STORYMIRROR

Sanjana Soma Guha

Children Stories Fantasy Children

3  

Sanjana Soma Guha

Children Stories Fantasy Children

মণিমালা, মুক্তামালা ও পারুল

মণিমালা, মুক্তামালা ও পারুল

17 mins
235

অনেককাল আগের ঘটনা, যখন মণিমালা-মুক্তামালার স্বামী, গুপি ও বাঘা, আবার বেরিয়ে পড়েছে দেশ ভ্রমনের উদেশ্যে। হাল্লা ও শুন্ডি, এই দুই রাজ্য চালনার ভার দুই রাজকুমারীর উপর এবং তারা সফল ভাবেই সে কাজ করছিল। সবই ঠিক যাচ্ছিল কিন্তু একদিন এক কান্ড ঘটল। 

 

সেইদিন রাজসভার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হওয়াতে শুন্ডির রাজকুমারী মণিমালা ঠিক করল তার স্বামী কে সে একখানি চিঠি লিখবে । কিন্তু অন্দরমহলে মন বসছিল না তার তাই রাজমহলের সুন্দর বাগানে এসে সে প্রকৃতির শোভাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছিল। 

 

হঠাৎ-ই রাজকুমারীর নজর যায় ঝিলের স্ফটিকের মতন জলের উপর পরে আছে একটা খুব সুন্দর বেগুনী রঙের ফুল। রাজকুমারী মণিমালার ফুলটা দেখে খুব পছন্দ হয়ে যায়। সে ঝিল থেকে ফুলটা তুলে নিজের ঘরে এনে রেখে দেয়। 

 

ফুল নিয়ে ফিরে এসে রাজকুমারী মণিমালা অনেক শান্ত বোধ করে এবং তার স্বামীকে একটা চিঠিও লিখে ফেলে। সেইদিন রাজকুমারী এই-সেই কাজের মধ্যে সেই ফুলের কথাটা ভুলেই যায়।

 

এর পরে কেটে গিয়েছে আরো কয়েকটা দিন। রাজকুমারী মণিমালা প্রায় ভুলেই গিয়েছে সেই ফুলের কথা। এর মাঝে হঠাৎ-ই তার সঙ্গে দেখা করতে আসে তার বোন, হাল্লার রাজকুমারী, মুক্তামালা। অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় দুই বোনের গল্পই শেষ হয় না। 

 

একথা-সেকথার মাঝে রাজকুমারী মুক্তামালা দেখতে পায় সেই বেগুনী রঙা ফুলটি। সে তার দিদি কে বলল, "ও মা কি সুন্দর ফুল রে দিদি," বলে সে সোনার রেকাবিতে রাখা ফুলটা তুলে নিল। হঠাৎ-ই মনে হল যেন সেই ফুল থেকে এক সুন্দর, মোহময়ী ও মোলায়েম রশ্মি বেরিয়ে আসছে।

 

রাজকুমারী মণিমালা ও মুক্তামালা দুইজনেই অবাক হয়ে দেখছিল সেই আলোরছ্‌টা। মণিমালা বলল, "আশ্চর্য তো! এই আলো তো প্রথমদিন দেখি নি।" রাজকুমারীর কথা সে না হতেই সেই ফুলের মধ্যে একটা আলোড়ন দেখা দিল। 

 

কিন্তু এই-ই শেষ নয়। আশ্চর্য হওয়ার আরো বাকি ছিল। হঠাৎ-ই ফুলটা শূণ্যে উঠে গেল। তারপর সেইখানেই একটা পাক খেয়ে কিছুক্ষন সেই জায়গাতেই ভাসতে থাকল। তারপর আসতে আসতে সেই ফুলের পাপড়িগুলো পাখির মতন ডানা মেলে সেই ফুলের কুসুম থেকে আলাদা হয়ে গেল। পুরো ঘর তখন এক অতীব সুন্দর রশ্মিতে ভরে গেল। আবার প্রত্যেকটা পাপড়ি এক জায়গায় জড়ো হল। সঙ্গে সঙ্গে এক চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া আলোয় ঠিকরে বেরল। রাজকুমারীরা নিজেদের চোখ ঢাকল। তারপর সেই আলোর প্রভাব কমলে দুই রাজকুমারী ধীরে ধীরে চোখ মেলল। 

 

কিন্তু কি আশ্চর্য? কোথায় ফুল আর কোথায় বা পাপড়ি! সামনে দাঁড়িয়ে এক সুন্দর এবং শান্ত কিশোরী। পড়নে তার বেগুনী রঙা এক শাড়ি। শ্যামবর্ণা, মিষ্টি মুখ তার, এক ঢাল কালো চুল। চোখ গুলো টানা-টানা কিন্তু বড্ড বিষন্ন। সে চারিদিকে চেয়ে দেখছে এক ভয়ার্ত দৃষ্টিতে।

রাজকুমারীরা বুঝতে পারল কিশোরী মেয়েটা ভয় পেয়েছে। রাজকুমারী মণিমালা তার কাছে গিয়ে বলল, "তুমি কে গো? আহাঃ! ভয়ে একেবারে মুখখানি শুকিয়ে গিয়েছে। তোমার নাম কি? আর এই ফুলেই বা বন্দি হলে কি করে?"

