Indrani Bhattacharyya

Children Stories Drama

4.6  

Indrani Bhattacharyya

Children Stories Drama

মায়ে পোয়ে

মায়ে পোয়ে

6 mins
3.4K



সমু - 'ভাই, কুপিটা নিভিয়ে দে তো'।

ভাই - ' পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে যে। একটু আলো থাক না। না হলে যে ঘুম আসে না আমার।খুব ভয় করে। তাই যখন আমি শুতাম দিদা তখন সারা রাত আমার মাথার কাছে একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে রাখতেন।'। 

সমু - 'আজ আর ভয় লাগবে না ,দেখিস। খেয়ে এসে বাবা শোবেন যে আমাদের পাশে'।

ভাই - 'বা রে! অন্ধকার ঘরে বুঝবি কি করে তিনি বাবা না অন্য কেউ'।

সমু - 'ঠিক বুঝতে পারবি। বাবার গায়ের অমন আদুরে গন্ধ আর কার গায়ে পাবি বল? আর তাছাড়া শুধু কি বাবা, মাও তো আকাশের তারা হয়ে রোজ এসে ফিসফিসিয়ে গল্প করে জানলার ওই পারে। এতদিন তো তুই দিদার কাছে মামাবাড়ীতে ছিলিস। সেখানে দিদার কোলে ঘুমোতিস। তাই সব গল্প শুধু আমিই শুনতাম একা একা '।

ভাই - ' কি মজা দাদা। কিসের গল্প দাদা ? রূপকথার?'

সমু - 'হ্যাঁ রে ভাই। দারুণ মজার সব গল্প, রূপকথা, শুকতারার গল্প, মেঘমল্লারের গল্প, ছায়াপথের কাহিনী আর এমনি আরো কত কি'।

ভাই - 'কিন্তু দাদা এত তারার মাঝে চিনিস কি করে মাকে'?

সমু - 'ঠিক চিনতে পারি। তাহলে একটা গল্প বলি শোন। তুই তখন সবে জন্মেছিস। মার সঙ্গেই আতুর ঘরে আছিস। আমি তখন ঠিক তোর মতই ছোট্টটি ছিলাম। সেই সময় একদিন বাবা এসে তোকে আমার হাতে দিয়ে বললেন - 'সমু, ও তোমার ছোট ভাই। ওকে যত্ন করে দেখেশুনে রাখবে। ওকে মাণিক বলে ডেকো। তোমাদের মায়ের সাথে আর কোনোদিন তোমাদের দেখা হবে না। মায়ের তো খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। তাই দুর্বল হতে হতে কখন যেনো একসময় হাওয়ায় তোমাদের মা মিলিয়ে গেছেন। তারপর আকাশ মায়ের কোলে তারা হয়ে পাড়ি দিয়েছেন মেঘেদের রাজ্যে। আর তোমার ভাইকে দিয়ে গেছেন আমাদের কাছে'। সেখানে জানিস ভাই ,মার নাকি কোনো কষ্ট নেই। শুধু আমাদের জন্যই নাকি খুব মন কেমন করে মায়ের । তাই তো প্রতি রাতে তারার বেশে জানলার পাশে এসে অপেক্ষা করেন আমাদের জন্য।মায়ের যে গন্ধ ভেসে বেড়ায় তখন বাতাসে। আমিই একমাত্র সে কথা জানি। আর আজ জানলি তুই '। 

ভাই - 'তাই বুঝি? তাহলে দাদা আলো নিভিয়ে দিচ্ছি। আমাকে ও তবে চিনিয়ে দে সেই তারা। আমিও পেতে চাই মায়ের মিষ্টি গন্ধ '।

সমু-'দেখছি দাঁড়া, সময় হলো কিনা ' বলে জানলা দিয়ে সমু মুখ বাড়িয়ে দেখলো খানিক আকাশটাকে। তারপর হাওয়ায় নাক ভাসিয়ে বলল- ' না রে ভাই। মা আজ আসেনি এখনও'।

গোল গোল চোখ করে বললো ভাই- ' দাদা তুই এত নিশ্চিত হয়ে বললি কিভাবে'?

