STORYMIRROR

Sanjana Soma Guha

Children Stories Drama Classics

3  

Sanjana Soma Guha

Children Stories Drama Classics

রাগী রাজপুত্রের কাহিনী

রাগী রাজপুত্রের কাহিনী

19 mins
838

দৃশ্য ১ 

(নেপথ্যকন্ঠঃ অনেক কাল আগেকার কথা। রাজা আদিত্যণারায়ানের রাজ্যে সবাই বেশ সুখে আর শান্তিতে থাকত। কারো মনে রাজা কে নিয়ে কোন ক্ষোভ বা অসন্তোষ ছিলনা। রাজা তার প্রজাকে খুব ভালবাসত আর সবসময় তাদের খুব খেয়াল রাখত, তবে এই রাজ্যকে রক্ষা শুধু রাজা আদিত্যণারায়নই করত না এই রাজ্যকে সবসময় রক্ষা করে চলত এক লালপরী।লালপরীই এই রাজ্যের রাজা নির্বাচন করে এসেছে প্রত্যেক সময়। আজ অবশ্য আমাদের রাজা কে একটু বিচলিত দেখাচ্ছে। কেন তা একবার দেখা যাক বন্ধুরা।)

(নেপথ্য দৃশায়নঃ আমরা দেখি রাজা আদিত্যণারায়ন হাসি মুখে রাজ্যবাসীর সব কথা শুনছে আর রাজ্যের মানুষের মুখেও কোথাও কোন বেদনা বা দুখের চাপ দেখা যায় না, তারা সবাই বেশ সুখী। এর মাঝে আমরা লাল পরীকে তার ছড়িই হাতে আকাশে উড়ে যেতে দেখি। তারপর আমরা দেখি চিন্তিত রাজা তার প্রাসাদের বারান্দায় পায়চারী করছে। কিছুক্ষণ পর মহারানীর সখি প্রিয়ংবদা এসে প্রবেশ করে। তার মুখ বেশ থমথমে।)

প্রিয়ংবদা: মহারাজের জয় হোক!

রাজা: বল কি সংবাদ এনেছ তুমি!

প্রিয়ংবদা: (একটু সময় নিয়ে) আঞ্জে, মহারাজ ছেলে হয়েছে।

রাজা: (আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরে গলা থেকে একটা মুক্তোর হার খুলে নিয়েপ্রিয়ংবদাকে দিয়ে দেয়) কি সংবাদ দিলে তুমি, প্রিয়ংবদা, এর চেয়ে ভাল সংবাদ আর কিই বা হতে পারে। এই নাও তোমার পুরস্কার। তোমরা সবাই আনন্দ কর! (রাজা দেখল মুক্তোর হার পেয়েও প্রিয়ংবদা ঠিক খুশি হতে পারছে না, তার চোখের কোনে জল লেগে আছে) কি হল তোমার চোখে জল কেন?

প্রিয়ংবদা: (কেঁদে ফেলে) মহারাজ আমরা যে মহারানী কে বাচাতে পারলাম না।

(নেপথ্য দৃশায়নঃ মহারাজের মুখ থমে থমে হয়ে এসেছে, তার চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পরে।)

প্রিয়ংবদা: মহারাজ চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি থাকতে রাজকুমারের কোন অসুবিধা হবে না। সে কখনও তার মায়ের অভাব বোধ করবে না। আর তা ছাড়া আমার স্বামী, এই দেশের মহামন্ত্রী সেও তো আছে, সে থাকতে আপনার চিন্তা কিসের)

রাজা: (একটু হেসে) তোমায় অনেক ধন্যবাদ প্রিয়ংবদা তুমি প্রকৃত অর্থেই মহারানীর সখি।     

দৃশ্য ২

(নেপথ্য কন্ঠঃ রাজপুত্রর জন্মের প্রায় তিন মাস পর প্রিয়ংবদার কোল আলো করে এসেছিল মন্ত্রীপুত্র। রাজা ঠিক করল দুই ছেলের নামকরণ একই দিনে হবে। তাই তিনি দিনক্ষণ দেখে একটা উৎসবের আয়োজন করলেন সেই দিনে। তারপর তিনি ডেকে পাঠালেন তার মহামন্ত্রী কে)

(নেপথ্য দৃশায়নঃ প্রিয়ংবদা হাসি মুখে কোলে নিয়ে আছে তার বাচ্চাকে। রাজা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাসাদের বারান্দায় যখন প্রবেশ করেন মহামন্ত্রী)।

মহামন্ত্রীঃ মহারাজের জয় হোক!

রাজা: এসো এসো মহামন্ত্রী। তোমার কথাই ভাবছিলাম। আজ যে আমার বড্ড খুশির দিন। আর ঠিক তিন দিন পরে শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে নামকরণ হবে রাজপুত্রের ও মন্ত্রীপুত্রের। কি তোমার ভাল লাগছে না?

মন্ত্রী: (এক গাল হেসে) আঞ্জে মহারাজ আপনি যে রাজপুত্র আর মন্ত্রীপুত্রের একদিনে নামকরণ রেখেছেন এ যে আমার কাছে কতও বড় সম্মান তা আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না।

রাজা: এই ভাবে বোলো না মহামন্ত্রী, তোমার পুত্র তো আমারও পুত্র না কি? তুমিও তো রাজপুত্র কে নিজের ছেলের মতন ভালবাস, তুমি ও তোমার স্ত্রী না থাকলে আমি এই মা-হারা বাচ্চা কে কি করে যে মানুষ করতাম কে জানে।

মন্ত্রী: (একটু লাজুক হেসে) কি যে বলেন মহারাজ, যাক গে আপনি আমায় ডেকেছিলেন কোন কাজ ছিল?

