এক অন্য রূপকথা
এক অন্য রূপকথা
পরীদিদাঃ ওরে বাবারে বাতের ব্যাথায় মরে গেলুম রে। যাক গে তোরা যখন গল্প শুনতে এসেই গিয়েছিস তখন আর আমি বেশি সময় নষ্ট করব না। আমি হলাম গিয়ে পরীদিদা। কেন দিদা? মা, ঠাক্মা বা পিসি নই কেন? তা জানি নে বাপু আর এই গল্পের সঙ্গে সেই সবের কোন যোগ ও নেই। তাই ছাড়ান্ দে।
গল্প শুরু করি তাহলে? দাড়া একখান পান খেয়ে নি (পান মুখে ঢুকিয়ে) হুম্ম্ম্ম্, এইবার গল্পে আসা যাক।
আমাদের গল্পের নায়ক সুনন্দ, তবে সবাই তাকে ডাকে নন্দ। দিকশূণ্যপুর রাজ্যে তার বাড়ি। ছোটবেলায় সে হারিয়েছে মা-বাপ দুজনকেই। সেই ছেলেবেলা থেকে কাকার কাছেই থাকে। কাকার দুই ছেলে, কিংশুক, চিনাংশুক। স্ত্রী গত হয়েছেন অনেকদিন। কাকার দুচক্ষের বিষ এই ভাইপো। বড়দার সম্পত্তি নেওয়ার ছিল বলে ভাইপোকে রাখতে হয়েছে কাছে, তাতে অবশ্য সুবিধাই হয়েছে। কাজের লোকের পিছনে আর খরচাপাতি করতে হয় না, ঘরের যত কাজ সব করে ঐ নন্দ, লেখাপড়া হয়েছে সেই কবে বন্ধ। ঐ যে চিলেকোঠার ঘরটা দেখছিস ঐটে তে থাকে নন্দ। খুব ছোট ও নোংরা কিন্তু তার জন্য ঐটেই বরাদ্দ।
ওমা দেখো দেখি কি কাণ্ড সাতটা বেজে গেল, সাড়ে-সাতটায় সবাই কে জলখাবার দিতে হবে আর এই ছেলে কিনা এখনও পরে পরে ঘুমাচ্ছে। এই যে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি যা গিয়ে ডাক ব্যাটা কে।
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিঃ নন্দ, এই নন্দ, ওঠ বলছি ঘুম থেকে। সকাল যে হয়ে গেল!
নন্দঃ (আড়মোড়া ভেঙ্গে) ঘুমটা কেন ভাঙ্গালি ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি? কি দারুন একটা স্বপ্ন দেখছিলাম আমি।
(গান গেয়ে) এই নতুন ভোরের আগমন
ভরিয়ে দেয় আমার প্রান-মন
আজ নতুন সূর্যের বার্তা
জাগাচ্ছে মনে এক নতুন আশা-আআআআআ
আশা-আআআআ
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিঃ (গান গেয়ে) নন্দ নন্দ কর বাজে কথা বন্ধ
তোর কপাল যে মন্দ
সুখের সাথে যে তোর চিরদিনের দ্বন্দওওওওও
নন্দওওওওওওওও
নন্দঃ (গান) রোজের কাজের মাঝে, স্বপ্ন দেখা বারন
তবুও আজ যে মন খুশি অকারননননননন
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিঃ (গান) নন্দ নন্দ কর বাজে কথা বন্ধ
তোর কপাল যে মন্দ
সুখের সাথে যে তোর চিরদিনের দ্বন্দওওওওও
নন্দওওওওওওওও
নন্দঃ (গান) করি বাজে কথা বন্ধ
দেরী হলে যে, হয়ে যাবে আজকের দিনটা মন্দ
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিঃ নন্দ ও নন্দ ও ও ও ও ও ও নন্দ
নন্দঃ সুখের সাথে, তোর যে, (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) চিরদিনের দ্বন্দ।
নন্দঃ (দরজায় কড়া নেড়ে) বড়দা, আসছি। (টেবিলে জল-খাবার রেখে) জলখাবার রেখে গেলাম খেয়ে নিও আর কিছু লাগলে বলো।
কিংশুকঃ (ঘুমের মধ্যে) ছাড়া জামা-কাপড়গুলো নিয়ে যা, ধুয়ে দিবি।
নন্দঃ নিশ্চয় আর কিছু?