 

রাজকুমারী মুক্তামালা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, "ভয় কি তোমার? আমরা তোমার বন্ধু। আমি হাল্লার রাজকুমারী মুক্তামালা," তারপর মণিমালা কে উদেশ্য করে বলল, "আরে ইনি হলেন শুন্ডির রাজকুমারী, রাজকুমারী মণিমালা, আমার দিদি।"

 

মেয়েটি তাও কিছু বলছে না দেখে দুই রাজকুমারী তাকে নিয়ে বসাল সেই ঘরে রাখা একটি বিশাল পালঙ্কে। তারপর তাকে খেতে দিল এক বাটি গরম দুধ। গরম দুধ খেয়ে মেয়েটি একটু সুস্থ বোধ করল।

 

আবার রাজকুমারী মণিমালা জিজ্ঞেস করল, "কি হল? কি নাম তোমার?" মেয়েটি এবার যেন একটু ভরসা করল। সে বলল, "আজ্ঞে আমার নাম পারুল।"

 

মুক্তামালা জিজ্ঞেস করল, "তা পারুল, তুমি এই ফুলে ঢুকলে কি করে?" পারুল একটু চুপ থেকে বলল, "রাজকুমারী সেই কথা জানতে গেলে আগে তোমাদের এক গল্প শুনতে হবে যে।" রাজকুমারী মুক্তামালা হেসে বলল, "বেশ তো বলো না। আমরা শুনব তোমার গল্প। 

 

"বেশ," বলে পারুল তার গল্প শুরু করল।

 

কয়েক বছর আগের কথা, অচিনপুরের রাজ্‌ রাজা বিজয় বেরল দেশ ভ্রমনে। এ রাজ্য, সে রাজ্য ঘুরে রাজা এল বিচিত্রপুর রাজ্যে। দক্ষিন দিকে, পাহাড়ের একদম কোলে অবস্থিত বিচিত্রপুর রাজ্য। এবং খুবই বিচিত্রই সে রাজ্য। এই রাজ্যে শিশুরা মাঠে চাষ করে, ব্যবসা করে, সেনা বাহিনীতে বীর দর্পে নিজের দক্ষতা দেখায়, রান্না করে, ঘর সামলায় এমন কি রাজ সিংহাসনেও তারাই বসে, রাজ্য সামলায়। আর বড়রা পাঠশালায় যায়, দুষ্টুমি করে, শিশুদের কাছে বকা খায়, শাস্তি পায়। রাজা বিজয় কে দেখে তো তাই তারা প্রথমে বকতে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে রাজা এবং তার মন্ত্রীরা তাদের থামায় এবং বোঝায় বাকি সব জায়গায় এমন কোন নিয়ম নেই বরং তার উল্টো নিয়মই সেই সব জায়গায় প্রযোজ্য।

 

"সে কি রকম?" বিচিত্রপুরের শিশু রাজা জিজ্ঞেস করল।

 

"আজ্ঞে সেইখানে শিশুরা বাবা-মায়ের আদর খায়, পাঠশালায় যায়, খেলাদুলা করে, আর রাতের বেলায় মা-ঠাকুমার কাছে যখন গল্প শুনতে বসে। তখন ঘুম-পাড়ানী মাসি-পিসীরা এসে তাদের ঘুম দিয়ে যায়।" রাজা বিজয় বললেন।

 

সেই কথা শুনতে শুনতে সাত বছরের শিশু রাজা কোন এক স্বপ্নের দেশে হারিয়ে গেল। রাজা বিজয়ের কথা শেষ হলে শিশু রাজা বলল, "বাহঃ! বেশ নিয়ম তো অন্য সব রাজ্যে। কোন দ্বায়িত্ব নেই, ঝামেলা নেই, শিশুরা তো বেশ আনন্দে থাকে সেইখানে। ইশ্‌শ্‌শ্‌ আমরাও যদি তাই থাকতে পারতাম!"

 

 মহারাজ বিজয় হেসে বলল, "আর আমার কি ইচ্ছে হয় জানেন মহারাজ? আমার ইচ্ছে হয় আপনাদের এইখানকার বড়দের জীবনটা পেতে।" 

 

শিশু রাজা হেসে বলল, "বেশ হত যদি আমরা নিজেদের রাজ্য অদলবদল করে নিতে পারতাম," তারপর সে জোরে হেসে উঠল। তারপর বলল, "সে যাই হোক মহারাজ আপনি যখন প্রায় এক অন্য দুনিয়ার গল্প নিয়ে আমার কাছে এসেছেন কয়েকদিন আপনি আমার অতিথি হয়ে থেকে যান। আমার খুব ভালো লাগবে।"

 

অনেক গল্প তো রাজা বিজয়েরও শোনার ছিল তাই সে থেকে গেল।

***

এইটুকু বলে পারুল থামল। মণিমালা জিজ্ঞেস করল, "কি হল? থামলে কেন? বলো তারপর কি হল?"

