জামাইষষ্ঠী
জামাইষষ্ঠী
ভূতের গল্প, সে বেশ গা ছমছমে হলে, তো কথাই নেই - ছোটবেলায় শুনতে কি ভালো লাগতো না? ঠাকুমার দিদিমার মুখে - সেই কোন ছোটবেলায় শোনা, গল্পের স্মৃতি হাতড়ে, নিজের মতন করে সাজিয়ে দিলাম - এই বহুশ্রুত/পঠিত একটি কাহিনী!
।।জামাই ষষ্ঠী।।
দেশের সেনা বিভাগে কাজ করছি প্রায় বছর ষোলো সতের হলো। আগামী বছরেই অবসর নিয়ে আবার নতুন কোন চাকরির চেষ্টা করতে হবে। অজয়ের ভাঙনে নিজেদের গ্রামের বাড়িটা তলিয়ে যাবার পর, বৌকে আপাতত কিছুদিনের জন্য তার বাপের বাড়িতে রেখে, আবার ডিউটি জয়েন করতে চলে আসি।
সেও প্রায় বছর তিনেক আগের কথা, এরমধ্যে তিন তিনটে যুদ্ধ, লাগাতার সীমানায় সংঘর্ষ আর বারংবার ছুটি বাতিল হওয়ায় পরিবারের কোন খবরও পাই নি। তাই এবার জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই টানা ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরছি। গ্রামে গিয়ে বেঁচে থাকা জমি জমার কিছু ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করে, একটা জায়গা দেখে বাড়িও করতে হবে। কিন্তু তারও আগে, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বৌয়ের খবর নিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে আসতে হবে।
তাই, আগে শ্বশুরবাড়ি যাওয়াই স্থির করলাম - কারণ, পরের দিনই আবার জামাই ষষ্ঠী, আর আমার সঙ্গে ব্যাগ পত্রও রয়েছে অনেকগুলো বেশ ভারী ভারী। তাই স্টেশন থেকেই একটা ফাঁকা ট্রেকার পেতেই, ড্রাইভারের পাশের পুরো জায়গাটা দখল করলাম। গায়ে আর্মির পোশাকটা তখনও থাকায় খুব একটা অসুবিধাও হল না। যাই হোক, শ্বশুরবাড়ির গ্রামের ভিতরে গাড়িটা যায় না বলে, মেন রাস্তার ধারেই লটবহর নিয়ে নেমে পড়লাম।
ড্রাইভারটা বেশ অবাক হয়ে বললো - আপনি এখানে নামবেন? আমি বললাম - হ্যাঁ, কাছেই এক জনের সঙ্গে একটু দেখা করে বেড়িয়ে পড়বো। তারপর শুধু প্রসঙ্গ বদল করার জন্য বললাম - এখন তো প্রায় সন্ধ্যে হয়েই এসেছে, ট্রেকার কত রাত অবধি চলে এদিকে? ড্রাইভারটা কেমন অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে বললো - তা' রাত আটটা অবধি পাবেন। তারপর হুশ করে চলে গেলো!
