বিবাহ প্রস্তাব
বিবাহ প্রস্তাব
গত আড়াই ঘণ্টা ধরে নিজের প্রয়োজনে মায়ের পিছন পিছন ঘুরছি তবে কাজের কাজটা করতে পারছি না। বাবার পকেট কেটে আয় করেছে হাজার টাকা, সে টাকা নিয়ে শপিং-এ এসেছে মা। আমাকেও টেনে এনেছে। আমার আসার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু ওই যে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তাই তো মা'কে না চটিয়ে মায়ের আগে পিছে ঘুরছি।
গত একঘন্টা ধরে একটা শাড়ির দোকানের সব শাড়ি দেখে, দোকনটাকে লন্ডভন্ড করে শেষে কিছুই পছন্দ হচ্ছে না বলে মা বেরিয়ে এলো। দোকানদারের অসন্তুষ্টি ও রাগটা মা না দেখলেও আমি ঠিক দেখেছি। তার সঙ্গে মানে মানে মায়ের আঁচল ধরে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এসেছি।
"ও মা আর কতক্ষন ঘুরবে, চলো বাড়ি যাই। আজ কিছু পছন্দ হবে না তোমার। আজ তোমার শপিং-লগ্ন নয়। তোমার শপিং-লগ্ন আগামীকাল শুরু হবে" মা'কে কথাটা বলতেই মা চোখ বড়বড় করে বলল, "সকালে খবরের কাগজে রাশিফল দেখেছিলি নাকি! ইসস আমি তো দেখিনি, তুই তো আগে বলবি আজ আমার শনির দশা চলছে"।
"তুমি বাড়ি চলো, নয়তো আমার শনির দশা শুরু হয়ে যাবে" আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম।
"কেন রে তৃণা, কি হয়েছে তোর? আমি কি তোর নামে শনি ঠাকুরের কাছে পুজো দিয়ে আসবো?" মায়ের এসব কথা শুনে আমি রেগে গিয়ে বললাম, "না, কিছু করতে হবে না। তাছাড়া আজ সবে রবিবার, আবার শনিবার আসতে এখন অনেক দেরী। ততদিনে আমি মরে ভূত হয়ে যাবো।"
"কি হয়েছে বলতো, আলতু ফালতু বকছিস কেন!! মাথায় বায়ু উঠলো নাকি?" মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলল।
আমি মুখ চুন করে তাকিয়ে রইলাম আর নিজের মনে বললাম, "আমার মাথায় বায়ু নয়, প্রেমের ভূত চেপেছে। আজ বিক্রম আসছে বাড়িতে বিয়ের কথা বলতে, আমাকে তো আগে থেকে মা'কে ম্যানেজ করতে হবে যাতে আমার রাগী বাপটাকে মা সামলায়"।
"কি রে কি এত ভাবছিস?" মায়ের ডাকে আমার ধ্যান ভাঙলো। কোনো কথা না বলে মায়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম বাড়ির পথে।
পাড়ায় ঢুকে একটা ঠেলা গাড়ি দেখে মা দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়িটায় প্ল্যাস্টিকের বালতি থেকে শুরু করে রোজকার প্রয়োজনীয় হরেকরকম জিনিস আছে। আর তাতে মাইক বাজছে 'হরেক মাল ৩০ টাকা'।
মা'কে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে আমার তো মাথাটাই জ্বলে উঠল। বাবার পকেট থেকে হাজার টাকা সরিয়ে, শেষে কি না ৩০ টাকার জিনিস কিনবে মা!!
