হে রাজমাতা কুন্তী
হে রাজমাতা কুন্তী
দিবস অতিক্রান্ত, ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম্ শান্ত, আত্মসমাহিত।
সন্ধ্যা সমাগত প্রায়, সপ্তাশ্ববাহী রথারূঢ় বিভাবসুর
বিদায়বন্দনে আমি নিয়োজিত।
সূর্যপুত্র বসুষেণ কর্ণ, রাধেয় রূপে পরিচিত,
পালক জনক আমার অধিরথ সূত।
মর্মকলুষিত তনয়, বিচলিত হৃদয়, অব্যক্ত ক্রন্দনময়,
কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধ পূর্বে অবগত হয়ে আপন জন্মপরিচয়।
পুণ্যতোয়া স্বচ্ছধারাবাহিনী সলিলা তীরে,
মৃদু মন্দ শীতল বাতাস বহিছে অতি ধীরে,
সাষ্টাঙ্গে প্রণতি রক্তিম অস্তাচলগামী সূর্যেরে,
লয়ে সুতীব্র ঘৃণা অন্তরের অন্তরতম গভীরে।
অদূরে দৃশ্যমান পাণ্ডব-কৌরব শিবির,
আসন্ন প্রথমযাম, অন্ধকার সুনিবিড়।
এ ঘোর রজনী পোহালে প্রভাতে আরম্ভ হবে সে মহা মহারণ,
কুরুক্ষেত্র রণক্ষেত্রে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ, পরস্পর আত্মীয় স্বজন।
কিঞ্চিৎ অন্যমনে আচ্ছন্ন কঠোরগর্ভা চিত্তে আমার নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ভাবনা,
অবশিষ্ট নাহি কি এ যুদ্ধরোধের ক্ষীণাতিক্ষীণ, ক্ষীণতমও সম্ভাবনা?
প্রকীর্ণ অস্ত্রাদি, বিশ্রাম শিবিরে, প্রবেশপথের আচ্ছাদনে,
সহসা এক রমণীর প্রচ্ছায়া যেন কম্পিত চরণে।
অসিবন্ধে রাখি হাত আমি কর্ণ, অভ্যাসবশে,
ছায়ামূর্তি ক্রমাগত সম্মুখে, স্পষ্ট অবশেষে,
অঙ্গরাজ বসুষেণ কর্ণ হাসি, বিদীর্ণ অট্টহাসে।
প্রণাম করি চরণে, কর্ণ আমি, আগ্রহী জিজ্ঞাসা....
"অয়ি, রাজমাতা, আগমন হেতু আমার দ্বারে কীবা, সর্বাঙ্গীন কুশল মঙ্গল তো বারতা?"
স্মিত বক্র শ্লেষাত্মক হাস্য ওষ্ঠে,
বিগলিত বিদ্রূপ উচ্চারণে কন্ঠে।
অপারগ পিতামহ ভীষ্ম অপিচ শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেব গোবিন্দ,
কুন্তীপুত্র কর্ণকে যুদ্ধবিরত করিতে, ত্যাজিতে সঙ্গ মন্দ।
কর্তব্যবন্ধনে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ অঙ্গরাজ কর্ণ, কুরুযুবরাজ মিত্র দুর্যোধন নিকট,
অকস্মাৎ এ প্রলোভন সূর্যপুত্রেরে, জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবরূপে রাজ্য অধিষ্ঠানের বিকট প্রকট।
সম্বোধন নিষিক্ত আমার বিতৃষ্ণাভারে, "হে মাতা...
বিচিত্রবুদ্ধি দুর্বাশা মুনির বিচিত্র বরে বালখিল্যে উদ্ভিন্নযৌবনা,
বরের সত্যাসত্য নিরূপণে কৌতূহলপ্রিয়া কুন্তীভোজ রাজকন্যা,
আবাহন করে সূর্যদেবে, সূর্যবীজে গর্ভবতী পৃথা
যুবতী অনন্যা,ধ্যধ্য
লোকলজ্জা ভয়ে ফুৎকারে নির্বাপিত দীপ, পৃথার মাতৃস্নেহ করুণা।
জন্মদাত্রী কুমারী মাতা সদ্যোজাতে ত্যাগ করে গোপনে নিতান্ত অবহেলায়,
ভাসায় কানীন পুত্র একান্তে অগোচরে অশ্বনদী স্রোতে তাম্রপাত্র ভেলায়।
জাহ্নবীনীরে কুড়ায় যে রমণী, জননী হয় সেই, সযত্নে সিঞ্চন পান করায়,
স্নেহমিশ্রিত দেহনিঃসৃত আপন পয়োধি অমৃতধারায়।
হে মাতা কুন্তী.... সে জননীকে ত্যাগ করি আজ যদি পাণ্ডবজননীকে মাতা বলি,
জীবনের ঋণে ঋণী যার ক্রোড়ে, সিংহাসন লোভে, সেই মাতা রাধাকে যদি আজ ছলি,
তবে ধিক, ধিক্কার, ছিছিক্কার আপন মনুষ্যত্বকে!
