Rituparna Rudra

Others

2.1  

Rituparna Rudra

Others

অচিন পাখি

অচিন পাখি

6 mins
17K


সদ্য শীতের অপার্থিব ভোরের আলোয় ঘরটা ভরে আছে। জানলার শার্সি দিয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে বালিশে, বিছানায়,মশারিতে। কিন্তু এটা কোন মশারি! ঘুম ভাঙা চোখে ঠাহর করতে পারেন না দীপালি ,চশমা ছাড়া তো কিছুই দেখেন না আজকাল, ভালো করে চোখ দুটো কচলে কিন্তু বেশ পরিষ্কার দেখতে পেলেন তিনি, সেই হলুদ লেস বসানো মশারিটা। বোঝো এই মিতার কান্ড। এটা কোথা থেকে বের করলো! মনে মনে বিরক্ত হন দীপালি, সমীরের ছেলেমানুষির কথা ভেবে একটু হাসিও খেলে যায় ঠোঁটে।

তখন সবে বছর পাঁচেক বিয়ে হয়েছে, হাওড়ার ছোট ভাড়া বাড়িটা ছেড়ে, কলকাতায় একটু বড় বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন তারা। সমীর একদিন কিনে আনলো এই হলুদ মশারিটা। খুব দাম নিয়েছিলো, বাজেট করে সংসার চালানো, হঠাৎ এই আলগা খরচে খুব বকেছিলেন তিনি সমীরকে। দু'একবার টাঙিয়েছিলেন তারপর যত্ন করে তুলে রেখে দিয়েছিলেন। পরে নিজেদের এই বাড়ি হবার পরে লোকজন এলে বার করতেন। মেয়ে জামাই শুয়েছিলো বোধহয় কয়েকবার। খুব সুন্দর হাল্কা হলুদ চারদিকে সাদা লেসের কারুকাজ এটার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। মিতা এটা বার করেছে কিছু বলেনি, কাল রাতেও খেয়াল হয়নি। বিছানায় উঠে বসে মোবাইলটা খুঁজলেন দীপালি কিন্তু কোথাও পেলেন না। বাথরুমের কাজ সেরে দেওয়াল ঘড়িতে দেখলেন সাতটা বেজে গেছে। এতক্ষণে মিতা এসে যায়, তারও পাত্তা নেই। অগত্যা রান্নাঘরে চা করতে করতে কী যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে তাঁর। কী সেটা ভাবতে ভাবতে মনে হোল সকালে উঠে এই সময়টা তার অন্যদিন বড্ড কষ্ট হয়, ব্যাথায় পিঠ কোমর টনটন করে, মাটিতে পা ফেলতে পারেন না। আজ মনেই পড়েনি, এই যে দাঁড়িয়ে চা করছেন কই কিছু মনে হচ্ছে না। যাক ওই ব্যাথার ওষুধটাতে ভালো কাজ হচ্ছে। খুশি খুশি লাগে দীপালির। 

বাইরের ঘরে চা বিস্কুট খেয়ে অভ্যাস মত খবরের কাগজটা খোঁজেন, দরজা খুলে দেখেন, নাহ্ এখনো দেয়নি, এক এক দিন দেরি করে। মিতাও এলো না এখনও। একটা ফোন করবেন ভাবলেন কিন্তু ফোনটা কোথায় রেখেছেন মনেই পড়ছে না। বড্ড ভুলো মন হয়েছে আজকাল। খিদে পাচ্ছে। রোজই প্রায় একই জলখাবার খান। ওটস, দুধ, কলা সামান্য চিনি দিয়ে, আজও কি তাই খাবেন? ছোটবেলায় মা বানিয়ে দিতেন রুটি, আলুর তরকারি। কি সুন্দর ছিলো তার স্বাদ। জলখাবারে গরম গরম। আহ্ দীপালির নাকে ভেসে এলো কালোজিরে ফোড়ন দেওয়া ঝাল ঝাল আলুর তরকারির গন্ধ। আটার কৌটোটা খুঁজতে হবে, এসব তো বেশি খাওয়া হয় না, পেটে সহ্যই হয় না, এ বয়সে ডাক্তারের কথা মতই চলেন দীপালি। মিতা বরং মাঝে মাঝে রুটি করে খায়। কোথায় রেখেছে আটার জায়গা রে বাবা! একটা গোলাপি প্লাস্টিকের জারে আটা থাকে সেটা জানেন তিনি, খুঁজতে গিয়ে ধন্দ লাগে তাঁর, এই কৌটোটা কিসের, প্রথম সংসার করার সময়ে একটা আ্যালুমিনিয়ামের কৌটো ছিলো তার, তাকের একদিকে সেটা শোভা পাচ্ছে এবং তার মধ্যে কি আশ্চর্য, আটা!মেখে ফেলেন তিনি৷ আলু কেটে, কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে তরকারি বসান, তারপর খাবার সাজিয়ে বাইরের ঘরে আসেন। কি অসাধারণ যে লাগে, যেন ছোটবেলায় ফিরে যান দীপালি। 