 

পারুল বলল, "বলছি আগে বলুন ভোর হতে আর কতখন সময় বাকি আছে?"

 

মুক্তামালা বলল, "সবে তো সন্ধ্যে হল। এখনও তো রাতই হয় নি। ভোর হতে তো ঢের সময় আছে।"

 

পারুল একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, "বেশ বেশ। তাহলে আমি বাকি গল্পখানা বলি আপনাকে।"

 

এই বলে সে আবার গল্পবলা শুরু করল।

মহারাজ বিজয়ের বিচিত্রপুর রাজ্যে খুব খাতির পেলেন। শিশু মহারাজ অতিথি সেবায় কোন ত্রুটি রাখলেন না কিন্তু মহারাজ বিজয়ের মনে সুখ এল না। রোজকার দ্বায়িত্ব, কাজ, রাজ্যভার সামলাতে সামলাতে তিনি ক্লান্ত। কেউ যদি একদিনের জন্য তাকে এমন জীবন দিত যেখানে সে খেলে বেরাতে পারত, আবার করে গাছে চড়তে পারত, তার উপর রাজ্য-শাসনের, নিজের পরিবারের কোন দ্বায়িত্ব না থাকত তাহলে কি ভালোই না হত। রাজা খালি ভাবে একদিন যদি এই জীবন পেতাম কি খুশিই না হতাম। 

একদিন হল কি রাজা একা ঘুরতে বেরলেন বিচিত্রপুর। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এলেন এক বেশ উচু পাহাড়ের কাছে। রাজা বিজয় দেখতে পেলেন সেই উচু পাহাড়ে দেখা যাচ্ছে একখানি ছোট আলোক বিন্দু আর সেইখান থেকে ক্ষীনভাবে ভেসে আসছে একসঙ্গে অনেকগুলো ঘন্টা বাজার শব্দ। রাজার কৌতুহল হল। তিনি জোরে শিস্‌ দিলেন অমনি আকাশে দেখা দিল ধবেধবে সাদা এক ঘোড়া। তার দুই ডানা মেলে সে হাওয়া কেটে বেরিয়ে আসছে আর চারিদিক এক অতীব সুন্দর জ্যোতি তে ভরে যাচ্ছে। এই প্রানী আর কেউই নয় রাজার সবচেয়ে প্রিয় পক্ষীরাজ ঘোড়া, ইরাবন। রাজা ইরাবনে চেপে নিমেষে পৌছে গেল সেই আলোকবিন্দুর কাছে। 

রাজা বিজয় সেই উচু পাহাড়ের চূড়ায় পৌছে দেখেন এক মস্ত মন্দিরে জ্বলছে হাজার হাজার প্রদীপের আলো। আরে ছাড়িদিকে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ধুপকাঠি। কোনটা জ্বলছে, কোনটা জ্বলে জ্বলে শেষ, আবার কোনটা আর্ধেকখানিক জ্বলেই নিবে গিয়েছে। রাজা অবাক হয়ে দেখলেন মন্দিরে একটি পাথরের বিগ্রহ আছে বটে কিন্তু তাতে তেল-সিদুঁর এমনভাবে লেগেছে যে তা আসলে যে কোন দেবতার তা বোঝা দায়। যাই হোক মহারাজ তো অবাক হয়ে চারিদিক দেখছেন, তিনি লক্ষ্য করলেন বিগ্রহের সামনে বসে আছে সাদা শাড়ি পরা এক যুবতী। তার মধ্যে কিন্তু কোন শিশু সুলভ ভাব নেই। তার হাতে একটা ছোট ঘন্টা, অন্য হাতে একটি ছোট প্রদীপ। সেই যুবতী এক মনে ঘন্টা বাজিয়ে ঠাকুরের পুজো করে যাচ্ছে আর সেই ছোট্ট ঘন্টা থেকে হাজার ঘন্টার শব্দ বার হচ্ছে। মহারাজ বিজয় অবাক দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি নিজের চোখ এবং কান কে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। 

যুবতী হঠাৎ পুজো থামিয়ে পিছন ফিরে চাইলেন। তার সুন্দর, স্নিগ্ধ, ও দিপ্তীময় মুখ দেখে মহারাজ বিজয় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। আর তারই সঙ্গে ভিষন ভাবে অবাকও হলেন। এই বিচিত্রপুরের এক যুবতী হয়ে তার মধ্যে শিশু সুলভ কোন ব্যাপার নেই কেন? 

মহারাজের মনের ভাব বুঝতে পেরে যুবতী একটু হাসলেন তারপর বললেন, "মহারাজ বিজয়, আমি যে সেই পরী যে এই শিশুদের মনের সব ইচ্ছে পূরণ করেছে।"

 

মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, "কি ইচ্ছা?"

 

পরী আবারও হেসে বলল, "বড় হওয়ার ইচ্ছে। বড়দের শাসন করার ইচ্ছা!"

 

"মানে?" 