রাজা: আরে দেখছ খুশির চোটে আসল কথাটাই বলতে ভুলে গিয়েছি। এই যে নামকরণের উৎসব হবে তার জন্য তো সবাই কে নিমন্ত্রণ করতে হবে। আর এই খানে কোন ভুলচুক হওয়া চলবে না। তাই এই গুরুদায়িত্ব আমি তোমায় দিলাম। সবার প্রথমে নিমন্ত্রণ করবে লাল পরী কে। মনে রেখো তিনি আমাদের দেবী, তার অবদানের জন্যই আমার এত সমৃদ্ধ রাজ্য হয়ে উঠেছি। এইটা ভুললে কিন্তু চলবে না।

মন্ত্রী: তা যা বলেছেন মহারাজ। তা ছাড়া ভুললে চলবে না লাল পরীর ক্রোধের স্বীকার আমরা কেউ হতে চাইব না। যা রাগ মহিলার! উফ্‌ফ্‌ফ্‌! এমন বদমেজাজি মহিলা আমি আমার বাপের জন্মেও দেখি নি।

রাজা: মন্ত্রী তিনি আমাদের দেবী তার দোষ খোজার চেষ্টা না করাই আমাদের কাম্য। তিনি ছাড়া আমরা কি বল? তিনি আছেন তাই আমরা এত সুখে শান্তিতে আছি এইটা ভুলে যেও না। যাও তাকে প্রথম নিমন্ত্রণ পত্র দিয়ে তারপর তার থেকে আশীর্বাদ নিয়ে বাকিদের নিমন্ত্রণ পত্র পাঠানো শুরু কর।

মন্ত্রী: তা করছি মহারাজ কিন্তু একটা কথা আমি না বুঝতে পারছি না। আপনার মতন এক বীর-বিচক্ষণ মানুষের এক পরীর কি কোন দরকার আছে?

রাজা: আমি যে বীর, আমি যে বিচক্ষণ এই কথাটা তোমরা সবাই বোঝার আগে লাল পরী বুঝেছে, তাই আজ আমি তোমাদের রাজা। আমি যে নির্বাচিত রাজা হে, লাল পরীই আমাকে নির্বাচন করেছেন, তাকে আমি ভুলি কি করে। এতটা অকৃতঞ্জ আমি হই কি করে বল তো? না হে, তাকে ছাড়া আমি কিছুই নই। তুমি যাও তাকে প্রথম নিমন্ত্রণ পত্রটা দিয়ে এস।

মন্ত্রী: যে আঞ্জে, মহারাজ (এই বলে মহামন্ত্রী বেরিয়ে গেল) (মনেমনে) আমিআমারস্ত্রী প্রিয়ংবদার মতননই, তোমাররাজাহওয়ারসখআমিখুবশিগ্‌গীরিঘোচাবো, আদিত্যণারায়ন।এইউদয়ভানুথাকতেঅন্যকেউরাজাহবেনা।

(নেপথ্য দৃশায়নঃ আমরা দেখি কুটিল মন্ত্রী রাজপ্রাসাদ থেকে বেড়িয়ে হেটে চলেছে। তার মুখের রাগ আসতে আসতে এক কুটিল হাসিতে বদলে যাচ্ছে। অবশেষে সে এসে দাঁড়াল একটা সুন্দর বাগান ঘেরা কুড়ে ঘরের কাছে। সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তার কুটিল হাসি আরও একটু চওড়া হল। তারপর সে কুড়ে ঘরের সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসে হেট হয়ে ঘরের মেঝেতে একটা প্রণাম ঠুকল)।

মন্ত্রী:প্রণাম দেবী!

লালপরী: (হটাৎ কোথা থেকে তার সামনে উড়ে চলে এলো এবং হাওয়ায় ভাসতে থাকল) মহামন্ত্রী যে! সব কুশল তো! পুত্র হয়েছে শুনলাম তা নামকরণ কবে হচ্ছে শুনি? তোমাদের জন্য আমি কি যে খুশি আমি তোমায় কি বলব!

মন্ত্রী: (মুখটা একটু দুখীদুখী করে, মিথ্যে চোখের জল মোছার ভান করে) দেবী আপনি সত্যিই এত ভালো যে আপনার জন্য মাঝে মাঝে আমার খুব দুখ হয়। আপনি সবার কথা খুব ভাবেন কিন্তু আপনার কথা কয়জনেই বা ভাবে বলুন।

লাল পরী: (একটু বিরক্ত হয়ে) উফ্‌ফ্‌ফ্‌ এই তোর বড্ড দোষ বুঝলি তো! আসল কথা বলার আগে এত বেশী শিবের গাজন গাস্‌ যে আসল কথা শোনার ইচ্ছেই চলে যায়। কিছু যদি বলার থাকে তো বল না হলে বিদে হ। আমার মেলা কাজ আছে।

মন্ত্রী: (একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) আঞ্জে কি ভাবে যে কথাটা আপনাকে বলব সেইটাই ভাবছি।

লাল পরী: কেন এই তো, তোর ঠোট দুটো বেশ নড়ছে, এই ঠোট আর মুখের সাহায্যে বলে ফেল।

মন্ত্রী: (একটু ভয় পেয়ে) আঞ্জে আপনি যখন অভয় দিচ্ছেন তখন বলি চুপ করে থাকলে আমারই কষ্ট বাড়বে, কিন্তু বললে যে আমি মহারাজের ক্রোধের মুখে পরব। তা পরি, তাতে যদি আমার স্ত্রী-সন্তানের প্রাণ সংশয় হয় তো হোক। কিন্তু আপনার সঙ্গে অবিচার আমি মেনে নিতে পারব না।

লাল পরী: (শেষ কথাটায় লাল পরী চমকে উঠল) আমার সঙ্গে অবিচার মানে?

মন্ত্রী: আজ থেকে তিনদিন পরে শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে নামকরণ হবে রাজপুত্রের, তা মহারাজ আমার উপর দয়া করে আমার পুত্রে নামকরণও সেইদিন করবে বলে শুনলাম। সেই যাই হোক, মহারাজ সেই নামকরণউপলক্ষে একটা উৎসবের আয়োজন করেছেন আর তাতে—

লাল পরী:(রেগে লাল হয়ে)তাতে কি! তাড়াতাড়ি বল না হলে তোকে এখুনি ভেড়া বানিয়ে দেব!

