Utso Bhattacharyya

Horror Tragedy Fantasy

4.3  

Utso Bhattacharyya

Horror Tragedy Fantasy

জাগরণ :শারদ সংখ্যা

জাগরণ :শারদ সংখ্যা

5 mins
298



শরতের আগমনে প্রকৃতি সমস্ত রঙ রূপ গন্ধের আয়োজনে নিজেকে সুসজ্জিত করে তোলে ৷ একটা স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের ছোঁয়া লাগে প্রকৃতির সমস্ত উপাদানে ৷ পেঁজা তুলোর মত শুভ্রকান্তি মেঘরাজি নির্মল নীলিমায় ভেসে বেড়ায় ৷ শিউলিফুলের সুরভীতে মাতোয়ারা হয় নান্দনিক চেতনারা ৷ সরোবরে শতপাপড়ি মেলে প্রস্ফুটিত হয় পদ্ম ৷ সেই নৈসর্গিক আনন্দ হিল্লোল জাগায় মানুষের মনের অন্দরমহলেও ৷ প্রকৃতির সজীব ও নির্জীব সমস্ত সত্তায় এই আনন্দের পরশ লাগার কারণটা সহজেই অনুমেয় ৷ শরৎ মানেই যে পরমাপ্রকৃতি মহামায়ার আসার সময় হল ৷ আর মায়ের আগমন বার্তাতে সন্তানেরা আহ্লাদিত হবে—সেটাই ত স্বাভাবিক ৷


    কিন্তু দিনের আলোর শেষ চিহ্ন মিলিয়ে আসার সাথে সাথেই যেমন রাতের আঁধার ঘনিয়ে ওঠে, তেমন ভাবেই মানুষের মধ্যে দেবত্বের গুণাগুণ আর আসুরিক প্রবৃত্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে ৷ ষড়রিপুর বশবর্তী হয়ে সেই তামসিক প্রবৃত্তিগুলিই সমস্ত নান্দনিকতার বিনাশ সাধনে তৎপর হয় ৷ সেই দুর্দান্ত হলাহলে জীবাত্মা অস্হির হয়ে ওঠে ৷ সন্তানেরা পরম সংকটে দেখেও মা কি স্হির থাকতে পারেন ? মায়ের স্নেহময়ী রূপটি তখন পরিবর্তিত হয় অসুরদলনী রূপে ৷ সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ঘটনাপ্রবাহে স্বয়ং মহাকালও হস্তক্ষেপ করেন না ৷ বাস্তবিকতা আর পরাবাস্তব একসূত্রে গ্রথিত হয় সেই মহাক্ষণে ৷ সময় প্রবাহ থমকে যায় তখন...

                           

           **********************

দুর্বলের সমস্ত অনুরোধ উপরোধকে পদাঘাতে দীর্ণবিদীর্ণ করে, মানবিক বোধগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা কেবল হুকুম তামিল করে ৷ দোর্দন্ডপ্রতাপ মালিকের আদেশ অমান্য করার মত সাহস নেই তাদের ৷ তা ছাড়াও পেটের দায় বড় বালাই ৷ তাই প্রতিদিন অন্যায় আদেশগুলো যথাযথভাবে পালন করে তারা ৷ আর পাপের পাঁকের মধ্যে ধীরে ধীরে আকণ্ঠ ডুবে যেতে থাকে ৷ একসময় তাদের মনেও মানবিক চেতনাগুলো ছিল ৷ কিন্তু সেই সব সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো যেন গতজন্মের ইতিবৃত্ত ৷ তাদের কাছে দুর্বল অসহায় মানুষেরা এখন ব্যবসায়িক কাঁচামাল মাত্র ৷ মানবিক অধিকারগুলো এখন তাই অন্ধকার জগতের ব্যবসায়িক পণ্যে পর্যবসিত হয়েছে ৷ সেই হুকুম তামিলকারীরাও এখন শয়তানের অনুচর ৷