"মা চলো" আমি খোঁচা দিতে মা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, "দাঁড়া না, দু'টো টুল কিনি। ওই রান্নাঘরের টুলটা ভেঙে যেতে বসেছে"।
"এত বড় চেহারা নিয়ে টুলে উঠলে ওটা তো ভাঙবেই" আমি গজগজ করতে করতে বললাম তবে ধীমে স্বরে। কিন্তু মা মনে হয় শুনে ফেলেছে, চোখ গরম করে তাকালো আমার দিকে। তারপর জিনিস দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এদিকে ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বাজতে যায়, আধঘণ্টার মধ্যে বিক্রম আসবে। মিনিট দশ দাঁড়িয়ে 'হরেক মাল ৩০ টাকা' শুনে শুনে শেষে মায়ের জিনিস নেওয়া হলো।
দু'টো প্লাস্টিকের গামলা ও একটা বেলনা নিয়েছে। গামলা দু'টো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মা এগিয়ে চলল। মনে মনে ভাবছি এবার মা'কে সব বলবো কিন্তু মায়ের হাতে বেলনাটা দেখে চুপসে গেলাম। রাস্তার মাঝে বিক্রমের কথা শুনে মা যদি বেলনা দিয়ে মারতে শুরু করে!! না না প্রেমের জন্য প্রেস্টিজ খোয়ানো যাবে না।
বাড়িতে ঢুকতে দেখলাম বাবা বসে আছে টিভির সামনে। আমাকে মায়ের সঙ্গে আসতে দেখে বাবা বলল, "হাজার টাকা ঝেড়ে নিয়ে শেষে কি না প্ল্যাস্টিকের গামলা?"
"ঝেড়ে মানে কি! কি যা তা বলছো?" মা ক্ষেপে গেল।
"ঝেড়েই তো, সকালে আমার জামা কাঁচার নামে যে জামাটা নিয়ে গেলে, তা জামার পকেটে থাকা টাকাটা দেখোনি? কড়কড়ে দুটো পাঁচশো টাকার নোট ছিল" বাবা একথা বলতেই মা রে রে করে তেড়ে গিয়ে বলল, "কিছু ছিল না তোমার ফুটো পকেটে, একদম মিথ্যে কথা বলবে না"।
মা বাবার গৃহযুদ্ধ দেখে আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। এত ঝগড়া ঝামেলার মাঝে বিক্রমের কথা বলবো কি করে সেটাই ভাবতে লাগলাম। ইতিমধ্যে কলিং বেল বেজে উঠল। বেশ বুঝলাম বিক্রম এসে গেছে।
আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। বিক্রম একচিলতে হাসি উপহার দিলো আমাকে, তবে আমার হাসি পেলো না। আমার ভয়ে বুকটা ধরাস ধরাস করছে। বিক্রম এখনো হাসি মুখে তাকিয়ে আছে দেখে আমি ঝাড় দিয়ে বললাম, "দাঁত বের করে হাসার দরকার নেই। আমার বাবা ডেন্টিস, এখুনি তোমার সব দাঁত তুলে নেবে"।
একথা শুনে বিক্রমের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। আমি ওকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকখানায় এলাম। বাবা মা দু'জনে এখনো ঝগড়া করছে। বিক্রমের সামনে মা বাবা ঝগড়া করছে দেখে আমার তো লজ্জায় মাথা কাঁটা যাওয়ার মতো অবস্থা। তবে মা বাবা বোধহয় ওর উপস্থিতি লক্ষ্য করলো তাই চুপ করে গেল।
বাবা গলা খাকারি দিয়ে বলল, "এটা কে তৃণা?"