 

মহারাজ খুবই অবাক হলেন পরীর কথা শুনে।

 

"অনেকবছর আগে বড়দের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে শিশুরা আমার কাছে প্রার্থনা করে যেন তারা এইবার থেকে বড়দের শাসন করতে পারে। তাদের প্রার্থনায় আমি তুষ্ঠ হয়ে তাদের মন কামনা পূরণ করি। তারপর থেকেই এই রাজ্যে শিশুরা রাজত্ব করে, আর বড়রা তাদের শাসন মেনে চলে। এইখানে সবাই চল্লিশ বছর আব্দি বাচে। তারপর তাদের মৃত্যু হয়। এই যে ধুপগুলো দেখেছেন এই ধুপ এইখানকার প্রত্যেক বাসিন্দার নামে জ্বালানো হয়েছে। যতক্ষন এই ধুপ জ্বলে ততদিন এইখানকার বাসিন্দারা বেচে থাকে। এই ধুপের আয়ু শেষ হলে যার নামে ধুপ জ্বালানো হয় তার আয়ুও শেষ হয়ে যায়।" পরী বলল।

 

"কিন্তু কাল এইখানকার রাজার সঙ্গে কথা বলে তো মনে হল তার খুব আফশোস কারন বাকি দেশের শিশুদের মতন তাদের কোন শৈশব নেই। তার সঙ্গে কথা বলে তো মনে হল না শিশুদের প্রার্থনার ফলে এই সব হয়েছে।" মহারাজ বিজয় আবার প্রশ্ন করলেন।

 

পরী আবার হেসে বলল, "প্রত্যেক জাদুর একটা মূল্য থাকে। এই মূল্য না দিলে যে জাদুতে কাজ হয় না। সব কথা মনে থাকলে হয়ত এরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারত কিন্তু এই জাদুর মূল্য দিতে গিয়ে সবার স্মৃতি-শক্তি লোপ পেল। এদের অবস্থা আরো করুন হল। এরা ভাবল এই বুঝি জগতের নিয়ম।"

 

মহারাজ সব কথা মন দিয়ে শুনে একটু চুপ থেকে বলল, "আচ্ছা সব জাদুতেই কি মূল্য দিতেই হবে!"

 

"বিনামূল্যে এই জগৎ-এ কিছু পাওয়া যায় না মহারাজ!" পরী হেসে বলল।

 

মহারাজ কিছু বললেন না অল্প হেসে সেইখান থেকে চলে গেলেন। ততক্ষনে তার পরী কে মনে ধরে গিয়েছে। তিনি ঠিক করলেন পরী কে তিনি তার পাটরানী করবেন। সেইমত পরেরদিন তৈরী হয়ে গেলেন পরীর কাছে। পরী মহারাজের আবদার শুনে তো থ। সে কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, "মহারাজ পাগলামো করবেন না। আমরা পরীরা শিশুদের সব প্রার্থনা ও মন-কামনা পূরণ করি ঠিকই কিন্তুই তাই বলে আপনার এই মনকামন পূরণ করতে পারব না আমি।"

রাজা বিজয় বলল, "কিন্তু কেন?"

পরী বলল, "মহারাজ, আমরা সবাই যে পরী রানির পরীর দেশে থাকি। সেই তো আমাদের ঘর, বাসা, সংসার সব কিছু। সেইখানেও তো থাকে ফুটফুটে, পবিত্র কিছু শিশু, আমরা যে তাদেরই দেখাশোনা করি। আমি তাদের ছেড়ে কোথাও যাই কি করে? মহারাজ আমায় ক্ষমা করবেন কিন্তু আপনার প্রার্থনা আমি পূরণ করতে পারব না। আপনি বরং আপনার রাজ্যে ফিরে যান।"

কিন্তু মহারাজ বিজয় সেই কথা শুনলেন না। উল্টে তার জেদ বেরে গেল। শেষে একদিন মহারাজ বিজয় আক্রমন করলেন বিচিত্রপুর রাজ্য। শিশু রাজা কি আর প্রাপ্তবয়স্ক রাজা বিজয়ের সঙ্গে পেরে ওঠে। কিন্তু তাও সে বীর বিক্রমে লড়াই করল কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। তার মৃত্যু হল আর সেই সঙ্গে তার সেনা আর পরিবার বন্দী হল। আর সঙ্গে বন্দী হল সেই পরী। রাজা তাকে জোর করে বিবাহ করলেন। এবং তাকে নিজের সঙ্গে নিজের রাজ্যে নিয়ে গেলেন। 

 

পরী চেষ্টা করেও কিছু করতে পারল না। কারন পরীর সব শক্তি ছিল সেই ছোট্ট ঘন্টায় যা পরী সেইদিন মন্দিরে বাজাছিল। রাজা বিজয় তা জানতে পেরেছিলেন এবং তাই তিনি ঘন্টাটা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন তার বিশাল শক্তিশালী গদা দিয়ে। আর তারপর পরী কে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের রাজ্যে। পরী শুধু শিশু রাজ্য থেকে নয় তার পরীর দেশ থেকেও দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। সে সব শিশুদের থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য হয় যাদের সে ভালোবাসত, আর যারা তাকে ভালোবাসত।

***

"মহারাজ বিজয় অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছিলেন! তার উচিত হয় নি এইভাবে পরীকে শিশুদের থেকে আলাদা করা," রাজকুমারী মণিমালা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন। 

 

"তিনি তার পাপের শাস্তি পেয়েছিলেন এবং এখনও পাচ্ছেন। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে কিছু নির্দোষও সেই পাপের শাস্তি পাচ্ছে," পারুল একটা দীর্ঘ্নিশ্বাস ছেড়ে বলল। 

 

"মানে?" রাজকুমারী মুক্তামালা জিজ্ঞেস করলেন।

 

পারুল বলল, "বলছি শুনুন!"