         ************************


এবারেও মায়ের আরাধনা হবে ৷ কিন্তু সেই চেনা ছন্দে ঢাক আর বাজবে না ৷ ঢাক বাজানোটা শিল্প হলে সুবল ছিল তার যোগ্য রূপকার ৷ সে যে আর বেঁচে নেই ৷ শয়তানগুলো বাঁচতে দিলো না তাকে ৷ অপরাধ ? তার মেয়ে ফুলিকে সাক্ষাৎ অসুরগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল সে ৷ পারেনি বাঁচাতে ৷ কিন্তু সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ৷ প্রাণের বিনিময়েও যদি ... কিন্তু আসুরিক ক্ষমতার সাথে এঁটে ওঠা সম্ভব হয়নি এক শিল্পীর পক্ষে ৷ কেউ সাহস করেনি প্রতিবাদের ৷ আর আইনকানুন সবই ত রঙ্গশালার কুশীলব ! অকালে চলে গেল সুবল আর ফুলির নান্দনিকতার বিনাশও সেই অসুরদের হাতেই...


           ******************


—তোদের চোখে কি ন্যাবা নাকি রে ? কালো কুচ্ছিত! দেখে শুনে এটাকে কোন আক্কেলে তুলে নিয়ে এসেছিস? এতদিন এই লাইনে আছিস, আর আজ অবধি এইটুকুও...

অশ্রাব্য গালিগালাজ সহযোগে বিদ্রুপাত্মক ভর্ৎসনা করে ওঠে শশাঙ্ক শাসমল ৷ 

—না মানে ফিগারটা তো বেশ ভালই... অন্ধকারে ঠিক করে বুঝতে...

হাত কচলিয়ে মিনমিন করে আত্মপক্ষ সমর্থন করার বৃথা চেষ্টা করে আসমাউল ৷

 অদূরেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাসেল, বাপ্পা, সঞ্জয় আর বিকাশ ৷

শশাঙ্ক আসমাউল'কে মাঝপথেই ধমকে থামিয়ে দেয় ৷ তারপর একটা কদর্য ইঙ্গিত করে বলে,

—অতই যখন পছন্দ নিজেরাই একটু... তারপর একদম... 

গলার কাছে আড়াআড়ি হাত নেড়ে অর্থপূর্ণ ইশারা করে শাসমল৷

—ঐ পালালো.. পালালো... ধর, ধর ! পালাতে দেওয়া যাবে না৷ নাহলে...


            ***************

রাসেলরা ঐ কালো মেয়েটা'কে ধরে আনতে গেছে —সে তো অনেকক্ষণ হয়ে গেল... ওদের সাথে দৌড়ে পারবে না৷ তবে কি... ওদের যেমন কুকুরের স্বভাব ! একটা বাঁকা হাসি হেসে, থুতু ফেলে শাসমল৷ তারপর রঙিন তরলে মন দেয়৷


কিছুদিন আগেই বিমর্ষতার আঁধার মেখে দশভূজা মায়ের পুজো সম্পন্ন হয়েছে ৷ সুবলের ঢাকের চেনা বোল আর কখনো শোনা যাবে না ৷ মায়ের চোখের কোণটাও কী আর্দ্র হয়ে উঠেছিল বিষণ্ণতার উৎসব যাপনের দিনগুলিতে ? সেই উত্তর জানা নেই কারো, কারণ অসহায়ত্বের যন্ত্রণায় আর প্রতিবিধানের আকুতিতে অনেকেরই দৃষ্টি স্পষ্টতা হারিয়ে ফেলেছিল সেই দিনগুলোতে ৷


  আজ উগ্ররূপিনী জগন্মাতার আরাধনার রাত ৷ অমাবস্যার সুগভীর কালিমায় চরাচরের সমস্ত অন্ধকার সমাহিত হয়ে রয়েছে৷টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে সন্ধ্যে থেকেই৷ খানিক দূর থেকে ভেসে আসছে মুণ্ডমালিনী মায়ের অর্চনার আভাস৷ কাঁসর-ঘণ্টা আর ঢাকের শব্দ... ডাকের বোলটা কেমন চেনাচেনা লাগছে না ? সুবল ঢাকি এরকম করেই ত ঢাক বাজাতো ? দূর ! তা কী করে হবে ? তাকে ত সেদিনই খতম করে... নেশাটা বোধ হয় বেশী হয়ে গেছে শশাঙ্ক শাসমলের ! নাহলে এই রকম উল্টোপাল্টা কথা তার মাথায় আসবে কেন ?

