এনকাউন্টার
এনকাউন্টার
কাল: খৃষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ
স্থান: একটি অরণ্য
"এই জায়গাটার নাম কী ?"
"জানি না ! তবে এটা জানি যে আমাদের শিকার এখানেই আছে।"
একটা গভীর বন। তার মধ্যে দিয়েই একটি সংকীর্ণ পথ ধরে চলছিল ওরা দুজন। দুই বন্ধু, দুই সৈনিক। সময়টা বিকেল, রোদের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে। গ্যাব্রিয়েল তার কবজিতে বাঁধা রিস্টওয়াচের মতো যন্ত্রটিতে চোখ রাখল।
"মনে হচ্ছে আমাদের শিকার এক কিলোমিটারের মধ্যেই আছে।"গ্যাব্রিয়েল-এর কন্ঠস্বরে শিকারীর উত্তেজনা।
আরিয়ান তার হাতের অস্ত্রটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। কমান্ডারের নির্দেশ এখনো তার কানে বাজছে -
"একেবারে সাফ করে দেবে, একটুও চিহ্ন যেন না থাকে কোথাও।"
আরিয়ান জানে এর অর্থ কী।
এনকাউন্টার !
শব্দটি মনে পড়তেই আরিয়ান-এর চোয়াল শক্ত হল।
প্রমাণের অভাবে যাতে কোনো ভয়ংকর অপরাধী ছাড়া না পায় তা নিশ্চিত করার জন্যই অতীতে পুলিশবাহিনী সাহায্য নিত এই পদ্ধতির। কিন্তু এই ২৮৮২ খৃষ্টাব্দেও যে আরো একবার এই পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে এ কথা আরিয়ান ভাবতেও পারে নি।
টাইম ট্র্যাভেল প্রযুক্তি অনেকদিন হল আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছে। তাই বর্তমান থেকে অতীত বা ভবিষ্যত কালে যাতায়াতে এখন আর কোনো বাধা নেই। এই প্রযুক্তি খুব সুলভ না হলেও মাঝেমাঝেই কালো টাকার বিনিময়ে এটি অপরাধীদের হস্তগত হয়। বিচার ব্যাবস্থার হাত এড়াতে তারা এই প্রযুক্তির সাহায্যে পালিয়ে যায় সময়ের উজানে। এরকম পলাতক অপরাধীদের ফিরিয়ে আনার জন্যই গঠিত হয়েছে একটি বিশেষ কমান্ডো বাহিনী। গ্যাব্রিয়েল আর আরিয়ান হল সেই বাহিনীর সেরা দুই সৈনিক। এর আগেও বহুবার বহু বিপজ্জনক অপরাধীর সন্ধানে তাদের আসতে হয়েছে সময়ের উজানে। প্রতিবারেই তারা ফিরেছে সফল হয়ে। অপরাধীকে গ্রেফতার করে ফেরত নিয়ে এসেছে নিজেদের সময়ে। কিন্তু এবার আর সফল হওয়া হবে না। এবার তাদের সাথে ফিরবে না কেউই।
কারণ, এবার অপরাধীর এনকাউন্টার করতে হবে !
অর্থাৎ অপরাধীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে।
কিন্তু সেটা জানবে শুধু কর্তৃপক্ষ । সাধারণ মানুষ জানবে যে গ্যাব্রিয়েল ও আরিয়ান ব্যর্থ হয়েছে। রিহাব্ জোহান্-এর মতো ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদীকে তারা গ্রেফতার করতে পারে নি।
"কী ভাবছ?" গ্যাব্রিয়েল-এর কন্ঠস্বরে আরিয়ানের চিন্তাস্রোত ছিন্ন হল।
"এনকাউন্টার" আরিয়ান মৃদুস্বরে বলল।
গ্যাব্রিয়েল হাসল
"এতে চিন্তার কিছু নেই। আমাদের হাতে অস্ত্র আছে। শিকারকে একবার খুঁজে পেয়ে গেলে বাকিটা জলের মতো সোজা।"
কথাটা সত্যি ! ওদের হাতে যে বিশেষ অস্ত্র দুটি রয়েছে তার সাহায্যে যে-কোনো প্রাণীকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যায় মূহুর্তের মধ্যে। এই অস্ত্রের সামনে সব অপরাধীই ঠাণ্ডা । এর সামনে পড়লে কেউ আর কোনো ঝুঁকি নেয় না, ঝটপট আত্মসমর্পণ করে।
কিন্তু...