দাদা বলল হেসে- 'মায়ের আসার সময় হলে যে সামনের আমলকী বনে ঝিরঝিরে হাওয়ায় কানে ভেসে আসে পাতা খসার খসখস শব্দ আর উঠোনের কোণে চাঁপা ফুলের গাছ থেকে ছড়িয়ে পরে মিষ্টি চাঁপা ফুলের গন্ধ। তখনই বুঝি তারার বেশে মা এসেছে, আমায় গল্প শোনাবে বলে। জানিস ভাই উঠোনের এই চাঁপা গাছটা মা নিজের হাতে লাগিয়েছিল । মা যে চাঁপা ফুল খুব পছন্দ করত। ছোটবেলায় মনে পড়ে আমি আর মা সন্ধ্যে হলে চাঁপা ফুল পেরে আনতাম সাজি ভরে আর তারপর সেগুলো দিয়ে সুন্দর করে সাজাতাম তুলসী মঞ্চটাকে '।

ভাই - ' দাদা, আজ কিন্তু তবে ডেকে দিস মা এলে। জন্মের পর থেকে আমি তো এতদিন দিদার কাছেই শুতাম। মায়ের সঙ্গে এমন মিষ্টি রাত কাটানোর ভাগ্যি আমার এর আগে কখনো হয়নি'।

সমু - ' আচ্ছা ভাই। ডেকে দেবো। আরো একটু রাত গভীর হোক। ঘুমিয়ে পড়ুক সকলে।মানুষের ছায়া আরো এক হাত লম্বা হোক। পেঁচা বাসা ছেড়ে রাতের শিকারে বেরিয়ে পরুক। আকাশে মেঘের চাদর সরিয়ে ঘুম ভেঙে জেগে উঠুক সকল তারা, তখন ঠিক ডেকে দেবো তোকে ।এখন তুই ঘুমিয়ে পড় দেখি'।

তারপরে সেদিন রাত্রি দুই প্রহরের পর যখন আমলকী বনে হাওয়ার মাতন লাগলো, চাঁপা ফুলের গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো হাওয়ায় ভর করে ঠিক তখনই মায়ে পোয়ে গল্প উঠলো জমে জানলার পারে। সাক্ষী রইলো আকাশপ্রদিপ, জোনাকির দল আর চাঁদের চরকা কাঁটা বুড়ি। 

এরপর থেকে এমনি করেই প্রতিদিন রঙিন গল্প আর রঙিন স্বপ্নে রাত কাটতে থাকে দুই ভাইয়ের।


কিন্তু সুখ শান্তিতে ভরা এমন নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব জীবন বেশিদিন কাটানো সম্ভব হলো না তাদের পক্ষে। একদিন হঠাতই তাদের গাঁয়ে রাক্ষসেরা হানা দিল। দেখতে যদিও তারা মানুষের মতো কিন্তু কাজ কারবার এক্কেবারে গল্পের বইতে পড়া রাক্ষসেরই মত ভয়ংকর। প্রচুর টাকা পয়সার মালিক তারা।গাঁয়ে এসেই রাক্ষসের মতো টাকার জোরে আর গায়ের জোরে সকল গ্রামবাসীকে ভিটে ছাড়া করলো। তারা বলল ওই গ্রামে নাকি শহরের লোকেদের জন্য বড়ো বড়ো প্রাসাদ মানে শহুরে ভাষায় যাকে বলে হোটেল, রিসর্ট, ভিলা, বাংলো, সেই সব বানানো হবে। তাই সেই দৈত্যপুরীতে নাকি সমু, মানিকের বাপ দাদাদের ঘর বাড়ির কোনো দাম নেই। ভুয়ো কাগজ দেখিয়ে, পয়সার জোরে গাঁয়ের মাথাদের হাত করে নিয়ে রাক্ষসেরা মেতে উঠল সর্বনাশের খেলায়। নিজেদের খুশি মত সেই গাঁয়ে ছবির মত সাজানো ঘরবাড়ি চোখের নিমেষে ধুলোয় মিশিয়ে দিল দানবের মত সব বড়ো বড়ো যন্ত্র দিয়ে। তারপর বিনা নোটিশে এক রাতের মধ্যে গাঁয়ের সকলকে দূর করে দিল। ছায়া ঘেরা শান্তির নীড় ছেড়ে গায়ের আর পাঁচ ঘরের মতোই সমু মানিককে নিয়ে তাদের বাবা মাথা গুজলো রাক্ষসদের বানিয়ে দেওয়া গরিব মহল্লায়।