কিংশুকঃ হ্যা।
নন্দঃ (একটু হেসে) বলো না?
কিংশুকঃ আজ চায়ে চিনি যদি আবার বেশি হয় তাহলে তোর দুদিনের খাওয়া বন্ধ। যা বের হ।
নন্দঃ ছোট্দা আসছি। (জলখাবার রেখে) জলখাবার রেখে দিলাম। আর কিছু লাগলে বল।
চিনাংশুকঃ কটা বাজে?
নন্দঃ সাড়ে সাতটা।
চিনাংশুকঃ তাহলে বাবা কে আগে দিলে পারতিস। উনি আবার ঝামেলা করবেন।
নন্দঃ (হেসে) ও নিয়ে চিন্তা কর না তুমি খেয়ে নাও।
চিনাংশুকঃ তুই কি করে এত দুখের মধ্যে হাসিস রে নন্দ?
নন্দঃ আমার বাবা বলত, যত হাসবে তত নিজের দুখ কম মনে হবে। তুমি খেয়ে নাও। আমি আসি।
নন্দঃ কাকাবাবু আসব?
কাকাঃ জলখাবার?
নন্দঃ আজ্ঞে।
কাকাঃ কটা বাজে?
নন্দঃ সাড়ে-
কাকাঃ না, সাতটা বত্রিশ! দুমিনিট দেরী কেন জানতে পারি? (নন্দ চুপ কিংশুক ঘরে ঢোকে)।
কিংশুকঃ তুই আবার দেরী করে বাবা কে জল খাবার দিলি। বাবা তুমি ওকে কিছু বলবে না?
কাকাঃ আমি আমার দাদা কে ভালোবাসতাম বলে তুমি আজও আমাদের সঙ্গে একই ছাদের তলায় বাস করছ। অন্য কেউ হলে এতদিনে তোমায় অস্ত্র কারাখানায় পাঠিয়ে দিত। কিন্তু তাই বলে তুমি আমাদের অবাধ্য হবে তা তো হতে পারে না।
নন্দঃ বিশ্বাস করুন আমি অবাধ্য হই নি। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে আর হবে না।
কাকাঃ এই ভুলের একটাই শাস্তি। আরো কাজ।
(গান) কাজ, কাজ, কাজ আরো কাজ
এই হল শাস্তি তোমার আজ।
কাজ কাজ কাজ আরো কাজ।
ধুয়ে-মুছে সাফ যেন হয়ে সব বাসন
তারপর পুরো ঘরে দেবে ঝাড়ন।
থাকে যদি ময়লা জামা-কাপড়ে
একটাও মার পড়বে না বাইরে।
কাজ কাজ আরো কাজ
এই হল শাস্তি তোমার আজ।
রান্নায় যেন কোন হয় না কো ভুল
তাহলেই দিতে হবে বড় মাসুল।
মনে করে করবে সেলাই জামা-কাপড়
তারপর পাল্টাবে সব বিছানার চাদর।
কাজ কাজ আরো কাজ
এই হল শাস্তি তোমার আজ।
নন্দঃ চাবুক, এইখানে অনেক ঘাস আছে তুই মন ভরে খা। তুই আধপেটা থাকলে বড়দা আমায় বকবে। (চাবুক চিইইইই করে ওঠে) তুই খা আমি এইখানে বসে একটু বাঁশি বাজাই (বলে সে বাঁশি বাজাতে থাকে)।
রাজপুত্রঃ বাহঃ! বেশ বাজালে তো?
নন্দঃ (চমকে উঠে) কে? কে তুমি?
রাজপুত্রঃ ভয় পেয়ো না আমি বাঘ-ভাল্লুক নই, এই রাজ্যের একজন। তোমার বাঁশী শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তাই প্রশংসা না করে পারলাম না।
নন্দঃ (হেসে) ওহ্ তাই বল। তোমার ভালো লেগেছে?
রাজপুত্রঃ অসাধারন। কোথায় শিখলে এই সুর?
নন্দঃ বাবা শিখিয়েছিল। বাবার শেখানো শেষ সুর।
রাজপুত্রঃ শেষ কেন?
নন্দঃ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) বাবা আর নেই। যাক গে ছাড়ো, তুমি কে বললে না তো?
