কুমিরডাঙা
কুমিরডাঙা
আকাশটায় বড্ড মেঘ করেছে। চারতলা ফ্ল্যাটের এই ব্যালকনিটা থেকে আকাশটা মেঘ করলে বেশ দেখতে লাগে। অন্য সময় হলে যেরকম মেঘ করেছে, মিষ্টি বাতাস বইছে তাতে আমাকে কবিতার পেছনে ছুটতে হত না, বরং কবিতাই এই সুন্দর আবহাওয়ায় নিজে থেকে এসে আমার কলম আঁকড়ে জাঁকিয়ে বসত।
-কি ভাবছো গো? এই নাও, চা এনেছি।
এই সন্ধেবেলাটা মোহর বেশ জমিয়ে চা টা করে করে কিন্তু। বছর দুয়েক আগে এরকম চা করে এনেছে, পুরো এরকম ওয়েদার একদম। বাচ্চুর দোকান থেকে আলুর চপ নিয়ে এসেছিলাম। চোখে ভাসছে পুরো দিনটা। লোকে বলে নাকি বয়স বেড়ে গেলে প্রেম হয় না। চপ মুড়ি আর চা, এরকম আবহাওয়া, উফফ, রোমান্স জলের পাইপ বেয়ে সোজা চারতলায় উঠে এসেছিল সেদিন।
-কি গো! কি ভাবছো! নাও চা টা।
-হুমম, দাও দাও।
-কিরকম মেঘ করেছে দ্যাখো!
-মনের আকাশেও যে বড্ড কালো মেঘ করেছে মোহর।
-হুমম গো! কবে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কে জানে!
-এত পরিজন প্রিয়জন কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছে কিছু ভালো লাগছে না মোহর।
-ফেলুদার মত সারাক্ষণই তো বলতে ইচ্ছে করে ভালো লাগছে না রে তোপসে, ভালো লাগছে না।
সকালে শম্পা ফোন করেছিল। আমাদের ছোটবেলাকার স্কুলের বন্ধু ছিল স্বপন, ওর কয়েকদিন ধরে জ্বর। টেস্ট করাতে নাকি কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট এসছে। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। খবরটা শোনার পর থেকে মনটা আরো খারাপ হয়ে আছে। শম্পা, মোহর, আমি, স্বপন, ইউনিস - আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। যখন আমার আর মোহরের বিয়ে হল তখন টানা চার-পাঁচ দিন কত মজা করেছিলাম আমরা পাঁচজন। তারপর থেকে কতবার প্ল্যান করেছি যে আবার পাঁচজন একসাথে মিট করব। কিছুতেই হয়ে উঠল না, আজ এর হয় তো কাল ওর হয় না। বড্ড চিন্তা হচ্ছে স্বপনের জন্য। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলেই হয় এখন।
-চিন্তা হচ্ছে স্বপনটার জন্য। তাই না?
-হ্যাঁ মোহর, চিন্তা হচ্ছে গো।
মোহর আমার হাতটা ধরল শক্ত করে।
-সুস্থ হয়ে যাবে ও তাড়াতাড়ি। আই বিলিভ।
স্মিত হেসে মোহরের দিকে তাকিয়ে সায় জানালাম। ওর চোখেমুখেও একটা চিন্তার ছাপ আছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
-সেই ছোটবেলায় মনে আছে তোমার! টিফিনের সময়ে আমরা কত করে বলতাম স্বপন, হাত ধুয়ে টিফিন খা, হাতটা ধুয়ে নে। কিছুতেই শুনতো না।
-হ্যাঁ গো! ছোট থেকেই তো ও ওরকম। যেটা শুনবে না তো কিছুতেই শুনবে না।
-বেমালুম খেলেধুলে কাদামাটি মেখে এসে ঐভাবে কেউ খেতে পারে নাহলে! বলো।
-কি আর বলবো বলো! সুস্থ হয়ে আসতে দাও। ওর খবর আছে। এমন ডোস দেব চা বিস্কুট খাবার আগেও সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোবে এবার থেকে।
সত্যিই মনটা বড্ড অস্থির করছে। ছেলেটা একদম নিজের প্রতি যত্ন নিত না। ছোটবেলায় মনে আছে বৃষ্টির পর রাস্তা পুরো পিছল। তবু ওকে আম কুড়াতে যেতেই হবে। দু-দুবার আছাড় খেয়ে উল্টে গেছিল। হাত পা কেটে একাকার অবস্থা তখন। হাঁটুতে এমন আঘাত পেল যে তিনদিন স্কুল কামাই করতে হল। তারপরও আমগুলো নিয়ে এসে ওর মুখে বিজয়ীর হাসি। ছোটবেলার স্মৃতি তো! সেই আম-বিজয়ীর কথা ভাবতে ভাবতে নিজের মুখে অখেয়ালেই একটুকরো হাসি ফুটে উঠেছে। পাশে তাকিয়ে দেখি মোহরের মুখেও একটা নস্টালজিয়ার হাসি। সেও হয়তো এরকম কোনো নস্টালজিয়ার সাগরে ডুব দিয়েছে।কিন্তু এই নস্টালজিয়ার সুখ তো সাময়িক। নিজেকে কিছু মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে রাখার মাধ্যম মাত্র। তবুও মোহরের সাথে নস্টালজিয়ার মুহূর্তটা ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হল। নিজেই জিজ্ঞেস করলাম
-কিগো কি ভাবছো?
