অঞ্জনা! স্মৃতি তুমি বেদনা (সামাজিক যাত্রাপালা) রচনা: লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
অঞ্জনা! স্মৃতি তুমি বেদনা (সামাজিক যাত্রাপালা) রচনা: লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
অঞ্জনা! স্মৃতি তুমি বেদনা (সামাজিক যাত্রাপালা)
রচনা: লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
প্রস্তাবনা
[মঞ্চ ধীরে ধীরে আলোকিত হয়। আবহ সঙ্গীত বেজে ওঠে – একটি বিষাদমাখা গ্রামীণ সুর, বাঁশি ও সারেঙ্গীর মিশ্রণ। মঞ্চের মাঝখানে সঞ্চালক এসে দাঁড়ান। তাঁর পরনে ঐতিহ্যবাহী ধুতি-পাঞ্জাবি।]
সঞ্চালক: (দৃঢ় অথচ দরদী কণ্ঠে) নমস্কার! নমস্কার সব দর্শকবৃন্দ! আজকের এই শুভ সন্ধ্যায় আপনাদের সামনে আমরা নিয়ে এসেছি এক সামাজিক যাত্রাপালা, যার প্রতি ছত্রে মিশে আছে জীবনের রূঢ় সত্য, ভালোবাসার বিশ্বাসভঙ্গ আর স্মৃতির অনন্ত বেদনা। পালার নাম – "অঞ্জনা! স্মৃতি তুমি বেদনা!"
স্মৃতি! এ বড়ই বিচিত্র জিনিস। একাধারে অমৃত, আবার তীব্র হলাহলও বটে। কিছু স্মৃতি সুমধুর, যা জীবনকে রঙিন করে তোলে। আবার কিছু স্মৃতি, সে যে বড় যন্ত্রণাদায়ক! ক্ষতবিক্ষত করে দেয় মন, জীবনকে করে তোলে বিষাদময়। আজকের আমাদের এই পালা তেমনই এক বেদনার্ত স্মৃতির আখ্যান। এক নারীর জীবনের উপাখ্যান, যে ভালোবাসার নামে প্রতারিত হয়ে, সমাজের চোখে কলঙ্কিনী হয়েও মাথা তুলে বাঁচতে চেয়েছিল।
আমাদের এই কাহিনীর নায়িকা অঞ্জনা। এক প্রত্যন্ত গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে। স্বপ্ন ছিল তার ভরা সংসার, এক টুকরো শান্তির নীড়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার সে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। এক নরাধমের ছলনায় তার জীবন হয়েছিল তছনছ। সেই স্মৃতি আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, প্রতি মুহূর্তে তাকে দংশন করে।
আজ আমরা দেখব, কীভাবে এক নিষ্পাপ প্রাণ ভালোবাসার নামে প্রতারিত হয়ে, সমাজের আঙুল তোলা ঘৃণার শিকার হয়েও, নিজের আত্মসম্মান আর সত্যের মশাল হাতে নিয়ে লড়াই করে গেছে। এ শুধু অঞ্জনা নয়, এ যেন সমাজের এমন অনেক অঞ্জনারই প্রতিচ্ছবি।
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারীর লেখনীতে আপনাদের সামনে আজ উন্মোচিত হবে এক নারীর সংগ্রাম, তার নীরব কান্না আর চরম মুহূর্তের বিস্ফোরক প্রতিবাদ। আর দেরি নয়, চলুন আমরা প্রবেশ করি স্মৃতির সেই বেদনাবিধুর জগতে।
[আবহ সঙ্গীত আরও জোরালো হয়। সঞ্চালক একপাশে সরে দাঁড়ান। মঞ্চে কুয়াশার মতো আলো-আঁধারি হয়। তারপর ধীরে ধীরে প্রথম দৃশ্য আলোকিত হয়।]
প্রথম অঙ্ক: স্মৃতির দংশন