আমি মাল পত্তর গুলো কোনোমতে একজোট করে, ট্রলি ধরে টানতে টানতে এগোতে লাগলাম শ্বশুরবাড়ির দিকে। সেও প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা, দুধারের জমি সব খাঁ খাঁ করছে - চাষ আবাদ এখনও হয়নি। রাস্তার ধারে গাছপালা গুলো কিন্তু আগের মতই ঘন আর আকাশ ঢাকা হয়েই রয়েছে এখনও। রাস্তায় বিশেষ লোকজন কাউকে দেখলাম না - হয়তো সন্ধ্যে হয়ে গেছে বলেই, তারওপর কারেন্টও নেই বোধ হয়। কারণ, কোনো পোলেই আলো জ্বলতে দেখলাম না।
আমার শ্বশুরবাড়িটা আবার গ্রামের ভিতর দিয়ে গিয়ে একবারে শেষ মাথায়। গ্রামের ভিতর হাঁটার সময় রাস্তাগুলোর তিন বছর আগের মতই একই বেহাল দশা দেখে বুঝলাম - এখানে বিশেষ কিছু কাজই করেনি প্রশাসন। রাস্তায় কারোর সাথে দেখা না হলেও, যথারীতি এদিক ওদিকে খামারে ছোট ছোট জটলা করে, লোকে বসে গল্পগুজব করছে দেখলাম। যদিও আমায় দেখেও তারা আগের মত কেউই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এলো না দেখে অবাক হলাম। কারণ, এই গ্রামে আমি খুবই জনপ্রিয় ও প্রায় সকলেরই পরিচিত। ভাবলাম - এই অন্ধকারে তাও এতদিন পর দেখে আমায় হয়তো ঠিক চিনতে পারেনি নিশ্চয়ই। আমিও এত বোঝা নিয়ে আর নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে তাদের সাথে কথা বলতে গেলাম না, ঠিক করলাম পরদিন সকালেই এই নিয়ে এক প্রস্থ ঠাট্টা তামাশা করা যাবে।
যাক গে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঢুকলাম। এই গ্রামে কারোর বাড়িতেই সদর দরজা বলে কিছু নেই - সব খোলা। আমি গিয়ে বৌয়ের নাম ধরে ডাকতে না ডাকতেই, সুলু, আমার বৌ, ঘর থেকে বেড়িয়ে এল - বাবাঃ, এতোদিন পর এলে? আমি তো ভাবলাম সব ভুলে বুঝি নতুন করে কোথাও ঘর বেধেঁছো! আমি হাসতে হাসতে তার পিছন পিছন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম - আরে না না, তোমরা কি দেশের কোন খবর রাখো না? এত গুলো যুদ্ধ গেলো, আমাদের কিভাবে দিনগুলো কেটেছে তা জানো?
সুলু হেসে বলে - আমরা আর ওসব খবর পাবো কি করে? সেই বছর তিনেক আগেই যা শেষ খবর শুনেছিলাম, তারপর তো সব... তার কথা শেষ হলো না, আমার শ্বাশুরি মা ঢুকলেন। আমি প্রণাম করতে যেতেই বাধা দিয়ে বললেন - থাক থাক, বাবা, এতো দূর থেকে এসেছো ক্লান্ত হয়ে, আর নমো করতে হবে না, বসো। আমি জলখাবারের ব্যবস্থা করি, তুমি জামা প্যান্ট ছাড়ো, ও সুলু জামাইকে জামা কাপড়গুলো বের করে দে! বলে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
আমি বললাম - আজকেই বিকেলে ট্রেন থেকে নেমে, বাড়ি না গিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছি জানো? সুলু বললো - তুমিও এতদিন আমাদের কোন খবরই পাওনি, না? আমি - না গো, তাইতো ঠিক করলাম আগে তোমাদের সাথে দেখা করে, তারপর তোমায় নিয়ে গ্রামে যাবো। তারওপর কাল আবার জামাই ষষ্ঠী, তোমার মাও নিশ্চয়ই খুশী হবেন - আমি এমন সময়ে এসে পড়াতে, কি বলো, তাই না?
ইতিমধ্যে শ্বাশুরি মা জল খাবার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, আমার কথা শুনে বললেন - সে তো বটেই বাবা, তবে কি আমাদের তো কাল কোনো শুভ অনুষ্ঠান করার বারণ আছে, তাই আজই তোমায় ফোঁটা দেবো, কেমন? আমার এমনিও আজ উপোস ছিল, আর ষষ্ঠীও পড়ে গেছে। তুমি জলখাবার খাও, আমি ষষ্ঠীর ব্যবস্থা করেই আসছি। তুইও একটু আয় তো মা, একটু হাতে হাতে এগিয়ে দে দেখি। - বলে তিনি আমার হাতে কাটা ফলের একটা প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন, আর তাঁর পিছু পিছু গেল সুলুও।
কারেন্ট না থাকায় আলো নেই, ঘরের কুলুঙ্গীতে একটা কুপি জ্বলছে টিমটিম করে। আমি হাত মুখ ধুইনি, পোশাকও পাল্টাইনি, তার আগেই কাটা ফল খেতে ধরিয়ে দিল! - ব্যাপারটা বেশ ভালো না লাগায়, খাবার প্লেটটা পাশে রেখে উঠে পড়লাম। গায়ের জামাটা খুলতে খুলতে উঠে জানালাটা খুলে দিয়ে দাঁড়ালাম একটু খোলা হাওয়া গায়ে লাগাবো বলে। কিন্তু সেখান থেকে যা দেখলাম তাতে তো চক্ষু চড়ক গাছ!
