আজবগড়ের আজব কথা
আজবগড়ের আজব কথা


আজবগড় রাজ্যের রাজা মহেন্দ্র। তার রাজ্যাভিষেকের পর কেটে গেছে গোটা একটি বছর। ভালই দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন রাজ্যপাট। আজব গড় ছোটো হলেও যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী রাজ্য।
এই রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী রূপচাঁদ হপ্তা দুয়েক আগে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে অকালে গত হয়েছেন। তাঁর পুত্র সোনাচাঁদ রাজা মহেন্দ্রর সম্মতিক্রমে পিতার ছেড়ে যাওয়া সেই জুতোয় পা রেখেছেন। বাবার মতো তেমন কোনো দক্ষতার নজির এখনও পর্যন্ত রাখতে পারেননি । কিন্তু মনে মনে তার অনেক দিনের সাধ ,রাজাকে তার হাতের পুতুল করে আসল ক্ষমতা করায়ত্ত করার।
মহেন্দ্র রাজা হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। সুশাসক হিসেবে ইতিমধ্যেই তাঁর নাম ছড়িয়েছে আজবগরের সীমানা ছাড়িয়ে পাশাপাশি রাজ্যগুলিতেও। তাই সোজা পথে উদ্দেশ্য সিদ্ধি সম্ভব নয় বুঝতে পেরে মন্ত্রিমশায় সোনাচাঁদ শুরু থেকেই কৌশলে নিজের কাজ হাসিলের চেষ্টা করতে লাগলেন। রাজাকে দিনের পর দিন কানে ফুষ্মন্তর দিতে থাকলেন যে রাজ্যে শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট নয়, শাসনে আনতে হবে এমন কিছু অভিনবত্ব যাতে পড়শী রাজ্যগুলোও অবাক বনে যায়।
রাজামশাই এমনিতে শান্তশিষ্ট ,কিন্তু নতুন কিছু করার ব্যাপারে বরাবরই তার প্রবল আগ্রহ। তাই মন্ত্রীর প্রস্তাব তিনি এককথায় লুফে নিলেন। বললেন - 'বলো দেখি মন্ত্রী তোমার কি অভিপ্রায়।' মন্ত্রী বুঝলেন ওষুধে কাজ দিয়েছে। উত্তর করলেন
- 'আজ্ঞে অভয় দেন তো বলি।দেশে অনেক কাল কোনো যুদ্ধ টুদ্ধু নেই। আমি নিজেও লোক পাঠিয়ে খবর নিয়ে দেখেছি । এই অবস্থায় জনগণের মধ্যে অবসাদ, বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। দেশপ্রেম, রাজার প্রতি আনুগত্য,একতা বোধ কমে আসছে দিন দিন। রাজ্যের ভবিষ্যতের কথা ভাবলে এমন বেশিদিন চলতে দেওয়া যায় না।' রাজা চিন্তিত হয়ে বলেন - 'তা তো বটেই। তবে কি আছে উপায়?' মন্ত্রী আবার বললেন - ' একটা উপায় আছে মহারাজ।একই জীবনধারায় অভ্যস্ত হতে হবে সকল প্রজাকে। তবেই একতা আর সম্প্রীতি বজায় থাকবে । তেমন হলে নয় রাজপরিবারের লোকজন কিংবা মন্ত্রী পারিষদকে এই নিয়মের আওতাভুক্ত না করলেও চলবে কারণ তারা সর্বক্ষণই থাকবে রাজার পাশে। কিন্তু বাকি প্রজাদের এই হুকুম অঞ্চলভেদে মানতে হবে।' রাজা বলেন - 'হক কথা। কি হুকুম করতে হবে বলো।' মন্ত্রী জবাব দিলেন - ' কাল সারা রাজ্যে ঘোষণা করে দিন যে সামনের সপ্তাহ থেকে গোটা রাজ্যে সকলকে বাজরার রুটি খেতে হবে। ভাত খাওয়া বন্ধ। ধান চাষ তুলে দিতে হবে ।অন্যথায় কড়া শাস্তি দেওয়া হবে।' রাজা বললেন - 'বেশ। তাই হোক তবে ।'