[আবহ সঙ্গীত: বিষণ্ণ লোকগীতি]
দৃশ্য ১: অঞ্জনার ভাঙা কুঁড়েঘর
[মঞ্চে একটি জীর্ণ কুঁড়েঘরের সেট। ঘরে সামান্য কিছু আসবাবপত্র। একটি মাটির প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে। অন্ধকার প্রায়। অঞ্জনা (বয়স ত্রিশের কোঠায়), পরনে মলিন শাড়ি, এলোমেলো চুল, উদাস নয়নে বসে আছে। তার কোলে একটি সাত-আট বছরের মেয়ে, 'কমলা', ঘুমিয়ে আছে। অঞ্জনা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, তার চোখ দিয়ে নীরবে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে আপন মনে বিড়বিড় করে কথা বলছে।]
অঞ্জনা: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আহা রে কমলা! তুই কী বুঝবি মা, তোর এই মায়ের ভাগ্যে কী লিখেছে ভগবান? তোর নিষ্পাপ মুখটি দেখলে মনে হয় – সব ভুলিয়ে দিই। কিন্তু ভোলা যায় না রে মা! কিছু স্মৃতি আগুনের ফুলকির মতো, যত দিন যায়, তত বেশি জ্বলে! (আকাশের দিকে তাকিয়ে) কোথায় তুমি, হে নিঠুর বিধাতা? কেন এমন ভাগ্য দিলে আমায়? কেন সাজিয়েও আমার সংসার ভেঙে দিলে?
[অঞ্জনা গুনগুন করে একটি গান গায় - এটি তার অতীতের প্রতিচ্ছবি, ভালোবাসার স্মৃতি ও বর্তমানের বেদনা মিশ্রিত একটি গান।]
কণ্ঠসঙ্গীত (অঞ্জনা): (বেদনার্ত সুরে) "সেদিন ছিল ফাগুন বাতাস, মন ছিল যে কাঁচাসোনা, ভালোবেসে দিয়েছিলাম, সবটুকু প্রেম, মনবাসনা। জানতাম না সে ছলনাময়, শুধু মিছে কথায় ভোলায়, হারিয়ে গেলাম ঘোর অমাবস্যায়, বিষাদ নদীর কিনারায়। স্মৃতি তুমি বেদনা, কেন বারে বারে ফিরে আসো গো, আঁচড়ে যাও মন আমার, আরও বেশি কেন কাঁদাও গো।"
[অঞ্জনা গান থামিয়ে চুপ করে থাকে। মঞ্চে প্রবেশ করে অঞ্জনার ছোট ভাই, সঞ্জয় (বয়স পঁচিশের কোঠায়), সেও জীর্ণ পোশাকে। সে বোনের অবস্থা দেখে ব্যথিত হয়।]
সঞ্জয়: (করুণ সুরে) দিদি! আবার সেই পুরোনো দিনের কথা ভাবছো? কতবার বলেছি, যা গেছে তা ভুলে যাও। কমলার ভবিষ্যতের কথা ভাবো।
অঞ্জনা: (সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক হাসার চেষ্টা করে) ভোলা কি এতই সহজ রে সঞ্জয়? শরীরের ক্ষত শুকিয়ে যায়, কিন্তু মনের ক্ষত! সে তো চিরজীবনের সঙ্গী। তোর ভাগ্নে-ভাগ্নীর মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচি, এটাই যা।
সঞ্জয়: আমার কষ্ট হয় দিদি। লোকলজ্জার ভয়ে তুমিএই গ্রামে আর ফিরতে চাও না। আমরাও তোমাকে এখানে একা দেখে এসেছি। শহরে তুমিও কমলার সঙ্গে চলে এসো।
অঞ্জনা: (মাথা নাড়ে) না রে সঞ্জয়। এই গ্রামেই আমার স্মৃতি জড়ানো। এখানেই আমার ভালবাসার জন্ম হয়েছিল, এখানেই আমার স্বপ্ন ভেঙেছিল। এ মাটি ছেড়ে আমি যাব না। তাছাড়া শহরে আমাদের মতো গরিবের কী কাজ?
