Partha Pratim Guha Neogy

Others

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Others

লেখিকার পত্র

লেখিকার পত্র

5 mins
311


আজ বাড়ি ফেরার পথে রোজকার অভ্যাসবশে লেটার বক্সটা চেক করতে গিয়ে দেখলাম,অনেকদিন পর লেটারবক্সে একটা চিঠি এসেছে। আজকাল তো নেটের দুনিয়ায় কেউ চিঠি লেখে না, ই - মেল করে। তবে পুরোন দিনের মানুষের মত চিঠি পাবার একটা রাস্তা আমি খোলা রেখেছি, অবশ্যই সেটা মূলত পত্রিকার লেখার জন্য। নিয়ম করেই দিয়েছি পত্রিকায় লেখা পাঠাতে হলে মেল করে নয়, ডাকযোগে পাঠাতে হবে। চিঠিতে নিজের হাতে লেখা গল্পের মধ্যে লেখকের নিজস্ব অনুভূতির একটা ছোঁয়া থাকে যেটা মনটাকে একটা আনন্দে ভরিয়ে দেয়। এই অনুভূতিটা পড়তে পারলে গল্পটাও বুঝে নিতে সুবিধা হয়।


দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সোনারপুর থেকে লিখেছে কোন এক অনামী পত্রলেখিকা। চিঠির বক্তব্য মোটামুটি এরকম- আমি কোন গল্পকার নই, সাধারণ এক তরুণী । গল্প পড়তে ভালবাসি। গল্প লিখে নাম করব এমন কোন বাসনা নেই। আমার অনুপ্রেরনার মূল উৎস যিনি সেই স্যার বলতেন – ‘গল্প লেখাটা অনেকটা তাস খেলার মতন। তুমি কোন তাসটা খেলবে আর কোন তাসটা ধরে রাখবে সেটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে। গল্পের যেটা চমক সেটাই হল ট্রাম কার্ড। ওটাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। ওটা আগে খেলে দিলে গল্প পড়ার আসল আনন্দটাই মাটি।’

স্যারই আমার আসল গুরুদেব। তিনি শুধু গল্প লিখতেন না জীবনের কথা বলতেন। তাঁকে আমার জীবনে পাওয়াটা মস্ত বড় প্রাপ্তি। তিনি যেভাবে আমাকে কলম ধরতে শিখিয়েছেন সেভাবে আর কেউ শেখাননি। তবে স্যারের কথা পরে, আগে নিজের কথা বলি। প্রতিটা মানুষের মত আমার জীবনেরও একটা গল্প আছে। এটা সেইরকমই এক গল্প। তবে আগেই বলেছি আমি তো নামী লেখিকা বা বাচিক শিল্পী নই তাই সেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে পারি না। আমার লেখা এর আগে কোন পত্রিকাতে প্রকাশও পায়নি। তবু সাহস করে আপনাদের মত বড় পত্রিকাতেই গল্পটা পাঠালাম। এর একটাই কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি প্রথম থেকে শেষ অবধি গল্পটা পড়বেন। অন্যান্য সম্পাদকের মত অনামী গল্পলেখক দেখে লেখাটা ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন না।

যারা লেখালিখি করেন অথবা নাও করেন আমার স্যারের নাম শোনেননি এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে, তাই ওনার নামটা উল্লেখ করলাম না । যবে থেকে গল্পের বই পড়া অভ্যাস করেছি তবে থেকে আমি তাঁর অন্ধ ভক্ত। বেশ মনে আছে মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে পড়ার বইয়ের নীচে ওনার গল্পের বই নিয়ে বসতাম। পড়ার লাইব্রেরীতে আমি শুধু স্যারের বই-ই খুঁজতাম। এইভাবে পড়তে পড়তে কবে যে ওনার অন্ধ ভক্ত হয়ে গেলাম নিজেই জানি না। খুব ইচ্ছে হত যদি একবার ওনার দেখা পেতাম তাহলে পায়ের ধুলো মাথায় নিতাম। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব জানতাম না। স্যারকে টিভিতে দেখতাম, খবরের কাগজের ছবিতে দেখতাম, বইমেলার অনুষ্ঠানেও দূর থেকে দেখেছি কিন্তু কাছে যাবার সুযোগ হয়নি।

একদিন অপ্রত্যাশিতভাবেই সুযোগ এসে গেল। আমার কলেজের এক বন্ধু কথায় কথায় জানাল ও নাকি স্যারের পাড়াতেই থাকে। ব্যাস হাতে যেন চাঁদ পেলাম । স্যারকে সামনে থেকে দেখব, অটোগ্রাফ নেব, ওনার সাথে একসাথে ছবি তুলে ফেসবুকে ছাড়ব। মনে মনে একটা ভয়ও আছে কেমন মানুষ হবেন উনি। এত গুণী মানুষ যখন নিশ্চয়ই খুব গম্ভীর হবেন। অকারণে হ্যা হ্যা করবেন না। বোকার মত প্রশ্ন করলে ধমক খাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

সামনে যেতেই সব ভয় গেল কেটে। কী সহজ, সরল ব্যবহার। বেশ মজার মানুষও। কথায় কথায় জানতে চাইলাম – লেখালিখির জগতে কেন এলেন?

ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন – আসতে চাইনি একদমই। ইচ্ছা ছিল রাখাল বালক হব। বাঁশি বাজাব আর গরু চরাব কিন্তু বাপ- মা অদ্ভুত ইচ্ছার কথা শুনে এমন কড়া চোখে তাকাল যে সে ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিতে হল। তবে এখন বুড়ো বয়সে সেই ইচ্ছেটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এখন মনের সুখে গরু চরাই।


সেকি! আপনি গরু চরান?হ্যাঁ চরাই তো। ওই যে কথায় আছে না গল্পে গরু গাছে ওঠে। আমাকেও তো গল্পে গরুকে গাছে চরাতেই হয়

ওনার কথা শুনে আমরা দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠলাম।

সেদিনের পরিচয়ের সূত্র ধরে বেশ কয়েকবার গেছি ওনার বাড়ি। গল্প নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। ওনার উৎসাহে একটা গল্প লিখেও ফেললাম। লিখে নিজেরই বেশ লাগল। ওদিকে আমার আর তর সইছে না। স্যারকে গল্পটা না পড়ানো অবধি শান্তি নেই। পরদিনই ছুটলাম স্যারের বাড়ি।


নাটকীয়ভাবে পড়লাম গল্পটা। গল্প বলা শেষ হলে স্যারের মুখের দিকে তাকালাম। উত্তরের প্রতীক্ষা করছি। ব্যগ্র প্রতীক্ষা। স্যার শুনে ভালোই বললেন। আরো ভালো লেখার কথা বললেন। এটাও বললেন প্রথম প্রচেষ্টা হিসাবে ভালোই। তবে আমি যেরকম উচ্ছ্বাস আশা করেছিলাম সেরকম কিছুই দেখলাম না। তবু যে সময় নিয়ে গল্পটা শুনলেন আর আমার মত একজন তরুণীকে গল্প লেখায় উৎসাহিত করলেন এটাই বা ক’জন করেন?


এদিকে দিন যত গড়াচ্ছে স্যারের ব্যস্ততাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। লেখার চাপের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র- পত্রিকা, বই প্রকাশের অনুষ্ঠান থেকেও ডাক আসছে মাঝে মধ্যেই। অনেক সম্মাননাও পাচ্ছেন। এর মধ্যে সবথেকে বড় যে খবর সেটা হল সর্বভারতীয় কথাসাহিত্য পুরস্কারের জন্য স্যারের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। অত্যন্ত সম্মানের এই পুরস্কার সাহিত্যিকদের কাছে মস্ত বড় এক প্রাপ্তি। সেরা একটি গল্পকে মনোনীত করে তাঁর স্রষ্টাকে সম্মানিত করা হয়। এমন আনন্দের খবরে আমার ছাতি ছয় ইঞ্চি বেড়ে গেছে। এমন গুণী একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি সেটা কম কথা নাকি?


ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যারের আচরণেও একটু বদল এসেছে। দেখা করার কথা বললে স্যার এখন সরাসরিই বলেন – ‘এখন একদম সময় হবে না বুঝলি , প্রচুর চাপে আছি।’ সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি তো খবরের কাগজে রোজ দেখতেই পাচ্ছি আজ এখানে তো কাল সেখানে ছুটছেন। তার ওপর নিজের লেখালিখি আছে। আমার মত মানুষের সাথে ফোনে যে দু’মিনিট কথা বলেন সেটাই অনেক। আমার প্রাপ্তির ভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে যায়।


ভেবেছিলাম সম্মাননা প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে স্যার আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। আমার থেকে বড় গুণমুগ্ধ তার আর কেউ আছে নাকি? কিন্তু আসার কথা বললেন না যখন একটু মনোকষ্ট পেলাম। মনকে বোঝালাম, এত ব্যস্ততার মধ্যে ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে স্যার সম্মাননা পাবেন আর আমি থাকব না এটা হয় নাকি? স্যার বলুন বা নাই বলুন আমি যাব।


প্রবেশ অবাধ, তাই অনুষ্ঠান দেখতে কোন অসুবিধা হল না। সাহিত্যজগতের বহু গুণীজনের উপস্থিতিতে স্যারকে সম্মানিত করা হল। উত্তরীয় পরিয়ে স্যারের হাতে যখন স্মারক তুলে দেওয়া হল স্যার জানতেও পারলেন না তখন পিছনের সীটে বসা মেয়েটার চোখ দুটো আনন্দে চিকচিক করছে।


সম্মাননার পর গল্পপাঠের আসর। পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পটাই পাঠ করলেন স্যার। স্তব্ধ হয়ে শুনছি গল্পটা। স্যারের বাগ্মিতায় পলক পড়ছে না কারোর। চমক ভাঙল গল্প শেষ হবার পর। হাততালির আওয়াজ কমে এসেছে। আচমকা আমার বেমানান হাততালির শব্দটা বোধহয় স্যারের কান অবধি পৌঁছাল!

এই হল আমার গল্প। এই গল্প আপনি প্রকাশ করতে পারেন, আবার নাও পারেন। যদি না করেন তাহলেও কোন দুঃখ নেই। আমি তো কোন বড় গল্পকার বা লেখিকা নই। তবে স্যার বলতেন কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়। আমিও অনেক কিছু হারিয়ে একটা গল্প পেয়েছি, জীবনের গল্প। এরকম অনেকের জীবনের গল্পই হয়তো শেষ অবধি অপ্রকাশিত থেকে যায়। কথায় আছে না গুরুদক্ষিণা না দিলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। স্যার আমার জীবন থেকে একটা গল্প নিয়ে নিলেন শুধু। নিয়ে নিলেন বলা ভুল। চাইলে আমি সানন্দেই দিয়ে দিতাম। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন সম্মাননা প্রাপ্তির গল্পটা আমারই লেখা। আমার গুরুদক্ষিণা দেওয়া শেষ। এবার আপনি দেখবেন আমি একদিন ভালো গল্পকার হয়ে উঠব, উঠবই।



Rate this content
Log in