STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract

জীবনযুদ্ধ

জীবনযুদ্ধ

5 mins
535


জীবন মানেই সংগ্রাম মানেই যুদ্ধ। আর তাই তো একে বলা হয় জীবনযুদ্ধ। প্রত্যেকের জীবনেই বিভিন্ন রূপে আসে এই যুদ্ধ। মূলত মানবজীবনের প্রতিটি স্তরেই টিকে থাকার জন্য সর্বক্ষণ চলে এক সংগ্রাম অর্থাৎ যুদ্ধ। এই সংগ্রাম কখনো ভালোবাসা জয় করতে, কখনো অর্থসম্পদ জয় করতে, কখনো সমাজে সম্মান জয় করতে, কখনো কর্মক্ষেত্রে অথবা রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, আবার কখনও বা অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করে সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন ফিরে পেতে। এসব যুদ্ধে কেউ কেউ জয়ী হয়, আবার কেউবা হাল ছেড়ে দিয়ে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। মানুষ যেদিন প্রথম এই পৃথিবীতে আসে, সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় তার জীবনযুদ্ধ। যেকোনো প্রাণীর চেয়ে মানবশিশু সবচেয়ে অসহায় হয়ে এই পৃথিবীতে আসে। আর তাই সে তার প্রয়োজনের কথা, অর্থাৎ যখনই তার খিদে পায় অথবা অন্য কোনো অসুবিধা হয়, তখন সে শুধু কান্নার মধেই তা প্রকাশ করে। এভাবেই সে যুদ্ধ করে কেড়ে নেয় তার বেঁচে থাকার অধিকার।


শিশুকালের যুদ্ধ এখানেই শেষ হয়ে যায় না। ধীরে ধীরে শিশুটি যখন বড় হতে থাকে, তখনো তাকে চালিয়ে যেতে হয় যুদ্ধ। পারিবারিক জীবনে এই যুদ্ধ বিভিন্ন রকম হতে পারে। কখনো মা–বাবার ভালোবাসা ভাইবোনদের সঙ্গে ভাগে বেশি পাওয়ার যুদ্ধ, কখনো স্কুলের সহপাঠীদের হারিয়ে ভালো ফলের জন্য যুদ্ধ। আবার কখনো খেলার মাঠে সাফল্য অর্জনের যুদ্ধ। এমনি করেই সংগ্রাম করতে করতে একসময় চলে আসে বয়ঃসন্ধিকাল আর তখন সামনে এসে দাঁড়ায় অন্য রকম যুদ্ধ। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবারের সঠিক লালনপালন অথবা যথার্থ বন্ধু নির্বাচনে ব্যর্থ হলে একরকম বখে যেতে শুরু করে। পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়ে সমাজের নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়। আর তখন তাদের নিজেদের জন্য ও পরিবারের জন্য অপেক্ষা করে থাকে এক বিশাল যুদ্ধ।


আর যদি তারা অসচ্ছল অথবা দরিদ্র পরিবারের হয়, তাহলে সংসারের অসচ্ছলতার প্রতিক্রিয়া তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখনই কিশোর–কিশোরীর মনে শুরু হয় অগণিত প্রশ্নে জর্জরিত দারিদ্র্যমুক্তির অন্বেষণে এক মানসিক যুদ্ধ। কেন তারা দরিদ্র? কেমন করে অর্থ উপার্জন করে সংসারের অসচ্ছলতা দূর করা যায় ইত্যাদি। এ অবস্থায় কেউ কেউ কষ্ট করে শিক্ষার আলোকে সঙ্গে নিয়ে এ যুদ্ধে জয়ী হয়ে যায় আবার কেউবা ভুল পথে গিয়ে সমাজের কলুষিত ব্যক্তি হয়ে অমানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। এই রকম যুদ্ধে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মোটামুটি জয়ের সম্ভাবনা বেশির দিকে থাকে, তবে এরও যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়, কথায় বলে ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!’ এসব ক্ষেত্রেই মা-বাবা এবং পরিবারকে এক অসাধারণ কঠিন যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হয়।


যে রকম যুদ্ধ বা সংগ্রামই আসুক না কেন, জীবনে ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে তার মোকাবিলা করতে হয়। ধরা যাক, একটা ভালোবাসার যুদ্ধ। এই ভালোবাসার যুদ্ধ বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন, প্রেমিক–প্রেমিকা, স্বামী–স্ত্রী, মা ও সন্তান, ভাই–বোন, দাদু –দিদা , ঠাকুরদা –ঠাকুমা , ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুর ভালোবাসা। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ভালোবাসায় আবার কেমন যুদ্ধ? অবশ্যই যুদ্ধ হতে পারে, আর তার প্রধান কারণ হলো ভুল বোঝাবুঝি। ভুল বোঝাবুঝিতে হারিয়ে যায় একে অন্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর তখনই শুরু হয় যুদ্ধ। এই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ

ও সহযোগিতা। উভয় পক্ষের অতি সাবধানে গঠনমূলক আলোচনায় সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা। আর তখনই এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, রাগ–অভিমান ও বিরূপ মনোভাব অন্তরে পুষে রেখে সম্পর্কে ছেদ টেনে আনলে হেরে যেতে হয় এই যুদ্ধে।


তবে সম্পর্ক সুন্দর ও সুস্থ থাকার ব্যাপারটা সত্যিকার অর্থে দুই পক্ষের ওপরই নির্ভর করে। এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে অনেক সম্পর্ক ভালোভাবে টিকে যায় আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ৪০ বছর একসঙ্গে সংসার করার পর ও স্বামী স্ত্রী দুজনেই একে অন্যের কাছে অপরিচিত বা অচেনা রয়ে যান। তাঁরা সামাজিক মূল্যবোধের চাপে পড়ে অথবা নিজেদের সন্তানদের কথা ভেবে একসঙ্গে জীবন যাপন করেন ঠিকই কিন্তু সম্পর্কের মাধুর্য তাঁরা কোনো দিনই উপলব্ধি করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা জয়ী, কিন্তু সত্যিই কি তা–ই? এ রকম আরও অনেক সম্পর্কে ছেদ থাকতে পারে, কিন্তু তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না। অনেক পরিবারেই দেখা যায় নিজেদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে এই সম্পর্কগুলো সত্যিই মধুর। তাই এখানেও এই জীবনযুদ্ধে হারজিতের প্রশ্ন রয়ে যায়।


এবারে আসা যাক অর্থসম্পদ জয় করার যুদ্ধে। এই যুদ্ধ এক অসাধারণ যুদ্ধ! কেউ কেউ কঠিন পরিশ্রম করে সততার সঙ্গে জয়ী হয় আবার কেউবা বিনা পরিশ্রমে অথবা অসৎ উপায়ে জয় করে অর্থ। বাকি একদল মানুষ সততার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয় এবং পরাজয় স্বীকার করে নেয়। আর তখনই নেমে আসে সাংসারিক ও মানসিক অশান্তি। এই হেরে যাওয়াটা সবাই সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। দারিদ্র্যের গ্লানি ও ক্লেশ ধীরে ধীরে কেড়ে নেয় মানুষের সুখ, শান্তি ও আত্মসম্মান। আর তারই রেশ টেনে নিয়ে আসে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা। তখন সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং অনেক ক্ষেত্রে হেরে গিয়ে আত্মহত্যা করার প্রবৃত্তি ও জাগে মনে।


অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ? এ যেন অসুখের নামে এক অসুরের সঙ্গে জীবন–মরণের লড়াই। এই লড়াই সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে নিয়তির ওপর। অর্থ এবং সেই সঙ্গে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেও যে ভালো চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হতে পারা যায়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেক ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে উড়োজাহাজ ভাড়া করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয় অসুস্থ ব্যক্তিকে। তারপরও অনেকে ভালো চিকিৎসা পেয়ে ও জয়ী হতে পারে না এ যুদ্ধে। তবে সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ হলো অসুখের সঙ্গে যুদ্ধ। মানুষ যখন অসুস্থ হয়, তখন তার কাছে টাকাপয়সা, ধনসম্পদ, বাড়ি–গাড়ি, কোনো মাইনে রাখে না। শুধু মনে হয়, এসব অর্থসম্পদের বিনিময়ে যদি সুস্বাস্থ্য ফিরে পাওয়া যেত, তাহলে সে তার সবকিছু বিলিয়ে দিত। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ তখন মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করতে চায় আর তখনই প্রয়োজন হয় মনোবলের। অসুস্থতায় মানুষ যখন মনোবল হারিয়ে ফেলে, তখন সেটাই সুস্থ হওয়ার পথে একটা বিরাট বাধার সৃষ্টি করে। জীবনযুদ্ধ যে প্রকার এবং যত কঠিনই হোক না কেন, মনোবল নিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে তার মোকাবিলা করা উচিত, তবেই জয়ের সম্ভাবনা থাকতে পারে। এই মানবজীবন তখনই পরিপূর্ণ ও নান্দনিক হয়, যখন জীবনের এসব ভিন্নমুখী যুদ্ধে জয়ী হয়ে মানুষ সত্যিকার আনন্দ ও সুখ খুঁজে নিতে পারে।

তাই সব কথার সার কথা হল জীবনে বাঁচতে গেলে যুদ্ধ করতে হবে আর যুদ্ধ করেই বাঁচতে হবে।


তথ্য : আন্তর্জাল, পত্র পত্রিকা।


Rate this content
Log in