সেইখানে জেলখানার কুঠুরির মত একেক খানা ঘরে দমবন্ধ হয়ে আসা নোংরা স্যাঁতস্যাতে পরিবেশে কোনো মতে দিন গুজরান করে ওই গ্রামের একেক খানা পরিবার।অন্য সকলের মতই সমু মানিকের খুব কষ্ট হচ্ছিল এখানে। কিন্তু তারা তো খুব লক্ষ্মী ছেলে । তাই ইচ্ছে না হলেও জোর করে মানিয়ে নিল সব কিছু। এখানে গাঁয়ের বাড়ির মত আকাশের মস্ত নীল সামিয়ানা চোখে পড়ে না।খড়খড়ির ফাঁক গলে কোনো মতে এক ফাঁলি আকাশ উঁকি ঝুঁকি মারে। সেটুকুতেই মুক্তির স্বাদ খোঁজে দুই ভাই। চারপাশে সামান্য এক ছটাক জমিতে আগাছা আর অযত্নে কোনমতে লেপ্টে আছে নিষ্প্রাণ সবুজ। সব থেকে কষ্টের ব্যাপার হলো ,রাতগুলো এখন একেবারেই দুই ভাইয়ের কাটতে চায় না আর। কাটবেই বা কি করে? খড়খড়ির ফাঁকে চোখ রেখেও যে খুঁজে পায় না তাদের গল্প বলা তারার বেশে মাকে। মনে মনে ভাবে আসার সময় তো বলে আসা হয়নি। তাই হয়ত মা এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁর নয়নের মনিদের। এই সব ভাবতে ভাবতে চোখের জলে আর মনের ক্লান্তিতে দু চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়ে দুজনে। তারপর দুঃস্বপ্নে আর দুশ্চিন্তায় কেটে যায় বাকি রাত। 

এইভাবেই কাটছিল তাদের রোজকার বেরঙিন দিন। এমন সময় একদিন সমু তার নতুন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখলো একজন মানুষ ঝাঁকায় করে গাছের চারা বিক্রি করছে বাজারের সামনে। কি মনে হতে টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে জমানো পয়সা দিয়ে কিনে নিলো একটা চাঁপা ফুলের গাছ আর তারপর সেটা লাগিয়ে দিল ঘরের বাইরের শুকনো এক চিলতে জমিতে। তারপর দুই ভাই মিলে দিনের পর দিন মন প্রাণ ঢেলে খুব যত্ন করলো গাছটার। এমন ভালোবাসা আর যত্নে কিছুদিনের মধ্যেই ডাল পালা মেলে চারাগাছ থেকে সেটি বেশ সজীব আর প্রাণচঞ্চল গাছ হয়ে উঠলো আর তার অল্প কিছুদিন পরেই ফুলে ফুলে ভরে উঠলো পুরো গাছ। গাছের সেই রূপ দেখে অনেকদিন পর আনন্দে ভরে গেলো তাদের মনও। তারপর সেই রাতে যখন ফুল ফুটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো চাঁপা ফুলের মিষ্টি সুবাস তখন দুই ভাই মিলে চুপিচুপি চোখ রাখলো খড়খড়িতে। এমন করে ভালোবাসলে মা কি আর না এসে পারে? 

কালো স্লেটের মত নিকষ কালো আকাশে তখন চকে লেখা একটা একটা অক্ষরের মত জ্বলে জ্বলে উঠছিল একটার পর একটা তারা। এমন সময় তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কখন যেনো অশ্বত্থ গাছের ঝুড়ি বেয়ে খিড়কির গায়ে টুপ করে খসে পড়লো একটা হিরের মত চকচকে ছোট্ট একটা তারা। সমু আর মানিকের চিনতে ভুল হলো না মোটেই। এই তারাটির জন্যই তো এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছে তারা। দুই ভাইয়ের মুখে বহু কাল পর আবার পূর্ণিমার চাঁদের মত গাল ভরা হাসি ফুটে উঠল। 

তারপর আর কি। মায়ের কাছে বসে আবার শুরু হলো গল্পে ভরা স্বপ্নে বোনা রাত কাটানো। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই বোধ হয় কিছু কিছু গন্ধ এমন করেই কোনো বিশেষ মানুষের বা বিশেষ মুহূর্তের দ্যোতক হয়ে ওঠে। আর তাছাড়া মায়েরা যে কখনোই কোনো অবস্থাতেই সন্তানদের ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারেন না।সন্তানদের ভালোবাসাতেই যে তারা বেঁচে থাকেন চিরটা কাল।


Rate this content
Log in