সঞ্জয়: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) কিন্তু দিদি, গ্রামে তোমার এই একা জীবন দেখে লোকে কত কথা বলে!
অঞ্জনা: (চোখ রাঙিয়ে) বলুক! যারা আমার সম্মান কেড়ে নিয়েছিল, তাদের মুখে ছাই দিয়ে আমি বেঁচে আছি। আর যারা পিছন থেকে কথা বলে, তারা তো কাপুরুষ! তাদের কথায় আমি কান দিই না। শুধু তোর চিন্তা হয়, তোর বিয়ে হয়ে গেছে, এখন তোর সংসারে এসব কথা উঠলে...
সঞ্জয়: (আবেগে) দিদি! তুমি এমন কথা বলো না। তুমি আমার দিদি, চিরকালই থাকবে। তোমার জন্য আমি সব সহ্য করতে রাজি। (আশেপাশের দিকে তাকিয়ে) কিন্তু ওই নরাধম, বিমল! সে নাকি শহরে বড় ব্যবসায়ী হয়েছে। মাঝেমধ্যে এদিকে আসে বলেও শুনছি।
অঞ্জনা: (পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়) বিমল! তার নাম করিস না সঞ্জয়! তার নাম শুনলে আমার রক্ত টগবগ করে ওঠে। তার জন্যই আমার জীবনটা আজ এই দশায়। কিন্তু সে যতই বড়লোক হোক, তার পাপের বিচার একদিন হবেই। ভগবান আছেন, তিনি সব দেখেন।
সঞ্জয়: (ভয়ে ভয়ে) দিদি, তাকে দেখলে তুমি নিজেকে সামলে রাখতে পারবে তো?
অঞ্জনা: (দৃঢ় কণ্ঠে) আমি কেন সামলাবো? সে আমার জীবন নষ্ট করেছে। তাকে ভয় পাওয়ার কী আছে? বরং সে আমাকে দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যাবে। আমি আর সেই দুর্বল অঞ্জনা নই, যে তার ছলনায় কান পেতেছিল। এ অঞ্জনা এখন মাটি কামড়ে বাঁচতে শিখেছে।
[আবহ সঙ্গীত আরও বিষণ্ণ হয়। অঞ্জনার দৃঢ়তা এবং তার ভেতরের ক্ষত স্পষ্ট হয়। ধীরে ধীরে মঞ্চ অন্ধকার হয়ে আসে।]
দ্বিতীয় অঙ্ক: কূলহারা তরী
[আবহ সঙ্গীত: চঞ্চল, কিছুটা ভিলেনসুলভ সুর]
দৃশ্য ১: গ্রামের মধ্যবিত্ত একটি বাড়ির বৈঠকখানা
[সময় গড়িয়েছে। প্রায় দশ বছর পরের ঘটনা। মঞ্চে একটি সুসজ্জিত বৈঠকখানা। বিমল (এখন চল্লিশের কোঠায়), পরনে দামী পোশাকে, অহংকারী ভাব। তার পাশে তার বর্তমান স্ত্রী রমা, তিনিও বেশ দাম্ভিক। গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, জগন্নাথ বাবু, তাদের সঙ্গে কথা বলছেন।]
জগন্নাথ বাবু: (হাতজোড় করে) বিমলবাবু, আপনি তো এখন শহরের বড় ব্যবসায়ী। আপনার মতো এমন গুণী সন্তান আমাদের গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে।
বিমল: (তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে) হাঃ হাঃ! জগন্নাথ বাবু, আমি তো এই গ্রামেরই ছেলে। কিন্তু এই গ্রাম আমাকে কী দিয়েছে? আমি নিজের যোগ্যতায় শহর থেকে অর্থ উপার্জন করেছি। এই গ্রামে থাকলে কি আমি আজ এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতাম?
রমা: (অহংকার করে) ওঁর কথা ছাড়ুন জগন্নাথ বাবু। আমার স্বামী সত্যিই পরিশ্রমী। নিজের চেষ্টায় তিনি আজ কোটিপতি।
জগন্নাথ বাবু: তা তো বটেই! আপনার মতো এমন রত্ন আমাদের গ্রামেই জন্মেছে, এটা আমাদের গর্ব। শুনেছি আপনি নাকি গ্রামের স্কুলটার জন্য কিছু অনুদান দিতে চান?
