ছোটবেলার সুপারহিরোরা
ছোটবেলার সুপারহিরোরা
- তারপর কি হলো মাসি?
- তারপর তো ঢিসুম করে একটা ঘুসি মারলো ওই পাপী রাজার মুখে। আর মুখে..
- কঙ্কালের খুলির ছাপ?
- এই তো। রিন্টু এখন সব বোঝে।
- ইয়ে !! কি মজা!! কি মজা! আচ্ছা মাসি!
- হুমম হুমম?
- অরণ্যদেব কি এরম ভাবে সবাইকে রক্ষা করেন?
- সবাইকে সোনা।
- আমাকেও রক্ষা করবে?
- হুমমম। সবাইকে।
- কি ব্যাপার! মাসি বোনঝি তে মিলে কিসের গপ্প চলছে?
রিন্টুর মা হাসি মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ‘মা’ বলে ডেকে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল রিন্টু।
- আজ মা তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। ইয়ে!!!!!
- আরে ছাড়! হাত পা ধোব তো! নাকি! তা আজ কিসের গল্প চলছিল!? অরণ্যদেব নাকি ম্যানড্রেক?
- অরণ্যদেব মা।
- বাহ বাহ! সুতপা, তুমি চলে যেতে পারো আজ এখন। আমি তো আজ চলেই এসেছি। তারপর তোমারও তো এখন প্রচুর কাজ। কি গো! সব কেনাকাটি কেমন চলছে?
- না মা। না। এখন মাসি যাবে না। বললেই হলো নাকি? এখনও মাসি ম্যানড্রেকের গল্প বলেই নি । আগে বলবে। তারপর …
- আচ্ছা! আজ না হয় ম্যানড্রেকের গল্প আমি বলব তোকে? চলবে?
- না। না। না। তুমি মাসির মত বলতে পারোই না। মাসি বলবে।
ছুট্টে মাসির কাছে চলে এল রিন্টু।
- কিগো মাসি! তুমি গল্প বলবে না?
- বলব রে বাবা, বলব।
রিন্টুকে কোলে বসিয়ে কপালে একটা চুমু খেল সুতপা মাসি। রিন্টুর মা রত্না দেবী বললেন
- সুতপা, আর তো কটা দিন! আমি তোমার পাশে বসে শুনি কিভাবে গল্প গুলো বল তুমি। রপ্ত করার চেষ্টা করি একটু। তুমি চলে গেলে এই গুরুভার তো আমাকেই নিতে হবে। নাকি!
রিন্টুর বয়স সাত পেরিয়ে আটের ঘরে, বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন। তাই রিন্টুর সকালবেলাটুকু দেখাশুনা করার জন্য সুতপা কে রাখা। চার পাঁচ বছরেই যেন সুতপা হয়ে উঠেছে রত্না দেবীর ছোট বোন। কিন্তু এবার সুতপা বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে। সেই সুদূর দক্ষিণ দিনাজপুরে বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের পর আর এই কলকাতায় এসে রিন্টুর দেখাশুনা সম্ভব হবে না। তাই বিয়ের আনন্দের মাঝেও মন ভার সুতপার। রত্না দেবীও যতটা আনন্দ পেয়েছেন , ঠিক ততটাই ওনার মনও কেঁদেছে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার দুঃখে। রিন্টু বাচ্চা মানুষ। এখনো বুঝেই উঠতে পারেনি মাসি চলে যাচ্ছে।
রিন্টুদের সাথে শেষ সপ্তাহ টুকু চোখের নিমেষে কেটে গেল সুতপার। শেষদিন রিন্টুকে ছেড়ে যাবার সময় আর চোখের জল ধরে রাখতে পারল না সুতপা। রত্না দেবীর চোখের কোণেও জলের ফোঁটা উঁকি মেরেছে। রিন্টুকে কোলে তুলে নিল সুতপা।
- মাসি, তুমি কাঁদছো?
- না রে রিন্টু। কই না তো।
- ওই তো তোমার চোখে জল।
- না রে। ধুলো বোধহয়।
- মা বলছিল তুমি আর আসবে না নাকি? আমায় অরণ্যদেবের গল্প কে শোনাবে তবে?
- আসব সোনা, হয়তো প্রতিদিন আসবো না। কিন্তু মাঝে মাঝে ঠিকই আসবো। মাঝের দিন গুলো মা শোনাবে। আর আমি যখন আসব আবার তখন আমি শোনাব।
রিন্টু ফিসফিসিয়ে সুতপা মাসির কানে কানে বললো
- তাড়াতাড়ি এস। কেমন! মা না ঠিক পারে না!