খেয়ে নিয়ে ঘড়ি দেখেন ন’টা বেজে গেছে, মিতা তো এমন করেনা। কখনও অসুবিধা কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে জানায়। ওকে ফোন করতেই হবে, ফোনটা খুঁজতে থাকেন তিনি, বিছানায়, তাকের ওপরে, বাথরুমে এমনকি আলমারিতে। নেই কোথাও নেই। মাস কয়েক আগে ল্যান্ডফোন ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। একা মানুষ, কত আর ফোন দরকার এই ভেবে। আলমারি বোধহয় এর মধ্যে গুছিয়েছিলো মিতা, কিছুই খুঁজে পাননা। বিয়ের সময়ে পাওয়া কিছু শাড়ি পরিপাটী করে সাজানো, কতবার মেয়েকে বলেছেন নিতে, তা সে তার কলেজে পড়াতে যায় প্যান্ট-শার্ট পরে, শুধু অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে। এসব পুরোন শাড়ি বোধহয় চলবে না, তাই নিতেও চায়না, কিন্তু শাড়িগুলো তেমন পুরোনো তো হয়নি। এই যে হলুদ লালে কাঞ্জিভরমটা এটা পরে সাধ হয়েছিলো তার। এই নীল তসরটা বিবাহবার্ষিকীতে সমীরের দেওয়া। দিব্বি আছে এখনও। কত কত শাড়ি। হাত বুলোন তিনি আস্তে আস্তে। সবই আছে কিন্তু ফোন নেই। স্নান করে এসে আবার খুঁজবেন নাহয়। 

একসময়ে স্নানটা দীপালির বিলাসিতা ছিলো, সমীর বকতেন, শাশুড়িও, স্নানের ঘরে ঢুকলেই এক ঘন্টা লাগতো তার। এখন তো আর আয়েশ করে স্নান করেননা তিনি, সময় অঢেল, বকারও কেউ নেই শুধু সেই ইচ্ছেটা আর হয়না। আজ কি ভেবে বাথরুমের তাকে খোঁজেন।হ্যাঁ এই তো সেই পুরোন ওডিকোলন এর একটা শিশি এখনও রয়েছে, দেখে নতুন মনে হচ্ছে, গন্ধটা দীপালিকে যেন কতদূরে নিয়ে গেলো। স্নান করেন দীপালি ওডিকোলন দেওয়া গরম জলে সাবান মেখে। স্নান সেরে বেরিয়ে আর হাউসকোট পরেন না, ওই নীল তসরটা পরে নেন। মুখে একটু ক্রীম লাগান, দিব্বি দেখাচ্ছে তাকে, এখনও এত সুন্দর তিনি, আয়না দেখা হয়নি নাকি বহুকাল। ফোন খোঁজার জন্য একবার মেয়ের ঘরেও ঢোকেন তিনি, প্রায় বারো বছর মেয়ে অামেরিকা নিবাসী তবুও ঘরটা ওর মতই সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। না এখানেও নেই ফোনটা। কিন্তু আলমারির কোণে ওটা কি? উল কাঁটা! একসময়ে দীপালির সবচেয়ে বড় শখ ছিলো সোয়েটার বোনা, উফ নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতেন তিনি। সমীরের তো সোয়েটার রাখার জায়গা হোত না, তার মেয়ে, ননদের ছেলে মেয়েরা সবাই তার হাতে বানানো গরম জামা পরেছে। এটা সেই সময়ে ফ্যাশনও ছিলো। সব মহিলাদের হাতে উল কাঁটা। তবে শেষ কুড়ি বছর এতে হাতও দেননি তিনি। এই নীল উলের গোলাগুলো তিনি কিনেছিলেন সম্ভবত সাবুর মেয়েকে অন্নপ্রাশনে সেট বানিয়ে দেবেন বলে তারপর কি যে হোল, বোধহয় সমীর অসুস্থ হয়ে পড়লো৷ তখন যা পরিস্থিতি, উল বোনা মাথায় উঠেছিলো এটাও তাই অবহেলায় পড়ে আছে। এখন তো কারুর হাতেই উল কাঁটা দেখেন না আর।

মাস ছয়েক আগে টুম্পার দ্বিতীয় সন্তান হয়েছে এবারও ছেলে। টুম্পার ফোনে শোনেন যে, খুব দুষ্টু হয়েছে নাকি। কবে যে দেখতে পাবেন কে জানে। বড় নাতির বেলায় তিনি ওদের ওখানে গিয়ে মাস ছয়েক ছিলেন কিন্তু এবারে ভরসা পাননি। এই বয়সে একা অতখানি প্লেনে চড়া, পোষাবে না তার। টুম্পার আসার কথা বছর খানেক বাদে। টুম্পা নাতি বাবুর অনেক ছবি পাঠিয়েছিলো কি মিষ্টি যে দেখতে। ওর জন্য একটা সোয়েটার বানালে কেমন হয়। উল কাঁটা নিয়ে বসার ঘরে ফেরেন তিনি। আন্দাজে ঘর তোলেন, তার হাত ঝড়ের গতিতে এগোয়, প্যাকেটে সাদা উলও রয়েছে, বুকের কাছে একটা ছোট পাখির নক্সা করে দেবেন সাদা দিয়ে। দুষ্টুটাকে পরিয়ে ছবি তুলে পাঠাতে বলবেন টুম্পাকে। উল বুনতে বুনতে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যান দীপালি, কার জন্য সোয়েটার বুনছেন টুম্পার জন্য? টুম্পা কি ওঘরে কেঁদে উঠলো? না না টুম্পার তো আটতিরিশ এখন, এটা তো তার অদেখা নাতিবাবু প্রবাহর জন্য। প্রবাহ ভারি সুন্দর নাম।

