Indrani Bhattacharyya

Children Stories Fantasy

4.8  

Indrani Bhattacharyya

Children Stories Fantasy

রনি ও তার বন্ধুরা

রনি ও তার বন্ধুরা

6 mins
546



রনি ,বনি, আর মনি তিন পিঠোপিঠি বন্ধু। একজনের বয়স তিন বছর আর বাকি দুজনের দুই বছর। রনি খুব শান্ত। মনিও তেমন দুষ্টু নয়। শুধু বনি একটু মারকুটে আর মাঝেই মাঝেই অকারণে রেগে যায় খুব। যদিও তিন জনের কিন্তু গলায় গলায় ভাব। রনির খিদে পেলে বাকি দুজনের জন্যও খাবার দিতে হয়। বনির ঘুম পেলে পাশে গিয়ে ঘুম না এলেও গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ে বাকি দুজন। ঘোরাঘুরি, স্নান করা এমনকি পটি করাও প্রায় এক সাথে করে তিন জনে। রনি দেখতে বেশ গাবলু গুবলু। বনি ( একটি গোল্ডেন রিট্রিভার) বাদামি আর সোনালী রঙের মিশেল। মনি ( একটি বিগল্ প্রজাতির সারমে়য়) কিন্তু এক্কেবারে দুধ সাদা। সমস্যা একটাই। রনির মাঝে মাঝে বনি কিংবা মনির মত চার পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে। তখন তার খুব দুঃখ হয় দুটো পা কম থাকায়। কি আর করা যাবে। অগত্যা সে তখন ছোট ছোট দুটো হাত মাটিতে রেখে প্রায় হামা দিয়ে চার পায়ের স্বাদ মিটিয়ে নেয়। 


ওদের বাবা অনেক দূরে কাজ করেন।সপ্তাহে একবার করে দুদিনের জন্য আসেন। যখন আসেন তখন প্রচুর জিনিস নিয়ে আসেন ওদের জন্য। ভারি মজা হয় সেই দিন। ওদের মাও অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে রোজ রাতের বেলা আর দিনের বেলা কিছুটা করে সময় কাটান ওদের সাথে। মা এমনিতে খুব ভালো। শুধু সারাদিন ঘর লন্ডভন্ড করে রাখলে একটু আধটু বকে দেন। দিদাই একমাত্র সবসময় থাকেন ওদের কাছে। রোজ রোজ নতুন নতুন খেলা করেন, গল্প বলেন আর মা না থাকলে দিদাই তাদের এখানে ওখানে ঘুরতে নিয়ে যান। 


তবে তিন বন্ধুই অপেক্ষা করে থাকে দুপুরটুকুর জন্য। প্রতিদিন দুপুরে দিদা যখন পুজো করেন আর খাবার পর ফুরফুর করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে যান তখন তাদের তিনজনের এক্কেবারে নিজেদের মতো করে সময় কাটানোর সুযোগ হয়ে যায়। ওই সময় ওরা যা খুশি তাই করতে পারে ।শুধু লক্ষ্য রাখতে হয়, দিদার ঘুম যেনো কোনমতে না ভাঙে। ওদের তিনজনের সারাদিনের যত জমানো কথা তখনই বেরিয়ে আসে ফোয়ারার মত। সেসব অন্য কেউ না বুঝলে কি হবে, ওরা তিনজনে কিন্তু দিব্যি বোঝে । 


ওদের ফ্ল্যাট এর সামনের দিকে যে চওড়া বারান্দা তারই এক কোণে বহুদিন ধরে রাখা আছে একটা ডালা ভাঙা, ঘুণে ধরা বাতিল জুতোর শেল্ফ ।সেখানেই তিন জনে জমিয়ে রাখে ওদের যাবতীয় দুষ্টু বুদ্ধি আর সেই সাথে আরো অনেক দরকারি জিনিসপত্র। এটা যদিও টপ সিক্রেট কিন্তু গল্পের খাতিরে আজ আমি বলে দিলাম তোমাদের। এছাড়া সেখানেই প্রয়োজনে বসে জরুরি মিটিং। বড়দের ওপর অভিমান হলে বনি আর মনি মাথা গুজে পড়ে থাকে ওখানেই। শুধু রনিই ঠিক ভাবে ওদের মত এঁটে উঠতে পারে না। তাই রনির মাঝে মাঝে খুব দুঃখ হয় ওদের মত সুন্দর শরীর নয় বলে। 