মন্ত্রী: (প্রচণ্ড ভয় পেয়ে) আঞ্জে মহারাজ সেই সভায় আপনাকে নিমন্ত্রণ করে নি!

লাল পরী: (রাগ কাপতে কাপতে) কি বললি! আমায় নিমন্ত্রণ করে নি! তা এর পিছনের কারণটা জানতে পারি কি!

মন্ত্রী: আপনার ক্রোধ, রাগ, যা বলবেন তাই।

লাল পরী: আমি রাগী?

মন্ত্রী: মহারাজের মতে, আপনার মতন এমন বদমেজাজি মহিলা উনি ওনার বাপের জন্মেও দেখেন নি। আমি মহারাজ কে বোঝাবার চেষ্টা করলাম আপনি আমাদের দেবী আপনার দোষ খোজার চেষ্টা না করাই আমাদের কাম্য। আপনি ছাড়া আমরা কি? আপনার জন্যই তো আমরা এত সুখে শান্তিতে আছি। আমি বললাম আপনাকে প্রথম নিমন্ত্রণ পত্র দিয়ে তারপর আপনার থেকে আশীর্বাদ নিয়ে বাকিদের নিমন্ত্রণ পত্র পাঠানো শুরু করা উচিৎ। কিন্তু তিনি কিছুই মানতে চাইলেন না। তার মতে তার মতন বীর-বিচক্ষণ রাজা একাই এই রাজ্যের পক্ষে যথেষ্ট। তার কোন পরীর দরকার নেই।

লাল পরী: (চিৎকার উঠল) কি! সে এই কথা বলেছে। সে ভুলে গিয়েছে যে সে নির্বাচিত রাজা। আমি তার নির্বাচন করেছি! এতটা অকৃতঞ্জ! (রাগে গজরাতে গজরাতে) বেশ আমিও এর শেষ দেখে ছাড়ব। তুই এখন এইখান থেকে যা।

(নেপথ্য দৃশায়নঃ মহামন্ত্রী মুখ কালো করে লাল পরী কে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর সে ঘুরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে তার দুখ উধাও হয়ে গিয়ে তার জায়গায় আসে এক কুটিল বিশ্রী হাসি। সেই হাসি নিয়ে সে বেরিয়ে আসে লাল পরীর কুড়ে থেকে।)

 দৃশ্য ৩

(নেপথ্য কন্ঠঃ উৎসবেরদিনসবাইএকেএকেরাজপুত্রকেআশীর্বাদকরল, লালপরীবাদে।সেরুদ্রমূর্তিধারণকরেউৎসবেপ্রবেশকরল।)

(নেপথ্য দৃশায়নঃ চারিদিকে খুশির আমেজ সবাই খুব মজা করছে, হঠাৎ-ই গুরু গম্ভীর মেঘের গর্জনে চারিদিক থমকে যায়। লাল শাড়ী পরে লাল পরী রাজসভায় প্রবেশ করে। মহারাজ তাকে দেখে উৎফুল্ল উঠে দাঁড়ায়)

রাজা: দেবী আপনি! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না আপনি এসেছেন। মহামন্ত্রী যখন আমায় বলল আপনি নামকরণের দিনে উপস্থিত থাকবেন না কারনের আপনাকে পরীদের সম্মেলনে যেতে হবে তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। একবার ভাবলাম স্থগিত করে দেব আজকের এই নামকরণের প্রক্রিয়া, কিন্তু শুভ সময় যে আবার সাত মাস পর অতদিন পর নামকরণেরহলে যে অনেকটা দেরী হয়ে যাবে। তাই—

লাল পরী: তাই ভাবলে লাল পরী কে ছাড়াই নামকরণ করি ছেলের! ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোমার এত অধঃপতন হয়েছে আদিত্য প্রথমে তুমি আমায় নিমন্ত্রণ কর না তারপর তুমি আমার সামনে আমাকে খুশি করার জন্য একটা মিথ্যে গল্প বানাচ্ছো! লজ্জা করে না তোমার!

রাজা: কি বলছেন দেবী! আমি আপনাকে সবার প্রথমে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছি। আপনি পাননি! আমি তো মহামন্ত্রী কে দিয়ে আপনার নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছি। কি হল মন্ত্রী বল কিছু!

মন্ত্রী: আগে মহারাজ আপনি আমার প্রভু আপনার সুরের সঙ্গে সুর না মেলালে যে আমার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকা দায় হবে।

প্রিয়ংবদা: কি যা তা বলছ তুমি! মহারাজ কখনই আমাদের দেবী কে অগ্রাহ্য করতে পারেন না—

মন্ত্রীঃ (প্রিয়ংবদাকে মাঝপথে তাড়াতাড়ি থামিয়ে) কিন্তু তিনি করেছেন। ভয় পেও না প্রিয়ংবদা, আমাদের সঙ্গে আমাদের দেবীর আর্শীবাদ আছে আমরা ভয় কেন পাব বল? তাই না দেবী?

লাল পরীঃ একদম! আর ভয় পাবেই বা কেন তুমি এখন থেকে আর আদিত্যণারায়ন তোমাদের রাজা নয়। আজ থেকে, এই মূহুর্ত থেকে, এই রাজ্যে নতুন রাজার নিয়োগ হল। আজ থেকে এই রাজ্যের নতুন রাজা হল রাজা উদয়ভানু সিংহ। (তার শেষ বাক্যে চারিদিকে আরো একবার গুরু গম্ভীর মেঘের গর্জন শোনা গেল। রাজা আদিত্যণারায়নের মাথা থেকে আপনা আপনি রাজমুকুট পরে গেল আর মহামন্ত্রীর মাথায় এক আজব মুকুট শোভা পেল)।

রাজাঃ (হাটু মুড়ে বসে) দেবী আপনি আমাকে রাজা না রাখতে চান না রাখবেন, উদয়ভানু আমার পরম প্রিয় বন্ধু সে রাজা হলে আমি মোটেও বিচলিত হব না। কিন্তু দেবী আমাদের সন্তানের নামকরণের দিনে এসে আপনি তাদের আর্শীবাদ না করে চলে যাবেন এ হতে পারে না। আপনি আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার দিন কিন্তু আমাদের সন্তানদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না।

