রাখী – ভাই
রাখী – ভাই


সকাল সাড়ে নটায় সবে আমার চেম্বারে গিয়ে বসেছি, ফোনটা বেজে উঠলো।
“হ্যালো! ডক্টর সিনহা বলছেন?” একটি অপরিচিত মহিলার গলার স্বর।
“ হ্যাঁ, আপনি কে?”
“ আমি মায়া। আমার দাদা আপনাদের হাসপাতালে ভর্তি আছে, সুজয় রায়।“
“আচ্ছা, আপনি সুজয়ের বোন?”
“ হ্যাঁ। কেমন আছে আমার দাদা?”
“ দেখুন অসুখটা তো খুব সাধারণ নয় । ওর পায়ের টিউমার টার জন্য হাঁটু থেকে ডান পা টা বাদ দেওয়ার পর...” আমি কথাটা শেষ করতে পারলাম না। ওদিক থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। আমি বুঝলাম খবরটা মায়ার জানা ছিল না।
“ আমি কিছুই জানতাম না। আমি কিছুই......” মহিলা কেঁদেই চলল।
“ এরকম ভাবে ফোনে সব ডিটেল তো আমরা দিতে পারি না। আপনি চলে আসুন না দেখতে।“ ভদ্রমহিলার কান্না একটু কমলে আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম।
“ আসলে আমি...... আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। তাই আমি কখনোই দেখতে আসিনি।“ ধীরে ধীরে বলল মেয়েটি।
“সে ক্ষেত্রে আমি বলব আপনি একবার দেখে যান।“
সেদিনই দুপুর বারোটা নাগাদ একটি রোগা মত মেয়ে আমার চেম্বারে এসে ঢুকলো।
“ নমস্কার ডাক্তারবাবু, আমি মায়া। সুজয় আমার দাদা।“
“ ও আচ্ছা আসুন।“ আমি মেয়েটিকে ভিতরে ডেকে বসালাম। ওর সঙ্গে ওর স্বামী বিরজু প্রসাদ ও এসেছে। আমার সঙ্গে পরিচয় হল। দুজনেই খুব ভালো মানুষ।
“ আপনি এর আগে কখনও আপনার দাদাকে দেখতে আসেন নি ?”
“ জানেন ডাক্তারবাবু আমার বাবা খুব ছোটো বয়সে মারা যান। দাদাই আমাকে মানুষ করে। তারপর আমি যখন মা আর দাদার অমতে বিয়ে করলাম ওরা মেনে নিতে পারেনি। ওরা আমার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই রাখত না। তাই আমাকে ওরা জানায়নি দাদার শরীর খারাপের কথা। আমি একজনের কাছে জানতে পেরে ছুটে এসেছি।“ বলতে বলতে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল মায়া।
“ এখন কেমন আছেন ভাইয়া?” জিজ্ঞাসা করলো বিরজু প্রসাদ।
“ সত্যি কথা বলতে কি উনি খুব ভালো নেই। টিউমারটা হয়েছিল ডান পায়ের হাঁটুর উপরে। পাটা হাঁটুর উপর থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারপরেও সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে রোগ। খুব বেশি দিন আর... আপনারা মন শক্ত করুন।”
অনেকক্ষণ ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার রাউন্ডের সময় হয়ে যেতে আমি উঠলাম। মায়া দেখা করতে চাইলো ওর দাদার সঙ্গে। বিরজু বলল ও বাইরে অপেক্ষা করবে।
সুজয়ের কেবিনে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন আছ সুজয়?”
বহুদিনের রোগে ভোগা চেহারা, চোখের তলায় গাঢ় কালি। আমাকে দেখেই সুজয়ের মুখে একটা হাসি খেলে গেল, “ভালো আছি ডাক্তার বাবু।“
আমি হেসে উঠে বললাম,” দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।“
আমার পিছন দিয়ে উঁকি দিল মায়া । মায়াকে দেখে সুজয়ের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। মুখটা জানলার দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিল ও।
সুজয়কে দেখে মায়া ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল,” ভাইয়া তোমার এ কি অবস্থা হয়েছে?”
কিন্তু সুজয় কোনো উত্তর দিল না।
আমি বুঝলাম ভাই বোনের মধ্যে প্রবল অভিমান কাজ করছে। সুজয় এর পাশে গিয়ে বসলাম, ও মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “বোনের উপর আর অভিমান কোরোনা।“
সুজয় নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করলো।
মায়া বলতে শুরু করল, “ আমি ভালো আছি দাদা। আমায় মাফ করে দাও।“
এরই মধ্যে সুজয়ের মা সুজয়কে দেখতে এসেছিলেন, তিনি ঢুকলেন ঘরে। মেয়েকে দেখে ওনার চোখে মুখে প্রথমে একটু বিরক্তি দেখা গেল। মায়া ছুটে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে মেয়ের কান্না দেখে ওনার মন নরম হয়ে গেল। মা, মেয়ে দুজনে সুজয়কে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো। আমি ওদের প্রাইভেট সময় দেওয়ার জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। মনটা খুব হাল্কা লাগলো। একটা পরিবারকে অন্তত আমি একসঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছি।
এরপরে মাঝেমাঝেই মায়াকে আমি হাসপাতালে আসতে দেখতাম। আমাকে দেখলে খুব খুশি হয়ে এক গাল হাসত।
এর একমাস পর সুজয় মারা গেল। একজন ডাক্তার হিসেবে আমার পক্ষে যতটুকু করার আমি সুজয়ের জন্য করলাম। বিরজু প্রসাদ দায়িত্ব নিয়ে সমস্ত কাজ সম্পন্ন করল।
এই ঘটনার প্রায় এক বছর কেটে গেছে। সুজয়ের বাড়ির লোকের সঙ্গে আর আমার কোন যোগাযোগ নেই, ওদের আর কখনো দেখিনি হাসপাতালে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাখীর দিন সকাল বেলায় একটা পার্সেল পেয়ে খুব অবাক হয়ে গেলাম। পার্সেলটা খুলে দেখলাম তার মধ্যে একটা রাখি আর একটা চিঠি রয়েছে। চিঠিটা এরকম- ডাক্তার বাবু,
আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো তা আমি জানিনা। দাদা মারা যাবার পর মা আমাদের কাছেই আছেন। এখন আমাকে আর আমার স্বামীকে উনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমি আর দাদা ছাড়া মায়ের আর কেউ নেই।
আমার এক ভাই চলে গেছে কিন্তু আপনি আমার দাদার মতো কাজ করেছেন। আপনি না থাকলে আমি আমার মা আর ভাইকে ফিরে পেতাম না।
তাই আজ থেকে আপনি আমার রাখি ভাই।
নমস্কারান্তে
মায়া
সমাপ্ত