রাজপুত্রঃ বললাম তো এই রাজ্যেই থাকি। এতদিন গুরু গৃহে ছিলাম এই ফিরেছি।
নন্দঃ গুরু গৃহ? সে ভারি মজার না?
রাজপুত্রঃ মজার কিনা জানি না তবে হ্যা বেশ জায়গা। কত কি শেখা যায় সেখানে। তুমি যাওনি কখনও।
নন্দঃ নাহ্!
রাজপুত্রঃ কেন?
নন্দঃ আজ থাক সে সব কথা অন্য একদিন হবে না হয়। এই প্রথম কেউ আমার প্রশংসা করল আমার কি যে ভালো লাগছে। আমায় একটু এই মূহুর্তটা উপভোগ করতে দাও।
রাজপুত্রঃ এতদিন কি তুমি অন্ধ আর কালা লোকেদের মাঝে ছিলে?
নন্দঃ কালা কেন বললে বুঝলাম কিন্তু অন্ধ কেন?
রাজপুত্রঃ (মনে মনে) অন্ধ নয়? এত সুন্দর কাজল কালো চোখ তোমার। কেউ কোন দিন তা তোমায় বলে নি?
নন্দঃ কি হল? বললে না তো?
রাজপুত্রঃ অন্য কোন দিন বলব নে।
নন্দঃ অন্য কোন দিন? আমাদের যদি আর দেখা না হয়?
রাজপুত্রঃ ঠিক হবে দেখো। (এমন সময় ঘোড়াটা চিইইই করে উঠল)!
নন্দঃ (তাড়াহুড়ো করে) আমি আসি আজ! দেরী হয়ে গেল।
রাজপুত্রঃ আরে যাও কোথায়? নামটা তো বলে যাও! আরে—যাহ্! চলে গেল!
মন্ত্রীঃ রাজপুত্র রূদ্রিকের জয় হোক!
রাজপুত্রঃ (চমকে উঠে) উফ্ফ্ফ্! আপনি! আপনাকে না বলেছি বাইরে আমাকে রাজপুত্র বলে ডাকবেন না।
মন্ত্রীঃ ক্ষমা করবেন রাজপুত্র, কিন্তু আপনাকে রাজকন্যা কাঞ্চনমালা ও রাজকন্যা মণিমালা জরুরী তলব করেছেন।
রাজপুত্রঃ যান আমি আসছি।
মন্ত্রীঃ যথা আজ্ঞা।
রাজপুত্রঃ হঠাৎ জরুরী তলব, ব্যাপার কি?
কাঞ্চনমালাঃ ব্যাপার সাঙ্ঘাতিক! আমাদের বার্ষিক উৎসবের দিন ধার্য হয়েছে আর সাতদিন পর। মহারাজ বললেন আজই রাজপুরহিত সঙ্গে কথা বলে উনি এই দিন ধার্য করেছেন।
রাজপুত্রঃ সে কি? এত অল্প সময়ের মধ্যে সব আয়োজন হবে কি করে?
মণিঃ রাজার বাড়িতে আয়োজনের সমস্যা, তুমি ও যেমন দাদা! এক কাজ কর বোন তুই গিয়ে সভাকবির সঙ্গে কথা বলে নিমন্ত্রন পত্রের জন্য একখান পদ্য লিখতে বল। বাকি সব আমরা দেখছি।
কাঞ্চনমালাঃ আচ্ছা সেই ভালো, আমি আসছি।
রাজপুত্রঃ তাড়ালি কেন কাঞ্চন কে?
মণিঃ (হেসে) তুমি দেখছি আমাকে আমার চেয়ে বেশি ভালো বোঝো! যাক গে একটা জরুরী কথা বলার ছিল তোমায়।
রাজপুত্রঃ বল না।
মণিঃ উৎসবের দিন বাবা ইচ্ছে করেই একটু তাড়াতাড়ি ফেলেছে। উনি চাইছেন তুমি তোমার জীবন সঙ্গী এই উৎসবে আসা অতিথিদের মধ্যে থেকে খুজে নাও। তাই তিনি ঠিক করেছে গরীব, বড়লোক সবার কাছে যাবে চিঠি। যে কন্যা কে তোমার পছন্দ তাকেই তোমার জীবন সঙ্গী ও আমাদের দিকশূণ্যপুরের ভবিষৎ-এর রানি করা হবে।
রাজপুত্রঃ (বিষন্ন হেসে) আমার জীবনসঙ্গী নয় বাবা দিকশূণ্যপুরের ভবিষৎ-এর রানিই খুজছে। আমার জীবন সঙ্গী কে বেচে নেওয়ার স্বাধীনতা আমার নেই। রাজপুত্র রূদ্রিকের নেই রে মণি (বলে সে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে)।
মণিঃ আমি হয়ত তোমার কথাটা কিছুটা বুঝেছি, তাই তোমাকে আগে থাকতে বলে রাখলাম। যাতে বাবা কথাগুলো তোমায় বললে তুমি বিব্রত বোধ না কর!