লাল পরীঃ বেশ তাই হোক তবে। কিন্তু যেহেতু এখন তুমি রাজা নও তাই আগে উদয়ভানুর সন্তান কে আমি আর্শীবাদ করব। তোমার ছেলের নাম কি রাখলে উদয়ভানু।

মন্ত্রীঃ (বিগলিত হয়ে) আঞ্জে বাপ্পাদিত্য দেবী।

লাল পরীঃ আমি আর্শীবাদ করি তোমার সন্তান বড় হয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমানী একজন ব্যক্তি হবে। তার মতন বীর পুরো রাজ্যে পাওয়া দায় হবে। মায়া, মমতা, ও ভালবাসায় ভরা থাকবে তার হৃদয়। ভবিষৎ-এ তার সাহায্যে কোন এক মহৎ কাজ সম্পন্ন হবে।

মন্ত্রীঃ (মনে মনে) বীর-বিচক্ষণই আব্দিই তো ঠিক ছিল আবার মায়া-মমতা কেন? এই সব মানুষকে বড্ড দুর্বল করে দেয়। (মুখে বলল) জয় লাল পরীর জয়!

প্রিয়ংবদাঃ (মনে মনে) আজ আমার আপনার উপর খুব রাগ হচ্ছে দেবী। আপনি কোন কথা না শুনে, কোন কথার সত্যতা যাচ্ছাই না করে একজন নিরীহ মানুষ কে শাস্তি দিলেন। এ যে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। কিন্তু দুটো নিষ্পাপ শিশুর কথা ভেবে প্রতিবাদও করতে পারছি না। উদয়ভানু সাঙ্ঘাতিক লোক ও কিছুই করতে পারে। শুধু একটাই সান্ত্বনা দেবী আপনি আমার পুত্রের মধ্যে ভালবাসা, মায়া, ও মমতা, এই তিন গুণ দিয়েছেন। এই তিন গুণ যথেষ্ট রাজা আদিত্যণারায়ন ও তার পুত্রকে তাদের অধিকার ও সম্মান ফিরিয়ে দেবার জন্য। আমি আজ প্রতিঞ্জা করলাম আমার পুত্র বাপ্পাদিত্য তার বাবার এই অবিচারের বিচার করবে। রাজা আদিত্যণারায়ন ও তার পুত্রকে তাদের হারানো অধিকার ও সম্মান ফিরিয়ে দেবে।

লাল পরীঃ (ব্যাকা হেসে) এইবার তোমার পুত্র কে আর্শীবাদ করব আমি। তা আদিত্যণারায়ন, কি নাম তোমার পুত্রের?

রাজাঃ (জোর হাতে) বিক্রমাদিত্য দেবী!

লাল পরীঃ বিক্রমাদিত্য এই রাজ্যের সবচেয়ে বদমেজাজি এবং রাগী একজন মানুষ হবে। তার ক্রোধের কারনে কেউ তার ধারে কাছে ঘেষবে না। রেগে গেলে তার শরীর লোহার মতন গরম হবে, ফুল, পাখি এবং এই পৃথিবীর সব সুন্দর জিনিস তার সামনে ছাই হয়ে যাবে। সে অপূর্ব সুন্দর দেখতে হবে কিন্তু তাও ভিষন একা হবে কারণ তার ব্যবহার তাকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে—

প্রিয়ংবদাঃ (হঠাৎ-ই হাঁটু মুড়ে বসে পরে) দেবী তার কি কোন গুণ থাকবে না!

লাল পরীঃ (প্রিয়ংবদার চোখের জল লাল পরীকে বিচলিত করে) বেশ সে হবে এক বীর যোদ্ধা, কিন্তু সে কোনদিন যুদ্ধে যেতে পারবে না। সে সব কাজ করতে পারবে কিন্তু তাকে সব সময় সব নিকৃষ্ট কাজের দ্বায়িত্ব হবে। ব্যাস এর বেশী আর কোন গুণ আমি তার মধ্যে দিতে পারব না, তবে সে যদি কোন দিন আমায় খুজে বের করে তার বাবার আপরাধের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চায় তাহলে আমি তাকে এই জীবন থেকে মুক্তি দিলেও দিতে পারি। (এই বলে লাল পরী ঝড়ের বেগে বেরিয়ে চলে গেল)।

রাজাঃ দেবী দাড়ান, শুনুন আমার কথা, (বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন)।

(নেপথ্য কন্ঠঃ লাল পরীর কথায় রাজা আদিত্যণারায়ন শোকে বিমর্ষ হয়ে মারা গেলেন।)

(নেপথ্য দৃশায়নঃ রাজার মাটিতে পরে থাকা নিথর দেহ আমরা দেখতে পাই)।

  দৃশ্য ৪

(নেপথ্য দৃশায়নঃ আমরা দেখি খাটে আধশোয়া মহামন্ত্রী, তার ঠোটের কোনে সেই কুটিল হাসি আর তার পা টিপে দিচ্ছে এক কিশোর, বিক্রমাদিত্য)।

মন্ত্রীঃ (চোখ বোজা অবস্থায়) আর একটু ওপরে, না না অতটা নয়, আর একটু নীচে, হ্যা ব্যাস ব্যাস, দে ভাল করে টিপে দে। উফ্‌ফ্‌ফ্‌ সারাদিন কত কাজ যায় বল তো। আরে বাবা রাজ্য চালানো কি চাট্টিখানি কথা নাকি! ১৮টা বছর ধরে এই কঠিন কাজটা করে আসছি কিন্তু তাও দেখ্‌ প্রজাগুলো নিন্দে মন্দ করতে ছাড়বে না। বলবে রাজা উদয়ভানু অত্যাচারী রাজা (বলে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে)। শুধু প্রজাদের কথাই বা বলি কেন, বেঁচে থাকতে নিজের বউ টা পর্যন্ত গাল মন্দ করে গেল। একবারও বুঝল না আমাকে। (একটু ব্যাকা হেসে) তা রাজপুত্র বিক্রমাদিত্য?

