Dhoopchhaya Majumder

Others

3  

Dhoopchhaya Majumder

Others

উদযাপন

উদযাপন

5 mins
9.6K


#love

তিনবাটির টিফিন ক্যারিয়ারটা ব্যাগের মধ্যে ভরে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছোটি ম্যাডামের মহল থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে হাঁটা লাগালো সাবিত্রী। অন্যদিন যাহোক ডাল-ভাত রেঁধে টিফিনবাক্সয় পুরে নিয়ে যায়। আজ তো আর তেমন করলে চলবে না, আজ যে ফেব্রুয়ারির চোদ্দ তারিখ! আজ এবাড়িতে হরেক কিসিমের রান্নাবান্না, মাছ,মুর্গি,মটনের গন্ধে চারিদিক ম'ম করছে৷ ওবেলা দলে দলে লোক আসবে দামী দামী ফুলের তোড়া হাতে করে, বাড়িতে থাকলে কল্যাণও কেমন সুন্দর এসব তাক লাগানো ব্যাপারস্যাপারে ভাগ নিতে পারতো! সবই কপাল সাবিত্রীর। আউটহাউসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে সে। তাদেরও তো আজকের দিনেই মালাবদল হয়েছিল, ছোটি ম্যাডাম ছোটাসাবের বিয়ের পরেই, ওই লগ্নেই। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ব্রাহ্মণত্বের অহঙ্কার ভুলে গিয়ে সাবিত্রীর বাবা কল্যাণ বাউরিকে জামাই হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। তাই সাবিত্রী তার বাড়ির ঠিকানা মন থেকে মুছে ফেলে কল্যাণের হাত ধরে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিল পাঁচ বছর আগে, আজকের দিনেই। সেদিন ছোটাসাবের বিয়ে, চৌধুরী সাব লোক ভালো, ওই হট্টগোলের মাঝেও কল্যাণ আর সাবিত্রীর মুখ চুন করে এসে দাঁড়ানো দেখে, সব কথা শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওইদিন তাঁর ছেলের বিয়ে হয়ে গেলে ওই আসনেই কল্যাণ মন্ত্র পড়ে সাবিত্রীর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেবে। কল্যাণের বাকি দুই কূলেও কেউ ছিল না, কাজেই 'ঝট মাংনি পট বিহা'র জবাবদিহি কাউকেই করতে হয়নি। তারপর কেটে গেছে পাঁচ বছর, কমলা এসেছে ওদের কোল জুড়ে৷চৌধুরী ইণ্ডাস্ট্রিজের দুই মালিকের খাস ড্রাইভার তখন কল্যাণ, শাকেভাতে বেশ কাটছিল ওদের দিনকাল, অন্তত এই ছমাস আগে পর্যন্তও।

ভাবনার ঘোরেই হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন চৌধুরী ভিলা ছেড়ে বেরিয়ে এসে অটোস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়েছে সাবিত্রী, সামনের অটোটা স্টার্ট দিয়ে কাছে এসে দাঁড়াতে হুঁশ ফেরে তার।

"আরে ও বউদি, কি অত ভাবছেন? অত ভাবলে মাথা কাজ করবে না আর। দেড় বচ্ছর বাদে দাদা ফেরা অব্দি মাথাটা ঠিক রাখতে হবে ত, নাকি? নিন নিন, উঠুন জলদি, আজ পোচ্চুর প্যাসেঞ্জার!" 

পাড়াতুতো দেওর প্রদীপের অটোয় উঠে বসে সাবিত্রী। গন্তব্য আর নতুন করে বলার কিছু নেই, প্রদীপ সবই জানে। শুধু প্রদীপ কেন, গত ছমাস ধরে এ মহল্লার প্রত্যেকটা লোক জানে রোজ দুপুরে সাবিত্রী কোথায় যায়, বছর দেড়েক পর কল্যাণের কোত্থেকে ফেরার অপেক্ষায় সাবিত্রীকে এখন চৌধুরী ভিলায় ছোটি ম্যাডামের রাতদিনের ঝিয়ের কাজ করতে হচ্ছে, সবাই সব জানে। 

অটোয় প্রায় আধঘণ্টার রাস্তা, শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত। আজ রাস্তায় একটু বেশিই ভিড় চোখে পড়ছে, বিশেষ করে অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের। জোড়ায় জোড়ায় জেন্টস সাইকেল -লেডিস সাইকেল পাশাপাশি, কিংবা একই সাইকেলে দুজনে দুজনের গা ঘেঁষে বসে, গালে গাল ঠেকিয়ে চলেছে সব, কোন চুলোয় কে জানে? এই ভরদুপুরে এত পীরিত জাগছে কোত্থেকে, ভগবান জানেন! মনে মনে গজগজ করতে করতে তিনবাটির টিফিন ক্যারিয়ারটা আঁকড়ে ধরে সাবিত্রী। আজ দইমাছটা খুব মন দিয়ে রেঁধেছে, লোকটা খুশি হবে তো খেয়ে? 

ম্যাডামরা বলছিল বোনলেস কিসব রাঁধতে, এত বড় কাতলার আবার ওসব ভাল্লাগে নাকি? সে জোর করে ছোটি ম্যাডামকে বলেছে সে দইমাছই রাঁধবে, তার হাতের দইমাছ একবার খেলে আর ভুলতে পারবে না কেউ। ছ'মাস আগের ঘটনাটার পর থেকে ছোটি ম্যাডাম তার কাছে মুখ তুলে বা জোর গলায় কিছু বলতে পারেনা, আর তার কমলাকে এমনভাবে আগলায়, যেন নিজের পেটের মেয়ে। ম্যাডামের নিজের এখনও ছেলেপুলে হয়নি, ডাক্তার দেখাচ্ছে নাকি, কানাঘুষোয় শুনেছে। আগে হলে বাঁজা মেয়েমানুষের অন্যের বাচ্চার ওপর এত দরদ সাবিত্রী সাদা চোখে দেখত না মোটেই, কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। কমলার ওপর ম্যাডামের টান বাড়লে যদি সাবকে বলে কল্যাণকে দুমাস আগেও বাড়ি ফেরাতে পারেন!

