নাইট শিফট
নাইট শিফট
ব্যস্ত নগরী, কলকাতা। এরই মাঝে ধুলো বালি মেখে রাস্তায় মানুষের যাতায়াত। রিক্সা, টোটো, অটোর হর্নের শব্দ। রাস্তার উপর দিয়ে শয় শয় বাস, লড়ি, ট্রাক, ট্যাক্সির চলাফেরা।
অরুণিমা, একটি অতি সৌন্দর্যের অধিকারিণী। সব ধরনের গুণ ওর মধ্যে আছে। পি এইচ ডি শেষ করে এখন আরজি কর মেডিকেল কলেজে কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টে জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে চাকরি করছে।
এমনই একটি দিন। আগস্ট মাসের ছয় তারিখ। অরুণিমা হাসপাতালে যায়। আজ ওর সিনিয়র একজন ডাক্তারের ওটি আছে, ওর ও এসিস্ট্যান্ট ডাক্তার হিসেবে যেতে হবে। তাই আজ সকাল সকাল বেরোলো। অপারেশন ভালো ভাবেই হল। অরুণিমা নিজের কেবিনে এল। গলার থেকে স্টেথোস্কোপ টা খুলে রেখে দিল টেবিলের উপর। একটু বাথরুম এ যাবে ও। বাথরুম থেকে যখন ফিরছে তখন ভাবল একবার প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে দেখা করে অপারেশনের ব্যাপারে জানাবে। যথারীতি সেই ভাবেই প্রিন্সিপালের ঘরের দিকে উদ্যত হল অরুণিমা। কিন্তু, প্রিন্সিপালের ঘরের সামনে দাড়াতেই ওর পা সেখানেই থমকে গেল। একজন স্টুডেন্টের সাথে প্রিন্সিপাল কথা বলছেন। যা শুনে অরুণিমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
প্রিন্সিপাল- "দেখ, সমীরণ, তোমাকে আমি এইখানে জয়েন করতে পারি একটা শর্তে। তুমি যদি আমায় অন্তত দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মত দাও। কারণ তুমি তো জানোই যে আমাদের এখানে যারাই ভর্তি হচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই আমাকে অন্তত এক থেকে দেড় লাখ টাকা দেয়। নাহলে আমি ভর্তি নিই না।"
অরুণিমার সব তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। "মানে এইখানকার অর্ধেক ডাক্তার এরকমভাবে টাকা দিয়ে ভর্তি হচ্ছে। তাহলে আমরা যেভাবে কষ্ট করে পরীক্ষা দিচ্ছি, আমরা কি করবো?"
অরুণিমা বাড়িতে ফেরে। কাল আর যাবে না ও।ভালো লাগছে না। এ কোন জায়গায় ও চাকরি করে যেখানে টাকা দিয়ে ভর্তি নেওয়া হয়??
পরের দিন...
অরুণিমার সকাল থেকেই ভালো লাগছে না। কালকের ব্যাপারটা খুব ভাবাচ্ছে ওকে। কাওকে জানাবে? না, থাক। দরকার কি?
দুপুর বেলা মা খেতে ডাকেন। মনমরা হয়ে খাচ্ছে অরুণিমা। তাই দেখে অরুণিমার মা জিজ্ঞেস করলেন- "কি রে অরু? মা? রান্না ভালো হয়নি? এরকম মনমরা হয়ে খাচ্ছিস? তুই ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে পছন্দ করিস, তাই তো করলাম?"
অরুণিমা না সূচক মাথা নাড়ায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেয়ে চলে যায়। ঘরে গিয়ে ধপ জোরে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কেন জানে না, আজ ওর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
পরের দিন**
আজ অরুণিমা হাসপাতালে যাবে। তাই রেডি হচ্ছিল। আজকেও একটা ওটি আছে। যথারীতি হসপিটালে পৌঁছে নিজের কেবিনে যায় ও। গায়ে শুভ্র রাঙ্গা অ্যাপ্রন টা জড়িয়ে নিয়ে ওটির উদ্দ্যেশে রওনা দেয়। হোল বডি চেকাপ করা, টেস্ট লেখা- এই সবই এসে পড়েছে অরুণিমার ঘাড়ে আজ। এইসব চেকাপ করে ওটি শুরু করতে অনেক সময় লাগে। প্রায় বিকেল চারটে। ওটি শেষ হতে আজ রাত নটা বেজে গেল। কার্ডিও আর্টেরি বাইপাস সার্জারি ছিল তাই। খুব খুব খুবই ক্লান্ত লাগছে আজ ওর। অরুনিমার আজকে নাইট শিফট করতে একদমই ইচ্ছে ছিল না। তবুও প্রিন্সিপাল স্যারের জোরাজোরিতে করতে এক প্রকার বাধ্য হলো। এদিকে আবার প্রিন্সিপাল স্যার বললেন যে ওর কেবিন টা আজ ব্যবহার করা যাবে না কি কারনে যেন? এমনিতেই ভীষণ ক্লান্ত লাগছে আজ অরুনিমার তার উপরে এত প্রশ্ন করতে ওর ইচ্ছা হলো না। তাই হল রুমেই নিজের মেডিকেল ব্যাগ আর জলের বোতলটা নিয়ে টেবিলে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।
