Partha Pratim Guha Neogy

Others

5  

Partha Pratim Guha Neogy

Others

আবীরের বৈশাখী মেলা

আবীরের বৈশাখী মেলা

7 mins
477


 আবীরের ঘুম ভাঙলেই প্রথমে তার চোখ যায় দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে। বয়স মাত্র নয়। এই বয়সে শিশুদের ঘুম থেকে উঠে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকানোর বিষয়টি একটু অস্বাভাবিক। তবে আবীরের বেলায় বিষয়টি ঘটেছে একটি বিশেষ কারণে।


সামনেই ১৫ই এপ্রিল। পহেলা বৈশাখ। এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আবীর। ঘটনাটা খুলে বলি, আবীর যখন থেকেই বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই কেন যেন পহেলা বৈশাখের দিনটা তার কাছে খুব প্রিয়। অন্যান্য বিশেষ দিনগুলোর চেয়ে এটি আলাদা লেগেছে তার কাছে। কারণ এইদিন সব মানুষের মধ্যেই কেন যেন উৎসবের আমেজ থাকে। অন্যান্য দিনগুলো কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য কিন্তু এদিন যেন সবার।


প্রতি বছর ১৫ই এপ্রিল আসলেই তার যেন আনন্দ আর ধরে না। বাবা-মার সঙ্গে এদিন ঘুরতে যাওয়া। শত শত মানুষের ভিড় এবং উৎসবমুখর পরিবেশ সবটাই তাকে মুগ্ধ করে। কলকাতা শহরে জন্ম এবং সেখানেই তার বেড়ে ওঠা হয়তো সে কারণেই একটু খোলামেলা পরিবেশ তার কাছে একটু বেশিই মনে ধরেছে।


এবারের পহেলা বৈশাখটা আবীরের কাছে একটু বেশি প্রতীক্ষিত। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার কাছে গ্রামের বৈশাখী মেলার গল্প শুনে এসেছে আবীর। তার বাবা-মা দুজনেই গ্রামের মানুষ। বাবা কলেজ শেষ করে শহরে এলেও মা বিয়ের আগ পর্যন্ত পাশের থানার কলেজ পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তারপর বিয়ে হয়ে গেলে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। তাই মায়ের কাছ থেকে গ্রামের মানুষ, নদী, মেলার গল্প শুনতে ভালোই লাগে আবীরের।


আবার এদিকে মা ছেলেকে নিজের গ্রামের গল্প শোনাতে পেরে বেশ আনন্দিত হন। বিশেষ করে তাদের গ্রামে বৈশাখী মেলার গল্প এবং তা নিয়ে আবীরের নানা প্রশ্ন। অবশ্য ইদানীং ব্যাপারটিকে বিরক্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে আবীর । কারণ গত কয়েক বছরে কতবার যে গল্প শোনাতে হয়েছে তার শেষ নেই। কিন্তু আবীরের মধ্যে কোনো বিরক্তির বিন্দুমাত্র লেশ নেই। ছেলের বৈশাখী মেলার প্রতি এমন আগ্রহ দেখে বাবা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে গ্রামের বৈশাখী মেলা দেখাতে নিয়ে যাবেন। আর তারাও শেষ গ্রামে গেছেন প্রায় দশ বছর হতে চলল। আবীরের জন্মের পর নানা কারণে আর যাওয়া হয়নি। গ্রামে যাওয়ার কথা শোনার পর থেকেই আবীর ক্যালেন্ডারে পাতায় দিনগোনা শুরু করেছে। আর সাতদিন পরেই তারা গ্রামের বাড়িতে যাবে। তার দুইদিন পরই পহেলা বৈশাখ। বাবা এবার অফিসে বলে ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছেন।


অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। বাবা-মার সঙ্গে আবীর যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে। এই প্রথম কলকাতার বাইরে যাচ্ছে সে। বাসে চড়ে তারা যাচ্ছে। মায়ের কোলে আবীর বসেছে জানালার পাশে। সেখানে থেকে সে রাস্তার পাশে সবকিছু খুব ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে। প্রথম এক ঘণ্টা শহরের জ্যাম কাটিয়ে শুরু হলো ফাঁকা রাস্তা। আস্তে আস্তে আবীর দেখতে পেল গ্রাম। মায়ের মুখে কতবার গল্প শুনেছে। গ্রামের ফসলের মাঠ, বাড়িঘর সবকিছু তার চোখে পড়ছে। এতদিন এসব গল্পেই শুনে এসেছে কিন্তু এই প্রথম নিজের চোখে দেখছে সে। তার চোখে-মুখে আনন্দ। মনে পড়ছে মা যখন খাবার খাওয়াতো তখন গল্প শোনাত বৈশাখী মেলার। মাঠে বসে সেই মেলা। দশ গ্রাম থেকে মানুষ মেলা দেখতে আসে। মেলায় নানা রকম জিনিসপত্রের দোকান বসে বেশিরভাগই মাটির জিনিসপত্র। গ্রামের মানুষ নাকি মাটির জিনিসপত্রেই বেশি ব্যবহার করে। এ ছাড়া নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস, সাপ খেলা, যাত্রাপালা আরো কতকিছু। গত কয়েক বছর এই গল্প শুনতে শুনতে মুখস্ত করে ফেলেছে সে। মায়ের মুখের কথাগুলো তার মনে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে সেগুলো নিয়ে নিজের মধ্যে এক স্বপ্ন তৈরি করে ফেলেছে। তা থেকে তৈরি হয়েছে সেগুলো দেখার প্রবল ইচ্ছা। দেখতে দেখতে ছয় ঘণ্টার সফর শেষ করে গ্রামে পৌঁছল তারা।

 

এদিকে এতদিন পর তাদের গ্রামে আসা উপলক্ষে বাড়িতে যেন উৎসব শুরু হয়েছে। বিষয়টি বেশ উপভোগ করছে আবীর । এখানে এসে এরইমধ্যে দুজন বন্ধুও জুটেছে তার। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা, আর ছুটোছুটি করেই সেদিন কেটে গেল। কিন্তু তার মনজুড়ে শুধু মেলা দেখার আগ্রহ। গ্রামে তার বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়েছে আবীর। মেলা নিয়ে তাদের কাছে নানা প্রশ্ন করেছে। তারা মেলা দেখেছে কিনা তা প্রশ্ন করেছে। পুতুল নাচ, সাপ খেলা, সার্কাস দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু আবীরকে অবাক করে দিয়ে তার বন্ধুরা জানাল, তারা নাকি মেলায় যায় না। আর এখন নাকি মেলায় যেতে দেয় না বাড়ির বড়রা। মেলার যাবার কথা শুনলেই নাকি মারমুখো হয়ে তেড়ে আসে। সবশুনে ভীষণ অবাক হয় আবীর । কিছুটা অবাক হলেও অতটা মাথা ঘামায় না।


আবীরের বাবা গ্রামে আসার পর সবার সঙ্গে দেখা করে সকলের কুশল - মঙ্গল জিজ্ঞেস করে। তবে ছেলেকে দেওয়া কথা মাথায় আছে তার। একমাত্র ছেলের শখ গ্রামে বৈশাখী মেলা দেখবে। নাগরদোলায় চড়বে, সার্কাস দেখবে, সাপ খেলা দেখবে। নিজের অজান্তেই যেন নিজের শৈশবে ফিরে গেছেন আবীরের বাবা। বাবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে টাকা চুরি করে সেইসময় মেলায় যেত সব বন্ধুরা মিলে। ফিরে এলে বাবার বকা। তার মনে হয় এই তো সেদিন যেন ঘটেছে সব।


শেষ যেবার গ্রামে এসেছে তখনো একবার মেলাতে গিয়েছে সে। তবে সেবার আগের মতো মজা পায়নি। হয়তো বড় হওয়াতেই এমন হয়েছে। তবে এখন সময় বদলেছে। সব কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। আগে গ্রামের ঢোকার পথেই সবার দেখা পেত। কিন্তু এমন গ্রামে ঢোকার পথে বটগাছের নিচে কয়েকজন উঠতি বয়সের যুবক ছাড়া কাউকে পায়নি। যুবকগুলোকে সে ঠিক চিনতে পারেনি। অনেকদিন পর গ্রামে আসাতে অনেককেই ঠিক চিনতে পারে না। যুবকগুলো চায়নার তৈরী মোবাইলে ফোনে উচ্চস্বরে হিন্দি গান বাজাচ্ছিল।