"বাবা ও বেকার আই মিন... মানে ও বিক্রম" আমি তাড়াহুড়োর চক্করে স্লিপ করে বললাম বেআক্কেলে মতো কথা।
"নমস্কার আংকেল আন্টি, আমি বিক্রম। ব্যারাকপুরে থাকি" বিক্রম নম্র স্বরে বলল, যদিওবা ও আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়েছে একবার।
"ব্যারাকপুরে তো আমার চেম্বার আছে, তাহলে বাড়িতে চলে এসেছো কেন! ছুটির দিনে আমি পেশেন্ট দেখি না" বাবা গম্ভীর গলায় বলল।
"না না আমি পেশেন্ট নই, আমার সব দাঁত ভালো আছে। আমি তো অন্য কথা বলতে এসেছি" বিক্রম তাড়াতাড়ি বলল।
"অন্য কথা আবার কি!" মা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
আমি বললাম, "মা তোমাকে তো কখন থেকেই বলতে চাইছিলাম কিন্তু তুমি কিছু শুনলে না। শুধু শপিং শপিং করে মরলে"।
"চুরি করা টাকায় শপিং! ছিঃ ছিঃ লজ্জা হওয়া উচিত" বাবা ভৎসনা দিয়ে বলল।
মা আবার কিছু বলে ওঠার আগেই বিক্রম বলল, "আপনারা পরে ঝগড়া করবেন, আগে আমার কথা শুনুন প্লিজ"।
"তুমি কে হে, যে তোমার কথা আগে শুনতে হবে, তুমি কি প্রধানমন্ত্রী!! আর যদি তাই হও তাহলেও আমার কিছু যায় আসে না। আগে আমি আমার অপমানের জবাব দেবো" মা চোখ মুখ খিঁচিয়ে বলল যা দেখে বিক্রম ভয় পেয়ে গেলো।
আমি এসব নাটক দেখে বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে উঠলাম, "উফফ থামো তো সব। আগে আমার কথা শোনো, আমি ওকে বিয়ে করবো। ও তোমাদের হবু জামাই"।
আমার কথা শুনে মা তো থমকে গেল, যেমন ভিডিও পজ্ করি তেমনি। বাবা তো চোখ বড় বড় করে তাকালো আমার আর বিক্রমের দিকে।
বিক্রম আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, "হ্যাঁ আংকেল আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি এবং বিয়ে করতে চাই"।
"এই আমার ঘর ঝাড় দেওয়ার ঝাঁটাটা কই, ঝেঁটিয়ে এর বিষ ঝেড়ে দেবো আমি" মা এমন ভাবে হঠাৎ ঝাঁটা খুঁজতে লাগলো যে বিক্রম ভয়ে আমার পিছনে লুকালো। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, "তোমার মায়ের হাতে ঝাঁটার বারি খেতে হবে নাকি তৃণা বেবি!"
"আহ এত ভয় পাওয়ার কি আছে, আমার জন্য দু ঝাঁটা খেয়ে নেবে। আমি তো ছোটোবেলা থেকে হামেশাই খাই" আমি একথা খুব সাধারণ ভাবে বললেও বিক্রম আঁতকে ওঠার মতো লাফিয়ে উঠল।
আমি মায়ের কাছে এসে মাকে থামিয়ে বললাম, "ও তোমার জামাই হবে মা, তুমি ওকে জামাইষষ্ঠী খাওয়াও কিন্তু ঝাঁটা মেরো না"।
ইতিমধ্যে বাবা কড়া গলায় বললেন, "ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো না আমি"।
একথা শুনে আমি রেগে গিয়ে বললাম, "কেন বাবা? কেন দেবে না?"
"চেনা নেই, জানা নেই, কেউ এসে বললেই তার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে হবে নাকি!" বাবার একথা শুনে বিক্রম বলে উঠল, "আপনি চাইলে আমি আমার বায়োডাটা জমা করে দেবো। ঠিক যেমন চাকরির ইন্টারভিউ হয় তেমন ভাবে ইন্টারভিউ দেবো আমি"।
আমি মায়ের সম্মতি নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম, "মা তোমার জামাই হিসেবে ওকে খুব মানাবে। দেখছো তো কি সুন্দর দেখতে, পাড়ার সব কাকিমারা জ্বলবে ওকে দেখলে। তোমার এত সুন্দর জামাই, এটা ওরা সহ্য করতে পারবে না। দেখবে, জ্বলবে আর লুচির মতো ফুলবে"।
মা বোধহয় খুশি হলো কথাটা শুনে তাই বাবার কাছে গিয়ে বলল, "একবার ছেলেটার সাথে কথাবার্তা বলো, মনে হচ্ছে ছেলেটা ভালো। আমার জামাই হিসেবে খুব মানাবে"।