বিমল: (স্বার্থপরের মতো) হ্যাঁ, দিতে পারি। তবে তার জন্য আমার নামের ফলক চাই, বড় করে। আমার সম্মান চাই। এই অনুদানের মধ্য দিয়ে গ্রামের লোকে জানুক, বিমল এখনও তাদের কথা ভাবে। (মনে মনে) আর এই সুযোগে গ্রামের কিছু জমিজমাও দেখে নেওয়া যাবে।
[হঠাৎ বাইরে থেকে কিছু গোলমালের শব্দ আসে। বিমল বিরক্ত হয়।]
বিমল: কিসের শব্দ ওটা? এই গ্রামে এখনও এত গোলমাল কেন?
জগন্নাথ বাবু: ও কিছু নয় বিমলবাবু। গ্রামের কিছু ছেলে-মেয়ে। আর... (আটকে যায়)
বিমল: আর কী?
জগন্নাথ বাবু: আর... অঞ্জনা। সে তো স্কুলের পাশেই তার কুঁড়েঘরে থাকে। তার মেয়ে কমলা স্কুলে পড়ে।
বিমল: (নামটি শুনে চমকে ওঠে, কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়, মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে) অঞ্জনা! সে এখনও এই গ্রামেই পড়ে আছে? ছিঃ ছিঃ! এই মেয়ের চরিত্র ভালো নয়। গ্রাম তাকে প্রায় একঘরে করেছে শুনি।
রমা: (ঘৃণাভরে) ওইসব নিচু মন ও চরিত্রের মেয়েদের কথা বাদ দিন। আমার স্বামীর সম্মান নষ্ট হবে।
[একটি দৃশ্যান্তর। মঞ্চের একপাশে অঞ্জনার কুঁড়েঘরের সামনে অঞ্জনা ও সঞ্জয় দাঁড়িয়ে। সঞ্জয় বিমলের গ্রামের আসার খবর দিচ্ছে।]
সঞ্জয়: দিদি! সেই নরাধম বিমল গ্রামে ফিরে এসেছে। শহরে সে নাকি বিরাট ধনী হয়েছে।
অঞ্জনা: (ক্ষুব্ধ চোখে) ধনী হয়েছে? পাপের টাকায় কেউ ধনী হয় না। তার পাপের ঘড়া ভরেছে, এবার ফেটে পড়ার পালা।
সঞ্জয়: সে নাকি গ্রামের স্কুলের জন্য দান করবে। নিজেকে খুব বড় লোক দেখাচ্ছে।
অঞ্জনা: (তীক্ষ্ণ কণ্ঠে) দান! সে দান নয়, সে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা। কিন্তু তার পাপ এত বড় যে কোনও দান দিয়ে তার ক্ষমা নেই। সে আমার জীবন নষ্ট করেছে, আমার সম্মান কেড়ে নিয়েছে। আমি তাকে ছাড়ব না।
সঞ্জয়: দিদি, কী করবে? তার অনেক প্রতিপত্তি।
অঞ্জনা: (দৃঢ়প্রতিজ্ঞ) প্রতিপত্তি! সত্যের চেয়ে বড় প্রতিপত্তি আর কিছু নেই। আমি তাকে সবার সামনে তার মুখোশ খুলে দেব। আমার আর ভয়ের কিছু নেই। আমি যা হারানোর, তা বহু বছর আগেই হারিয়েছি। এখন শুধু আমার কমলার মা হিসেবে বাঁচা। আর আমার কমলার জন্য আমি যে কোনও লড়াই লড়তে পারি।
[আবহ সঙ্গীত আরও তীব্র হয়। অঞ্জনার চোখে প্রতিশোধের স্ফুলিঙ্গ। মঞ্চ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসে।]
তৃতীয় অঙ্ক: সত্যের মুখোমুখি
[আবহ সঙ্গীত: উত্তেজক ও নাটকীয় সুর]
দৃশ্য ১: গ্রামের বারোয়ারী মাঠে জনসভা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠান
