খুশির পুজো
খুশির পুজো
শারদ প্রভাতের উজ্জ্বল আলোয় চতুর্দিক ঝলমল করছে। আকাশে শ্বেত শুভ্র মেঘের ভেলা জানান দিচ্ছে মা আসছে। এ যেন তারই নৌ- বহর। আকাশ গাঙে বজরা ভাসিয়ে মা এলেন বলে। দুর্গা পূজো এলেই ছোট্ট আনোয়ারের মনে খুশির জোয়ার আসে। ঢাকের আওয়াজ, মন্ডপে মন্ঠপে ঠাকুর দর্শন এ সব কিছুই তার বেশ ভালো লাগে। আর ভালো লাগে যখন পাশের বাড়ির গৌরী এসে তার পাকা পাকা কথায় চোখে মুখে নানান অঙ্গ- ভঙ্গী করে মা দুর্গার নানান গল্প বলে। আনোয়ার তো হেসে গড়িয়ে পড়ে যখন গৌরী নিজেই মা দুগ্গা সেজে একটা গাছের ডালকে ত্রিশূল বানিয়ে তাকে মহিশাসুর সাজিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। সেই মহালয়া থেকে গৌরীর এমন খেলার নিত্য সঙ্গী সে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আনোয়ার নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলে। নদীর দুই পাড়ে কাশের বন বহু দূর পর্যন্ত চলে গেছে। হঠাৎ যেতে যেতে কানে তার কান্নার শব্দ আসে। কিছুক্ষন থেকে ঠাওর করে সে কান্নার শব্দ অনুসরণ করে ঢোকে কাশের বনে।
' একি গৌরী তুই এখানে বসে কাঁদছিস কেন?'
গৌরী তাও ফুপিয়ে চলে কিছুতেই কান্না থামে না। অনেক কাতর অনুনয় বিনয়ের পর গৌরী জানায় যে তারও দুগ্গা পূজো করার বড় সাধ জেগেছে। গ্রামের লাহাদের বাড়িতে দুর্গা পূজা হয়, কত ধুমধাম সেখানে । তা দেখে তারও ইচ্ছা সেও পূজো করবে। বাড়িতে মূর্তি কেনার বায়না করায় বেশ করে বকা খেয়েছে। আসলে ছোট্ট গৌরীর ছেলে মানুষী খেয়ালের কথায় অত কান দিলে কি চলে! ওদের মতো দিন আনি দিন খাই দের বাড়িতে এমন সাধ- ইচ্ছা বাহুল্য মাত্র। তাই ছোট্ট মেয়েটির খেয়ালিপনাকে কেউ গ্রাহ্য করেনি। তা এত গম্ভীর বিষয় ছোট্ট গৌরীর সরল সাধা- সিধে মনে ঢোকার নয়। আনোয়ার অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে আচার- হজমি গুলির লোভ দেখিয়ে গৌরীকে বাড়ি নিয়ে চলে।
পরের দিন মহাসপ্তমী । গ্রামের পূজো মন্ডপ থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছে। নব পত্রিকা স্নানে বের হবে তারই আয়োজন চলছে। গৌরীও যাবে সেই স্নান দেখতে। নদীর ধারে সবাই যখন নব পত্রিকা স্নানে ব্যস্ত তখন গৌরী দেখে নদীর পাড়ে কাশ বনের ধারে তার আনোয়ার দাদা দাড়িয়ে হাতে একটা ছোটো দুর্গা মূর্তি। গৌরী একছুটে সেখানে গিয়ে দেখে কি সুন্দর মূর্তি! মা দুর্গা তার বাহনের পিঠে দাড়িয়ে। এক পাশে লক্ষ্মী- গনেশ, অন্য পাশে কার্তিক- সরস্বতী। হাতে মুখে কাদা মাটি মেখে এক নির্মল সরল হাসি মুখে ছোট্ট আনোয়ার তার সাধের বোনকে বলে -' তোর জন্য বানিয়েছি। কেমন হয়েছে রে? '
ডাগর ডাগর চোখ দুটি তখন বিস্ময়ে ভরা। একবার মূর্তির দিকে আর একবার তার আনোয়ার দাদার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে গৌরী। গৌরীর চোখে এত বিস্ময় দেখে আনোয়ার বলে- ' ঐ শালুডাঙার মাঠে খেলতে গিয়ে আমি দেখেছি ওখানকার কুমোরটুলিতে কি রকম করে মূর্তি বানায়। তারপর থেকে এইখানে নদীর পাড়ে বসে আমিও অনেক মূর্তি বানাতে চেষ্টা করতাম। অনেক কষ্ট করে এটা বানিয়েছি। তোর পছন্দ হয়নি বোন?'
গৌরী আনন্দে খুশিতে হাততালি দিয়ে বলে ওঠে -' খুব মজা হবে এবার আমি দুর্গা পূজো করব। ' তখন গৌরী মূর্তিটাকে নিয়ে নদীর ধারের কাশবনের ভেতর এক ফাঁকা জায়গা দেখে ছোট ছোট হাতে বালির বেদী করে তার ওপর রাখে। কাশ ফুল দিয়ে সাজায়। দূরে কোনো উঁচু গাছের ডালে বসে একটা নীলকন্ঠ পাখি ডেকে ওঠে। তার পর শুরু হয় নীল আকাশের চাঁদোয়ার নীচে কাশ ফুলের সজ্জায় সজ্জিত প্রকৃতির অপরূপ মন্ডপে দুই ছোট ছোট ছেলে -মেয়ের দুর্গা পূজো। তাদের এই পূজোয় নেই কোনো নিয়ম, নেই কোনো আচার- বিধি, নেই কোনো তিথি - ক্ষন, নেই কোনো বিসর্জন। আছে শুধুই দুই নিষ্পাপ সরল শিশু মনের অনাবিল আনন্দ। আর তাতে খুশি মনে সায় দেয় প্রকৃতি রাণী শরতের স্নিগ্ধ শীতল বাতাসে নিজেকে মেলে ধরে।
(সমাপ্ত)