রাজপুত্রঃ তোকে ছাড়া আমার কি হত রে মণি?
মণিঃ আচ্ছা হয়েছে আমি আসি! (মনে মনে) হে ভগবান, আমার দাদাটা বড্ড ভালো, উৎসবের দিন সে যেন নিজের সত্যিকারের ভালোবাসা কে খুজে পায়। তারপরের লড়াইটা না হয় আমরা সবাই মিলে করব!
নন্দঃ এইটা কেমন?
কিংশুকঃ খুব সুন্দর! উৎসবে যদি আমায় সঙ সেজে যেতে বলত তাহলে এর চেয়ে ভালো পোষাক দুটো ছিল না।
নন্দঃ আচ্ছা আমি অন্য একটা আনছি।
কাকাঃ কি রে তোদের হল?
চিনাংশুকঃ আমার হয়ে গিয়েছ দাদার পোষাকই পছন্দ হয় না।
কাকাঃ (গর্বের সঙ্গে) হবে কি করে, আমার কিংশুকের মতন সুপুরুষ এই পুরো দিকশূণ্যপুরে নেই। তার কি যা তা পোষাক পছন্দ হয়। (একটু থেমে) বাবা তোমার উপর অনেক ভরসা আমার, একবার রাজকন্যা মণিমালা তোমাকে পছন্দ করে নিলে আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কিংশুকঃ কোন চিন্তা কর না বাবা, আজ পর্যন্ত কত মেয়েকে নাচিয়েছি, এ তো আতুপুতু একটা রাজকন্যা!
চিনাংশুকঃ নাচিয়েছি? এ কি ভাষা তোর?
নন্দঃ (হাপাতে) এইটা?
কাকাঃ হ্যা এইটা বেশ হয়েছে। এইটা পর তুই। নন্দ যা গিয়ে জুতোগুলো পরিষ্কার করে রাখ্। কি রে দাঁড়িয়ে রইল কেন?
নন্দঃ কাকাবাবু আমি এইবার বাড়ির সব কাজ শেষ করে রেখেছি! এই বছর অন্তত আমায় উৎসবে যেতে দিন।
কাকাবাবুঃ (হেসে) তা কি পরে উৎসবে যাবি? ছেঁড়া ফতুয়া আর পাঞ্জাবি?
নন্দঃ না, না, আমি নিজে আমার জামা সেলাই করেছি। দাঁড়ান আনছি! (সে চলে যায়)
চিনাংশুকঃ এইবারটা অন্তত ওকে যেতে দাও।
নন্দঃ এই যে!
কিংশুকঃ একি এতো আমার জামার বোতাম!
নন্দঃ কিন্তু এইটা তো যে জামার বোতাম সেইটা তো ছেড়া!
কিংশুকঃ তাই বলে তুই না বলে নিবি? (জামাটা-ছিড়ে ফেলে)
নন্দঃ (কেদে ফেলে) না, বড়দা, না! (আরো জোরে কাঁদতে শুরু করে)
কিংশুকঃ নে এইবার পর!
চিনাংশুকঃ দাদা! তুই মানুষ!
কাকাঃ আহ্ আর কথা নয়। চলো এইবার!
চিনাংশুকঃ কিন্তু—
কাকাঃ চলো! (সবাই বেরিয়ে যায়)।
নন্দঃ (কাঁদতে কাঁদতে) ঠাকুর আমি কি করেছি? কেন আমায় এত শাস্তি দাও তুমি?
পরীদিদাঃ আহ মোলো যা, পরে পরে কাঁদলে হবে নাকি? ওঠ ওঠ!
নন্দঃ (চমকে উঠে) কে? কে তুমি?