[মঞ্চে একটি বড় বারোয়ারী মাঠের সেট। গ্রামের বহু মানুষ জড়ো হয়েছে। মঞ্চে পঞ্চায়েত প্রধান, জগন্নাথ বাবু, এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বসে আছেন। বিমল ও রমাও তাদের পাশে। বিমলকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। চারপাশে ফুলমালা, আলো ঝলমলে পরিবেশ। কমলার মতো কিছু গ্রামের ছোট বাচ্চারাও ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অঞ্জনা ভিড়ের একপাশে তার মেয়ে কমলাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ বিমলের দিকে স্থির।]
পঞ্চায়েত প্রধান: (মাইকে) আজ আমরা গর্বিত! আমাদের গ্রামের কৃতি সন্তান, শ্রী বিমল রায় মহাশয়, যিনি আজ শহরে একজন সফল ব্যবসায়ী, তাকে আমরা সংবর্ধনা জানাচ্ছি। তিনি আমাদের গ্রামের উন্নয়নে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। [তুমুল করতালি। বিমল গদগদ মুখে উঠে দাঁড়ায়, রমা পাশে বসে মুচকি হাসে।]
বিমল: (মাইকে, অহংকারী কণ্ঠে) ভাই ও বোনেরা! আজ আমি গর্বিত যে এই গ্রামের মাটি থেকে আমি উঠে এসেছি। আমি জানি, এই গ্রামের কিছু মানুষ আমাকে ভুল বোঝে। কিন্তু আমি প্রমাণ করে দেব, আমি এই গ্রামেরই সন্তান। আমি এই গ্রামের মেয়েদের শিক্ষার জন্য, তাদের উন্নয়নের জন্য... [কথা শেষ না হতেই, অঞ্জনা ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে। তার চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে।]
অঞ্জনা: (আর্তনাদের মতো তীব্র কণ্ঠে) থামো! থামো বিমল! আর কত মিথ্যা বলবে? আর কত ভণ্ডামি করবে? [সবাই চমকে ওঠে। বিমল অঞ্জনাকে দেখে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। রমা ঘৃণায় মুখ বাঁকায়। সঞ্জয় চিন্তিত মুখে দূরে দাঁড়ায়।]
বিমল: (কষ্টে গলা পরিষ্কার করে) কে তুমি? এখানে এমন ঝামেলা করছো কেন? আমি তোমাকে চিনি না!
অঞ্জনা: (হাসে, সে হাসি ব্যথার) চিনিস না? হাঃ হাঃ! আজ যে তুই এত বড় বড় কথা বলছিস, এত বড় মহৎ সাজার চেষ্টা করছিস, সেই বিমল রায়ের ভেতরের নরাধমটাকে আমি চিনি! আমি অঞ্জনা! তোর সেই ভালোবাসার অঞ্জনা! [সবাই ফিসফিস করতে শুরু করে। জগন্নাথ বাবু, পঞ্চায়েত প্রধান সবাই অবাক।]
বিমল: (রাগ দেখিয়ে) সবাই শোনো! এই মহিলা একজন কলঙ্কিনী! এর চরিত্র ভালো নয়। এ আমাকে ফাঁসাতে এসেছে।
অঞ্জনা: (চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কণ্ঠস্বর দৃঢ়) কলঙ্কিনী? আমি কলঙ্কিনী? আমার শরীর কলঙ্কিত হয়েছিল, কিন্তু আমার মন নয়। আমার বিশ্বাস ভেঙেছিল, কিন্তু আমার আত্মসম্মান নয়। আজ আমি সবার সামনে প্রমাণ করে দেব, কে আসল কলঙ্কিনী, আর কে আসল নরাধম। (কমলার হাত ধরে এগিয়ে আসে) এই দেখ! এই আমার মেয়ে কমলা! এ কার ঔরসের সন্তান, বিমল! [কমলাকে দেখে বিমল আরও হতভম্ব হয়ে যায়। ভিড় স্তব্ধ। রমা চিৎকার করে ওঠে।]
রমা: মিথ্যে কথা! আমার স্বামীর কোন অবৈধ সন্তান নেই!
