অশরীরী আত্মার কান্না
অশরীরী আত্মার কান্না
আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর আমার বন্ধু সৌভিক সেনগুপ্ত দুজনেই আমরা ইতিহাসের ছাত্র । আমরা কাজ করছি পুরাতত্ত্ব বিষয় নিয়ে ।আমরা দুজনে ইতিহাসের অনেক বিষয় নিয়ে রিসার্চ করতে ভালোবাসি। আমরা দুজনেই একটা স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে কাজ করি। আমরা দুজন মিলে ঠিক করলাম দোলের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাবো। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় পাথরা নামে একটা মন্দির গ্রাম আছে । সেই গ্রামে সারা গ্রাম জুড়ে মন্দির । অনেক দিন ধরে ইচ্ছা ছিল সেই মন্দির দর্শন করার। শুনেছি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝারগ্রাম নামক জায়গায় খুব ভালো দোল উৎসব পালন করা হয়। আমারা ঠিক করেছি ঝারগ্রামে দোল উৎসব পালন করে , পাথরা জাবো মন্দির দর্শন করতে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমরা দুই বন্ধু হোলির দিন খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লাম নিজের একটা চারচাকা গাড়ি নিয়ে । প্রায় দশটা নাগাদ আমরা ঝারগ্রাম পৌছালাম। সকালে শুধু চা খেয়ে বেরিয়েছি, পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে ভেবে, রাস্তায় বেশি কিছু খাওয়া হয়ে ওঠেনি। ঝারগ্রাম পৌঁছেয় দুজনে আগে একটা ভালো হোটেল দেখে টিফিন খেয়ে নিলাম কচুরি, ঘুগনি,নলেনগুরের সন্দেশের সহযোগে।এরপর আমরা দুজনেই দোলে অংশগ্রহণ করলাম। এতো সুন্দর সুষ্ঠ ভাবে দোল উৎসব পালন হলো দেখে আমাদের মনটা ভরে গেলো। আমরা দু'জনেও খুব খুব আনন্দ করলাম সকলের সঙ্গে। পাশেই একটা হোটেলে রুম বুক করা ছিলো আগে থেকেই, সেখানে গিয়ে ভালো করে স্নান করে, ফ্রেশ হয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম আমরা। দুপুরের খাওয়া খেয়ে বেরিয়ে পরলাম প্রায় সারে তিনটে নাগাদ। ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমারা পাথরা গ্রামে পৌঁছে গেলাম। পাথরা গ্রামের বাসিন্দার প্রকাশ মাহাতোর সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল, সেও ইতিহাসের ছাত্র। আমারা গাড়িটা তার বাড়িতে রেখে পায়ে হেঁটে ঘুরতে লাগলাম। প্রকাশ আমাদের গাইডের কাজ করলো।অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভালো ভালো যা মন্দির ছিলো তা আমাদের দেখিয়ে দিলো।পরে আবার এসে বেশি সময় নিয়ে গ্রামটা ভালো করে দেখবো সেই পরিকল্পনা মনে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।প্রকাশ ওদের বাড়িতে থাকার কথা খুব করে বলছিলো, ওকে বোললাম এর পরের বার এলে তোমার বাড়িতে অবশ্যই থাকবো। এবার খুব অল্প সময়ের জন্য হঠাৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী এসেছি তাই এবার থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের বেরোতে বেরোতে প্রায় সাতটা বেজে গেলো। আমরা খুব জোরেই ড্রাইভ করছি ঝারগ্রাম পৌঁছানোর জন্য। রাস্তায় পরলো একটা জঙ্গল। লোধাসুলি জঙ্গল হয়ে ফেরার পথ ধরলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হবো হবো। সবে আলো নিভে চারিদিকে আঁধার নেমে এসেছে জঙ্গলটাতে। খুব একটা সেফ নয় লোধাসুলি জঙ্গল ।এখানে অনেক লৌকিক অলৌকিক ঘটনা ঘটে অনেক চোর-ডাকাত ছিনতাইকারীদের উপদ্রব আছে ।