পরীদিদাঃ আমি হলাম গিয়ে তোর পরীদিদা, কিছুক্ষন আগে ঠাকুরকে দুষছিলিস, ঠাকুর আমায় পাঠিয়ে দিল তোর কাছে।
নন্দঃ কিন্তু—
পরীদিদাঃ আর কথা নয় উঠে দাড়া তো দেখি। হ্যা এই তো, লক্ষি ছেলে। হুম্ম্ম্। "ধুলো ময়লা মুছে যাক, নন্দ আমাদের রাজপুত্তর হয়ে যাক!"
নন্দঃ (চমকে উঠে) একি এতো রাজপোষাক!
পরীদিদাঃ তবে? আমায় কম ভাবলি নাকি? আচ্ছা এইবার একটা ভালো জুতো চাই। "ধুলো ময়লা মুছে যাক/নন্দর পায়ে সুন্দর জুতো এসে যাক!"
নন্দঃ (খুশি হয়ে) এইটা আমার? সত্যি বলছ পরীদিদা?
পরীদিদাঃ শুধুশুধু মিছে কথা বলব কেন? নে এই বার যা উৎসবে! না দাড়া একটু দাড়া! ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি আয় তো এইখানে!
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিঃ এই যে এইখানে পরীদিদা!
পরীদিদাঃ এই তো! আয় আয়, "ধুলো ময়লা মুছে যাক/ ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি সুন্দর রথ হয়ে যাক!" এই নে তৈরী তোর সওয়াড়ি! এইবার যা দেখা করে আয় নিজের মনের মানুষের সঙ্গে। কিন্তু মনে রাখিস এই জাদু শুধু কিছুক্ষনের জন্য, রাত বারোটার মধ্যে না ফিরলে তুই আবার ছেড়া ফতুয়া চলে আসবি।
নন্দঃ চিন্তা নেই তার আগেই ফিরব। চলরে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি!
কাঞ্চনমালাঃ ওহ্ ক্ষমা করবেন!
নন্দঃ না, না। ক্ষমা তো আমার চাওয়ার কথা। আমি অন্যমনস্ক হওয়াতে ধাক্কা লাগল। আপনার খুব জোরে লাগে নি তো?
কাঞ্চনমালাঃ একদমই না। কিন্তু আপনি কোন দেশের রাজপুত্র? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?
নন্দঃ আমি—মানে, আমি আসলে—
কাঞ্চনমালাঃ নাগাড়া বাজছে, মানে এইবার নাচ শুরু হবে আসুন আসুন!
পরীদিদাঃ কি? কেমন লাগছে গল্প? এই যে নাচের কথা বলল কাঞ্চনমালা এই নাচ সে কবে থেকে হয়ে আসছে এই উৎসবে। এই নাচ রাজ-প্রজাকে এক করে। গরীব-বড়লোক বিভেদ ভুলে সবাই এক বৃত্তে নাচে। প্রথমে সবাই এক সঙ্গে তারপর সঙ্গীর সাথে, নাচের তালের সাথে সবার সঙ্গী পদে পদে বদলায়। ঐ শোন কেমন মাদল, নাগাড়া, ধামসা, বাঁশি, জলতরঙ্গ এক সাথে বাজছে। আর ঐ দেখ কাঞ্চনমেলা কেমন নাজেহাল কিংশুককে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে।
কাঞ্চনঃ উফ্ফ্ফ্ফ্ এত তাল ভুল করলে হয় নাকি? অসহ্য!
কিংশুকঃ আসলে অচিনপুরের তালগুলো অনেক আধুনিক আমাদের এইখানকার বড্ড সেকেলে!
কাঞ্চনঃ তাহলে অচিনপুরে গিয়ে থাকুন এইখানে কি করছেন!
পরীদিদাঃ ওরে বাবা! ক্ষেপেছে রাজকন্যা! যাক গে ঐ যে মণিমালা ও চিনাংশুক।
চিনাংশুকঃ (বাজনার আওয়াজের জন্য কানের কাছে চেচিয়ে বলল) আমি কি খুব বাজে সঙ্গী? মানে নৃত্য সঙ্গী?
মণিঃ (একইভাবে) কেন বলুন তো?