অঞ্জনা: (রমার দিকে তাকিয়ে) হ্যাঁ রে হতভাগী! তোদের মতো টাকার লোভে যারা অন্যের স্বামীকে ছিনিয়ে নেয়, তারা এই সত্যকে হজম করতে পারবে কেন? (বিমলের দিকে তাকিয়ে) মনে আছে তোর, বিমল? ফাগুন মাসের সেই রাত? সেদিন তুই আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলি। আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে বলেছিলি, "অঞ্জনা, তুমি শুধু আমার।" আর তারপর? তারপর যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা হলাম, তুই আমাকে অস্বীকার করলি। গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেলি, আর আমাকে ছেড়ে গেলি এই সমাজের কাছে, ঘৃণার শিকার হওয়ার জন্য। [অঞ্জনার কথা শুনে ভিড়ে গুঞ্জন শুরু হয়। গ্রামের কিছু বয়স্ক মানুষ মাথা নিচু করে।]
বিমল: (রেগে) এই সব মিথ্যে! তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছ!
অঞ্জনা: (চিৎকার করে) ব্ল্যাকমেইল? আমি? আমার জীবনটাই তো তুই ব্ল্যাকমেইল করেছিস! আমাকে দিয়েছিস এই সমাজ থেকে পাওয়া অপবাদ, আমার এই সন্তানকে দিয়েছিস পিতৃহীনতার কলঙ্ক। (জনতার দিকে তাকিয়ে) আপনারা বলুন, গ্রামবাসীগণ! আমি কি মিথ্যা বলছি? এই নরাধম বিমল, সে আমার জীবন তছনছ করে দিয়েছে। সে তো এই সমাজের বুকে এক পিশাচ। আজ সে বড়লোক হয়েছে বলে তার পাপ ঢাকা পড়বে না। [সঞ্জয় এগিয়ে এসে অঞ্জনাকে সমর্থন করে।]
সঞ্জয়: দিদি ঠিক কথা বলছে। আমি এর সাক্ষী। এই বিমল আমার বোনের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
জগন্নাথ বাবু: (স্তম্ভিত হয়ে) এ কি বলছো অঞ্জনা? বিমলবাবু, এ সব কি?
বিমল: (ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে) না না! আমি কিছুই জানি না। এ মিথ্যা!
অঞ্জনা: (কমলার হাত ছেড়ে বিমলের দিকে এগিয়ে যায়) মিথ্যা? আমার এই নিষ্পাপ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বল, বিমল! তুই এর বাবা নোস? (বিমলের শার্টের কলার ধরে) তুই জানিস না, এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি কত কষ্ট করে দিনের পর দিন কাটিয়েছি? কত অনাহার, কত অপমান সহ্য করেছি? আজ তুই লোক দেখানোর জন্য দান করতে এসেছিস? তোর দান তোর মুখে ছাই নিক! তোর টাকার প্রয়োজন আমার নেই। আমার শুধু চাই আমার আত্মসম্মান। আমি চাই সমাজের সামনে থেকে তোর এই মুখোশটা খুলে দিতে। [অঞ্জনা বিমলের কলার ছেড়ে দেয়। বিমল ভয়ে কুঁকড়ে যায়, তার মুখ ফ্যাকাশে। রমা হতভম্ব। জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিছু যুবক বিমলের দিকে তেড়ে আসে।]
জনতা ১: ধিক্ ধিক্ বিমল রায়!
জনতা ২: এ কেমন কাজ? এমন নরাধমকে গ্রামে ঠাঁই দেব না!