কেন আজ এক্ষণে যুদ্ধপূর্বে তোমাকে আপন করি নেবো মাতা? কী বা প্রয়োজন?
কোন অধিকারে অকারণ স্বীকৃতি পাবে পাণ্ডব, হবে মোর ভ্রাতা? কী নিগূঢ় কারণ?
আমার বিচারে নহ তুমি আদর্শ কন্যা, আদর্শ স্ত্রী অথবা আদর্শ সুমাতা।
তুমি কেবল স্বার্থান্বেষী রাজনন্দিনী, রাজবধূ, রাজেন্দ্রাণী রাজমাতা।
কারা পাণ্ডব, মাতা? তারা তো নহে কেহ পাণ্ডুপুত্র!
নিয়োগ-পদ্ধতিতে তারা ভিন্ন ভিন্ন পিতার ঔরস্য পুত্র মাত্র।
ভ্রাতা কী রূপে হয়? সহোদর বৈ তো তারা নয়!
সেই হেতুই কী মাতা, তোমার ঐ নিষ্ঠুর অনৈতিক আদেশ? পাঞ্চালীর সম্মতির অপেক্ষা ব্যতিরেকে?
তোমারই নির্দেশে তোমার পুত্রেরা লিপ্ত অজাচারে?
কন্যা তথা ভগ্নীসমা কনিষ্ঠা ভ্রাতৃবধূ অথবা....
মাতৃসমা যথা জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃবধূর সহিত সহবাস....
প্রদর্শিত কী নির্মম নিরতীত নিরতিশয় উপহাস!
এ কী প্রকার নির্লজ্জ অনাচার ভারতশ্রেষ্ঠ রাজ পরিবারে?
চাহি না মাতা পৃথা, হে রাজমাতা কুন্তী,
চাহি না হতে পরিণত সে পরিবারের পাপাচারী... স্বৈরাচারী অংশীদারে।
আপন গর্ভজাতের পরম দুঃখের দিন, জন্মদাত্রী মাতাকে এহেন তিরষ্কারে।
তথাপি মাতা, এ তোমার প্রাপ্য, ভূষিতা হও মাতা... তিরষ্কারের পুরস্কারে।
নতজানু আমি বসুষেণ কর্ণ, হই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হে মাতা,
সাক্ষী এ নিভৃত রজনীর তারকাখচিত আকাশ,
সারস্বত স্রোতস্বিনীর স্নিগ্ধ নির্মল জলীয় বাতাস,
অলক্ষিত অন্তরীক্ষে পূর্বজ-জন, স্বর্গের সর্ব প্রমুখ দেবগণ।
স্থিরচিত্তে মাতা করো গো শ্রবণ.....
সুরক্ষিত রবে সবে পাণ্ডুপুত্র কৌন্তেয়গণ,
কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধ যবে হবে অতিক্রমণ।
নিহত হবে না তারা কেহ, সহজাত কবচ কুণ্ডলধারী মার্তণ্ডেয়র অস্ত্রে......
পারঙ্গম তারা অতিশয়, নিরাপদ প্রয়োগে আপন আপন শস্ত্রে।
হস্তিনাপুরের রাজমুকুট, রাজসিংহাসন সে আমার নয়,
পারিতে যদি মাতা ত্যাগ করিতে তুচ্ছ লোকলজ্জা ভয়, আমার জন্মকালে.....
উপযুক্ত মর্যাদায় মাতা, তবে আজি আঁকিতে রাজটীকা, নিষ্কণ্টক আমার কপালে।
ফিরে যাও, হে অয়ি, হে রাজমাতা কুন্তী,
স্নেহ বিহীন, সুখ বিহীন, শান্তি বিহীন, আনন্দ বিহীন,
স্বার্থমগ্ন লোলুপ বিষবাষ্পপূর্ণ রাজঅন্তঃপুরে।
পারো যদি ব্রতী হও আপন অহংশূন্য বিবেক, গৌরবশূন্য অস্তিত্ব, স্বার্থশূন্য অন্তরাত্মার উদ্ধারে।
যাবার কালে পাণ্ডবজননী, রাধেয়কে করো আশীর্বাদ,
বীরগতি প্রাপ্ত যেন মহানিষ্ক্রমণে হই, অবগত হবে সে সংবাদ।"
আপামর মহাভারতের ভারতবাসী.....
দানবীর কর্ণ আমি, অকৃতজ্ঞ নই।
রাজধর্ম, কুলধর্ম, মিত্রধর্ম, পুত্রধর্ম, ন্যায়ধর্ম, সত্যধর্ম, স্ব-স্বস্থানে স্বমহিমায়,
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বার্থলোভীদল কেবল করুণানিধন জঘন্য সর্বগ্রাসী হতে চায়।।
(বিষয়: ভুল সংশোধন):