যাই হোক। এবার আসল কথায় আসি।


আজ আবার দুপুর বেলা তেমনি জরুরি মিটিং বসেছে বারান্দায়। দুদিন আগে বনি পাশের বাড়ির ফ্লপি ( আরেকটি গোল্ডেন রিট্রিভার) র সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে জানতে পেরেছে ওদের আবাসনের সামনের ফুটপাথে নাকি হপ্তা দুয়েক হলো কয়েকজন নতুন মানুষ থাকা শুরু করেছে। ব্যাপারটা এই অব্দি হলে চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু সেই সাথে গত কয়েকদিনে আসা যাবার পথে সে লক্ষ্য করেছে , একটা পুটপুটে কাপড় জড়ানো বলের মত মানুষও নাকি শুয়ে থাকে সারাদিন আর খুব কান্না করে। ফ্লপি ব্যাপারটা শুঁকে দেখতে গেছিলো কিন্তু ওই পুটপুটের কাছে যেতে না যেতেই সামনে চায়ের দোকানের বিল্লু ( বেড়াল বাবাজি) আর কালু ( পাড়ার সারমেয় কুলের ডাকসাইটে নেতা) পথ আটকে দাড়িয়েছিল। ফ্লপি আর সেদিন সাহস না দেখিয়ে গুটিগুটি ঘরে ফিরে এসেছিল।

পুরো গল্পটা শোনার পর রনি বলল - 'সবই তো বুঝলাম বন্ধু।কিন্তু পুটপুটে কাঁদে কেনো, সেটাই ভাববার বিষয়। নিশ্চয়ই ওর খুব খিদে পায় বা ঘুম পায় কিংবা কোনো কিছুতে খুব অসুবিধা হয়। ব্যপারটা একবার নিজের চোখে দেখতে পারলে বেশ ভালো হতো। তোমার কথা শুনে পুটপুটে


তারপর তিনজনে বিষয়টা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে অনেক চিন্তা ভাবনা আলাপ আলোচনা করে জুতোর শেল্ফ খুলে নামিয়ে আনলো একটা ছোট্ট কাঁচের বয়াম। তোমাদের জানতে খুব ইচ্ছে করছে তো কি আছে তাতে? শোনো তবে। সেই বয়ামের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা গোলাপী রঙের ছোট্ট ছোট্ট বুদবুদ । সেই প্রত্যেকটা বুদবুদে ভরা আছে হাসি আর খুশির গন্ধ। জিনিসটা বানানো খুব কঠিন কিনা তাই বুঝে শুনে খরচ করে ওরা। বানানোর প্রক্রিয়াটাও বেশ জটিল এবং অত্যন্ত গোপনীয় । রনি বনি আর মনি ছাড়া কেউ জানে না সেটা ।আমি অনেক সাধ্য সাধনা করাতে বলেছিল আমাকে । তবে এও বলে দিয়েছিল, এসব কথা মোটেই জানানো যাবে না বড়দের। সব কথা বড়োদের বলতে নেই কিনা!


ব্যপারটা হলো অনেকটা এই রকম। যখন জমা কাপড় কাঁচা হয় তার ফেনা লুকিয়ে ছাঁকনিতে ধরে রাখতে হয়। তারপর সেটাকে রোদে শুকিয়ে বনির লেজের বাতাস দিয়ে ঠাণ্ডা করে তাতে মনির হাঁচির শব্দ আর রনির হাসির শব্দ মিশিয়ে তৈরি করতে হয় গোলাপী হাসি খুশির বুদবুদ। সেই ফেনার বল কারুর নাকের সামনে একবার ফাটিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতেহ্। আর কোনোদিন তার দুঃখ হবে না, মানে অন্তত কয়েকদিনের মধ্যে তো নয়ই। সবসময় হাসি খুশি থাকবে সে। 

এবার সেদিনের কথায় আসি। বনি কাঁচের সেই বয়াম খুলে গুনে গুনে বের করে নিল তিনটে বুদবুদ। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘেউউউ বলে লম্বা সুরে যেই না ডাকলো অমনি শুনতে পেয়ে আকাশ থেকে টুপ করে মেঘদাদা গড়িয়ে পড়ল বারান্দায়। এতে যদিও অবাক হবার কিছু নেই। মেঘদাদা মাঝে মাঝেই ওদের সাথে খেলতে আসে। বিশেষ করে যখন কিনা শীতকাল। তখন আকাশ থাকে পরিষ্কার তাই ছুটি থাকে মেঘেদের স্কুল। এখন যদিও বসন্তকাল আর মেঘেদের স্কুলও খুলে গেছে দিন কয়েক আগে তবু আজ আকাশ পরিষ্কার থাকায়, বিশেষ কাজের তেমন চাপ ছিল না। তাই না রনি, বনিদের ডাকে সাড়া দিয়ে সাথে সাথে আসতে পারলো। এর মধ্যে রনি ছুট্টে গিয়ে দেখে এসেছে তার শোবার ঘরটা। নাঃ, ভয় নেই। দিদার নাকে এখনও ভেঁপু বাজছে। 


মেঘদাদাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললো ওরা। মেঘদাদা সব শুনে তিনজনকে চাপিয়ে নিল নিজের কাঁধে । ওদের তো তখন ভারী মজা। তুলোর মত নরম পিঠে চেপে পাখির মত উড়তে লাগলো আকাশের বুকে। আশে পাশে পাখিরা দেখে একটু অবাক হচ্ছিল বটে তবে মেঘদাদাকে সবাই চেনে কিনা আর মেঘদাদাতো ওদেরও বন্ধু তাই ওদের দেখে ভয় পায়নি মোটে। মেঘের পিঠে চেপে তিনজন একটু ওপর থেকে দেখতে পেল পুটপুটেকে। রাস্তার ওপর একা একা শুয়ে শুয়ে হাত পা ছুঁড়ছে। একটু দূরেই কালু বসে বসে ঝিমোচ্ছে। বিল্লুকে যদিও কাছে পিঠে দেখতে পেল না। 


রনি তাক করে ওপর থেকে ওদের দিকে লক্ষ্য করে ভাসিয়ে দিল দুটো বুদবুদ। সেগুলো নাচতে নাচতে গিয়ে পুটপুটে আর কালুর নাকে ধাক্কা খেয়ে ফেটে গেলো। ওরা বুঝতেও পারলো না কিচ্ছুটি। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই দেখা গেলো কালু আর পুটপুটে কেমন হাসিখুশি আর চনমনে হয়ে উঠেছে। রণিরা বুঝলো ওষুধে কাজ দিয়েছে। মেঘদাদা এরপর পুটপুটেদের তুলে নিল নিজের তুলোর জামার ভেতর। আরামে আর নরম গরমে ওরাও নিজেদের শরীর গুজে দিল সেখানে। তারপর আরেকটু দূর যেতেই একটা এঁদো গলির ভেতর দেখা গেলো বিল্লুকে অন্য একটা হুলোর সাথে ঝগড়া করতে। একইভাবে বিল্লুকেও দেওয়া হল গোলাপী বুদবুদ আর তারপর তাকে কোলে করে তুলে নিল মেঘ দাদা। তারপর উড়তে উড়তে নিয়ে গেলো মেঘের রাজ্যে। 


ততক্ষণে ঘুম ভেঙেছে পুটপুটে, কালু আর বিল্লুর। তারা তখন দু চোখ ভরে দেখছে সব। সে এক ভারী মজার দেশ। চারপাশে তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘেরা। নানা রঙের ফুল, পাখি আর প্রজাপতি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আকাশজোড়া রামধনু হাসছে খিলখিলিয়ে। মাঠের ওপর পিঠ এলিয়ে শুয়ে আছে সুয্যিমামা। ওদের মতোই আরো কত কচিকাঁচারা মনের আনন্দে ছুটে বেড়াচ্ছে চারিদিক। এ যেনো ঠিক খেয়াল খুশির দেশ। ততক্ষণে রনি বনি আর মনির সাথে দিব্যি ভাব হয়ে গেছে পুটপুটে, কালু আর বিল্লুর। রনি বনিরা আগেও এসেছে এখানে কিন্তু পুটপুটেদের কাছে এ দেশের সবই নতুন । সেখানে সহজেই তাদের সকলে আপন করে নিল। সবার সাথে মিলে ওরাও সারা দুপুর খুব আনন্দ করলো। 


তারপর রনির হঠাৎ মনে পড়লো ফিরে যেতে হবে এইবার। না হলে দিদা ঘুম ভেঙে দেখতে না পেলে খুব চিন্তা করবে। মেঘদাদাকে গিয়ে বলতেই মেঘদাদা তড়িঘড়ি ওদের তিনজনকে পিঠে চাপিয়ে চোখের পলকে এনে হাজির করলো ফ্ল্যাটের বারান্দায়। আসার আগে পুটপুটে, কালু আর বিল্লুকে ওরা অনেক আদর করে এলো। কালু, বিল্লু ,পুটপুটে রয়ে গেলো মেঘরাজ্যে আকাশ মায়ের কোলে আরো অনেকের মতো যাদের দেখার কেউ নেই। 

এরপর মাঝে মাঝেই সুযোগ পেলে রনি বনি মনি মেঘদাদার পিঠে চেপে পাড়ি দেয় মেঘরাজ্যে নতুন বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। পুটপুটেদের নতুন ঠিকানা শুধু জানে ওরা তিনজন আর আমি আর এই মাত্র জানলে তোমরাও। চাইলে বা স্কুলের ছুটি পেলে ঘুরে আসতেই পারো সেখানে । শুধু যাবার আগে একটিবার মেঘদাদার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিলেই চলবে।


Rate this content
Log in