আগে ওই জঙ্গলে মাওবাদীদের খুব উৎপাত ছিল এখনও অল্পস্বল্প মাওবাদীদের ভয় আছে তবুও আমরা সাহসে ভর করে দুজন মিলে গাড়ি করে আসতে লাগলাম জঙ্গল থেকে লোকালয়ের দিকে । আসার সময় রাস্তার উপরে এক মহিলাকে চিৎকার করে কান্না করতে দেখলাম । ভদ্র মহিলা উচ্চ স্বরে কান্না করতে করতে রাস্তার ঠিক মাঝখানে আমাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো । পরনে তার একটা আটপৌরে শাড়ি মাথার চুল এলোমেলো করা, খুব লম্বা রোগা চেহারার একজন মহিলা । আমাদের গাড়ির সামনে এসে দাড়ালো আর জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো। আমাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ানোর জন্য আমরা বাধ্য হয়েই গাড়ির ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড় করালাম ।যদিও জানি এই সময়ে এই রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করানো ঠিক না। কিন্তু একজন মহিলাকে এই রাতের বেলায় রাস্তায় কান্না করতে দেখে গাড়ি দাঁড় করাতেই হোলো। আমি গাড়ি দাঁড় করিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করলাম , "কে আপনি ? এই রাতের বেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না করছেন কেনো ?" উত্তরে সে কিছুই বললোনা। আমি আমার বন্ধুকে বললাম, কোন উত্তরতো দিচ্ছে না। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে কি জিজ্ঞেস করবো। আমার বন্ধু আমার হাত চেপে ধরে বলল, "একদোম না। এই ঘন অন্ধকারে কখন কি বিপদ ঘনিয়ে আসে ।" আমি ভাবলাম ও ঠিকই বলেছে এই অন্ধকার রাতে নামাটা ঠিক হবে না। যদিও আজ পূর্ণিমা তথাপিও এই জঙ্গলে এতো গাছের ভীরে ঠাসাঠাসি যে, প্রায় কিছুই ঠাওর করা যায়। আমি গাড়িতে বসেই আরো জোরে চিৎকার করে বললাম,"কে আপনি পথের মাঝে দাঁড়িয়ে কান্না করছেন?" সে একটু কান্না থামিয়ে চুপ করে থাকলো, তারপর ধীরে ধীরে কিছু একটা বলল, আমারা দু'জনের কেও সে কথার মানে বুঝতে পারলাম না। আবার বললাম,"আপনার কথা কিছু বুঝতে পারলাম না?" এবার সে আস্তে আস্তে মেদিনীপুরের গ্রাম্যটানে বলল,"আমার নাম শান্তা মাহাতো, আমার বাড়ি ঘাটালে।" বলে চুপ করে থাকলো। এবার আমার বন্ধু বলল,"ঘাটাল সে তো এখান থেকে অনেক দূরে, তা আপনি এই রাতের বেলায় এখানে এসে কান্না করছেন কেনো। আপনার কি ভয় ডর কিছু নেই।" মহিলাটি আবার কিছু ক্ষন চুপ করে রইলো। আমরা অধৈর্য্য হয়ে ওঠেছি, আমাদের যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাটা শুনসান কোন গাড়ি বা লোকজোনের দেখা নেই। মনে হচ্ছে আমারা ভুল রাস্তায় এসে পরেছি। যাওয়ার সময় এতো ঘনো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমরা যায়নি। এবার মহিলাটি আস্তে আস্তে গাড়ি কাছাকাছি এসে বলল,"আমার বাড়ি ঘাটালে, আমার শশুর বাড়ী বীনপুরে। আমার একটা সাত মাসের ছেলে আছে।" একটু থেমে আবার বলল, "আমার শশুর বাড়ী থেকে বলছে কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে না আসলে আমাকে খেতে দেবে না। কিন্তু আমার বাবার সেই টাকা দেবার সামর্থ নেই । লোকের জমিতে জোন খেটে খায়।" এবার সে আবার কান্না করে উঠলো। সে আবার বলতে শুরু করল,"আমি বললাম আমার বাবা টাকা দিতে পারবে না। তাই আমার শশুর বাড়ীর লোকজন, আমাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমার ছেলে কেও, আমার থেকে কেরে রেখে দিয়েছে। তাই আমি মনের দুঃখে এই জঙ্গলে এসে কান্না করছি।"