[পঞ্চায়েত প্রধান ও জগন্নাথ বাবু পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেন। বিমল তার অপরাধ স্বীকার না করলেও, তার মুখ দেখে আর জনতার ক্ষোভ দেখে বোঝা যায়, সত্য প্রকাশিত হয়েছে।]
অঞ্জনা: (অশ্রুসিক্ত চোখে, দৃঢ় কণ্ঠে) হ্যাঁ! আজ থেকে আমি আর লাঞ্ছিত অঞ্জনা নই। আজ থেকে আমি আমার কমলার মা। আমার জীবন হয়তো আর কখনো সুখের হবে না, কিন্তু আমার আত্মসম্মান আমি ফেরত পেয়েছি। আমার স্মৃতি হয়তো বেদনার, কিন্তু এই বেদনাই আজ আমার প্রতিবাদের ভাষা!
(অশ্রুসিক্ত চোখে, কিন্তু কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তার এক নতুন ঝলক নিয়ে অঞ্জনা গ্রামবাসীদের দিকে তাকায়। তার চোখে একাধারে বঞ্চনার বেদনা এবং প্রতিবাদের আগুন জ্বলছে।)
গ্রামের মানুষ, মা-বোনেরা, পঞ্চায়েত প্রধান, জগন্নাথ বাবু, এবং যারা আজ এই সত্যের উন্মোচন প্রত্যক্ষ করলেন...
(একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
হ্যাঁ! আপনারা আজ এক লাঞ্ছিত নারীকে দেখলেন, যাঁর সম্মান পদদলিত হয়েছে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে, এই বেদনা, এই লজ্জা আমি আর বহন করব না। আমার অশ্রু আজ দুর্বলতার প্রতীক নয়, আমার নীরবতা আজ ভয়ের প্রাচীর নয়।
বিমল হয়তো তার মুখ দিয়ে সত্য স্বীকার করেনি, কিন্তু তার চোখে চোখ রেখে আপনারা কি দেখেননি সেই কালো পাপের স্পষ্ট ছাপ? জনতার ক্ষোভ, যা আজ এখানে ফেটে পড়েছে, তা কি মিথ্যা? অন্ধকার ভেদ করে আলো বেরিয়ে এসেছে, মিথ্যা আর প্রবঞ্চনার জাল ছিন্ন হয়েছে। সত্যের শক্তি আজ প্রকাশ পেয়েছে, যা কোন মিথ্যা বা ছলনা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না।
হ্যাঁ! আজ থেকে আমি আর লাঞ্ছিত অঞ্জনা নই। আজ থেকে আমি আমার কমলার মা। আমার কমলার নিষ্পাপ মুখ, তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আমাকে আজ এই শক্তি দিয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, আমি আর মাথা নিচু করে থাকব না। আমার জীবন হয়তো আর কখনো সুখের হবে না, এই ক্ষত হয়তো কোনদিনও সারবে না। কিন্তু এই যন্ত্রণা, এই অশ্রু, আজ আমার অসহায়তার প্রতীক নয়। এই বেদনাই আজ আমার প্রতিবাদের ভাষা!
আমার স্মৃতি হয়তো বেদনার, হয়তো সারা জীবন এই অভিশপ্ত স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। কিন্তু এই স্মৃতিই আজ আমার প্রতিবাদের মশাল। এই মশাল জ্বেলে আমি অন্ধকারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি! আমি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি সেই সমাজকে, সেই মানসিকতাকে, যা একজন নারীর সম্মানকে খেলনা ভাবে! আমি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি সেই কাপুরুষতাকে, যারা নারীর দুর্বলতার সুযোগ নেয়!