***

পরী কে বিয়ে করে মহারাজ বিজয় সুখি হতে পারলেন না। কারন পরীর মনে আনন্দ, সুখ, শান্তি কিছু ছিল না। পরী সারাক্ষন রাজা কে অভিশাপ দেয় সে যেমন তার শিশুদের থেকে আলাদা হয়েছে সেইভাবে রাজাও কোনদিন সন্তানসুখ পাবে না। পরীর অভিশাপ সত্যি হয়। পরী আর রাজার কোন সন্তান হয় না।

 

রাজা সন্তান পাবার আসায় আবার বিবাহ করেন। এইবার এক রাজকন্যে কে। কিন্তু বিয়ে হয় রাজকন্যের অমতে। রাজকন্যে চাইত দেশ-বিদেশ স্বাধীনভাবে ঘুরে বেরাতে, পরীদের মতন ডানা মেলে অচেনা-অজানা অভিযানে বেরিয়ে পরতে। কিন্তু তার বাবা তার কথা শুনল না। 

 

কি আর করা। রাজকন্যা তাই মনের দুঃখে বাবার আদেশ মেনে নেন। কিন্তু রাজপ্রাসাদে এসে সে যখন তার সতীন, সেই পরীর কাছে নিজের সব মনের কথা খুলে বলল তখন পরী তাকে সাহায্য করল  রাজপ্রাসাদ থেকে পালাতে আর সে পরী রানীর ঠিকানাও রাজকন্যাকে দিয়ে দেয়। সাথে দেন একখানা চিঠি। রাজকন্যা পরী রানীর কাছে অনেক পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে তবে পৌছায়। 

 

রাজা তখন যুদ্ধে সে যখন ফেরে তখন দেখে মহল ফাকা। রাজকন্যা নেই। থাকবে কি করে? রাজকন্যা তো তখন পরী রানীর দরবারে। পরী রানী রাজকন্যার থেকে বিচিত্রপুরের পরীর চিঠি পরে সব কথা জানতে পারে, আর তখন রাগে তার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। 

 

পরী রানী বিচিত্রপুরের শিশুদের থেকে সব শুনেছিল। কিন্তু তাও মানতে চাননি। বারেবারে তার মনে হয়েছিল শ্বেত পরীর কোন অনিষ্ট হয় নি। সে ঠিক আছে। কিন্তু আজ সে জানল যে সে ঠিক নেই। তখন মহারাজ বিজয় কে উচিত শিক্ষা দেওয়ার সংকল্প করলেন তিনি। 

 

মহারাজ বিজয় আবার বিবাহ করলেন। এইবার এক বণিক কন্যাকে। সে এত দেশ-বিদেশ ঘুরেছে যে তার যাত্রায় ঘেন্না ধরে গিয়েছে। সে চায় থিতু হতে আর তাই বিয়েতে তার কোন আপত্তি নেই শুধু সে চায় সুখে সংসার করতে। এমন মেয়েকেই তো মহারাজ বিয়ে করতে চায়। তাই তাদের বিয়ে হল খুব ধুম-ধাম করে। নতুন রানী এলো রাজপ্রাসাদ আলো করে। কিন্তু রানী হয়েই বণিক কন্যার মধ্যে বদল এলো। সে আয়েসী, ভোগী ও লোভী হয়ে উঠল। রাজ্যের মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হওয়ার জোগাড়। অবশেষে এমন একদিন এলো যখন লোভী ও ভোগী বণিক কন্যা, রাজার পাটরানীর, উপর প্রজারা ক্ষেপে গেল। অবস্থার বেগতিক দেখে রাজা বিজয় তাকে বনবাসে পাঠিয়ে দিলেন এবং সেইখানেই প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে সেই বণিক কন্যার মৃত্যু হল।

 

রাজা আবার বিবাহ করলেন কিন্তু সেই বিয়েও স্থায়ী হল না। রাজা আরো দুইবার বিবাহ করলেন কিন্তু কোন বিয়েই বেশি দিন টিকল না। পরী আর পরী রানীর অভিশাপে ছ'বার বিবাহ করার পর ও রাজার কোন সন্তান হল না। শেষে রাজা গেলেন তার গুরু কাছে যদি তিনি কিছু করতে পারেন। গুরু তার কন্যার সঙ্গে রাজার বিয়ে দিলেন। গুরু কন্যা সর্বগুণ সম্পন্না এক নারী। তার মধ্যে কোন কিছুরই অভাব নাই, সে রাজা কে ভালোবাসে, নির্লোভ দয়ালু এবং সব দিকে সুলক্ষনা। এমনই রানী তো মহারাজ বিজয় খুজছিলেন। অবশেষে রাজার মনে সুখ এলো। 