আমি বললাম,"কিন্তু এই রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে, আপনি একজন মহিলা, আপনার এখানে থাকা ঠিক নয়। আপনি আমাদের গাড়িতে উঠে পরুন। জঙ্গলের সীমানা পার করে কোন লোকালয় দেখে নামিয়ে দেবো। তারপর আপনি আপনার বাবার বাড়ি চলে যাবেন।বাবার বাড়ি গিয়ে, বাড়িতে বসে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করবেন।" মহিলাটি সব শুনে গাড়ির খুব কাছে এগিয়ে এলো,"বলল ঠিক আছে , আপনি যা বলেছেন তাই করবো।" আমার বন্ধু সৌভিক, গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে দিলো, মহিলাটি গাড়িতে উঠে পড়লো। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো, মিনিট পরেনো পর, মহিলাটি হঠাৎ করেই গাড়ি থামাতে বলল। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম , জঙ্গলতো এখনো শেষ হয়নি। সেই কথা শুনে মনে হোলো তাঁর চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠলো, আগুনের ভাঁটার মতো আর মূহুর্তের মধ্যেই সে আমার বন্ধু সৌভিকের কাঁধে কামোর বসিয়ে দেয়। হাতটা লম্বা করে আমার গলা টিপে ধরার চেষ্টা করল, তার হাতের নখের আচোর আমার গলা স্পর্শ করল কিন্তু সে পুরোপুরি আমার গলা টিপে না ধরে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। আমি ভয়ে আতঙ্কে গাড়ি থামিয়ে দিয়, আমার বন্ধু যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। আমারা হঠাৎ এমন ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পরি ভয়ে মুখ শুক্ন হয়ে যায়। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম দুজনে, শুধু একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বাকরুদ্ধ হয়ে। মহিলাটি গাড়ি থেকে নেমে জোরে দৌড় দিয়ে, পাশেই থাকা বট গাছের উপর গিয়ে ওঠে, দমকা বাতাসে চারিদিকে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। এখানে গাছের পরিমাণ কম। তাই পূর্ণিমা রাত হওয়ার জন্য চারিদিকের পরিবেশটা মোটামুটি ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে হঠাৎ মহিলাটি আবার লাফিয়ে বটগাছ থেকে পাশের তালগাছে গিয়ে ওঠে। তার দেহটা তাল গাছের মতো লম্বা হতে থাকে। সেখান থেকে লাফিয়ে পাশের পুকুরে গিয়ে পরে। জোরসে একটা তীব্র ধুপ করে আওয়াজ হলো আর মনে হলো, পুকুরের জল সব উথালপাথাল হয়ে গেলো। আমারা ভয়ে কোনো রকমে জোরসে গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে চলে আসি। প্রায় আধঘণ্টা পর একটা লোকালয়ে এসে পৌঁছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা ওষুধের দোকান খুঁজে বের করি। সেখানে একটি ওষুধের ফার্মেসি খুঁজে পায়। সেখানে গিয়ে সব বললে, একটা কোয়াক ডাক্তার আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে টিটেনাস ইঞ্জেকশন ও কিছু ওষুধ দিয়ে দেয়।তিনিই বললেন বেশ কিছু বছর আগে একটি মেয়ে ঔ জঙ্গলের মধ্যে বটগাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে মারা গেছে। সে মাঝে মাঝেই মানুষকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে য়ায়। তারপর তাদেরকে আক্রমণ করে। আপনারা অনেক অল্পের উপর দিয়েই বেঁচে গেছেন। আমার মনে পরলো আমার ঠাকুরদার কথা, তিনি বলেছিলেন আমাদের শরীরে পৈতে আছে তাই কোন ভূত পিশাচ সহজে আমাদের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। তাই হয়তো ঔ অশরিরী আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি, আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।