চিনাংশুকঃ তখন থেকে আপনার মন নাচের থেকে বেশি রাজপুত্র দিকে আছে।
মণিঃ ক্ষমা করবেন। আসলে অবশেষে দাদাকে মন থেকে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে দেখলাম। তাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
চিনাংশুকঃ ওর সঙ্গে ছেলেটাও কেন জানি আমাকে আমার ভাইয়ের কথা মনে করাচ্ছে।
মণিঃ ভাই?
চিনাংশুকঃ হুম্ম্ম্ আমার দুখি ভাই!
পরীদিদাঃ দেখি তো রাজপুত্র কার সঙ্গে নাচছে! ওমা! এত আমাদের নন্দ! শুনি তো ভালো করে কি বলছে ওরা।
রাজপুত্রঃ (চেচিয়ে বলল) বলেছিলাম না আবার দেখা হবে। ওমন চোখ বড় বড় করে কি দেখছ? তোমায় প্রথম দেখায় চিনেছি!
নন্দঃ কি করে?
রাজপুত্রঃ (চেচিয়ে) বড্ড ভীর আর আওয়াজ এইখানে। আসো আমার সঙ্গে আসো!
নন্দঃ (অবাক হয়ে) অসাধারন! রাজপ্রাসাদের ভীতর এমন সুন্দর একটা বাগান আছে আমি তো জানতামই না!
নন্দঃ আচ্ছা তুমি আমায় চিনলে কি করে?
রাজপুত্রঃ তোমার ঐ কাজল কালো চোখ যে আমার মনে গাথা হয়ে গিয়েছে। তা তোমার নাম কি?
নন্দঃ সুনন্দ। তোমার?
রাজপুত্রঃ রূদ্রিক। (কিছুকক্ষন চুপ থাকার পর)
নন্দঃ চিলেকোঠার ঘর থেকে আকাশটা যে এত বড় বুঝতেই পারি না। কত তারা! আমার দারুন লাগছ।
রাজপুত্রঃ জানো আমার সব চেয়ে বেশি কি ভালো লাগছে?
নন্দঃ কি?
রাজপুত্রঃ এই যে তুমি আমার এত কাছে, আমি তোমাকে স্পর্ষ করতে পারছি, এর মধ্যে কি যে এক অদ্ভুত আনন্দ আছে আমি তোমায় বলে বোঝাতে পারব না।
নন্দঃ কিন্তু এইটা তো স্বপ্ন। একে তো তুমি রাজপুত্র, তার উপর—
রাজপুত্রঃ তার উপর?
নন্দঃ না তোমার জন্য তো নিশ্চয় কোন কন্যা ঠিক করবেন মহারাজ।
রাজপুত্রঃ আজ, এই মূহুর্তে থাক এই সব। আজ শুধু তারারা সাক্ষি থাকুক আমাদের গোপন সব কথার।
রাজপুত্রঃ (গান) রাতের এই তারারা জানে
মনের গোপন কথার মানে।
এই স্বপ্ন মিথ্যে জানি
তবু কেন মনে হয় এই স্বপ্ন কেই সত্যি মানিইইইইইইইইইইই!
নন্দঃ এই সত্যি মিথ্যের বেড়াজাল ভেঙ্গে ফেলো
আজ এই স্বপ্ন কে সত্যি মেনে চলো।
রাজপুত্রঃ এই সত্যি
নন্দঃ এই সত্যি
রাজপুত্রঃ এই সত্যি মিথ্যের বেড়াজাল
নন্দঃ বেএ এ এ ড়াজাল
রাজপুত্রঃ ভেঙ্গে ফেলো
নন্দঃ ভে এ এ এ ঙ্গে ফেলো
রাজপুত্রঃ আজ এই স্বপ্ন
নন্দঃ এই স্বপ্ন কে
রাজপুত্রঃ সত্যি মেনে চলো।
মেনে চলো।
নন্দঃ মেনে এ এ এ এ চও ও ও লোও ও ও
রাজপুত্র ও নন্দঃ এই সত্যি মিথ্যের বেড়াজাল ভেঙ্গে ফেলো
আজ এই স্বপ্ন কে সত্যি মেনে চলো। (২)।
(বারোটা বাজার ঘন্টা শোনা যায়)
নন্দঃ বারোটা! আমায় যেতে হবে। আমি আসি!