 

আসতে আসতে রানী সন্তান সম্ভবা হলেন। রাজার খুশি আর ধরে না। এর মধ্যে কিন্তু পরীর মধ্যে অনেক বদল এসেছে। সে আর আগের মতন রাজা কে গাল দেয় না। তার আর রাজার মধ্যে একটা যেন সন্ধি হয়েছে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব না হলেও তারা একে-ওপরকে সহ্য করে নেয়। কিন্তু পরীর সঙ্গে ছোট রানী, অর্থাৎ রাজার সপ্তম রানীর খুব ভাব হল। তাই ছোট রানী যখন সন্তান সম্ভবা হলেন তখন পরী, বড় রানী হিসাবে ছোট রানীর সব দ্বায়িত্ব নিল এবং বড় দিদির মতন ছোট রানীর খেয়াল রাখতে লাগল।

 

পরী ছোট রানীর ঘরের সঙ্গে রাজ সভার যোগ স্থাপন করার জন্য একটা একটা দড়ি তে ঘন্টা বেধে দিল। ঘন্টা রইল রাজার দরবারে বা সভায় আর দড়ির দিক রইল ছোট রানীর ঘরে। ঠিক হল, সন্তান হলে বড় রানী, মানে সেই পরী, দড়ি নাড়িয়ে দেবে আর তখনই ঘন্টা বাজবে রাজ সভায় আর রাজা ঠিক সেই খবর পেয়ে যাবে। 

 

আসলে পরী যেইটা বলেনি তা হল এই দড়ির গুণের কথা। এই দড়ি পরী কে দিয়েছিল তারই রানী, পরীদের রানী। এই দড়ি মায়াবী দড়ি। এই দড়ি ধরে টান মারলে রাজার সন্তান চলে যাবে পরীর দেশে আর তার বদলে কোন জন্তু চলে আসবে তার জায়গায়।

 

ব্যাস এইভাবে ছোট রানীর কোলে আটবার সন্তান এলো। সাত'বার এলো সাতটি ফুটফুটে ছেলে আর শেষে এলো এক মিষ্টি মেয়ে। কিন্তু প্রতিবারই তারা গেল পরীর দেশে আর তার বদলে এলো ব্যাঙ্গ, কুকুরের মতন সব জীব। 

 

রাজা আবার সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত হলেন। পরী কে তিনি এইবার কারাগারে বন্দী করলেন কারন তিনি বুঝলেন এই সবের পিছনে নিশ্চয়ই পরী আছে। কিন্তু পরী কে বন্দী করার পর ও তার রাগ কমল না। এবং তার সব রাগ গিয়ে পড়ল ছোট রানীর উপর। তিনি তাকে রাজপ্রাসাদ থেকে দূরে তাড়িয়ে দিলেন। সে বেচারী ঘুটে কুড়ানী হয়ে রাজ্যের এক কোনে পরে রইল কারন তখন তার বাবার, মানে রাজার গুরুর, মৃত্যু হয়েছে। তাই তার কাছে গিয়েও আশ্রয় পাবার কোন উপায় নেই। 

মণিমালা পারুলের সব কথা মন দিয়ে শুনছিল। সে এইবার বলল, "কিন্তু পারুল এই সবের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? তুমি কে?"

 

পারুল বলল, "আমি সেই ছোট রানীর মেয়ে, পারুল। আমার জন্মের পর আমি চলে যাই পরীর দেশে। আমার ভাইদের সঙ্গে। সেইখানেই ষোলো বছর কাটাই। তারপর একদিন হঠাৎ এক ঘুটে কুড়ানীর কান্না আমাদের কানে আসে। আর আমাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। পরীদের রানীর কাছে আমাদের এই বেদনার কারন জানতে চাইলে প্রথমে সে না বললেও পরে আমাদের সব বলতে রাজী হয়। পরী আর রাজার এই লড়াই-এ কে বেশী দোষী, কে কম আমরা জানি না। কিন্তু এই সবের মধ্যে কষ্ট পাচ্ছে আমাদের মা আর আমরা সেইটা মেনে নিতে পারছি না।"

মণিমালা আবার জিজ্ঞেস করল, "তুমি এই ফুলে বন্দি হলে কি করে?" 

পারুল বলল, "পরী রানী কে আমরা অনেক অনুরোধ করাতে তিনি আমার সাত ভাই কে চম্পা ফুল আর আমাকে পারুল ফুলে বদলে দিয়ে রাজা বিজয়ের বাগানে রেখে দিলেন। সেইখানেই আমরা এতদিন ছিলাম আর সেইখানেই আমরা তোমাদের কথা শুনি। জানতে পারি তোমরা তোমাদের উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহস দিয়ে এর আগে অনেক রাজা, মন্ত্রী ও সাধারন মানুষের উপকার করেছ। তাই আমি তোমাদের কাছে এসেছি সাহায্য চাইতে।"

 

মুক্তামালা বলল, "তাহলে সেই কথা আমার দিদি কে প্রথম দিনই বলো নি কেন?"