বিকেল হয়ে এলো বোধহয়, একটু ক্লান্ত লাগছে দীপালির, অন্যদিন দুপুরে একটু শুয়ে পড়েন, আজ শোয়া হয়নি। একটু শোবেন ভেবে বাইরের ঘর থেকে উঠে পড়েন তিনি, আজ সমীরের কথা খুব মনে পড়ছে, কতদিন হোল সমীর নেই। আজ দুপুরে কিছু খাওয়াও হয়নি, কিন্তু তেমন ক্ষিদেও পায়নি। চলতে গিয়ে থামেন দীপালি, ল্যাণ্ডলাইনটা বাজছে, কি আশ্চর্য ওতে কানেকশান নেই তো, বোধহয় টেলিফোন অফিস থেকে।

হ্যালো..

ওপ্রান্তের কণ্ঠস্বর শুনে গায়ে কাঁটা দেয় তার।

“কেমন আছো দিপু?”

মিতার জ্বর জ্বর লাগছিলো তাও মনের জোর করে বাড়ি থেকে বেরোলো। গতকাল যাওয়া হয়নি কি জানি কি করে চালিয়েছে মাসিমা। কাল বেরিয়েছিলো কিন্তু বড়রাস্তার পাশে এসে কিভাবে যে পড়ে গেলো নিজেই জানেনা। ভাগ্যে পাশের ঘরের মালতীও তখন কাজে যাচ্ছিলো। ওই চ্যাঁচামেচি করে লোক জোগাড় করে মিতাকে তুললো, ধরাধরি করে একটা রিক্সা ডেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। সেই থেকে শুয়েই আছে মিতা। চুন হলুদ গরম করে লাগিয়েছিলো বিকেলে ছেলে ব্যাথার ট্যাবলেট এনে দিলো সেই সব করে একটু কম আছে। কতবার যে মাসিমাকে ফোন করেছে মিতা কিন্তু কেন যেন ফোনটা লাগলোই না। ব্যাথা পা টেনে টেনে হাঁটে মিতা, মাসীমার গেটের বাইরে দুটো খবরের কাগজ পড়ে আছে, গতকাল আর আজকের হবে, মাসিমা দরজা খোলেনি কেন!

বারবার বেল দিচ্ছিলো ও, কিন্তু সাড়াই নেই৷ হঠাৎ মনে পড়ে দরজার একটা চাবি তো ওর কাছেও থাকে, ব্যাগ হাতড়ে চাবি খুঁজে দরজা খোলে ও। মাসিমা কি ঘুমোচ্ছেন? ভিতরে যায় ও, এই তো মাসিমা শুয়ে। কিন্তু এটা কি টাঙানো, হলুদ রঙের কি সুন্দর মশারিটা! এটা কে টাঙিয়ে দিলো! মিতা কখনও এই মশারিটা দেখেনি। 

মশারির মধ্যে রাজকন্যার মত মাসিমা শুয়ে আছে, দেখে কেমন অবাক লাগে ওর, কি সুন্দর লাগছে। মুখে হাসি, বয়স যেন অর্ধেক হয়ে গেছে, পরণে কি ওটা, একটা মিষ্টি নীল রঙের শাড়ি, ঘরে তো হাউসকোট পরেন উনি, শাড়ি তো পরেন না। ছোটবেলায় গল্প শুনতো ঠাকুমার কাছে, মাথার কাছে সোনার কাঠি দিয়ে রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হোত, মাসিমার মাথার কাছে দুটো কাঠি, চমক লাগে মিতার, উলের কাঁটা, মাসিমাকে উল বুনতে দেখেনি ও, পাশে একটা সুন্দর বাচ্চাদের সোয়েটার, হাতে তুলে দেখে বুকের কাছে সাদা রঙ দিয়ে একটা পাখি। মিতার সব গোলমাল হয়ে যায়। মাসিমা, মাসিমা করে ডাকে ও, না সাড়া নেই কোনো। মাসিমার ফোন থেকে সবাইকে খবর দিতে হবে, ফোনটা কোথায়, এই তো বালিশের পাশেই রয়েছে । হাতে ধরে বাইরে আসে মিতা। তারপর কি মনে হতে সোয়েটারটা আরেকবার দেখে, পাখিটা উড়ে যাচ্ছে।

সমাপ্ত


Rate this content
Log in