"আত্মসমর্পণকারীর ওপর অস্ত্র চালাবো কীভাবে ?" আরিয়ান প্রশ্ন করল।
"চিন্তা কোরো না, আমাদের আজকের শিকার কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবে না।"
আরিয়ান জানে যে গ্যাব্রিয়েল কিছু ভূল বলে নি।
রিহাব্ জোহান কখনো আত্মসমর্পণ করে না। এপর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টায় প্রাণ গেছে অসংখ্য সেনা ও পুলিশ অফিসারের। তার মতো চতুর, হিংস্র ও নিষ্ঠুর অপরাধীকে গ্রেফতার করা সহজ নয়।
তাই কর্তৃপক্ষ এবার আর সে চেষ্টাও করছে না। বরং তার এনকাউন্টার করতে চাইছে অর্থাৎ তাকে শেষ করে ফেলতে চাইছে ।
আর এই কারণেই এলিট্ কমান্ডো ফোর্স-এর সেরা দুজন কমান্ডোকে পাঠানো হয়েছে।
জোহান-এর এবার আর নিস্তার নেই।
কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী জোহান্কে নিশ্চিহ্ন করে আরিয়ান ও গ্যাব্রিয়েল ফিরে এসে জানাবে যে তারা জোহান্কে খুঁজে পায় নি। তাদের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে জোহান্ অনন্ত কালপ্রবাহের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। তার পক্ষে আর বর্তমানে ফিরে আসা সম্ভব নয়।
জোহান্-এর টাইম ট্র্যাভেলার যন্ত্রটি তারা নিয়ে আসবে প্রমাণ হিসেবে।এই যন্ত্র ছাড়া কাল-এর মধ্যে যাতায়াত করা অসম্ভব।
বিচারকেরা তাদের এই যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হবেন। আর এইভাবেই সমাপ্ত হবে ওই ভয়ংকর নরঘাতকের জীবনের শেষ অধ্যায়।
"সামনে কতগুলো কুটির দেখা যাচ্ছে।" গ্যাব্রিয়েল জানাল।
"আমার ট্র্যাকার যন্ত্র বলছে যে আমাদের শিকার ওগুলোরই একটাতে আছে।"
"হুঁ, সাবধানে এগনো যাক, শিকার কাউন্টার অ্যাটাক করতে পারে।" আরিয়ানের কন্ঠস্বরে শিকারীর সহজাত সতর্কতা।
ওরা দুজনে সাবধানে গুঁড়ি মেরে এগোতে লাগল। কুটিরগুলোর কাছাকাছি আসতেই ওরা দেখল কয়েকজন মানুষ, তাদের বস্ত্র গৈরিক এবং মস্তক মুণ্ডিত।
"আরে ! এটা তো …..."
"ধর্মস্থান। কিন্তু আমার যন্ত্র বলছে যে ওইদিকের ওই বড়ো কুটিরটায়……"
"বুঝেছি। চলো, সাবধানে এগনো যাক।"
দুই সৈনিক সন্তর্পণে কুটিরটার দিকে এগিয়ে গেলো।
মুণ্ডিত মস্তক মানুষগুলি ওদের দুজনকে দেখতে পেল। তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়। কিন্তু তারা ওদের বাধা দিল না।
বাধা দিলেও অবশ্য ওদের আটকানো যেত না।
ওরা সৈনিক। শিকারের কাছে পৌঁছনোর পথে সমস্ত বাধাই ওরা শেষ করে দেয় নির্মমভাবে।
কুটিরের কাছাকাছি পৌঁছতেই একজন সৌম্যদর্শন মানুষ ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন।
ইনিও গৈরিক পরিহিত কিন্তু এঁর মস্তক মুণ্ডিত নয়। মানুষটির দৃষ্টিতে যেন শান্তি ও করুণা ঝরে পড়ছে।
গ্যাব্রিয়েল মানুষটির দিকে এগিয়ে গেল।
"স্বাগত বন্ধুগণ"
গ্যাব্রিয়েল-এর গতি স্তব্ধ হল। সে বিস্মিতভাবে তাকাল মানুষটির দিকে।
আরিয়ান-এর মুখের ভাবও তার বন্ধুর মতোই।
এও কী সম্ভব !
খৃষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ এটা।
আর ওরা এসেছে ২৮৮২ খৃষ্টাব্দ থেকে।
কিন্তু এই মানুষটি ওদের সাথে কথা বলছেন ওদের ভাষাতেই।
সত্যিই কি কথা বলছেন উনি ?