-আরে আমরা সেই কুমিরডাঙ্গা খেলতাম মনে আছে!
-থাকবে না আবার? উফফ, সন্ধ্যে সাতটা, আটটা… আমাদের কুমিরডাঙ্গা খেলা চলছে। বাপরে বাপ!
-ইউনিস একবার টানা কুড়ি মিনিট মত চোর হয়েছিল। তারপর দাসকাকুদের কার্নিশটার তলায় বাবু গোঁসা করে বসে ছিলেন।
-যা বলেছ। দাস কাকু বেরিয়ে বলেন, কি গো বাবা! শরীর ঠোরীর ঠিক আছে তো?
-সে শুনে তো ইউনিস আরো রেগে গেল। উফফ, কবেকার কথা!
ঠিক যেমন সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পরে শান্ত বালুচরে বারবার, ঠিক তেমনই নস্টালজিয়ার সুখস্মৃতি বারবার আছড়ে পরছে মনের মাঝে। আবার সেই ঢেউ ফিরে গেলেই মনের মধ্যে একরাশ কালো মেঘ ভিড় জমায়।
-এই, তোমার মনে আছে স্বপনটা খালি চোর হত কুমিরডাঙায়।
-কি লেভেলের কনফিডেন্স ছিল মাইরি। এখনো মনে আছে। আমি চোর হয়েছি। হঠাত দেখি, স্বপন আমার এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে বলছে কুমির তোর জলে নেমেছি। ব্যাস, খপাত করে ধরেছি।
-একদম রোজকার ঘটনা। ও সব থেকে বেশিবার চোর হবেই হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম
-কি জানি! এই অভ্যেসটার জন্যই আজ হয়তো এই অবস্থা। ভাইরাসের সাথেও হয়তো কুমিরডাঙা খেলতে গেছিল।
-সোশ্যাল ডিস্টেন্স মানত না বলছ!
-জানি তো না। মানতো কি মানতো না। হয়তো মানে নি। সপ্তাহ তিনেক আগে বাজারে দেখা হয়েছিল। কোনো ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সের বালাই ছিল না। হোয়াটস্যাপ করে বলেওছিলাম। ভাই, এগুলো এখন মেনে চ। শুনলে তো!
-এই, শোনো না
-কি গো!
-ও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে তো?
-আলবাত হবে।
আমার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির হাসি হাসলো মোহর।
-ও সুস্থ হোক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। তারপর একদিন পাঁচজন বসে জমিয়ে আড্ডা মারব।
-শুধু আড্ডা না। কুমিরডাঙাও খেলবো।
-বয়সটা ভুলে গেছ নাকি!
-সবকিছু আর বয়সে হয় নাকি গো! মনে তো তারুণ্য।
-যা ভালো বুঝবে করবে।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। ইউনিস ফোন করেছে। কি ব্যাপার!
-হ্যালো
-ভাই শোন না। স্বপনের জন্য আল্লার কাছে দোয়া করলাম। আমি জানি শম্পা আর মোহরও ঠাকুরের কাছে প্রে করবে। ভাই, তুইও প্লিস নাস্তিকতার অহংবোধটা একটু দূরে সরিয়ে রেখে প্ৰে কর না রে। দ্যাখ, তাতে স্বপন অনেক তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
-আচ্ছা।
-রাখি রে এখন ভাই। এটা বলতেই ফোন করলাম।
-আচ্ছা, টাটা রে।
আমি তো সত্যিই মানি না ঠাকুর। মোহরকে তো বলেইছি ঠাকুর ঘরের চৌকাঠ মারাব না কোনোদিনও। কি জানি! ইউনিস কথাটা বলাতে এখন সত্যিই একবার ঠাকুরঘরে যেতে ইচ্ছে করছে যে।
-মোহর
-বলো গো।
-আমি ঠাকুরের কাছে কিছু বললে ঠাকুর শুনবে?
-ঠাকুর সবার কথা শোনেন। যাও।
বিশ্বাসের কাছে হয়তো হেরে যায় যুক্তিবোধ। হারুক যুক্তি, বিশ্বাসটা যে বড্ড দরকার আজ। স্বপনকে যে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতেই হবে। ঠাকুরঘরে গিয়ে স্বপনের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম আবার। মোহর তখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে। আমি এসে ওর পাশে দাঁড়াতেই আমার কাঁধে ও আস্তে করে মাথাটা এলিয়ে দিল।
-কি বললে গো ঠাকুরকে? যাতে আমরা পাঁচজন আবার খুব তাড়াতাড়ি কুমিরডাঙা খেলতে পারি?
হেসে বললাম
-তুমিই তো বল, ঠাকুরের কাছে কি চাইছি সেটা বলতে নেই কাউকে।