পরিবেশ ও ওয়ান্ডার গ্যাস
পরিবেশ ও ওয়ান্ডার গ্যাস
কি এই ওয়ান্ডার গ্যাস? নামটা কি খুব অপরিচিত লাগছে? আসলে এটা আর কিছুই না.. আমাদের অতি পরিচিত CFC ( ক্লোরোফ্লুরোকার্বন).... "ওজন হোল" এর জন্য দায়ী যে গ্যাস। "ওজন হোল" এই শব্দটার সঙ্গে কমবেশি আমরা আজ সবাই পরিচিত।
এই CFC এর আরও একটা ভূমিকা হল... উষ্ণায়ন' এর ক্ষেত্রে CFC এক বড় খলনায়ক। আজ একথা প্রমাণিত যে বিশ্ব উষ্ণায়নে কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাসের তুলনায় CFC গ্রিনহাউস গ্যাস হিসাব অনেক বেশি শক্তিশালী। ( চিত্রে গ্রাফটি দ্রষ্টব্য)।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে 1980 সালে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা এক ভবিষ্যৎ বানী করেছিলেন যে .. " আগামী দিনগুলিতে এই গ্রহের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে তবে এই তাপমাত্রার বৃদ্ধি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি হবে উত্তর মেরু(সুমেরু) অঞ্চলে।
চল্লিশ বছর পরে আজ এই 2020 তে এসে কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ বাণী র যাথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা দেখেছি ... এই গ্রীষ্মে উত্তরমেরু অঞ্চলে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ... রেকর্ড পরিমাণ বরফের গলন (আর্কটিক সাগরে ভাসমান বরফ) আর তার ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্যে আঘাত।
সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি আর্কটিক অঞ্চলভুক্ত কানাডার ইগালুইট শহর, যেখানে সারা বছরের গড় তাপমাত্রা থাকে 1degC সেই শহরে এই গ্রীষ্মে তাপমাত্রা এতটাই বেড়েছিল যে শহরের বিভিন্ন স্থানে জলের পাইপ ও নিষ্কাশনী পাইপ গুলোতে ফাটলের সৃষ্টি হওয়ার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
এখন প্রশ্ন হল কি কারণে এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর মেরু অঞ্চলের এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি যে শুধু মেরু অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা তো নয়.. এর প্রভাব যে সারা বিশ্বে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়।
আমরা জানি বায়ুমন্ডলের উপরিভাগে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অঞ্চলে যে ওজনের স্তর আছে সেই
স্তর ভূপৃষ্ঠ কে রক্ষা করে সূর্যের বিপজ্জনক অতিবেগুনী রশ্মির হাত থেকে। আর এও জানি বিলাসবহুল আধুনিক জীবন যাপনের কল্যাণে কি বিপুল পরিমান CFC, হ্যালোনস ও সম্পর্কিত আরো কিছু রাসায়নিক বাতাসে মিশে নিঃশব্দে ক্ষয় করে চলেছে আমাদের রক্ষাকারী এই ওজনের স্তরকে। আর এ ক্ষয়িত ওজন স্তরকেই বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ওজন হোল।
ওজন হোল কিন্তু সেই অর্থে কোন হোল বা গহ্বর না। এ হল ওজন স্তরের সেই অংশ যেখানে ওজনের ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত অনেক কম। আর এই ওজন হোল প্রধানতঃ উল্লেখ্যোগ্য ভাবে সৃষ্টি হয় অ্যান্টার্কটিকা অর্থাৎ দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে। আর এই ওজন হোলের বিস্তৃতি হয় 20-25 কোটি বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে(যা আয়তনে গ্রীণল্যান্ডের আয়তনের তিন গুণ)। একই রকম ওজন হোল উত্তর মেরু অঞ্চলেও সৃষ্টি হয় .... তবে তা আয়তনে অনেক অনেক ছোট। এর কারণ আমরা জানি দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের তুলনায় উত্তর মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি। এর আগে উত্তর মেরু অঞ্চলে শেষ উল্লেখ্যোগ্য পরিমান(sizable) ওজন হোল সৃষ্টি হয়েছিল 2011 সালে।
অতএব বিপজ্জনক ওজন হোল বলতে আমরা যা বুঝি তা অ্যান্টার্কটিকার ওপরে সৃষ্ট ওজন হোল। খুব সংক্ষেপে বলি CFC কিভাবে ওজন হোল তৈরি করে। কেনই বা ওজন হোল তৈরি হয় মেরুঅঞ্চল এর ওপরেই।
