গন্ধ
গন্ধ


একটানা বৃষ্টিতে তালগাছের থেকে নেমে আসা নিপুণ ভাবে একটা একটা করে খড়কুটো দিয়ে বানানো ঝুলন্ত বাবুই এর বাসা নড়বড়ে লাগে, কাঁপতে থাকে ভিতরের প্রাণগুলো, দূরে ব্যালকোনির শার্সি থেকে দেখি তা, ভাবি এই পরিমিত স্থানে কতটা ভালোবাসা যে মেশানো আছে, তার গন্ধ আমার নাকে এসে লাগে। মনেপড়ে যায় পুরোন অজস্র স্মৃতি।
দেড়খানা ঘরে চারটি প্রাণের সাথে মিশে যেতো কত কত প্রাণ। তখন ওটাই ছিল আনন্দ উৎসব। একটা খাটে ছয়জন মিলে মিশে আছি নীচে টানা বিছানা, সারা রাত গল্প গুজব, পিসি, পিসতুতো ভাই ,আম্মা , মামাতো দিদি, মামাতো ভাই। সে এক দারুণ আনন্দ, মা কে কখন দেখিনি মুখ ভার করে থাকতে, নিজের কষ্ট জাহির করতে, সেই সব দিনগুলোই চোখে ভাসে, নাকে লেগে থাকা বাতাবি লেবু ফুলের গন্ধ, কামরাঙা মাখার গন্ধ, কুলের আচার, লেবুর আচারের গন্ধ, ভালোবাসার গন্ধ। হাজার চেষ্টাতেও আমার তৈরি আচারে সেই ঘ্রাণ পাইনা। আজ আমার তিনকাঠা জমির উপর বাড়িতে সেই আনন্দ যেন নেই! সেই হুটোপুটি, সেই নির্ভেজাল হাসাহসি, হঠাৎ ঠিক করে সিনেমা যাওয়া, হঠাৎ কোন শীতের অলস দুপুরে ঠিক হওয়া সেদিন রাতেই পিকনিকের আনন্দ কিম্বা লোডশেডিং এ লুডোর দানের হেরাফেরি, এসবের গন্ধ আজ আর পাইনে, যা পাই তা মেকি। মা, পিসতুতো দিদি, মাসতুতো দাদা এঁদের সকলকে দেখেছি পাক্ষিক "দেশ" এর গন্ধ নিতে। একটা বই দিন পনেরো ঘুরে বেড়াতো বাড়ির সকলের হাতে হাতে। আমরা যারা ছোট , তারা পড়তাম কমিক্স।
বেতাল, অরণ্যদেব তাদের গায়ের গন্ধ নিতাম "দেশ" কে ছুঁয়ে আবার শীত এলেই শুরু হতো বই মেলা। কত নতুন নতুন বই এর গন্ধ নিতাম আমরা। তখন জন্মদিনে, পুজোতে আমাদের জামা কাপড়ের চেয়েও দামী ছিল নতুন বই এর গন্ধ। এখন অবশ্য তেমন কোন ঘ্রাণ নিতে দেখিনা ছেলেমেয়েদের। আমার নতুন ক্লাসে ওঠার সময়ও নতুন বই এর মলাটে, বইএর পাতায় যে ছাপার কালির যে সুগন্ধী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো তাকে জাপ্টে ধরে বহুদিন জলচ্ছবি লাগিয়ে আমার আমার চিহ্ন দিয়ে রেখে যে মায়ায় বেঁধে রাখতে চাইতাম আজ তার অভাব প্রতি মুহূর্তে টের পাই।
শীতের অলস দুপুরে কিম্বা মেঘলা সকালে আচার, কমলা লেবু অথবা সোঁদা মাটির যে গন্ধ পেতাম বহুতল বাড়ির গাড়ি বারান্দাতে মধুমেহ রোগের কৃপায় আজ তাদের অলীক বলে মনেহয়। মায়ের মতোন মুড়ি ঘণ্টের আঘ্রাণ কেন যে পাই না আমার তৈরি করা পদে ! জানি ভালোবাসার গন্ধ কোনদিন পরিমিত হয় না যে, তার সীমানা অসীম অপরিমিত।