এদিকে রাজ্যে এই হুকুম জারি হতেই শুরু হলো সমস্যা । এহেন প্রজাদরদি রাজার এমন হঠকারি সিদ্ধান্তে সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ পড়ল।কৃষকরা গিয়ে রাজদরবারে হাজির হয়ে বললো - 'রাজামশাই এ আপনার কেমন বিধান, আজবগড় যে নদীপাড়ের দেশ। মা লক্ষ্মীর কৃপায় আর স্বর্ণবেনি নদীর জলে এ মাটি সোনা ফলায় বছরভর। ধান ছাড়া এ জমিতে রুখা সুখা অঞ্চলের ফসল ফলানোর বিদ্যা তো আমাদের জানা নেই। তাই চাষই যদি না হয় তবে লোকে খাবে কি?' রাজা বললেন - 'অতশত বুঝি না।তোমরা কৃষক, তোমরা জানো চাষ হবে কি ভাবে। মনে রাখবে হাকিম নড়ে তবু হুকুম নড়ে না ।'
রাজাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে কৃষকরা কিছুদিনের মধ্যেই হাল ছেড়ে একে একে পাড়ি দিল ভিনরাজ্যে। সামান্য কিছু জায়গায় জোয়ার বাজরার চাষ শুরু হলেও দেশের খাদ্যভান্ডারে টান পড়ল অচিরেই। শোনা গেলো দুর্ভিক্ষের প্রথম পদধ্বনি। উদ্বিগ্ন রাজা শুধোলেন মন্ত্রীকে - ' বলি কাজটা কি ঠিক হলো?' মন্ত্রী বললেন - 'সবুর করুন মহারাজ।নতুন ওষুধ তাই ধরতে সময় নিচ্ছে একটু। লোকে একবার মেনে নিলেই দেখবেন ছবিটা বদলে যাবে পুরোপুরি। দেশে খাওয়া নিয়ে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না । লোকজনের শরীর স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।আর এটাই হবে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ। আপনি বরং এবার আরেকটি হুকুম করার ব্যাবস্থা করুন। যে মহৎ উদ্দ্যেশ্য নিয়ে আপনি সিংহাসনে বসেছেন সেই দেশসেবার কাজকে তো আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে , তাই নয় কি '? রাজা ঈষৎ ঘাবরে গিয়ে বললেন - 'আবার একটা ! আচ্ছা শুনি কি বলতে চাও'। মন্ত্রী জবাব দিলেন - ' অবুঝ জনতাকে সুশৃঙ্খল এবং সুশাসিত করার জন্য একটু কঠিন হতে হলে, হতে হবে বৈকি। মা বাবাকেও তো কখনো কখনো কঠিন হতে হয় সন্তানের কথা ভেবে।' রাজা বললেন ' এটা তুমি উচিত কথাই বলেছ।' ভরসা পেয়ে মন্ত্রী বলল, ' কালই তবে বিধান দিন সকলকে জুতো না পড়ার। মাটি আমাদের মা। তাতে জুতো দিয়ে আঘাত করলে মাটির উর্বরা শক্তি কমে যাবে আর প্রকৃতির সাথেও অকারণ দূরত্ব তৈরি হবে। দেশের মাটিকে না ভালবাসলে আর দেশপ্রেম কিসের। রাজা - উজির ব্যস্ত মানুষজন, প্রয়োজনে যেতে হয় হেথা হোথা, এদেশ বিদেশ। তাদের কথা ভিন্ন। বাকি প্রজাদের জুতোর জন্য এই অহেতুক খরচের
