Dipayan Sarkar

Children Stories Inspirational Others

3  

Dipayan Sarkar

Children Stories Inspirational Others

"মোহভঙ্গ"

"মোহভঙ্গ"

4 mins
55


জীবনের বেশ কয়েকটি বসন্ত পার হয়ে গেলেও সকালবেলায় প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাসটা কিছুতেই বদলাতে পারলাম না। কিন্তু কোভিড -১৯ এর ধাক্কায় সেই অভ্যাসটা যখন মৃতপ্রায় ঠিক তখনই মাথায় এলো এক অন্যরকম প্রাতঃভ্রমণ করার উপায় । রাস্তায় চলা মানা থাকলেও ছাদে হাঁটাহাঁটি করা যেতেই পারে। সেই মতো শুরু করলাম এক অনন্য প্রাতঃভ্রমণ।

    আমার বাসভবনের ঠিক সামনেই রয়েছে বিশাল বড় একটা উদ্যান; যার নাম "প্যারাডাইস পার্ক"। যেমন নাম ঠিক তেমনই সেটার বিস্তার। অজস্র জানা-অজানা ও হরেক রকম গাছের সমাবেশ এর সৌন্দর্যকে অপরূপ আখ্যা দিতে বাধ্য করেছে। এই উদ্যানের মাঝ বরাবর একটি কৃত্রিম ঝর্ণা ও আছে, যার আকৃতি দেখতে অনেকটা পদ্মের মতো। একে ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি ফুলের বাগান। কিন্তু এসব কিছুই আজ যেন অন্য রূপে দেখতে পাচ্ছি ছাদে হাঁটতে হাঁটতে।

    আসলে রাস্তায় হাটার সময় সাধারণত চোখ যায় সামনে ও আশেপাশে, হয়তো আকাশের দিকে চোখ যায় না। তাই আশেপাশের গাছপালা আর বাগান ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়েনি আগে। কিন্তু ছাদে প্রাতঃভ্রমণ করার সময় প্রকৃতির যে দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলো তা এককথায় অতুলনীয়।

   একদম সকাল সকাল ছাদে এসে হাঁটা শুরু করলাম। সময়টা দেখে বোঝার উপায় নেই যে অরুণোদয় নাকি গোধূলি লগ্নে এসে উপস্থিত হয়েছি! কারণ পশ্চিমের আকাশে আধখানা রুপালি চাঁদ ক্ষীণ প্রভায় প্রজ্বলিত আছে। আর অপরদিকে পূর্ব আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘে ভরা নীল আকাশের বুক চিরে উদয় হয়েছে সোনালী আভায় আলোকিত অংশুমালী।

   বড় বড় গাছপালা যেগুলো রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় চোখে পড়েনি, আজকে তিনতলায় ছাদে হাঁটতে গিয়ে সেগুলোর মাথায় গোছা ভরা চুলের মত সবুজ পাতায় ভরা ডালপালা গুলো দেখে; মনে এক অনন্য তৃপ্তি এসে যাচ্ছে। তবে শুধুই সবুজ নয়, অদূরে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো হালকা লাল আর কমলা রঙের ফুলে ভরে আছে। মনে হচ্ছে যেন ৫০ ফুটের মতো অনেক গুলো ফুলের তোরা রাস্তার দুই ধার ঘেঁষে সাজিয়ে রাখা হয়েছে! সেই ফুলগুলোর উপর সূর্যের সোনালী আভার প্রতিফলনে ফুলগুলো ঝলমল করে উঠছে। আর মাঝে মাঝে হালকা মৃদুমন্দ স্নিগ্ধ বাতাস এসে তাদেরকে দোলনাতে দুলিয়ে দেওয়ার মত দোলাচ্ছে। সেই উঁচু উঁচু গাছপালা গুলোর মাঝেই একটু নিচের দিকে চোখ গেল দুটো স্থলপদ্মের গাছের দিকে। সূর্যের সোনালী কিরণ তখনও তাদের শরীরে এসে পৌঁছাতে না পারলেও অপরূপ সুন্দর স্থলপদ্ম গুলো প্রস্ফুটিত হয়ে আমার চোখে এক শান্তির বার্তা বয়ে নিয়ে এলো। সাদা ও হালকা বেগুনি বর্ণের ফুলগুলো প্রভাতের শীতল বাতাসের ছোঁয়ায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে।

   আশেপাশের কোনো এক গাছ থেকে কোয়েলের কুহু কুহু গান কানে এসে এক মনমুগ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সে যেন মলিন বাতাসে পাতায় পাতায় সৃষ্ট এক অপরূপ ছন্দের তালে তালে গান গেয়ে চলেছে। সেই সাথে এক ঝাঁক পায়রা বকম বকম শব্দ করে সঙ্গ দিচ্ছে সেই কোয়েলের। তারা মাঝে মাঝেই বাধাহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে। ছোট ছোট রঙিন অচেনা পাখি গুলোও পিছিয়ে নেই, তারাও কিচিরমিচির শব্দের মাধ্যমে গুনগুন করে গেয়ে চলেছে তাদের প্রভাতের গান।