রাজপুত্রঃ সুনন্দ! সুনন্দ দাড়াও! সুনন্দ যেও না! সুনন্দ! (কেঁদে ফেলে) যেও না সুনন্দ, যেও না! (কাঁদতে কাঁদতে থেমে গিয়ে) একি তাড়াহুড়ো তে এক পাটি জুতো ফেলে গেল। বেশ এই এক পাটি জুতো ফেরাতেই যাবো তোমার কাছে।
মহারাজঃ ভিতরে আসব?
রাজপুত্রঃ আসুন।
মহারাজঃ তুমি কাল কাউ কে পছন্দ করলে?
রাজপুত্রঃ হ্যা, সুনন্দ বলে একজন কে।
মহারাজঃ সুনন্দ? এ আবার কার বাড়ির কন্যা?
রাজপুত্রঃ কন্যা নয়, পুত্র!
মহারাজঃ কি সব বলছ তুমি!
রাজপুত্রঃ মহারাজ আপনাকে দুটো কথা বলার আছে। এক আমার থেকে অনেক ভালো শাসক হল মণি, শুধু মাত্র মেয়ে বলে এই রাজ্যের মানুষকে এক ভালো শাসকের থেকে বঞ্চিত করবেন না। আর দুই আমাকে আর আমার জীবন সঙ্গী কে মনে থেকে মেনে নিতে পারলে আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব, না পারলে ও কোন ক্ষতি নেই কারন সে আমার জীবন সঙ্গী থাকবেই, কিন্তু আমি আর আপনার পুত্র থাকব না। চলি!
মণি-কাঞ্চনঃ দাদা আমরাও যাবো তাকে খুজতে!
মণিঃ আমি জানি সে কোথায় থাকে। তুমি এসো আমার সাথে।
কাঞ্চনঃ হ্যা দাদা চলো। আজই তোমার জুতোর মালিক কে খুজে পাবো!
চিনাংশুকঃ কিন্তু বাবা তো নন্দ কে চিলেকোঠায় আটকে রেখেছে। কাল দাদা ও কে উৎসব থেকে পালাতে দেখে বাবা কে সব বলে। বাবা কালই ওকে অস্ত্র কারাখানায় পাঠিয়ে দেবে।
মণিঃ তাহলে তো সময় খুব কম!
রাজপুত্রঃ চিলেকোঠার ঘরটা কোন দিকে?
চিনাংশুকঃ ঐ যে ঐদিকে!
রাজপুত্রঃ বেশ।
(গান) রাতের এই তারারা জানে
মনের গোপন কথার মানে।
এই স্বপ্ন মিথ্যে জানি
তবু কেন মনে হয় এই স্বপ্ন কেই সত্যি মানিইইইইইইইইইইই! (কিছুক্ষন সব চুপ)
নন্দঃ রূদ্রিক! (হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ আসে)
চিনাংশুকঃ নন্দ!
নন্দঃ ছোট্দা!
চিনাংশুকঃ যা পালা! ও এই নে তোর এক পাটি জুতো আর এক পাটি তোর অপেক্ষায় আছে!
নন্দঃ কিন্তু কাকাবাবু?
চিনাংশুকঃ (হেসে) দুই রাজকন্যার তলোয়ারের সামনে দুজনেই কাবু!
নন্দঃ ছোট্দা—
চিনাংশুকঃ ভালো থাকিস ভাই!
নন্দঃ (দৌড়াতে দৌড়াতে) ধন্যবাদ রাজকুমারীরা!
মণি-কাঞ্চনঃ ভালো থাকবেন!
নন্দঃ (হাপাতে হাপাতে) রূদ্রিক!
রূদ্রিকঃ বা পা টা দাও দেখি! এইবার বেশ লাগছে! দু-পাটি এক সঙ্গেই বেশ লাগে! আর এই এক পাটি কে একা করে যাবে না তো সুনন্দ!
নন্দঃ কখনো না!
রূদ্রিক-সুনন্দঃ (গান) এই সত্যি মিথের বেড়াজাল যে ভেঙে গেল
আমার এই স্বপ্ন যে সত্যি হয়ে গেল। (২)
পরীদিদাঃ কেমন লাগল গল্প? আবার বলবি না তো, রাজপুত্র রাজকন্যাকে পেল না কেন? আসলে কি বল তো, কখনো কখনো রাজপুত্র ভালোবাসে সুনন্দ কে। আবার রাজকন্যা ভালবাসে সুনন্দিতা কে। আর তাতে কোন দোষ নেই।