বিক্রমঃ (মাথা নীচু করে পা টিপতে টিপতে বলে) আঞ্জে?

মন্ত্রীঃ বাবা ছেলে নিজেকে রাজপুত্র ভাবছে দেখছি? (উঠে বসেবিক্রমের চুলের মুঠি ধরতে উদ্যত হলে হাতে ছ্যাকা খেয়ে ওঠে) ওরে বাবারে মাগো, মরে গেলাম রে! চুল তো নয় যেন গরম লোহা। (হাতের লাঠি বিক্রমের দিকে তাক করে) ভালো করে কান খুলে শুনে রাখ্‌। তুই রাজপুত্র নোস্‌, তুই আমার খাস্‌ চাকর!বুঝেছিস্‌ (বিক্রম পা টিপতে টিপতে মাথা নাড়ে) কি বুঝলি!

বিক্রমঃ(চোখটা রেগে লাল হয়ে আছে) আঞ্জে আমি আপনা খাস চাকর বিক্রমাদিত্য।

মন্ত্রীঃ হুম্‌ম্‌ম্‌। মনে থাকে যেন। আর পা টিপতে হবে না তোকে, যা গিয়ে রাজকুমার বাপ্পাদিত্যর ঘরটা ভালো করে ধুয়ে মুছে রাখ। কাল সে গুরুকুলের পড়াশোনা শেষ করে রাজ্যে ফিরছে। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে না তোকে কি বলব! যা গিয়ে ভালো করে ঘরটা পরিষ্কার করে রাখ্‌। মনে রাখবি রাজকুমার বাপ্পাদিত্য এই রাজ্যের রাজপুত্র, তুই নোস্‌।

(নেপথ্য দৃশায়ণঃ বিক্রমের চুল রাগে পুরো লাল হয়ে গিয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে খুব রেগে গিয়েছে। সে আসতে আসতে মন্ত্রীর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে, তার চোখে মুখে ভয়নাঙ্ক রাগ ঝলসে পড়ছে। সবাই তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আসতে আসতে সে এসে পৌছায় আর একটা কামরার সামনে। জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে দেয় দরজা এবং আমরা দেখি সেইখানে আরও একজন কিশোর দাঁড়িয়ে। সে এসে জড়িয়ে ধরে বিক্রমাদিত্য কে। বিক্রমাদিত্য বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে)।

বিক্রমঃ (বিস্মিত হয়ে) রাজকুমার আপনি?

বাপ্পাদিত্যঃ (নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবাক চোখে দেখল বিক্রম কে) আমি আবার রাজকুমার কবে হলাম দাদা, আমি তো বাপ্পাদিত্য, তোমার বাপ্পা।

বিক্রমঃ (রেগে) আপনি জন্ম থেকেই আমার রাজকুমার, মাঝে মাসি, না মহারানীর আমায় একটু বেশীই ভালবেসে ফেলেছিল তাই ভুলে আপনাকে আমার ভাই ভেবেছিলাম আজ মহারাজ সেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিল।

বাপ্পাঃ (হেসে) বুঝেছি (বলে সে তার কামরার দরজাটা বন্ধ করে দেয়)। বাবার উপর রাগ হয়েছে না তোমার? চিন্তা কর না দাদা আমরা আজ রাতেই বেরোব। তোমার হারানো সম্মান ফেরানোর কর্তব্য আমার।

বিক্রমঃ কোথায় বেরোব? আর তুই ঢুকলি রাজপ্রাসাদে কেউ জানতে পারল না কেন?

বাপ্পাঃ কারণ কেউ জানতে পারলে আমাদের কাজটা মুশকিল হয়ে যাবে। তাই আমি ছদ্মবেশে বেশে রাজপ্রাসাদে ঢুকেছি। আমার এক বন্ধু কাল সকালে আমার চিঠি নিয়ে বাবার কাছে আসবে, তাতে আমি লিখেছি কিছু কাজের জন্য আমার রাজ্যে আসতে একটু দেরী হবে। তাই কাল ভোর হওয়ার আগেই আমাদের বেরোতে হবে। আমি ফিরতামই না কিন্তু এই কাজটা তোমাকে ছাড়া হবে না, আর তোমাকে রাজপ্রাসাদ ছাড়া পাবো কোথায় বল তাই আসা। এখন রাত হওয়া অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। রাত ঘন হলে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের বেরোতে হবে। তুমি তোমার সঙ্গে রাজা আদিত্যণারায়নের তলোয়ারটা নিতে ভুলো না কিন্তু। আর শোন তুমি তোমার কাজ যেমন করছ করে যাও কেউ যেন তোমায় সন্দেহ না করে বুঝেছ?

বিক্রমঃ সে তো বুঝলাম কিন্তু বাবার তলোয়ার নেবো কি করে সে তো মহারাজের ঘরে, ওটা তো এখন ওনারই তলোয়ার!

বাপ্পাঃ (একটু চিন্তা করে) আচ্ছা বাবা কে রাতের খাবার তো তুমি দাও না? (বিক্রম মাথা নাড়ে) বেশ আজ একটা জিনিস দেব মনে করে বাবার খাওয়ারে মিশিয়ে দিও।

বিক্রমঃ কি জিনিস?

বাপ্পাঃ (হেসে) জব্বর জিনিস! একবার খেলে এমন ঘুম হবে না যে গন্ডারে গুঁতোলে বা কাঁসর বাজলেও ভাঙবে না। (এই কথাতে দুই কুমার অট্টহাসিতে ফেটে পরে।)

(নেপথ্য দৃশায়নঃ আসতে আসতে আকাশে রাতের চাঁদ দেখা গেল। মন্ত্রী তার কক্ষে সবে খাওয়া শেষ করে উঠেছে, বিক্রম তার বিছানার পাশে মাথা নীচু করে পিছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মন্ত্রী ক্রমাগত হাই তুলে যাচ্ছে।)

মন্ত্রীঃ (একটা বড় হাই তুলে) তখন তো খুব রাগ দেখিয়ে কাজে ফাকি দিলি, নে এইবার ভাল করে গা-হাত-পা সব টিপে দিবি। কাল রাজকুমার আসবে আজ (আবার একটা হাই তুলে) ভাল করে ঘুমোতে হবে বুঝলি? (বলে সে বিছানায় উঠে পাশ ফিরে শুয়ে পরে) কি রে দাঁড়িয়ে রইলি কেন!