বাড়ির রাখালকে ডেকে এবারের মেলা হচ্ছে নাকি জিজ্ঞেস করলেন আবীরের বাবা। রাখাল জানায়, মেলা তো প্রতি বছরই হয়। তবে মেলা নাকি আর সেই মেলা নেই, একটু অন্যরকম। এখন মেলা হয় রাতের বেলা। এখন যা হয় তার মূল আকর্ষণ - জুয়া খেলা আর অশ্লীলতা। সবকিছু শুনে মন খারাপ হয় আবীরের বাবার। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের পরিবর্তন এসেছে। মানুষের মধ্যে আগের চেতনা আর নেই। গ্রামের মানুষ আর আগের সহজ সরল গ্রামের মানুষ নেই। আধুনিকতার নামে বিদেশি অপসংস্কৃতি মানুষের মূল্যবোধে ফাটল ধরিয়েছে। মানুষ এখন শহুরে জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। কোনটি আধুনিকতা আর কোনটি অপসংস্কৃতি তা বোঝার ক্ষমতা তাদের তৈরি হয়নি। ছেলেকে তারা মেলার গল্প শোনাতো। মেলাকে ঘিরে তাদের উন্মাদনার গল্প শোনাতো। কিন্তু আজ সেগুলো কোথায়। যে মেলার গল্প শুনে তার ছেলে গ্রামে এসেছে। যে গ্রামের গল্প শুনে তার ছেলে গ্রামকে ভালোবেসেছে সে গ্রাম কেথায়? তাহলে কী ভবিষ্যত প্রজন্মকে আমরা কিছুই বলতে পারব না। আমাদের অতীত, আমাদের ঐহিত্য কোনোকিছু্ই তাদের বলতে পারব না। আর যদি বলি তাহলে তাদের কী সেগুলো দেখাত পারব না? আর যদি তাদের সেগুলো দেখাতে না পারি তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমরা মিথ্যেবাদী ছাড়া কিছুই নয় বলে পরিচিত হব । নিজের মনেই চিন্তা করছিলেন আবীরের বাবা।


আজ পহেলা বৈশাখ। সকালে বাবার নববর্ষের উপহার দেওয়া পহেলা বৈশাখের পোশাক পরেছে আবীর। সকাল থেকেই বাবার কাছে তার বায়না কখন মেলা দেখতে যাবে। মেলা নিয়ে বাবা আগে বেশ উচ্ছ্বাস দেখালেও এখন তা নেই। নানা কারণে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু আবীরের জেদের কাছে বাবাকে হার মানতে হলো। ছেলেকে নিয়ে মেলা দেখতে রওয়ানা হল। কিন্তু কোথায় মেলা? কিসের মেলা? চিন্তা করছেন তিনি । ছেলেকে বলতে পারছেন না কিছুই। তার মনে হচ্ছে ছেলেকে চিৎকার করে বলতে, তোমাকে যা বলেছি সব মিথ্যে। এগুলো কিছুই নেই। আমরা এখন শুধু নামেই বাঙালি। বাঙালির কোনো বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে নেই। আমাদের বাঙালিয়ানা শহরের কয়েকটি স্থানেই সীমাবদ্ধ। ভবিষ্যত প্রজন্ম আর কতটুকু রক্ষা করতে পারবে তা নিয়ে শঙ্কা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।