দেখি - সুলু উনুনের ভিতর পা দুটো ঢুকিয়ে দিয়ে বসে আছে, দাউ দাউ করে জ্বলছে উনুন, আর তার ওপরে বসানো চায়ের সসপ্যানে টগবগিয়ে ফুটছে চা! তার ওপর আবার ওখানে বসে বসেই লম্বা হাত বাড়িয়ে, কুলুঙ্গী থেকে একটা কাপ প্লেট নামিয়ে আনলো সে চা ঢালবে বলে!
এদিকে দেখি - উঠোনের কোণে আমার শ্বাশুরি মা একা লড়ে চলেছেন, তাঁর ভাসুরপো আর দেওরদের সঙ্গে; বলছেন - আমার জামাই খবর নিতে পারেনি, দেশের হয়ে যুদ্ধ করছিলো বলে। ওর ক্ষতি ক'রো না কেউ, ওর সাদা মনে কোন দাগ নেই বলেই, কোন খোঁজ খবর না নিয়েই, সোজা এখানে এসে হাজির হয়েছে এতদিন পর। এতোদিনের বাসি ফলগুলো, আধোয়া প্লেট কোনো কিছু নিয়েই কোনো অভিযোগ অবধি সে করেনি, উল্টে আমায় প্রণাম করতে আসলো জানো? এমন জামাই তো কপাল গুণে মেলে - ও আমার জামাই নয়, আমার ছেলে। ওর কোন ক্ষতি আমি কাউকে করতে দেবো না!
আর কি, শুনে একবার তাকালাম ফলের প্লেটটার দিকে, আর বুঝলাম - আমি এতক্ষণ যা শুনলাম যা দেখলাম সব সত্যি! আমার শ্বশুরবাড়ির কেউই, হয়তো বা এই গ্রামের কেউই আর জীবিত নেই। যাঁদের আমি দেখছি তাঁরা প্রত্যেকেই অশরীরী এবং বহু আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন সকলেই! যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সামনে মাথা ঠাণ্ডা রেখে, পরবর্তী প্ল্যান ঠিক করার অভ্যেস তো ছিলই, তবুও এই পরিস্থিতিতে আমার হাত পা সব যেন কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
এক নিমেষেই ঠিক করে নিলাম - এখানে আর এক মুহুর্তও নয়, মাঠে মাঠে দৌড়ালে আটটার আগেই মেন রোডে যদি পৌঁছাতে পারি, তো সেই ট্রেকারটা ধরে স্টেশন চলে যেতে পারবো। ব্যস, যা ভাবা তাই কাজ - জিনিস পত্র সব ফেলে রেখেই, সবেগে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম। চা নিয়ে ঘরে ঢুকছিল সুলু, আমার গায়ের ধাক্কায় সে ছিটকে গিয়ে পড়লো উঠোনে। আমি স্বভাব সুলভ একটা "স্যরী" বলেই, সোজা মাঠে মাঠে পড়ি মরি করে দৌড় লাগালাম। পিছন থেকে তেনাদের আওয়াজ আসতে লাগলো - ধঁর ধঁর, পাঁলালো, পাঁলালো। ওঁকে ধঁর, ধঁর।
ওদিকে আমি দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছি - ঐ এক কিলোমিটার রাস্তা পাড় হতে, সেদিন যেন একযুগ লাগলো আমার। মেন রাস্তায় এসেও থামলাম না, রাস্তা ধরে উল্টোদিকে দৌড়াতে লাগলাম। বেশ অনেকটা দৌড়াবার পর দেখি - ট্রেকারটা আসছে রাস্তা দিয়ে, আমি প্রায় তার ওপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফিরলে দেখি - আমাদের গ্রামের বুড়োশিব মন্দিরের সামনের রাস্তায় আমি শুয়ে আছি, পাশে আমার সমস্ত ব্যাগ পত্তর নিয়ে!