কোনো প্রয়োজন নেই। বরং সেই টাকা খাজনা হিসেবে কোষাগারে জমা পড়লে দেশের আয় বাড়বে আর অনেক উন্নতিও করা সম্ভব হবে ?' রাজা খুশিতে ডগমগ হয়ে মন্ত্রীর পিঠ দিলেন চাপড়ে। ভাবলেন আহা কি পরিবেশবান্ধব দেশহিতকারী ভাবনা। ঘোষণা করে দিলেন পরদিনই রাজ্যে বছরভর চলতে হবে খালি পায়ে।জুতো পড়া , বানানো, বিক্রি করা সব বন্ধ। আর সেই সাথে খাজনার পরিমাণও দিলেন বাড়িয়ে।শুনে রাজ্যবাসীর পড়ল মাথায় হাত। খাওয়াদাওয়ার সুখ তো চুকেছে আগেই ,এবার শুরু হলো অন্য জ্বালা। হাঁটাচলা, কাজকম্ম চুলোয় উঠলো এর পর। যারা কাজ করতে গেল, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তাদের পায়ের অবস্থা হলো শোচনীয়। রাজার কাছে প্রতিকার চেয়ে লাভ হলো না কোনো। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই রোগে ভুগে মারা যেতে লাগলো। আবার অনেকে প্রাণের আশায় ভিটে মাটি ছেড়ে পাড়ি দিল ভিন রাজ্যে । গোটা রাজ্যে রয়ে গেলো হাতে গোনা কিছু পরিবার। রাজার সুবুদ্ধি ফিরে আসার আশায় দিন গুনতে লাগলো তারা।
এদিকে মন্ত্রিমশাই ভারী খুশি ততদিনে। রাজাকে তিনি প্রজার চোখে নামিয়ে এনেছেন অনেকটা নিচে। রাজ্যেও বাসা বেঁধেছে অলক্ষ্মী। আর কিছুদিন এমন চললে আজবগড় তলিয়ে যাবে বিস্মৃতির আড়ালে। রাজা বেগতিক বুঝে রাজদরবারে ডেকে পাঠালেন মন্ত্রীকে। বললেন - 'তোমার বুদ্ধিতে আমার সাধের রাজ্য যে রসাতলে গেলো। ' মন্ত্রী বলেন - 'এ আপনার ভারী অন্যায় কথা রাজামশাই। বৃথাই আমায় দোষ দিচ্ছেন। দেখুন তো প্রজারা কেমন জোট বেঁধেছে, সব ব্যাপারেই এক সুরে গান গাইছে ।......' রাজা থামিয়ে দিয়ে বললেন -' হ্যাঁ কিন্তু সেতো আমাদেরই বিরুদ্ধে।' মন্ত্রী উঠলেন বলে - 'আজ আমাদের বিরুদ্ধে। অভিমুখ বদলে দিলেই কালই তা অন্য কারুর বিরুদ্ধে হবে। আপনাকে এখন সেটিই করতে হবে।' রাজা বললেন - ' বেশ । তবে বলো কি করতে চাও।' মন্ত্রী সবিনয়ে জানান - 'প্রজাদের বলুন সকলকে একযোগে যুদ্ধে যেতে হবে পাশের রাজ্য বিশালগড়ের বিরুদ্ধে। বিনিময়ে প্রতি পরিবারের একজন স্থায়ী চাকরি পাবে সেনাবাহিনীতে। এতে লাভ আপনারই। প্রজারা সুযোগই পাবে না রাজার বিরুদ্ধে মুখ খোলার।' উপায়ন্তর না দেখে মন্ত্রীকে বিশ্বাস করে রাজা তাই করলেন। যা ভেবেছিলেন স্বাভাবিক কারণেই ফল হলো বিপরীত। অনেক মায়ের কোল খালি করে অনাহার ক্লিষ্ট অপটু দুর্বল সেনাবাহিনী সহজেই হার মানলো বিজয়গরের সামনে। সম্মান খুইয়ে প্রচুর সম্পদের বিনিময়ে গদি বাঁচালেন রাজা মহেন্দ্র।