"মেয়ের বর দেখছো নাকি নিজের!" বাবা ধমকে উঠতে মায়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মুখ বাঁকিয়ে বললো, "আমার সময় কি পছন্দ করার সুযোগ ছিল নাকি! সুযোগ পেলে এই টেকোকে বিয়ে করতাম না"।
মায়ের গা জ্বালানো কথা শুনে বাবা আবার ফোঁস করে ওঠার আগেই আমি বললাম, "বাবা ওর পড়াশোনা শেষ। ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ করেছে। খুব তাড়াতাড়ি ও ওর বাবার ব্যবসায় যোগ দেবে"।
"তোমাদের কিসের ব্যাবসা বাবা!" মা জিজ্ঞেস করলো।
বিক্রম উত্তরে বলল, "লজেন্সের"।
বাবা নাক মুখ সিঁটকে বলল, "লজেন্স! লজেন্স খেলে দাঁতে ক্যাভিটি হয়। না না শারীরিক ক্ষতি করে এমন বাড়িতে আমি আমার মেয়েকে দেবো না"।
"বাবা একথা বলো না। আচ্ছা আজ থেকে ওদের লজেন্সের ব্যাবসা বন্ধ করে দেবে আর তার বদলে চিরতার জল বিক্রি করবে" আমি বাবার মন রাখতে বললাম। বিক্রম আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো, আমি একটা চোখ মেরে বোঝালাম এমনিতেই মিছিমিছি বলেছি। বিক্রম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
"কি গো এবার ঠিক আছে তো!" মা বাবাকে জিজ্ঞেস করল।
বাবা এখনো মুখের গম্ভীরতা ধরে রেখে বলল, "না এতেও হবে না। আমি আমার মেয়ের বিয়ে এই ছোকরার সঙ্গে দেবো না"।
বাবার এই গোয়ার্তুমি দেখে আমি প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে বললাম, "আমরা একে অপরকে ভালোবাসি বাবা। তুমি আমার থেকে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে পারো না। তোমার পাপ লাগবে"।
"লাগুক। এই ছোকরা তুমি বিদেয় হও। আমার মেয়ের ধারে কাছেও ঘেঁষবে না। আচ্ছা বলো আমার মেয়েকে ছাড়ার বদলে তুমি কি নেবে! যা চাইবে তাই পাবে, শুধু আমার মেয়েকে ভুলে যাও" বাবা নাইনটিসের সিনেমার ডায়লগ দিয়ে ফেলল শেষে।
বিক্রম আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, "আপনার এই বাড়ি, বিষ্ণুপুরের বাগান বাড়ি, দুটো চারচাকা, টু হুইলার, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, কাকিমার গয়না সব সব চাই"।
বিক্রমের কথা শুনে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। এ ছেলে মকা পেয়ে চওকা মেরে দিয়েছে। আমাদের সবকিছু চাই ওর, তাও আমাকে ছাড়ার বদলে!
আমি অগ্নিগর্ভা হয়ে বিক্রমকে দেখছি, শুধু ওকে চিবিয়ে খাওয়ার সুযোগ ও সময় খুঁজছি। ব্যাটা সেয়ানা, আমাকে বিয়ে করে যৌতুকেও যা পাবে না, তা চেয়ে নিয়েছে আমাকে ছাড়ার বদলে।
আমি মনে মনে গজগজ করছি তখনই বাবা নিজের নিশ্চুপ নীরবতা কাটিয়ে বলল, "কাল এসো তোমার বাবা মা'কে নিয়ে, আমি আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো"।
কথাটা শুনে আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, হঠাৎ বাবার মত পরিবর্তন কি করে! এ তো মেঘ না চাইতেই জল।
বিক্রম তো টুক করে মা বাবাকে প্রণাম করে নিল। মা মিষ্টি মুখ করালো।
ওর সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ওর ঘাড় চেপে ধরলাম, "আমাকে ছাড়ার বদলে সব হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি এঁটে ছিলে, তাই না!!"
বিক্রম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, "আরে বেবি তুমি এত বুদ্ধিমতী হয়ে বোকার মতো কথা বলছো কেন!! তোমার বাবা সিনেমার ডায়লগ দিলেও সে যে কিপ্টে মানুষ তা তো জানোই। সে কখনো নিজের সবকিছু দেবে না তা আমি জানতাম।"
বিক্রমের বুদ্ধি দেখে আমি তো আনন্দে গদগদ হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। যাক, ফাইনালি আমার হিল্লে হলো।