 

পারুল বলল, "ফুল হয়ে ভেসে ভেসে তো এলাম এই রাজ্যে কিন্তু ঠিক জায়গায় এসেছি কিনা বুঝব কি করে? তারপর এসে দেখি একজন মাত্র রাজকুমারী। ভয় পেলাম। কি জানি বাবা ঠিক রাজকুমারীর জায়গায় এলাম তো? শুন্ডির বদলে ঝুন্ডি চলে যায় নি তো?" 

 

মণিমালা, "তাই মুক্তার আসা আব্দি অপেক্ষা করলে?" পারুল মাথা নাড়ল, তারপর বলল, "এক সপ্তাহের মধ্যে আপনার বোন না এলে আপনাকেই সব কথা খুলে বলতাম তারপর যা হত দেখা যেত।"

 

মুক্তামালা বলল, "তা বলো এখন তুমি কি সাহায্য চাও আমাদের থেকে?"

 

পারুল বলল, "আমরা শুধু আমাদের মা কে চাই আর কিছু চাই না!"

 

মণিমালা আর মুক্তামালা অনেকক্ষনি কিছু ভেবে বলল, "আচ্ছা তোমাদের পরী রানীর সঙ্গে দেখা করা যাবে?"

 

পারুল, "হ্যা যাবে তো! তোমরা কথা বলবে?"

 

মণিমালা, "হ্যা গো, বললে বেশ হয়।"

 

পারুল বলল, "বেশ!"

 

***

অচিনপুরের রাজার বাগানের মালি সকালে বাগানে এসেছে রাজার প্রিয় ফুল তুলতে। হঠাৎ তার চোখ যায় সাতটা উজ্জ্বল চম্পা ফুল ও একটি পারুল ফুলের দিকে। সে তাড়াতাড়ি ফুল পারতে গেলে সেই সাতটা চম্পা ফুলের ডাল ও তার সঙ্গে পারুল ফুলের ডালটাও উপরে উঠে যায়। মালি তো অবাক! সে তাড়াতাড়ি রাজাকে খবর দেয়। রাজা আসে এবং এইবার সে ফুল তুলতে যায়। কিন্তু ফুল আবার উপরে উঠে যায়। রাজা এইবার বন্দী পরী কে ডাকে আনে এবং তাকে ফুল তুলতে আদেশ দেয়। কিন্তু ফুল এইবারও উপরে উঠে যায়। রাজা এর আগে যে সব মহিলাদের রানী করে এনেছিল তাদের সবাই কে খুজে বার করে তাদের বলে ফুল তুলতে বলে, সবাই চেষ্টা করে কিন্তু যতবারই ফুল তুলতে যায় ফুল উপরে উঠে যায়। শেষে দেখা যায় দেখা যায় সাতটা চম্পা ও একটি পারুল ফুল আকাশে তারার মতন ঝলমল করছে। সেই সময় হঠাৎ দুই নারী সেই ঘুটে কুড়ানী মানে মহারাজের সব চেয়ে ছোট রানী কে নিয়ে আসে। ঘুটে কুড়ানী আসতেই সাতটা চম্পা ও একটা পারুল ফুল নীচে নেমে আসে এবং কিছুক্ষন পর সবাই দেখে ঘুটে কুড়ানী কে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাতটা কিশোর ও একটি কিশোরী।

 

রাজা কিছুক্ষন অবাক হয়ে থেকে বলে, "তোমরাই কি আমার সেই সন্তান যাদের আমি হারিয়েছিলাম?" পারুল বলে, "হ্যা মহারাজ!" রাজা তাদের বুকে জড়াতে গেলে সাত ভাই ও পারুল পিছিয়ে যায়। সাত ভাই বলে, "তোমার জন্য আমাদের মা কষ্ট পেয়েছে।" পারুল বলে, "ঠিক কথা। তাই আমরা তোমার কাছে যাব না।" 

 

রাজা তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঘুটে কুড়ানীর কাছে ক্ষমা চায়। তখন ঘুটে কুড়ানী মানে আমাদের ছোট রানী বলে, "মহারাজ আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারি যদি আপনি আর একজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে আপনার ভুল স্বীকার করেন।"

 

রাজা বিজয় অবাক হয়ে বললেন, "কার কাছে?"

 

এইবার যে দুই নারী ঘুটেকুড়ানী কি নিয়ে এসেছিল তারা সামনে এলো। এ আমাদের অতি প্রিয় রাজকুমারী মণিমালা ও রাজকুমারী মুক্তামালা। তারা নিজেদের পরিচয় মহারাজ কে দিয়ে বলল, "মহারাজ আপনি মোটে ষোলোটা বছর, মাত্র আট সন্তানের থেকে দূরে থেকে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছেন কি ঠিক কি না?"