আপনারা, যারা এতক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, নীরব দর্শক হয়ে এই নির্মম সত্যের উন্মোচন দেখেছেন, তাঁদের কাছে আমার একটাই প্রার্থনা – এই প্রতিবাদ যেন শুধু আমার একার না থাকে। এই গ্রামকে কলঙ্কমুক্ত করার দায়িত্ব শুধু পঞ্চায়েত প্রধান বা জগন্নাথ বাবুর নয়, এ আমাদের সকলের। প্রতিটি অন্যায়কে রুখে দাঁড়ানোর দায়িত্ব আমাদের সবার।
আমি চাই, এই গ্রাম যেন ভবিষ্যতে আর কোন অঞ্জনাকে লাঞ্ছিত হতে না দেখে। আমি চাই, এই মাটি যেন আর কোন কমলার নিষ্পাপ শৈশবকে অন্ধকারে ডুবিয়ে না দেয়। আমার আত্মসম্মান আজ আমি ফেরত পেয়েছি। এই আত্মসম্মান আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।
আমি হয়তো সুখ হারাবো, কিন্তু সম্মান নয়। আমি হয়তো নীরব হয়ে থাকবো না, আমার আত্মসম্মান আজ আমার সবচেয়ে বড় শক্তি! জয় হোক সত্যের! জয় হোক মানুষের!
[আবহ সঙ্গীত তীব্র এবং বিজয়ী সুরে বেজে ওঠে। অঞ্জনা তার মেয়ে কমলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বিমল ভয়ে মুখ ঢাকে। মঞ্চ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসে।]
উপসংহার
[মঞ্চে পুনরায় সঞ্চালক এসে দাঁড়ান। আবহ সঙ্গীত স্তিমিত হয়ে আসে, একটি শান্ত অথচ গভীর সুর বেজে ওঠে।]
সঞ্চালক: (শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে) ভায়েরা ও বোনেরা! আপনারা দেখলেন, এক নারী – অঞ্জনা – তার জীবনের এক কঠিন সংগ্রাম। ভালোবাসার নামে প্রতারিত হয়ে, সমাজের চোখে কলঙ্কিনী হয়েও, সে মাথা নত করেনি। সে তার স্মৃতির বেদনাকে রূপান্তরিত করেছিল প্রতিবাদের অগ্নিশিখায়।
বিমল রায়, সে হয়তো সমাজের চোখে কোটিপতি ছিল, কিন্তু অঞ্জনার কাছে সে ছিল এক কাপুরুষ, এক নরাধম। টাকার জোরে সে সত্যকে চাপা দিতে চেয়েছিল, নিজের পাপকে ঢাকতে চেয়েছিল। কিন্তু সত্য কখনও চাপা থাকে না। আজ অঞ্জনা তার নিজের সম্মান ফিরে পেয়েছে, তার সন্তানের পিতৃপরিচয় উন্মোচন করেছে। মিথ্যা জয়ী হতে পারেনি, পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে সবার সামনে।
পথ হয়তো দীর্ঘ, অঞ্জনার জীবন হয়তো মসৃণ হবে না। কিন্তু আজ থেকে সে আর সমাজের ভয়ে ভীত নয়। সে হয়তো কোনো পুরুষকে পুনরায় বিশ্বাস করতে পারবে না, কিন্তু সে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাহস খুঁজে পেয়েছে। তার স্মৃতি হয়তো আজও বেদনা দেয়, কিন্তু সেই বেদনাই আজ তার শক্তি।
এই যাত্রাপালা শুধু অঞ্জনা বা বিমলের কাহিনী নয়। এ সমাজের সেইসব নারীদের গল্প, যারা প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হয়, প্রতারিত হয়। যারা সমাজের চোখে শুধুমাত্র নারী হওয়ার জন্য, দুর্বলের প্রতীক হওয়ার জন্য, সহস্র অপবাদ সয়। এই পালা তাদের জন্য এক আহ্বান, মাথা তুলে দাঁড়ানোর, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার।
স্মৃতি তুমি বেদনা – এই শিরোনাম আজ কেবল একটি শব্দগুচ্ছ নয়, এটি এক নারীর হৃদয়ের আর্তনাদ, যা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজয়ের পথ দেখায়।
[আবহ সঙ্গীত ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে, একটি আশাব্যঞ্জক, দৃঢ় সুর। সঞ্চালক মাথা নত করে বিদায় নেন। মঞ্চ সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে আসে। প্রেক্ষাগৃহে করতালির রেশ।]
।। সমাপ্ত ।।