আআআহ্!

হঠাৎ সব শব্দ ছাপিয়ে একটা মর্মান্তিক আর্তনাদ ভেসে এল... প্রলয়ঙ্করী শব্দে বাজ পড়ল কাছেই৷ একবার নয় ৷ বেশ কয়েকবার ৷ অনেকগুলো পায়ের শব্দ... প্রাণভয়ে কারা যেন দৌড়ে আসছে এদিকেই... তাদের পেছনে কে ধেয়ে আসছে? তবে কি...নাহ! পুলিশ তো এখন এদিকে আসবে না...সে'সব সেটিং করাই আছে৷ তাহলে?


             ***********

বিশ্বাসদের বাগানবাড়ি ও সংলগ্ন এলাকাটা অনেকদিন থেকেই পরিত্যক্ত৷ অসামাজিক কাজকর্মের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে জায়গাটা৷ অপরাধের আস্তানাটায় সংবিধানের তেইশ নম্বর ধারাটি'কে রীতিমত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, প্রাথমিক নির্বাচনের কাজ শেষে চড়া দামে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনাও নির্দিষ্ট করা হয়৷ অর্থ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে প্রশাসন ও আইনকেও নিষ্কর্মা করে রাখা হয়েছে৷ যেই প্রতিবাদ করতে চেয়েছে, তাকেই প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে৷

 এতদিন পর্যন্ত সব কিছুই শশাঙ্ক শাসমলের পরিকল্পনামাফিকই চলেছে৷ কিন্তু আজ যেন কালপ্রবাহ থমকে গেছে!বাস্তবেই শশাঙ্কর হাতঘড়ি আর মোবাইল জবাব দিয়ে দিয়েছে৷ পলায়নে উদ্যত পাগুলোর পিছনে কার পদসঞ্চারে মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে? তবে কি তাঁর আসার মাহেন্দ্রক্ষণে সময় এইভাবেই থমকে যায়?

                                          

          *************

 প্রকৃতি তাণ্ডবনৃত্যে রত৷ আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসেই শশাঙ্কর বিস্ফারিত চোখজোড়া দেখতে পেল এলোকেশী করালবদনা মায়ের সংহারমূর্তি! চোখের সামনেই পরমাপ্রকৃতি মহামায়ার সেই মূর্তি কখনো দশভূজা সিংহবাহিনীর রূপ পরিগ্রহ করছে, আবার কখনো চতুর্ভূজা ঘোরকৃষ্ণবর্ণ মুণ্ডমালিনী মার প্রতিরূপ হয়ে উঠছে ৷ শোণিতপিপাসু মহাখড়গের এক একটা আঘাতে রাসেল, বাপ্পা, বিকাশদের ছিন্নমুণ্ড থেকে যে রক্তধারা নির্গত হচ্ছে, তা পান করছে... ও... ওরা কারা? শ্যামলী, বিপাশা, অর্চনা... ওরা তো... 

ঐ তো, ঐ তো ! অদূরেই দেখা যাচ্ছে ফুলিকে ৷ আর তার বাবা সুবল তার নিজস্ব ছন্দে বাজিয়ে চলেছে ঢাক ৷ সেই ঢাকের বোলে প্রথমবারের জন্য কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল শশাঙ্ক শাসমলের অন্তরাত্মা !

তবে কি বিশ্বাসবাড়ির জাগ্রত কালীমায়ের কিংবদন্তী সত্যি? 

মা নিজে এসেছেন, অসহায় সন্তানদের অকথ্য যন্ত্রণার আর অসম্মানের প্রতিবিধান করতে৷ আকাশ চৌচির করে প্রতিক্ষণে বাজ পড়ছে, উগ্র উলুধ্বনিতে আর দুন্দুভিনিনাদে কানে তালা ধরে যায়! লোলজিহ্বা রুদ্ররূপিনীর মুখটা এত চেনা মনে হচ্ছে কেন? চিনতে বড় ভুল হয়ে গেছে শশাঙ্কর... এ যে সেই কালো মেয়েটা...


যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্হিতা...

নমঃ তস্যৈ নমঃ তস্যৈ নমঃ তস্যৈ নমো নমঃ !




Rate this content
Log in