 

রাজা বিজয় বিমর্ষ মুখে বলেন, "আমি মরে বেচেছিলাম রাজকুমারী!" মুক্তামালা হেসে বলে, "তাহলে একবার ভাবুন তো এত গুলো বছর পরী তার কতগুলো সন্তানের থেকে দূরে ছিল শুধুমাত্র আপনার জেদের কারনে। সে তার ঘর, পরিচয় এমন কি তার মায়াবী শক্তি ও হারিয়েছে। কেন? শুধুমাত্র আপনার প্রস্তাবে না বলার জন্য। আপনি শুধু পরী নন এমন কি বিচিত্রপুর রাজ্যের শিশুদেরও কষ্ট দিয়েছেন, তাদের বন্দী করেছেন। এ কি ঠিক করেছেন মহারাজ?"

 

মহারাজ বিজয় তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতাপে জর্জরিত হয়ে পরীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। পরী কিন্তু অত সহজে গলে না তখন মণিমালা বলে, "পরী, মানছি রাজা তোমার সঙ্গে অন্যায় করেছে। কিন্তু সত্যি করে বলো তো তুমি কি কারোর সঙ্গে কোন অন্যায় করো নি? এই যে ফুলের মতন শিশুরা তাদের মা-বাবা কে ছাড়া বড় হলো এতে কি তাদের সত্যিই কোন দোষ আছে? এই যে আজ ছোট রানী ঘুটে কুড়ানী হয়ে জীবন কাটাচ্ছে কেন? এ জীবন কি সত্যিই সে চেয়েছিল?" পরী বুঝল ভুল সেও করেছে। তাই সে রাজা কে ক্ষমা করল কিন্তু তাও তার মুখে হাসি দেখা দিল না।

 

তখন মুক্তামালা বলল, "জানো পরী কাল তোমাদের রানী আমাদের একটা কথা বলল। তুমি তোমার জাদুই ক্ষমতা হারানোর পর সে অনেক বই, অনেক পুঁথি পরে এইটা জানার জন্য কি ভাবে তুমি তোমার সব ক্ষমতা ফেরত পেতে পারো, কি ভাবে তুমি আবার পরীর দেশে ফিরে যেতে পারো। বেশীর ভাগ পুথিঁতেই কোন উত্তর ছিল না কিন্তু একটি অতি প্রাচীন পুঁথিতে লেখা ছিল ক্ষমা এমন এক গুণ যা মানুষ কে পরিণত করে আর পরীদের নিজেদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে সাহায্য করে।"

 

এই কথা শুনে পরীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মণিমালা বলে, "এই কয়েক বছরে তোমার মনের সব আলো নীভে গিয়ে কারাগারের অন্ধকার সেই জায়গা নিয়েছিল। পরীর রানীর মনও তাই উদাস হয়ে গিয়েছিল, তাই তো পরীর দেশ কালো মেঘে ভরে গিয়েছিল। সেইখান কার শিশুরা কতকাল সূর্য দেখে নি। অন্ধকারে তো সব পরীর ক্ষমতা হারিয়েছিল। কিন্তু যেই মূহুর্তে এই আট শিশু তাদের মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার পাওয়ার পরিকল্পনা করে অন্ধকার কেটে যেতে থাকে, আর পরী রানীর সঙ্গে আমাদের কথা বলাও সহজ হয়ে যায়। এইবার দেখো তো তোমার সব ক্ষমতা তুমি ফেরত পেয়েছ কিনা?"

 

পরী এইবার ছোট রানীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আলতো করে তার মাথায় হাত রাখে, ওমনি ছোট রানীর ঘুটে কুড়ানীর ময়লা, গন্ধওয়ালা কাপড় কোথায় হারিয়ে যায়। তার জায়গায় আসে দামি শাড়ি, গহনা, মুকুট, তাকে আবার রানীর মতন দেখতে লাগে। 

 

তারপর? তারপ আর কি? রাজা পরীর পা ধুয়ে তার কাছে ক্ষমা চায় আর বিচিত্রপুরের সবাই কে বন্দী দষা থেকে মুক্তি দেয়। বিচিত্রপুরে আবার স্বাধীন এক রাজা কা পায় তবে এইবার আর শিশু রাজা নয়। শিশুরা এইবার বাকি রাজ্যের শিশুদের মতন জীবন চেয়েছে তাই আবার বিচিত্রপুরে শিশুরা হয়েছে শিশু, আর বড়রা হয়েছে বড়। 

পরী রানীর পরীর দেশে সব কালো মেঘ উড়ে গিয়ে দেখা দিয়েছে রোদ ঝলমলে সকাল। সূয্যি মামা বাচ্চাদের কাছে এসে তাদের সঙ্গে খেলা করে গিয়েছে। 

 

আর পারুল আর তার সাত ভাই? তারা তাদের মা-বাবাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে মেতেছে। রাজা বিজয় ঠিক করেছে আর কোনদিন কারোর উপর জোর-জবরদস্তি করে তাকে কষ্ট দেবে না। সবার মতামত কে শ্রদ্ধা জানিয়ে তা মেনে নেবে। রাজার এই পরিবর্তনে ছোট রানী ও খুব খুশি।

 

আর রাজকুমারী মণিমালা ও মুক্তামালা? তারা ফিরে গিয়েছে তাদের নিজ নিজ রাজ্যে, অনেক কাজে সেইখানে। প্রজাদের সকল কে দেখে রাখতে হবে তো?  


Rate this content
Log in