আবীরের মনে আনন্দের সীমা নেই। এতদিন বাবা-মার মুখে শুনে এসেছে এবার নিজের চোখে বৈশাখী মেলা দেখবে। গ্রামে আসার আগে বন্ধুদের কাছে গল্প করেছে আবীর । তার কথা শুনে বন্ধুদের কী হিংসা। অনেকের আফসোস তাদের বাবা-মা কেন আবীরের বাবা-মার মতো নয়। আবীর দেখতে পেল দূরে ফাঁকা মাঠে অনেক উঁচু উঁচু ঘরের মতো তাবু টাঙানো। মায়ের মুখে শুনেছে সার্কাসের বড় বড় তাবুর কথা। অবশেষে মেলার এলাকায় ঢুকলো তারা। ঢুকেই যেন কিছুটা ধাক্কা খেল আবীর । তেমন লোক নেই। বেশিরভাগই বড় মানুষ। ছোট ছেলেমেয়েদের সংখ্যা খুবই কম। দোকানের সংখ্যাও খুব কম। আর মাটির তৈরী নয় জিনিসপত্র এবং খেলনাগুলো - সব প্লাস্টিকের। মেলা বলতে এতদিন সে যা ভেবে এসেছে তার সঙ্গে যেন কিছুই মিলছে না। তবু সে ভাবল হয়তো মানুষ এখনো মেলায় আসেনি। বাবার কাছে পুতুল নাচ আর সার্কাস খেলা দেখার বায়না ধরে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বুঝতে পারে আবীর যে কোনো কারণে বাবার মন খারাপ। মনে মনে ভাবে হয়তো সে জেদ করেছে তাই বাবা মন খারাপ করেছে। ধীরে ধীরে পুরো মেলাস্থল ঘুরে দেখে নেয় আবীর এবং তার বাবা। শেষের দিকে এক কোণায় একটা তাঁবুর মতো ঘর। বড় বড় অক্ষরে লেখাটার ওপর চোখ পড়ে আরিবের। লেখা তার খুব যেন চেনা মনে হয়। ভাঙা ভাঙা ভাবে সে মনে মনে পড়ে ‘পুতুল নাচ’। তার মনে এক ধরনের আনন্দ। উচ্ছ্বাসে বাবার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে সে। তাঁবুর কাছে আসতেই শুনতে পায় তাঁবুর সামনে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে থাকা লোকটা বলছে পুতুল নাচ ১০ টাকা টিকেট, পুতুল নাচ দেখেন ১০ টাকা টিকেট। কাছে আসতেই আবীর খেয়াল করল বাবা যেন লোকটার কথা শুনতেই পাচ্ছে না। জায়গাটা দ্রুত পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আবীর বাবাকে বলল, কী বাবা পুতুল নাচ দেখব না। বাবা চুপ করে আছে, কিছু বলছে না। শুধু ছেলের হাতটা শক্ত করে ধরে দ্রুত সেই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আবীর আবার বলল, কী বাবা পুতুল নাচ দেখব না? বাবা চুপ, সে মনে মনে ভাবছে ছেলেকে সে কী বলবে আর কীভাবেই বা বোঝাবে, পুতুল নাচের সংজ্ঞাটা এখন বদলেছে। পুতুল নাচ বলতে আমরা যা বলতাম সেটি এটি নয়। এটি অশ্লীল শরীর প্রদর্শনী। আবীরের মেলা দেখা এ পর্যন্তই। কিন্তু কিসের মেলা, কোথায় কী? সে তো কিছুই দেখল না। তার মনে একটাই প্রশ্ন তার উত্তর সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। মেলা দেখাবে বলে বাবা কলকাতা থেকে গ্রামে নিয়ে এল কিন্তু মেলা না দেখিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে কেন?


গ্রামের রাস্তা ধরে বাবা আর আবীর হেঁটে চলেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের রাস্তা কিছুটা অন্ধকার হয়ে গেছে। তবে রাস্তাগুলো আর আগের মতো মেঠোপথ নয়। পিচ ঢাকা পাকা রাস্তা। বাবা ভাবেন সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে, সংস্কৃতির পরিবর্তন হচ্ছে। আবীরের মনে রাগ, বাবা কেন তাকে পুতুল নাচ দেখালো না। অন্য তাঁবুতে হয়তো সার্কাস হচ্ছিল সেগুলোও দেখাল না। আবীরের মেলা দেখা হলো না।


  



Rate this content
Log in