ওঁর ঠোঁট তো নড়ছে না।
গ্যাব্রিয়েল আরিয়ান-এর দিকে ফিরল।
"মনে হচ্ছে ইনি একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন যোগীপুরুষ।"
"ওঁকে জিজ্ঞাসা করো না, আমরা যাকে খুঁজছি তার সন্ধান উনি দিতে পারেন কি ?"
মানুষটি আরিয়ান-এর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন। তারপর কুটিরের দরজার দিকে ইঙ্গিত করলেন।
"অবিশ্বাস্য !"আরিয়ান-এর কন্ঠস্বরে বিস্ময়।
"সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এগনো যাক।" গ্যাব্রিয়েল বলল।
কুটিরের দরজাটা ভেজানো ছিল। এক ধাক্কায় সেটাকে খুলে দুই সৈনিক বিদ্যুৎগতিতে ভিতরে প্রবেশ করল।
কিন্তু কোথায় জোহান !
একজন গৈরিক পরিহিত মুণ্ডিত মস্তক ব্যক্তি ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন। এ ছাড়া কুটিরের মধ্যে আর দ্বিতীয় কেউ নেই। দুই সৈনিক হতবাক হয়ে মানুষটির দিকে চেয়ে রইল।
এবার আরিয়ান তার বেল্ট-এর খাপ থেকে একটি মোবাইল ফোনের মতো ক্ষুদে যন্ত্র বের করল। যন্ত্রটি সন্তর্পণে মানুষটির গায়ে ঠেকাতেই সেটি সচল হয়ে উঠল। যন্ত্রের স্ক্রিনে একের পর এক মানুষের মুখ ভেসে উঠতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব মুছে গিয়ে রয়ে গেল কেবল বিশেষ একটি মুখের ছবি।
সেই মুখটি ওরা ভালো করেই চেনে।
কোনো সন্দেহ নেই। এই মানুষটিই হল কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী রিহাব্ জোহান।
মানুষটির ধ্যান ভঙ্গ হল। সে চোখ খুলল এবং ওদের দেখল।
ওরাও দেখল তাকে।
এই মানুষটিই রিহাব্ জোহান ! এও কি সম্ভব !
কোথায় সেই ক্রুর, নিষ্ঠুর দৃষ্টি ? সেই ভয়ংকর ভ্রুকুটি ?
এর দৃষ্টিতে তো হিংসার চিহ্নমাত্র নেই। বরং তার পরিবর্তে বিরাজ করছে অপার শান্তি।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মানুষটি। তারপর ওদের চোখে চোখ রেখে বলল-
"আমি প্রস্তুত"
দুই সৈনিক চেয়ে রইল হতবাক হয়ে। ওরা অস্ত্র তুলতে পারল না। তুলবে কী করে ? এই মানুষটি তো তাদের শিকার নয়। জোহান-এর দেহের মধ্যে এ যেন এক অন্য মানুষ।
আরিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
"জোহান-এর এনকাউন্টার হয়ে গেছে !"
"কে করল এই অসম্ভব কাজ ?" গ্যাব্রিয়েল বিহ্বলভাবে জানতে চাইল।
দরজায় একটা শব্দ হতেই ওরা চমকে তাকাল ।
ওদের পূর্বদৃষ্ট সেই যোগীপুরুষ। মুখে স্মিত হাসি ও করুণামাখা দুটি চোখ।
ওরা বুঝল যে এই অসাধ্যসাধন ইনিই করেছেন। কোনো সন্দেহ নেই, এঁর শক্তি ওদের অস্ত্রের চেয়ে অ-নে-ক বেশি ।
মানুষটি যেন শান্তির প্রতিমূর্তি। কে ইনি ?
ওরা ভালো করে চেয়ে দেখতেই চিনতে পারল তাঁকে।
ইনিই তো সেই মহাপুরুষ ! এঁর দ্বারা প্রচারিত অহিংসার বাণীতেই তো শান্তিলাভ করবে অনাগত কালের অসংখ্য মানুষ । সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এঁর বাণী।
ওরা সতৃষ্ণভাবে চেয়ে রইল মানুষটির দিকে। একসময়ে অহিংসাকে অর্থহীন প্রলাপ মনে হত ওদের। কিন্তু আজ অহিংসার শক্তি দেখে ওরা স্তম্ভিত।
ওদের হাত থেকে অস্ত্র খসে পড়ল। নতজানু হয়ে ওরা বসে পড়ল তাঁর পদতলে।
মানুষটি ওদের মাথায় হাত রাখলেন।
এক অনস্বাদিত শান্তিতে ডুবে যেতে লাগল ওদের মন………
এনকাউন্টার !