মিউনিসিপ্যালিটি বাজারের পাশ দিয়ে অটোটা যাওয়ার সময় প্রতিদিনের মতোই আজও সাবিত্রী কাঠ হয়ে বসে ছিল, দেখব না দেখব না করেও চোখ পড়ে গেল বাজারগেটের সামনের পানগুমটিটার দিকে। এই দোকানটাতেই ধাক্কা মেরেছিল ছোটাসাব, ছ'মাস আগের এক সন্ধেয়, গয়নার দোকান থেকে ফেরার সময়। ড্রাইভার কল্যাণকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালানোর শখ হয়েছিল তাঁর সেদিন। রঙিন চোখ, নাকি চশমার অভাবে, কেন সাবিত্রী জানে না, পানদোকান ভেঙে তার মালিকের ঘাড়ে আরামসে গাড়ি তুলে দিয়েছিলেন তিনি। ঠিক তেমনিভাবেই, থানাপুলিশ যখন হলো, নিজের সব দোষ তিনি অবলীলায় তুলে দিয়েছিলেন কল্যাণের ঘাড়ে। 

সাবিত্রী আজও জানে না, ঠিক কি কারণে কল্যাণ এতবড় একটা মিথ্যে অপবাদ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে দু'বছরের শাস্তিভোগ করছে সদর জেলে। যতবার জিজ্ঞেস করেছে, কল্যাণের এক উত্তর, "তোদের বাঁচাতে চাই, তাই।"

অবশ্য শুনেছে নাকি জেল হয়েছিল আরও কয়েক বছরের জন্য, বড়াসাবের অসীম দয়া, তাঁর পরিবারের সম্মান বাঁচানোর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি কলকাঠি নেড়ে সে শাস্তি দু'বছরে কমিয়ে এনেছেন। সেই একই কৃতজ্ঞতার উদাহরণ হলো সাবিত্রীর এবাড়িতে রাতদিনের ঝিয়ের চাকরি পাওয়া। আজকের দিনে মেয়েসমেত খাওয়াপরা;মানইজ্জত ইত্যাদির দায়িত্ব আত্মীয়রাই কেউ নেয় না, সেদিক দিয়ে এঁরা মহানুভব বৈকি! এমনকি এই যে সাবিত্রী রোজ দুপুরে জেলখাটা বরের জন্য খাবার বয়ে নিয়ে যায়, এও মেমসাব আর বড়াসাবের সুপারিশেই সম্ভব হয়েছে। 

বাপরে, ফুলের দোকানগুলোতে ভিড় উপচে পড়ছে। স্কুলকলেজের ছেলেমেয়েদের ভিড় সব। বিরক্ত হতে গিয়ে সাবিত্রীর মনে পড়ে, আরে!তাদের বিয়ের দিনেই ভ্যালিন্টাইন দিন না? বিয়ের আগে জানতো না, বিয়ের পরেই জানতে পারে আজকের দিনটা নাকি ভালবাসার দিন! অবাক হয়ে গিয়েছিল শুনে। ভালোও বাসতে হয় দিনক্ষণ দেখে! এ তো তার বাপের পাঁজি দেখে নিম-বেগুন খাওয়ার মতো ব্যাপার! কল্যাণ বুঝিয়েছিল, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ভালবাসাকে মনে রেখে দেওয়ার জন্য এ হলো ভালবাসার উৎসব। তেমন কিছুই বোঝেনি সাবিত্রী, তবে দুবছর আগে এই দিনটায় কল্যাণ পায়ের আঙুলে পরার চুটকি এনে দিয়েছিল একজোড়া, মুখে রাগ দেখালেও মনে মনে ভারি খুশি হয়েছিল সে।

আগের কথা মনে করে ছোট্ট একটা নিশ্বাস পড়ে। তারপর মনে হয়, মনে রেখে দেওয়া নিয়ে তো কথা! আগেরবার কল্যাণ দিয়েছে, এবার নাহয় সেই দিক কিছুমিছু। কিন্তু জেলের গারদের ওপারে থাকা মরদকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে তথা বিবাহবার্ষিকীতে কি উপহার দেওয়া যায়, তা ভেবে কুলকিনারা পায় না বেচারি সাবিত্রী।

গন্তব্যে পৌঁছে অটো থেকে নেমে চোখ পড়ে পানের দোকানটার দিকে। এই তো, পেয়ে গেছে দেওয়ার জিনিস! লোকটা পান খেতে খুব ভালবাসতো, মোলায়েম মিঠাপাত্তির মিষ্টি পান, জর্দা কম দিয়ে। সাবিত্রীই রাগারাগি করে ছাড়িয়েছে একসময়, খরচা বেড়ে যাওয়ার ভয়ে। আজ সেই একখিলি মিঠা পান কিনে টিফিনবাটির ব্যাগে ঢুকিয়ে থানার ভেতর ঢুকে পড়ে সে, ঠোঁটে লেগে থাকে একচিলতে একটা হাসি, মায়ামাখা, একটু অন্যরকম। 

আর তক্ষুনি, ব্রহ্মাণ্ডের কোনও এক কোণে বসে মুচকি হাসেন, কোনও এক সেইণ্ট ভ্যালেন্টাইন।। 


Rate this content
Log in