বিক্রমঃ (বসে পরে হাত-পা টিপতে শুরু করে) ঠিক আছে, মহারাজ?

মন্ত্রীঃ হুম্‌ম্‌ম্‌!

(নেপথ্য দৃশায়ণঃ কিছুক্ষণ হাত-পা টেপার পর বিক্রম মন্ত্রীর নাক ডাকার আওয়াজ পেল। সে আসতে আসতে বিছানা থেকে নেমে এসে কক্ষের এক কোনায় গিয়ে একটা তলোয়ার নিয়ে মন্ত্রীর বিছানার কাছে ফিরে আসে। নাক ডাকার শব্দ বেরেই চলেছে, সে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে আসে, বাইরে তখন প্রহরির বেশে দাঁড়িয়ে বাপ্পাদিত্য।)

বাপ্পাঃ (ফিস্‌ ফিস্‌ করে) পেয়েছ?

বিক্রমঃ (তলোয়ার খানা দেখিয়ে) হ্যা এই যে!

বাপ্পাঃ বেশ, তাই হলে আর দেরী নয়, চল যাওয়া যাক।

(নেপথ্য দৃশায়ণঃ বিক্রমাদিত্য ও বাপ্পাদিত্য আন্ধকারে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসে।)

 দৃশ্য ৫

(নেপথ্য দৃশায়ণঃ বিক্রম ও বাপ্পা হাটতে হাটতে একটা জঙ্গলে এসে পরে। কিছুক্ষণ পর তার হাপিয়ে পরে একটা বড় গাছের ছাওয়া এসে বসে)।

বাপ্পাঃ সব বুঝলে তো দাদা, তুমি যে রাগী এটা তোমার দোষ নয় তোমার অভিশাপ।

বিক্রমঃ মাসি তোকে এই সব কিছু চিঠিতে বলে গিয়েছে?

বাপ্পাঃ হ্যা গো। মা এও বলেছে তুমি যদি লাল পরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও তাহলে তোমার অভিশাপ ভেঙ্গে যাবে।

বিক্রমঃ (তার চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে আছে) আমায় ক্ষ্মা চাইতে হবে কেন আমার তো কোন দোষ নেই। আমার বাবার ও নেই। তাহলে আমি কেন ক্ষমা চাইব?

বাপ্পাঃ ক্ষমা চাইলে তুমি ছোট হবে না দাদা। আর আমি তো বলছি না যে আমি লাল পরী কে বলব না তার দোষের কথা, আমি সব বলব। কিন্তু তার আগে তার রাগটা তো পরা দরকার। তবেই তিনি আমাদের কথা শুনবেন।

বিক্রমঃ কিন্তু—

বাপ্পাঃ কোন কিন্তু নয় দাদা! ভুলে যেও না তুমি একজন রাজপুত্র, আর রাজপুত্রদের শুধু নিজের কথা ভাবলে চলে না তাকে তার প্রজার কথাও ভাবতে হয়। তোমার ইচ্ছে করে না দাদা তোমার প্রজারা সুখে থাকুক (বিক্রম মাথা নাড়ে) তাহলে আমি যা বলছি, তাই কর।

বিক্রমঃ কিন্তু আমরা লাল পরী কে পাবো কোথায়?

বাপ্পাঃ মা আমকে বলে গিয়েছে লাল পরী আমাদের রাজ্যে আসার আগে এই জঙ্গলের একটা গাছের কোটরে থাকত, মার অনুমান রাগ করে হয়ত লাল পরী আবার সেই গাছের কোটরেই ফিরে এসেছে।

বিক্রমঃ সে গাছ কাঠুরে তো কেটেও ফেলতে পারে?

বাপ্পাঃ না গো দাদা, যে গাছে পরী থাকে সে কি আর এমনি গাছ হবে সে তো জাদুই গাছ হবে। আমাদের এখন সেই জাদুই গাছকেই খুজতে হবে।

বিক্রমঃ(রেগে গিয়ে) তোর যেমন কথা এই এত বড় জঙ্গলে একটা পুরনো জাদু গাছ খুজতে হবে! কে খুজবে শুনি?

বাপ্পাঃ (হেসে) কেন বাপ্পাদিত্য আর বিক্রমাদিত্য! (এই কথা শুনে বিক্রম ও ফিক্‌ করে হেসে ফেলে)।

(নেপথ্য দৃশায়ণঃ দুই কুমার গাছের গুড়িতে গা এলিয়ে বিশ্রাম করছে হঠাৎ-ই গাছের গুড়িটা কথা বলে ওঠে)

গাছঃ উঃ ভাব দেখে বাচি না! সব ঢং, জানা আছে আমার!

(দুই কুমার চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পরে অলোয়ার বার করে আনে)

বিক্রমঃ কে? কে কথা বলছে? হিম্মত থাকলে সামনে আয়।

গাছঃ তোমাদের থেকে ঢের বেশী হিম্মত আমার। যতটা সামনে আছি ততটাই যথেষ্ট এর বেশী পারব না।

(বিক্রম মানুষের খোজে এ দিক ও দিক তাকায় তারপর কিছুটা ছুটে গিয়ে আবার ফিরে আসে। সে দেখে বাপ্পা ঠায় গাছটা কে দেখছে)

বাপ্পাঃ আচ্ছা আপনি কি আমাদের সঙ্গে কথা বললেন এখন?

গাছঃ যাক তোমার তাও কিছুটা বুদ্ধি-সুদ্ধি আছে, তোমার দাদার মাথায় তো গোবর পোরা পুরো!

