রাজার গল্প
রাজার গল্প


রাজা ভিক্ষায় নেমেছে মুকুটের জন্য। প্রজাগন তো ব্যতিব্যস্ত। একি কান্ড! রাজা কি পাগল হয়ে গেল? রাস্তাঘাট ভিড়ে ভিড়াক্কার। ছেলে-বুড়ো সকলে রাস্তায় নেমে পড়েছে। যানবাহন বন্ধ। রাজধানী স্তব্ধ। রাজা ভিক্ষায় নেমেছে মুকুটের জন্য।
আজ সকাল থেকে মুকুট পাওয়া যাচ্ছে না। নিছক গায়েব! প্রিভেনটিভ ডিটেনশন দ্বারা আসামিদের কারারুদ্ধ করা হয়েছে। গুপ্তচরেরা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। চিরুনি তল্লাশি চলছে। শহরবাসীরা রীতিমতো ভিত সন্ত্রস্ত। চারিদিকে কি হয় কি হয় রব। কাওকে ঢুকতে বা বেরতে দেওয়া হচ্ছে না রাজধানীতে। এদিকে রাজা ভিক্ষায় নেমেছে মুকুটের জন্য।
ভিক্ষায় নামার কারনও আছে; সে মুকুট দেখবার মত। সোনার পুরু পাত দিয়ে তৈরি, রূপো দিয়ে বাঁধানো। চারিদিকে বড় বড় পাথর; সোনার কড়ি রূপোর কড়ি। এ মুকুট ছাড়া রাজা যে রাজাই নয়! সিংহাসন ছেড়ে, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে তাই রাজা ভিক্ষায় নেমেছে মুকুটের জন্য।
রাজা সবার কাছে একবার করে যায় আর মুকুট ভিক্ষা করে। সকলেই স্তম্ভিত। এও কি রাজার কোনো কৌশল? রাজা কাঁদকাঁদ। পরনে জড়ির কাজ করা পোশাক নেই আজ; ছেঁড়া উত্তরীয়। নগ্ন পা। নগ্ন মাথা। দিকে দিকে বার্তা রটে গেছে এর মধ্যেই। বেলা বাড়ছে, সাথে সাথে মানুষের সমাগমও। দূরদূরান্তর থেকে রাজাকে দেখতে আসছে সকলে।
রাজার নরম পায় কাঁকড় ফুটছে; রাস্তা রক্তময়।
হাতে নিমের ডাল, রাজদণ্ড নয়।
রাজা তুমি কেমন রাজা আজ?
না আছে মুকুট, না রাজ কাজ!
রাজা তুমি কেমনে হাঁটো আমজনতার পথে?
রাজা তোমার সিংহাসন সে ঘোড়ায় টানা রথে!
এখনো কিশোর ছেলে হৈহল্লার মাঝে
আলতামাখা সাঁঝে
উড়িয়েছে ওই ঘুড়ি,
রাজা, তোমার মুকুট গেছে চুরি!
এমন যখন ব্যাপার, তখন ভিড় ঠেলে
এক চাষির ছেলে এলে।
বললে, "রাজা তোমার মুকুট কোথা গেল?"
"তুই
কার ব্যাটা গো?" রাজা জিজ্ঞাসিল।
"কি হে রাজা, তুমি আমায় নাহি চেনো?
আমি তোমার মুকুট নিকোই, এই কথাটি জেনো।"
এই বলে সে রাজার পায় সাষ্টাঙ্গপ্রণাম করল। বলল,
"রাজা, তুমি মুকুট ছাড়াও রাজা।
কৃষক মেথর আমজনতার রাজা।
তুমি শখের রাজা নও। তুমি অনেক বড় হও।
তুমি মুকুটখানিই বাসলে ভালো,
তাই পেলে এ সাজা। তুমি নিজের রাজা নও।
রাজপ্রাসাদের নও, রাজা দেশের রাজা হও।
নাই বা পেলে মুকুট, নাই বা পেলে ধন,
রাজা, প্রাসাদ কর ছোট, বৃহৎ কর মন।
রাজা, এই যে তোমার দেশ, এ কি শুধুই রাজবেশ?
একটু নাহয় নিলেই করে মোদের আপনজন।
রাজার মুকুট যত মণ, দেশেতে মানুষ তত জন!
রাজা, তুমি কেমন রাজা হে?
এই যে মুকুট এই যে প্রাসাদ, এ কাদের টাকাতে?
তুমি চাইলে চারিদিকে, দেখবে এক এক করে,
দীনজনেরা মুখ লুকিয়ে খাচ্ছে কত লড়ে।
রাজা, তুমি মুকুট ছাড়াও রাজা।
কৃষক মেথর আমজনতার রাজা।
তুমি শখের রাজা নও। তুমি অনেক বড় হও।
মুকুট ভারি মাথায় বসে,
বুদ্ধিনাশের বিসর্জনে, তুমি নতুন রাজা হও।"
এই বলে কৃষক বালক তার ঝোলা থেকে একটা কাগজের মুকুট বের করে আনল। তাতে না আছে আড়ম্বর, না রাজকিয়তা। রঙিন কাগজের এক সাদামাটা মুকুট। রাজার মাথায় পরিয়ে দিল সে। রাজার চোখ দিয়ে অঝোরে কান্না ঝরে পড়ছে। নতুন রাজা কৃষক বালককে কোলে তুলে নিল। সকলে হৈহৈ করে উঠল চারিদিকে, রাজা পাগল হয়নি! রাজধানীময় উৎসব লেগে যাবে আজ। একটু পরেই। রাজা ফিরে যাবে রাজপ্রাসাদে। রাজ্যপাট চলবে রাজার মৃত্যুকাল অবধি। তফাত শুধু এটুকু, রাজার মাথায়, সোনার নয়, কাগজ মুকুট থাকবে।