CFC একটি আদর্শ গ্যাস(ideal gas).. তাই এই গ্যাস বাতাসের সঙ্গে সর্বত্র ভেসে বেড়ায়... অবাধে পৌঁছে যায় মেরু অঞ্চলেও। শীতকালে
মেরু অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা যখন প্রায় -80 deg C এ নেমে যায়, তখন সেখানের জমে যাওয়া মেঘের জলকণার (ice particles)ওপর CFC গ্যাসের অনুগুলো শোষিত হয়ে থাকে। এরপর বসন্তের সমাগমে উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বরফকণাগুলো
গলে যায় আর তখন শোষিত CFC অনু গুলো মুক্ত হয়ে যায়। এই মুক্ত CFC অনুর দল এবার বসন্তের উজ্জ্বল সূর্যালোক থেকে UV রশ্মি শোষণ করে বিয়োজিত হয় এবং অতি সক্রিয় একাধিক ক্লোরিন পরমানু তৈরি করে। আর এই অতি সক্রিয় ক্লোরিন পরমানু গুলো(nascent chlorine) অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে জমে থাকা ওজন স্তরের ওজনের অনু গুলোকে ভেঙে ফেলতে শুরু করে এক স্বতঃপ্রণোদিত ধারাবাহিক বিক্রিয়ার(self sustaining chain reaction) সাহায্যে। এই পদ্ধতিতে মাত্র একটা CFC গ্যাসের অনু সর্বাধিক এক লক্ষ ওজন অনুকে ধ্বংস করতে পারে।
এবার আসি অতি সংক্ষেপে একটু "মনট্রিল চুক্তি" প্রসঙ্গে। এই সেপ্টেম্বরেই 1987 সালে বিখ্যাত মনট্রিল চুক্তি(Montreal protocol) সম্পাদিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক এই চুক্তিতে CFC, Halons ইত্যাদি সমস্তরকম 'ওজন হোল' সৃষ্টিকারী রাসায়নিকের উৎপাদন, আমদানি ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছিল। বিশ্বের 197 টি দেশের এই চুক্তিতে সাক্ষর ও উৎসাহী যোগদান ... এক অভূতপূর্ব সাফল্য এনেছে ওজন হোল' এর মোকাবিলায়।
একথা অনস্বীকার্য যে মনট্রিল চুক্তির ফলস্বরূপ সমগ্র বিশ্বের আবহাওয়ায় CFC , Halons ও অন্যান্য ওজন হোল সৃষ্টিকারী গ্যাসের নিষ্ক্রমণ উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে।
তবে "বাতাসে CFC র উপস্থিতির ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় " এই সম্ভাবনার দিকটা সেই সময় বিজ্ঞানীদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে বাতাসে প্রকৃত পক্ষে CFC এর পরিমাণ কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমানের থেকে অনেক অনেক গুণ কম। কিন্তু প্রকৃত হিসাবে দেখা গেছে... একটি CFC অনুর তাপধারন ক্ষমতা একটি কার্বনডাইঅক্সাইড অনুর থেকে প্রায় 11,000 গুণ বেশি।
আর আরো একটা বিশেষ উল্লেখ্যোগ্য বিষয় হল.. CFC যৌগের অনুগুলো বাতাসে 45-100 বছর সময় পর্যন্ত ভেসে বেড়াতে সক্ষম। তাই যদিও আজ বাতাসে CFC নিষ্ক্রমণের পরিমান প্রায় শূন্যের কাছাকাছি ঠেকেছে তবুও অতীতের ভেসে থাকা CFC অনুদের সৃষ্ট ওজন হোল'গুলির মেরামত হতে যেমন আরো বহু বছর সময় লাগবে তেমনই ঐ ভেসে থাকা অতি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস
হিসাবে CFC এর এফেক্ট এর মোকাবিলা ও চালু রাখতে হবে আরো কয়েক দশক।
তবে প্রকৃতির রক্ষনাবেক্ষণের ভার কিছুটা বোধ হয় প্রকৃতি নিজের হাতেই নিয়ে নেয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য করি MAY 1, 2020 তে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট..
An unprecedented ozone depletion in the Northern hemisphere(Arctic) has healed, but unlikely due to the impacts of world wide Corona virus lockdowns, scientists say. A "record level" ozone hole over the arctic ... the biggest since 2011.. has now closed-- the UN World Meteorological Organization(WMO).
এত বিশাল মাপের 'ওজন হোল' এর এই স্বমেরামত(self repairing ) এর কারণ এখনো পর্যন্ত কিন্তু আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের গবেষণা স্তরেই আছে।
তথ্যসূত্র :--
Ozonewatch.gsfc.nasa.gov
www.climate.gov ... event tracker
www.frostpost.com. ... Science
www.soest.hawali.edu..
mguidry
Nunavut.THE CANADIAN PRESS/sean.Kilpatrick