বিয়েতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিল সুতপা। দিন দুয়েকের মধ্যেই রিন্টুর মন মেজাজ খারাপ। মায়ের আঁচল ধরে কান্নাকাটি করে সে সুতপা মাসিকে খোঁজে। কেঁদে কেঁদে মাকে একের পর এক বলে চলে
“ মাসি আসবেনা?”, “জানো মা, টিকটিকিটা ঘুলঘুলি থেকে বেরতো। আমি ভয় দেখিয়ে ওকে তাড়িয়ে দিতাম। না হলে ও তো মাসি কে ভয় দেখাত।“, “এখন মাসিকে কে গার্ড দেবে!”, “মাসির পায়ে মশা বসলে আমি মেরে দিতাম।“, “মাসি তো খুব কষ্ট পাবে। একা হয়ে যাবে।“
হাজারো প্রশ্নে যুক্তি থাকে না। থাকে পদ্মকুঁড়ির সারল্য আর অপরিসীম ভালোবাসা। কোনো উত্তরেই রিন্টু সন্তুষ্ট হয় না। ভালোবাসার কাছে হার মানে যুক্তিরা।
বিয়ে হল সুতপার। উপহারের ডালি নিয়ে হাজির হল রত্নাদেবীরা। বিছানার চাদর, গয়না, বই.. সব কিছু দিয়ে সুতপাকে কে আশীর্বাদ করে বিদায় জানালেন রত্না দেবী।
সময় সময়ের মত অতিবাহিত হয়ে চলল। বাজারে মোবাইল ফোন এল। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ায় গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোতে এল। আমাদের রিন্টুও বড় হয়ে গেছে। তার ছেলে তুতানের বয়স এখন আট। আর আমাদের রত্না দেবী তুতানের যত্নআত্তি করেন ঠিক যেমনটি করে সুতপা রিন্টুর যত্নআত্তি করত বছর তিরিশ আগে।
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আবারও সুতপার সাথে রিন্টুর যোগাযোগ হল। একদিন সুতপা মাসিকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানাল রিন্টু। সুতপা এল। চোখে মুখে বয়সের ছাপ। কিন্তু হাসিতে সবুজ তারুণ্য ঝিলমিল করছে। তুতানকে দেখে উচ্ছসিত হয়ে জিজ্ঞেস করল
- এ কী আমাদের ছোট রিন্টু?
রত্নাদেবী হেসে বললেন
- সুতপা! কত দিন পর! এস এস।
- তা রিন্টু কই?
- একটু বেরিয়েছে। এক্ষুনি আসবে।
তুতান দিদার হাত জড়িয়ে জিজ্ঞেস করল
- দিদা, এটা কে!
- এটা বলে না সোনা। বল ইনি।
- ইনি কে!
- তোমার আরেক দিদা সোনা। তোমার এক নতুন দিদা।
- দাঁড়াও, আমি এখুনি আসছি।
ছুটে পাশের ঘরে গেল তুতান। রত্নাদেবী সুতপাকে জিজ্ঞেস করল
- তা সুতপা, পুরোই ভুলে গেছ বল আমাদের!
- কি করে ভুলি বলুন। রিন্টু ভুলতে দিয়েছে?
- কেন সে আবার কি করেছে?
- আপনারা জানেন না?
- না তো। কি হয়েছে?
- এই দেখুন।
সুতপা ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বার করল। রত্না দেবী কাগজ টা হাতে নিলেন। একি! তার রিন্টুর ছোটবেলার হাতের লেখা।
- এটা কোথায় ছিল সুতপা!
- আপনার ছেলে আপনাদের উপহারের সামগ্রীর মাঝে এটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
রত্না দেবী কাগজ টা হাতে নিয়ে দেখলেন লেখা আছে
“ মাসি, চিন্তা করো না। আমি অরণ্যদেবকে পাঠাচ্ছি। কোন বিপদ আসবে না তোমার কাছে।“
রত্নাদেবী খানিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
- মানে?
- এই দেখুন।
আরেকটা কাগজ বের করল সুতপা। তাতে প্যাস্টেল কালার দিয়ে অরণ্যদেবের ছবি আঁকা।
- এই কাগজ দুটো আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি দিদি। আজীবন রেখেও দেব। বিপদে পড়লেই মনে হয় রিন্টুর অরণ্যদেব তো রয়েছে আমার সাথে।
ততক্ষনে তুতান এসে হাজির হয়েছে। মুখে স্পাইডারম্যানের মুখোশ।
- নতুন দিদা, কোনো বিপদ হবে না তোমার। এই তো স্পাইডারম্যান চলে এসেছে।
- হা! হা! একে অরণ্যদেবে রক্ষা নেই, আবার স্পাইডারম্যান দোসর।
স্পাইডারম্যান এখন নতুন বন্ধু অরণ্যদেবের ছবি দেখতে মগ্ন। আর দুই বাস্তবের সুপারহিরো সুতপা আর রত্নাদেবী রিন্টু আর তুতানকে নিয়ে গল্পে মশগুল। নস্টালজিয়ার সমুদ্রে ডুব দিয়ে মাঝের তিরিশ টা বছর তখন বেমালুম বেপাত্তা।