সার্ভিস লিফট
সার্ভিস লিফট
"ড্যাম ইট" সার্থক তিক্ত স্বরে বলল ।
তিনটে লিফটের মধ্যে প্রথমটা বেসমেন্টে আর দ্বিতীয়টা টপ ফ্লোরে আটকে আছে। তৃতীয় লিফটটা খারাপ।
প্রতি শনিবারেই সেই এক গল্প।অফিস ছুটির সময় লিফট পাওয়া যায় না।
আসলে টপ ফ্লোরের নাইট ক্লাবটায় প্রতি শনিবার উইকেন্ড পার্টি থাকে। বড়লোকের ছেলেমেয়েরা এসে ভিড় জমায়। তারাই বেসমেন্টের কার পার্কিং জোনে আর টপ ফ্লোরের নাইট ক্লাবে লিফটগুলো আটকে রাখে।
সার্থক বুঝল আজকেও তার কপালে সার্ভিস লিফটই নাচছে। প্রায় প্রতি শনিবারেই সার্থককে তার নাইন্থ ফ্লোরের অফিস থেকে এই লিফটেই নীচে নামতে হয়।
বিল্ডিং এর পিছন দিকের এই লিফটটা দিয়ে সাধারণত মালপত্র তোলা হয়। এর চলটা ওঠা মেঝে, বিবর্ণ দেওয়াল আর টিমটিমে আলো সার্থকের মুড অফ করে দেয়।
তবে জেনারেল লিফটগুলো পাওয়া না গেলে তখন এই সার্ভিস লিফটটাই একমাত্র ভরসা।
সার্থক লিফটে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটনটা প্রেস করল।
আজ তার শরীরটা ভালো নেই, বুকের বাঁ দিকে একটা চিনচিনে ব্যথা। সার্ভিস লিফটের মন খারাপ করে দেওয়া পরিবেশ তার অস্বস্তিটা আরো বাড়িয়ে দিল।
লিফট কিন্তু নিচে না গিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। সার্থক বুঝলো ওপরের নাইট ক্লাব থেকে কেউ লিফটটা কল করেছে।
-"সার্ভিস লিফটটাকেও ছাড়লো না !" সার্থক স্বগতোক্তি করল।
এবার হয়তো নাইট ক্লাব থেকে একদল মদ্যপ ছেলে-মেয়ে উঠবে।
সার্থক অনুভব করল তার বুকের মধ্যে অস্বস্তিটা বাড়ছে।
টপ ফ্লোরে পৌঁছতেই লিফটের দরজা খুলে গেল।
একটা প্রায় অন্ধকার প্যাসেজ। পিছন থেকে ভেসে আসছে জোরালো পার্টি মিউজিক "ইটস্ দ্য টাইম টু ডিস্কো....."
হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে ফুটে উঠল একটি অবয়ব।
একটি মেয়ে।
মেয়েটি লিফটে প্রবেশ করে সার্থকের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বেসমেন্টের বাটনটা প্রেস করল।
লিফট নিচে নামতে লাগলো।
সার্থক দেখছিল মেয়েটিকে।
মেয়েটি অত্যন্ত রূপসী। খোলামেলা পোশাকে তাকে আরো আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে, যাকে বলে 'হট' !
তার শরীরের যে অনাবৃত অংশগুলি দেখা যাচ্ছিল সেগুলি ধবধবে সাদা....... যেন রক্তশূন্য।
মানুষের শরীর কি এতটা সাদা হয় !
মেয়েটার ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক।
ঠিক যেন রক্ত মাখা দুটি ঠোঁট !
মেয়েটা সার্থকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল।
-"হাই হ্যান্ডসাম"
মেয়েটি কি একটু অপ্রকৃতিস্থ ?
হয়তো বেশি মাত্রায় ড্রিংক করে ফেলেছে।
এইবার একটা কান্ড ঘটলো।
মেয়েটি হঠাৎ একটা বাটন প্রেস করতেই লিফটটা এক ঝটকায় থেমে গেল।
সার্থক হতভম্ব হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটির ঠোঁটের কোণে একটা ক্রুড় হাসি। সার্থকের হতভম্ব ভাবটা যেন সে উপভোগ করছে।
এবার ধীরে পদক্ষেপে সে এগিয়ে এল সার্থকের দিকে........মাকড়সা যেমন এগিয়ে আসে জালে বদ্ধ পতঙ্গের দিকে ।
তার মুখ এখন সার্থকের মুখের খুব কাছে।
সার্থক বুকের মধ্যে তীব্র অস্বস্তি অনুভব করছিল। দামি মদ আর পারফিউমের সুতীব্র ঘ্রাণ তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।
হঠাৎ কিছু একটা ঘটল !
সার্থক দেখল তার চারপাশের সবকিছু দ্রুত ঝাপসা হয়ে আসছে। ওই মেয়েটি, এই সার্ভিস লিফট সবই যেন হারিয়ে যাচ্ছে একটা ধোঁয়াশার চাদরের পিছনে।
আর সেই চাদরের পিছনে থেকেই ছুটে আসছে মেয়েটির তীব্র চিৎকার!
******
-"ঘটনাটা তাহলে প্রতি শনিবার ঘটে ?" ইন্সপেক্টর ভদ্র প্রশ্ন করলেন।
-"না, ওর মৃত্যু হয়েছিল এক ফোর্থ স্যাটারডে-তে । ওই সার্ভিস লিফটের মধ্যেই হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে ও মারা যায়। সেই থেকে প্রতি মাসের ফোর্থ স্যাটারডেতে ওই লিফটে ওকে দেখা যায়। অনেকেই দেখেছে, তবে এর আগে কখনো কারো ক্ষতি হয় নি।"
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন রুদ্রনীল আচার্য, শ্যাডো মডেলিং এজেন্সির কর্ণধার।
-"ক্ষতি যে এবারেও বিশেষ কিছু হয়েছে তা নয়" ইন্সপেক্টর ভদ্র বললেন "তবে ডাক্তার বলেছেন যে পেশেন্ট একটু শক্ পেয়েছে। চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখলে শক্ পাওয়াটা স্বাভাবিক।"
-"তো আপনারা কি করবেন ভাবছেন ?" মিঃ আচার্য জানতে চাইলেন।
-"ওয়েল, ভূত-প্রেতের হ্যাপা সামলানো পুলিশের ডিউটির মধ্যে পরে না" ইন্সপেক্টর ভদ্র বললেন "তবে আমরা বিল্ডিং ম্যানেজমেন্টকে বলেছি ওই লিফটটা সিল করে দেওয়ার জন্য।"
একটু থেমে ইন্সপেক্টর ভদ্র মিঃ আচার্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন "এত অল্প বয়সে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলো কী করে ? খুব কাজের প্রেশার দিতেন বুঝি ?"
-"প্রেশার দিতে হতো না" মিঃ আচার্য বললেন "ও নিজেই অনেক দায়িত্ব নিয়ে কাজ করত। Trainee হিসেবে জয়েন করে ও শেষ পর্যন্ত সিনিয়র ফ্যাশন মডেল হয়েছিল।"
-"বুঝলাম, তা কি যেন নামটা ছিল বললেন ?"
-"সার্থক সেনগুপ্ত" মিঃ আচার্য বললেন।
(সমাপ্ত)