যুদ্ধ শেষ । রাজ্য আজ প্রায় প্রজাশূন্য। চারিদিকে বয়ে গেছে রক্তগঙ্গা। রাজামশাই কপালে হাত দিয়ে ডেকে পাঠালেন মন্ত্রিকে। কিন্তু মন্ত্রী কোথায়? সে তো ততক্ষণে পিঠটান দিয়েছেন দূরের কোনো রাজ্যে। সময় খারাপ বুঝে আখের গুছিয়ে সরে পড়েছেন রাজপারিষদ চাটুকারের দল।
রিক্ত মনে শূন্য প্রাঙ্গণে এসে বসলেন রাজা মহেন্দ্র। বসে রইলেন অনেকক্ষন। মনে ভিড় করে রয়েছে হাজার দুশ্চিন্তা আর অপরাধবোধ। হঠাৎ কানের কাছে একটা পিনপিনে আওয়াজ অনুভব করলেন। তাকানোর সাথে সাথে কাঁধের কাছে এসে বসলো প্রজাপতিটা । তার আকাশ আলো করা রঙের বাহার ক্ষণিকের জন্য যেনো জুড়িয়ে দিল মনের সব অবসাদ। ভাবলেন আহা ঈশ্বরের কি অপরূপ সৃষ্টি। রাজার মনের কথা বুঝতে পেরেই যেনো বলে উঠলো প্রজাপতি - 'রাজামশাই আমার এত রং আপনার মন করেছে জয়। তবে কেনো প্রজাদের জীবনের ভিন্নতায় আপনার এত ভয়? মন্ত্রিমসাই কুটিল ভারী বিষিয়েছে আপনার মন। নিয়মের অন্যায় বেড়াজালে বন্দী করেছেন মানুষজন।' রাজা কাতর হয়ে বললেন - 'ভুল করেছি আমি। সব শাস্তি মাথা পেতে নেব যদি ফিরে পাই আমার প্রজাদের। তারা সন্তান আমার। জানিনা তারা আর করবে কিনা ক্ষমা আমায়।' প্রজাপতি বললো হেসে - ' চিন্তা করোনা তুমি আর, এতদিনে ভুল যখন করেছ স্বীকার।ফুলে ফুলে ছড়িয়ে দেবো আজবগড়ের কথা, পাখিরা গাইবে দেশে দেশে তোমার গুনগান। আসবে আবার সুদিন ফিরে, তুমি হবে মহান।
এরপরে দেখতে দেখতে কেটে গেছে একটি বছর। রাজা মশাই প্রতিশ্রুতি মত এই কদিনে আবার রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন সুশাসন। রদ করেছেন তাঁর নিজের জারি করা সমস্ত একুশে আইন। আজবগড় রাজ্য আজ সমৃদ্ধির শীর্ষে। চতুর্দিকে জয়জয়কার হচ্ছে রাজা মহেন্দ্রর নামে। এখন প্রজাদের মতামত অভাব অভিযোগ রাজা মন দিয়ে শোনেন, গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেন। দেশের স্বার্থে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে প্রজাদের নিয়ে সভা ডাকেন। প্রজাদের দিয়েছেন নির্ভয়ে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা।
আজ রাজার জন্মদিন। সেই উপলক্ষে গোটা রাজদরবার উৎসবমুখর। রাজামশাই এসে বসলেন রাজ প্রাঙ্গণে পুরনো সেই আসনটিতে । দেখলেন ফুলে ফুলে নেচে বেড়াচ্ছে তার সেই বন্ধু প্রজাপতি। আজ আর সে একা নয় । শিশুদের কোলাহল, প্রজাদের সমাগম, প্রজাপতি আর পাখিদের কলকাকলিতে আজ যেনো সারা উদ্যান খেলা করছে জুড়ে অকাল বসন্ত।