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেছিল আমি কোন মজা করছিনা যা বলছি সব সত্যি। আর আমি খুব তাড়াতাড়ি মোনালিশাকে বিয়ে করতে চাই। আমি তোমাকে বিয়ে করে ভুল করেছি আসলে আমি ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারিনি। এখন আমি বুঝতে পারি আমি কোনদিনও তোমাকে ভালোবাসিনি শুধুমাত্র তোমার প্রতি আমার একটা ভালোলাগা ছিল এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।
সঙ্গীতা সেইদিন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি, রাগে মোনালিশার গালে একটা সপাটে চড় মেরে বলেছিল আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলি তুই? ছিঃ তোর আমার বন্ধুত্বের কোন মর্যাদা রাখলিনা। আমার ঘৃনা হচ্ছে নিজের ওপর এই ভেবে যে একজন আমার ভালোবাসা আর একজন আমার প্রিয় বান্ধবী দুজনেই বিশ্বাসঘাতক!!!! আমি মানুষ চিনতে কি করে এত বড় ভুল করলাম!!!!
হঠাৎ করে সঙ্গীতার তানপুরার সুর কাটল ফোনের আওয়াজে। সঙ্গীতা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল একটা অচেনা নাম্বার। ফোনটা ধরার আগেই ফোনটা কেটে গেল। সঙ্গীতা ফোনটা রেখে দিয়ে আবার তানপুরায় মনোনিবেশ করল। কিন্তু ফোনটা আবার বেজে উঠল। সঙ্গীতা বিরক্ত ভরা মন নিয়ে ফোনটা ধরে বলে উঠল হ্যালো...... কে বলছেন?
ওপাশ থেকে ভেসে আসল আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি সঙ্গীতা প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আমার জীবনে ঠিকই কি!! আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি, প্লিজ সঙ্গীতা আমায় আর একটা সুযোগ দেবে!! আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই। আমি বেশি সময় নেবনা, তোমার মূল্যবান সময় থেকে এক ঘন্টা দিলেই হবে।
সঙ্গীতা গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছে এটা পলাশের গলা। সঙ্গীতা নিজের রাগ কন্ট্রোল করে তীক্ষ্ম স্বরে বলে উঠল দ্বিতীয় বার আর আমাকে ফোন করার সাহস দেখাবেননা মিস্টার পলাশ সেন। সঙ্গীতা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল ক্ষমা করা কি অতই সহজ!!!, আর সব কাজের ক্ষমা হয়না, আর আমি বিশ্বাসঘাতকদের আমার জীবনের মূল্যবান সময়ের এক ঘন্টাতো দূরের কথা এক সেকেন্ড দিতেও পছন্দ করিনা। আশাকরি আপনি আপনার প্রশ্নের সমস্ত উত্তর পেয়ে গেছেন। গুডবাই মিস্টার সেন। সঙ্গীতা ফোনটা কেটে দেয় কারন আর কোন রকম কথা শোনার ইচ্ছা নেই সঙ্গীতার। সঙ্গীতার চোখটা আজ আর জলে ভরে উঠেনি, বরং যোগ্য জবাব দেওয়ার আনন্দে উজ্বল হয়ে উঠেছে। সঙ্গীতা তানপুরাটায় সুর তুলে গেয়ে উঠল.......
এসো... এসো.. কাল রজনীর..
অবসানে প্রভাত-আলোর দ্বারে....,
যেয়ো না.., যেয়ো না... অকালে হানিয়া
সকালের কলিকারে...।
এসো.... এসো.... যদি কভু সু...সময়
নিয়ে....আসে তার ভরা... সঞ্চয়,
চির নবীনের যদি... ঘটে জয়–
সাজি ভরা....হয় ধনে...।
নিয়ো... না, নিয়ো না... মোর পরিচয়
এ....ছায়ার আবরণে.....॥
.