হঠাৎ মাঝরাতে অরুণিমা অনুভব করতে পারল যে ওর হাতদুটো কেউ শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধছে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে তাকাতেই অরুণিমা দেখতে পায় যে, ওর সবচেয়ে কাছের বান্ধবী সুস্মিতা ওর দুটো হাত চেয়ারের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধছে। হঠাৎ এই কাণ্ডে কিছু না বুঝতে না পেরে ও চিৎকার করে ওঠে। তারপর ও দেখতে পায় যে ওর সহকর্মী ডাক্তাররা লাইনে আসছে পেছন থেকে। হঠাৎ করে চমকে যায় অরুণিমা। অরুনিমা যেই চিৎকার করতে যাবে ওমনি ওর মুখটা শক্ত কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে ওর সহকর্মী ডাক্তাররা তারপর ওর পা দুটো চেয়ারের সঙ্গে প্রচন্ড শক্ত করে বাঁধে যার ফল স্বরূপ ওর পেলভিক হার ছিড়ে যায়। তারপর নিমেষের মধ্যে চোখে অন্ধকার দেখে অরুনিমা। ওর শরীরের উপর দিয়ে একে একে প্রতিটা লোক বোট জুতো পড়ে হেঁটে যেতে যেতে ওকে পিষে দিতে থাকে। তৎক্ষণাৎ শরীরটা পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায় আর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে অরুনিমার নিথর দেহটা। এরপরেই শেষ নয়। এই হসপিটালের চারিদিকে একটা সিভিক ভলেন্টিয়ারের টিম ঘোরাফেরা করতো। তারই মধ্যে একজন সিভিক ভলেন্টিয়ার মদ মাতাল ছিল যে পশুপাখি-মানুষ কারোর মধ্যেই তফাৎ রাখত না। তারপর সেই লোকগুলো ওকে ফেলে রেখে সেই ভলেন্টিয়ারকে ডেকে আনে। বলে- "যাও হে! তোমার জন্য নতুন পাখি রয়েছে।"
সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জু তখন মদের নেশায় মাতাল। সেই ডাক্তারগুলোর কথা শুনেই, জিভ চেটে বুভুক্ষ কুত্তার মত ছুটে যায়। তারপর অরুণিমার সেই নিথর, নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত শরীর থেকে টেনে হিঁচড়ে পোশাক খুলে ফেলে, ওকে খুবলে খুবলে খেতে থাকে।।
কতটা নৃশংস পিশাচ হলে এই রকম টা কেউ করতে পারে। মেরে ফেলেও শান্তি হলো না। মৃত দেহটাকেও ধর্ষণ করতে হলো। ছিঃ, ছিঃ! কতটা নিচে নামতে পারে মানুষ!
পরের দিন সকালেই পুলিশ আসে তদন্ত করার জন্য। ইতিমধ্যেই, হাসপাতালের সিসি ক্যামেরাটাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। হল রুম টাকে নাকি নতুন কোনো কেবিন করবে বলে ভাঙ্গা হচ্ছে। সবই যে কি কারনে হচ্ছে, তা সবাই জানে। হলরুমে যে টাটকা রক্তের ছোপ, রক্ত আর বীর্যের মিশ্রণ! রাস্তায় শত শত পথিক বেরিয়েছে মোমবাতি নিয়ে। হাহ! "আমরা বিচার চাই" বললেই কি আমরা সত্যিই জলের মত বিচার পেয়ে যাই? ছোট ছোট বিষয় দিয়ে দেখি না। বাসে বা ট্রেনে কোনো মেয়ে উঠলে প্রায় সময় আমাদের শুনতে হয়- "এই মালটা দারুন সেক্সী ভাই! বাইরে টা এত ফর্সা, ভিতর টা কি হবে ভাই!" আরো অনেক নোংরা ভাষা ও ইঙ্গিত। তখন যদি আমরা মেয়েরা প্রতিবাদ করি, তখন কি আমরা সত্যিই বিচার পাই। উল্টে আরো নোংরা ভাষা ও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আর যদি কিছু হয়ে যায়, তখন দোষ পড়ে আমাদের পোশাকের উপর। দোষটা দেওয়ার সময় মানুষ ভেবে দেখে না যে তাহলে ছোট ছোট শিশুদেরকেও কেনো এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, বয়স্ক বৃদ্ধাদের কেও কেনো হতে হয় ধর্ষণ? তারাও কি বাজে পোশাক পরে বের হন। কটা পুরুষই বা ভালো বলুনতো। হাতে গোনা কয়েকজন হবে হয়ত যারা নারীদের সম্মান করতে জানেন, একটি মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেন। যেই মাটিতে আমরা দেবী দুর্গার পুজো করি, সেই মাটিতে আমরা মেয়েরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ অথবা আর সমান সমান অসম্মানের মুখে পড়ি। আরজি কর মেডিকেল কলেজে এখন ফিমেল ডাক্তারদের জন্য প্রটেকশন ফোর্স বসানো হল চব্বিশ ঘণ্টার জন্য। কিন্তু আমরা সাধারণ মেয়েদের কি হবে? আমরা কি তাহলে প্রতিনিয়ত তাহলে এরকম নোংরা পরিস্থিতির মুখে পড়ব??