    এমন অপরূপ সুন্দর প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে পেতে হঠাৎ মোহভঙ্গ হলো কিছু কাকের কর্কশ শব্দে! এতক্ষণে অঁজিষ্ণু ও তার তেজ রশ্মির উজ্জলতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভোরের শীতলতা ধীরে ধীরে ক্ষীন হয়ে পড়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার চোখ গেল বাসভবনের সামনের রাস্তায়।

   সুন্দর চোখ ধাঁধানো যে ফুলগুলো মন একেবারে রাঙিয়ে তুলেছিল; সেগুলোর কিছু কিছু রাস্তার উপর ও তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেখানেই একজন ঝাড়ুদার রাস্তা কে পরিষ্কার করে চলেছে অনবরত। ফুল তো দূরের কথা, এতটাই পরিষ্কার হচ্ছে যেন মনে হচ্ছে ধুলোর একটা কণা পর্যন্ত ও নেই। প্রায় প্রতিদিনই প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসার সময় এই ব্যক্তির সাথে আমার দেখা হতো। এক অপরূপ সুন্দর প্রাণবন্ত হাসি সহযোগে আমাকে সুপ্রভাত জানাতো। সত্যিই যতদিন দেখেছি একটা দিনও মনে হয়নি যে তার হাসিটা কৃত্তিম। সানন্দে ঝাড়ু দিতে দিতে দিতে ছাপ ছাপ শব্দে ঝাড়ু টাকে নৌকার দাঁড় এর মত ব্যবহার করত। আজ সে একইভাবে পরিষ্কার করে চলেছে। দূর থেকে হয়তো অতটা ভালো বুঝতে না পারলেও মনে হল যেন তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। সেই হাসিটা মনে হচ্ছে যেন ম্লান হয়ে গেছে! না, ঠিক কোন কষ্ট নয়! হতে পারে সেই ভয়ে; যে ভয়ে আমরা বাড়ি থেকে বের হচ্ছি না। আমাদের মতই উনাদের ও তো পরিবার রয়েছে, এটা ভাবতে ভাবতেই আমার সুন্দর অনুভূতি গুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

   ওই ঝাড়ুদার যেখানে পরিস্কার করছিল ঠিক সেখান থেকে কিছুটা দূরে একজন কে দেখতে পেলাম। আমার পাশের এক বাসভবন থেকে একজন মহিলা তার ভয়ঙ্কর দেখতে একখানা বিলেতি কুকুর নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্যই তাঁর মুখে রয়েছে মাস্ক! ভাবলাম, ইনিও হয়তো প্রাতঃভ্রমণের উদ্দেশ্যেই বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। কিন্তু এরপর যেটা দেখলাম সেটা মনকে ভারাক্রান্ত করে দিল। দেখলাম সেই রাস্তার ধারেই সেই কুকুরকে মলত্যাগ করিয়ে দিয়ে অদ্ভুত ভাবে সেখান থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ আগে সেই জায়গাটা পরিষ্কার করে নোংরা মুক্ত করে তুলেছিল সেই ঝাড়ুদার। অন্য দিক থেকে পরিষ্কার করে এই স্থানে পুনরায় আসার পর সে হয়তো আবারও পরিষ্কার করে দেবে।

   কিন্তু আমার মনের মধ্যে এক আলোড়ন সৃষ্টি হল। ভাবলাম যে পেটের দায়ে তো সবাইকেই কাজ করতে হয় কিন্তু আমরা যখন ঘরে বসে নিজের ঘর পরিষ্কার করি তখন এই হতভাগা সাফাই কর্মীরা আমাদের সমাজের নোংরা দূর করে। আজ হয়তো আমরা অনেকেই এই মানুষগুলো কে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি কিন্তু সত্যিই কতটা যে মন থেকে, সেটা নিয়ে আমার সংশয় আছে! কারণ কিছুদিন পর যখন সব আবার আগের মত হয়ে যাবে তখন আমরা সবাই আগের মতই এদেরকে ভুলে যাব। বাড়ি বসে সমালোচনা করতে বসবো যে ভারত বর্ষ এত নোংরা কেন! ওই মহিলার কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ দেখে মনে প্রচুর ক্ষোভের সঞ্চার হলেও নিজেকে খুব অসহায় লাগলো এটা ভেবে যে, এর প্রতিবাদ জানাতে পারলাম না।

    আমার মাথায় বেশ কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। নোংরা আবর্জনা না হয় এই সাফাই কর্মীরা পরিষ্কার করে দেবে কিন্তু মনের কালিমা গুলো কে পরিস্কার করবে? কে শুধরে দেবে এই বিকৃত মানসিকতার মানুষগুলো কে? আর কবেই বা আমরা মলিন মনের অধিকারী হয়ে প্রকৃত মানুষ হবো?




Rate this content
Log in