জন্ম- মৃত্যু
জন্ম- মৃত্যু
হলো, যাবার আয়োজন
দেওঘরে খুবই শীত পড়ে।
মাথা মুখ ঢেকে মহামায়ার ছোট জা আঁতুড়ঘরের দরজার সামনে অপেক্ষা করছিলেন। পাশে দুই বিধবা ননদ বসে, শাঁখ হাতে… সকলে কথা বার্তা বলছিলেন।
ভোর হয়ে এল, বাড়ির পুরুষ ও বাচ্চারাও আস্তে আস্তে জেগে উঠল।
বন্ধ ঘরের দরজা খুলে দাই এসে দাঁড়াল, 'খোঁখি মাঈজী...'
আসে পাশে কিছু আত্মীয়াও জড় হয়েছিলেন, একজন বলে উঠলেন, 'আহা এবারেও মেয়ে। আমরা ভেবেছিলাম, এবারে বৌমার খোকা হবে।'
কেউ সান্ত্বনা জানাল, কেউবা পুলকিত মনে নানা রকম মন্তব্য করতে করতে আস্তে আস্তে সরে পড়তে লাগলেন।
অসন্তুষ্ট বড় ননদ উঠে দাঁড়ালেন, 'ছোট বউ, ওদের গরমজল, কাপড়- চোপড়, আগুন- মালসা দাও… আর শাঁখটা তুলে রাখ।'
বড় বোন দুটো, ছোট বোনকে দেখার আশায় কাকীমার পেছনে ঘুর ঘুর করতে লাগল।
ছোট জা বললেন, 'মেয়ে নিয়ে অনেক ভোগান্তি, নাহলে আর কী? মানুষ করে তুলতে তো সমানই কষ্ট। বড় করে পরের ঘরে পাঠাও, সেখানে সে কেমন থাকে... সে চিন্তাও তো আছে।'
আরতি, ভারতী প্রথম দুই মেয়ের সঙ্গে মিলিয়ে তার নাম খোঁজা চলল। বাবা আশুতোষ তার নাম দিলেন, তপতী।
নিস্তব্ধ একটা সকালে বেশ দেরী করেই ঘুম ভাঙল তপতীর, সূর্যের আলো চোখে পড়তে। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই।
'কেউ আমাকে ডাকেনি কেন?'
….ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম ধ্বান্তারিং সর্ব্বপাপঘ্নং প্রণতোস্মি দিবাকরম...
বাবার উদাত্ত কণ্ঠের সূর্য বন্দনা আর ধুপের গন্ধে ঘুম ভাঙে রোজ ছোট্ট তপতীর।
এক ছুট্টে ছাদে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। জবা ফুলে সূর্যার্ঘ্য দেন তিনি। তাঁকে ছোঁয়া অবশ্য বারণ, বাসী কাপড়ে।
তপু চুপ করে দাঁড়িয়ে সকালের এই পবিত্র মুহূর্তটুকু উপভোগ করে...
দৌড়ে ছাদে চড়ল তপু, কেউ নেই। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। আর তো শোনা যাবে না সেই কন্ঠস্বর। গতকাল দুপুরে যে সে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্যে।
ঘুমের মধ্যেই বাবা চলে গেছেন...
এই নিয়ে দু'মাসের মধ্যে দু' দুটো মৃত্যু প্রত্যক্ষ করল তপু।
কয়েকদিন আগেই পিসতুতো ভাই দেবাঞ্জনকে নিয়ে গেল সবাই মিলে। তপুর সব রকম দুষ্টুমির সঙ্গী, বড় প্রিয়, বড় আদরের।
মা ওকে সাজিয়ে দিলেন চন্দন পরিয়ে।
ওর হাতটা ধরে বসেছিল তপু।
মরে গেলে নাকি শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়… অঞ্জনের গা টা কিন্তু বেশ গরম ছিল। অনেক আশায় ছিল তপু, এই বুঝি অঞ্জন উঠে বসবে।
তার মামাকে নকল করে বলবে, 'তপু, পড়তে বোস...'
খুব অসুখ করেছিল অঞ্জনের। এই বাড়িতে নিয়ে আসার পরে জানা গেল ওর মেনিঞ্জাইটিস হয়েছে... পিসির বাড়িতে এতদিন না কি ডাক্তার টাইফয়েডের চিকিৎসা করেছেন।
বাড়িতেই ডাক্তার এসে পিঠ বেঁকিয়ে শিরদাঁড়া থেকে জল বের করে দিতেন। খুব কষ্ট হত ওর, কি ভাবে কাঁদত। মা, খুব যত্ন করেছিল। ডাক্তার বলে গেলেন, মায়ের যত্নেই ও এতদিন বেঁচে ছিল। মামার বন্ধু, নিরঞ্জন ডাক্তার মামা তো মায়াকেই ওর মা মনে করেছিলেন।
একদিনই পিসি, জ্যোতি এসেছিল তার ছেলে, অঞ্জনকে দেখতে।
মাছ ভাত গলিয়ে পিসির হাতে দিয়ে, মা বলেছিল, 'আমি বাবার খাবারটা দিয়ে দিই, তুমি একটু একটু করে ওকে খাইয়ে দাও।'
গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে দিদু এসে দেখেন গলায় ভাত আটকে সে ছেলে প্রায় যায় যায়। এত্তখানি খাবার তার মুখে ঠুসেছে পিসি। অঞ্জনের তো দম বেরিয়ে যায় আর কি!
চেঁচামেচিতে এসে দাঁড়ান মহামায়া।
'ওকে ভার দিয়েছ রুগীর সেবার, বৌমা? ও কী একটা মানুষ… জানোয়ার জানোয়ার।'
সেদিন শাশুড়ির চোখেও ভর্তসনা দেখেছিল মায়া, তাঁর মেয়ের প্রতি।
'তোর ছেলে মরছে, একবার এসে দাঁড়াবারও সময় হয় না তোর। ইচ্ছে হলে আসবি, খবরদার! ওর গায়ে হাতও দিবি না।'
ছাদ থেকে নেমে, মুখ হাত ধুয়ে, জামা বদলে তপু বসল গিয়ে তার পড়ার টেবিলে। টেনে নিল তার লেখার খাতাটা।
কত স্মৃতি...কত কথা। কী লিখবে সে? তার কান্না কেন পাচ্ছে না, সে কী বাবাকে ভালবাসে না?
সকলের পরিবর্তন সবসময় বোধহয় বাইরে দেখা যায় না। দু চার দিন কান্না কাটি করে, অনেকেই শোক সামলে উঠে বসে। তপু তাদের দলে পড়ে না।
চোখের কান্নাটাই পৃথিবীর কাছে বড়… তাই মৃত্যুর আসল চেহারাটা সকলে দেখতে পায় না। অঞ্জন, বাবার মৃত্যু হয়েছে। তপুর জন্যে সে মৃত্যু প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের। যতদিন বাঁচবে, সে মৃত্যু পাশে পাশে থাকবে। সে অভাব আর কেউই বুঝবে না।
তপুর হাসি- কান্না, দুখ-আনন্দ, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপে পর্যন্ত সে মৃত্যু যে মিশে থাকবে… তা হয়তো বিশ্ব বোধের বাইরে।