বিক্রমঃ (রেগে গিয়ে তলোয়ার বাগিয়ে তেড়ে যায় গাছটার কাছে) তবে রে দ্যাখ এখুনি এক ঘায়ে কেমন করে তোকে শেষ করি দেখ।

গাছঃ তাই বুঝি তা করে দেখাও দেকি!

বাপ্পাঃ (বিক্রমের কানে কানে) এই মনে হয় সেই জাদুই গাছ। এই আমাদের লাল পরীর কাছে নিয়ে যেতে পারবে। তুমি এখন একটু শান্ত থাক। (গাছের দিকে ফিরে) আমাদের মাপ করবেন আসলে গাছ কথা বলছে এটা তো সচারচর দেখা যায় না, তাই দাদা একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল আর কি!

গাছঃ হুম্‌ম্‌ম্‌ বুঝলাম, তা তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমরা মন্ত্রীপুত্র বাপ্পাদিত্য আর রাজপুত্র বিক্রমাদিত্য।

বাপ্পাঃ একদম ঠিক!

গাছঃ প্রমাণ কি?

বাপ্পাঃ কি প্রমাণ চাই বলুন?

গাছঃ লাল পরী রাজা আদিত্যণারাযন কে একটা তলোয়ার দিয়েছিল তার ভালো কাজের জন্য। সেটা কি আছে তোমাদের কাছে।

বিক্রমঃ (গাছের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তলোয়ারটা মাটিতে রাখে) এই যে।

গাছঃ যাক তাহলে বড়দের সম্মান দিতে জানো তুমি। (বাপ্পার দিকে তাকিয়ে) তা তুমি মন্ত্রীপুত্র বাপ্পাদিত্য বুঝব কি করে? দাঁড়াও একটু ভাবি। (ভাবার পর) পেয়েছি! লাল পরী আর্শীবাদ দিয়েছিল যে তুমি সবার চেয়ে বুদ্ধিমান হবে দেখি তুমি কত বুদ্ধিমান! বল তো এমন কি জিনিস আছে যেখানে দেশ আছে লোক নেই, প্রাণী নেই, রাজ্য আছে, ইমারত নেই, ঘর নেই, বাড়ী নেই, নদী আছে জল নেই, পাহাড় আছে বরফ নেই।

বাপ্পাঃ (হেসে) মানচিত্রে দেশের নাম থাকে লোক-প্রাণী কিছু থাকে না, রাজ্যের নাম থাকে কিন্তু ইমারত, ঘর-বাড়ী কিছু থাকে না। তেমনি ভাবে নদী আর পাহাড়ের নাম থাকলেও সেই খানে জল বা বরফ কিছু থাকে না।

গাছঃ বেশ বেশ! তা এই খানে কি মনে করে?

বাপ্পাঃ আজ্ঞে, আমরা লাল পরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই!

গাছঃ কে? ও সেই বদমেজাজি পরী আগে যে এইখানে থাকত! না, না তার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। সে গিয়েছি আমি বেচেছি! বাপের জন্মে এমন রাগী পরী দেখি নি আমি।

বিক্রমঃ (রেগে উঠে দাঁড়িয়ে) দেখন নি ঠিক আছে। এত কথা বলতে কে বলেছে আপনাকে। ভুলে যাবেন না উনি আমাদের রাজ্যের দেবী। আগেও ছিল এখনও আছে ভবিষৎ-এও থাকবে।

গাছঃ সে তো বোঝাই যাচ্ছে। তিনি যেমন তার রাজ্যের লোকেরাও তেমনি—বদমেজাজি ও রাগী।

বাপ্পাঃ (রেগে গিয়ে) আপনি আমাদের রাজপুত্র কে বদমেজাজি বলতে পারেন না। তাকে অসম্মান ও করতে পারেন না। আপনার বয়স ও অভিজ্ঞতা দেখে আপনাকে সম্মান করছি মানে এই নয় যে আপনি আমাদের রাজপুত্র কে অপমান করে যাবেন।

গাছঃ আর হাসিও না বাপ্পাদিত্য! তোমার বাবা যাকে নিজের খাস চাকর বানিয়ে রেখেছে সে নাকি তোমার রাজপুত্র! সত্যি করে বল তো কি চাও? একেবারে যদি খতম করে দিতে চাও, তাহলে তোমার মতন বুদ্ধিমান ছেলে ঠিক জায়গাই বেচেছে বলতে হবে। এই খানে বিক্রমাদিত্য কে মেরে ফেললে দোষটা হিংস্র জানোয়ারদের উপরই যাবে।

বিক্রমঃ (রেগে গিয়ে) আর এক মূহুর্ত এই জঙ্গলে নয় বাপ্পা! আমার প্রজাদের ভালো রাখার দ্বায়িত্ব আমার মানছি কিন্তু তোকে কষ্ট দিয়ে সেটা করতে পারব না। সবাই যখন আমার রাগ কে ভয় পেয়ে আমার থেকে দূরে চলে গিয়েছে তখন তুই আমার কাছে ছিলিস্‌। কতবার তুই আমার প্রাণ বাচিয়েছিস্‌ আর আজ শুধু রাজা হব বলে একটা গাছ তোকে দু:খ দেবে আর আমি সেটা মুখে বুজে মেনে নেব এটা হতে পারে না।

বাপ্পাঃ না দাদা,এই সন্দেহটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক! তুমি মাথা ঠাণ্ডা রাখো আমি কথা বলছি! (গাছের দিকে ফিরে) আপনার সন্দেহ খুবই স্বাভাবিক কিন্তু আমি এও জানি আমি কোন ভুল করছি না। আপনি চাইলে আমার পরীক্ষা নিতে পারেন।

গাছঃ বেশ। শুনেছি তুমি খুব ভালো তলোয়ারবাজিতে। ডান হাতে দারুন তলোয়ার চালাও। (একটু থেমে) আজ এই মূহুর্তে তোমার ডান হাত সমর্পন কর আমায়।

(নেপথ্য দৃশায়ণঃ বাপ্পাদিত্য বিনা দ্বিদ্ধায় তার ডান হাত সমর্পন করতে যাবে সঙ্গে সঙ্গে গাছের কোটরে একটা ফাক হয়ে যায় এবং লাল পরী তার থেকে বেরিয়ে আসে। )

লাল পরীঃ তোমরা তাহলে এলে! (দুই কুমার নীচু হয়ে বসে লাল পরী কে আভিবাদন জানায়) আমি তোমাদের জন্য কত অপেক্ষা করেছি জানো?

বাপ্পাঃ কেন দেবী?

লাল পরীঃ তোমার মার মৃত্যুর পর আমি জানতে পেরেছিলাম অতিরিক্ত রাগে অন্ধ হয়ে আমি কত মানুষের জীবন নষ্ট করে ফেলেছি। কিন্তু আমার যে আর কিছু করার ছিল না আমি যে অভিশাপ দিয়ে ফেলেছি, সেটা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না শুধু শর্ত পূরণ হলে ভেঙ্গে ফেলা যায়। আবার করে রাজ্যে যেতে পারতাম কিন্তু তখন যে রাজ্যে কোন উপযুক্ত লোক ছিল না যাকে আমি রাজা করতে পারি তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না।

বিক্রমঃ (জোড়হাতে) আপনি জানেন আমার বাবার কোন দোষ ছিল না কিন্তু আমার বাবা রাজা থাকাকালিন আপনি কষ্ট পেয়েছেন তাই বাবার হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

লাল পরীঃ আমি বলেছিলাম তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইলে তুমি এই জীবন থেকে মুক্তি পাবে। আমি আমার কথা রাখছি, আজ থেকে তোমায় দেওয়া আভিশাপ ভেঙ্গে গেল। আজ থেকে তুমি একজন নতুন মানুষ এই বার একটা ভালো দিনক্ষণ বার করে আমায় ডেকো আমি তোমায় রাজা ঘোষনা করে দেব।

বিক্রমঃ আমি যে রাজা হতে চাই না দেবী!

বাপ্পাঃ মানে?

বিক্রমঃ যে রাজ্যত্ব বন্ধুর জীবন কে বাজি রেখে পেতে হয় সেই রাজ্যত্ব আমি চাই না!

লাল পরীঃ (হেসে) তোমার বাবা ভুল লোক কে ভরসা করেছিল, তার জন্য তার জীবন এক বিশাল বড় অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছিল, আমি তাই দেখে নিচ্ছিলাম তুমি বন্ধু নির্বাচনে কোন ভুল করছ কি না? না কোন ভুল নেই তুমি একজন প্রকৃত বন্ধু, একজন ভাই কে পেয়েছ তোমার কাছে। বাপ্পাদিত্য তোমার বিচক্ষণতা ও বুদ্ধি দেখে আমি তোমায় রাজা ঘোষনা করার কথা ভাবছিলাম। তোমার আপত্তি নেই তো?

বিক্রমঃ (খুশি হয়ে) সত্যি! (বাপ্পা কে জড়িয়ে) আমি যে কি খুশি। তুই আর কোন কথা বলবি না! আমাদের দেবী কখনই ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না তাই তার বিরুদ্ধে যাওয়া আমাদের উচিত হবে না।

বাপ্পাঃ (নিজেকে ছাড়িয়ে) আমি জানি দাদা কিন্তু তুমি ভুলে যেও না এই রাজ্যের লোকেরা কোনদিনই একজন ভালো মহামন্ত্রী কে পায় নি। মহামন্ত্রীর নামে তারা পেয়েছে এক কুটিল মন্ত্রী কে, আর তা ছাড়া এই জঙ্গলে হয়ে যাওয়া ঘটনার কোন সাক্ষী নেই। আমি যদি রাজা হই সবাই ভাববে আমি ও আমার বাবার মতন কোন ছল করে রাজা হয়েছি। আমার প্রজারা যে আমায় মন থেকে মেনে নেবে না দাদা। (লাল পরী র দিকে ফিরে) দেবী সত্যি যদি আমার কাজে খুশি হয়ে থাকেন তাহলে আর্শীবাদ করুন আমি যেন মায়া-মমতায় ভরা এক দয়ালু মহামন্ত্রী হতে পারি।

লাল পরীঃ সত্যি তুমি উদয়ভানুর নয় প্রিয়ংবদার ছেলে বোঝায় যায়। তোমার মায়ের সব গুণ তোমার মধ্যে আছে। বেশ, তুমি যা চাও তাই হবে। তুমি রাজা বিক্রমাদিত্যের বীর-বিচক্ষণ, এবং দয়ালু মহামন্ত্রী হবে যে মানুষের দুখ কষ্ট সব বুঝবে এবং তাদের পাশে থাকবে।

(নেপথ্য কন্ঠঃ এই ভাবে রাগী রাজপুত্র তার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেল। সে খুব তাড়াতাড়ির রাজ্যের মানুষের মন জয় করে ফেলল, সবাই রাজা বিক্রমাদিত্যর জয়ধ্বনি দিল, তবে সবাই এও স্বীকার করল মন্ত্রী বাপ্পাদিত্য না থাকলে এই রাজ্য এত সমৃদ্ধ হতে পারত না। প্রজারা তাদের সব দুখে তাদের পাশে পেত মন্ত্রী বাপ্পাদিত্য কে। উদয়ভানু বাপ্পাদিত্যর বাবা বলে বিক্রমাদিত্য খুব কঠর শাস্তি দিতে পারল না শুধু তাকে লালপরীরখাস চাকর বানিয়ে দিল)

(নেপথ্য দৃশায়ণঃ হাসি মুখে রাজমুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছে রাজা বিক্রমাদিত্য আর পিছনে শোনা যাচ্ছে প্রজাদের জয়ধ্বনি তারপরই দেখা যায় মন্ত্রী বাপ্পাদিত্য কে যে হাসি মুখে প্রজাদের সব কথা শুনছে। আর শেষ দৃশ্যে দেখা যায় বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে লালপরী আর ব্যাজার মুখে তা পা টিপে দিচ্ছে উদয়ভানু, আর লালপরীর মুখে একটা দুষ্টু হাসি)। 


Rate this content
Log in